___দুইদিন পেরিয়ে গেল। প্রাপ্তি নিজের সংসারটাকে গুছিয়ে নিয়েছে। আয়ান বেশি অসুবিধা না হলে হসপিটাল যায় না। প্রাপ্তি আসার পর থেকেই যেন আয়ান বাড়িতেই সময় কাটায় বেশি। আরিয়াও মাকে পেয়ে আস্তে আস্তে নয়নাকে পুরোপুরি ভাবেই ভুলে যাচ্ছে। নয়নার কথাগুলো আরিয়ার কাছে এখন মিথ্যাই মনে হয়।
সারাক্ষণ প্রাপ্তির পিছন পিছন লেগে থাকে সে। মাকে যেন সে চোখে হারায়।
আজ সকাল বেলা নয়না আবার এসেছে আয়ানের বাড়িতে, প্রাপ্তি আরিয়াকে কোলে নিয়ে আয়ানকে হসপিটালে যাওয়ার জন্য বিদায় দিয়ে গেটের সামনে থেকে ঘরে ভিতর আসার জন্য পা বাড়াতেই পিছন থেকে নয়নার ডাক শুনে ফিরে তাকিয়ে, আরে আপু আপনি?
নয়নাকে দেখে আরিয়া যেন নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইছে। শক্ত করে প্রাপ্তির গলা জড়িয়ে কাঁধের উপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে।
- হ্যাঁ আমি।
- আমাদের বিয়েতে কেনো আসেননি?
প্রাপ্তির কথা শুনে নয়না বুঝেছে আয়ান প্রাপ্তিকে কিছুই বলেনি।
- একটু ব্যস্ত ছিলাম। আয়ান কোথায়?
- এখুনি তো বেরিয়ে গেল। আমরা মা মেয়ে বিদায় দিয়েই যাচ্ছিলাম। আসেন আপু ভিতরে আসুন।
প্রাপ্তি আরিয়ার ব্যাপারটা চোখ থেকে এড়ালো না। নয়নাকে বসিয়ে চা নিয়ে আসার নাম করে রান্নাঘরে গিয়ে, আরিয়া মাথা উঠাও।
আরিয়া নিভু নিভু চোখ করে তাকিয়ে, মা ওই আন্টিটা কেনো এসেছে?
- তোমার বাবাইয়ের কাছে এসেছে। কিন্তু উনাকে দেখে ভয় পাচ্ছ কেনো?
আরিয়া কিছু বলল না। প্রাপ্তি এই নিয়ে আরিয়াকে আর কিছু বলেনি। নয়না অনেকক্ষণ প্রাপ্তির সাথে সময় কাটিয়ে, প্রাপ্তি একটা কথা বলবো?
- জ্বি আপু বলেন।
নয়না স্বাভাবিক ভাবেই বলল, আয়ান আর আমার খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল সে তোমায় বলেছে?
- আপু আপনারা একে উপরে বন্ধু, ঘনিষ্ঠ না হলে কী আয়ান এতো বড় একটা কাজ করে?
আরিয়াকে নিলিমা বেগমের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে, আপনার মেয়েকেও সমাজে স্বীকৃতি দিয়েছে। সচারাচর এইটা কেউ করে না আপু।
- প্রাপ্তি আমি তোমাকে তা বলেনি। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কিন্তু অনেক কিছুই বুঝাতে পারে। নিজের স্বার্থেও অনেকে মহৎ কাজ করে বেড়ায়।
- সবাই স্বার্থে কাজ করে কি করে না সেটা আমার জানার প্রয়োজন বোধ করি না। কিন্তু আমার আয়ান কখনো নিজের স্বার্থ দেখে না। যাইহোক আপু, আপনি আমাকে কি বলতে চাইছেন সেটুকুই বলেন। আমার ঘুরিয়ে পেছিয়ে কথা একদম পছন্দ না।
নয়না খানিকটা সময় নিয়ে তারপর বলল, আয়ান আমায় সুযোগ নিয়ে ব্যবহার করেছে। ও আমাকে বলেছে আমার সন্তানের বাবা হবে। এইটা বলে সে আমার সাথে রাতের পর রাত এক সাথে থেকেছে।
প্রাপ্তি কথাটা শুনে সমস্ত রাগ যেন মাথায় চেপে বসেছে। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নয়নার গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় দিয়ে, সাহস কী করে হয় আপনার? আমার সামনে বসে আমার স্বামী কে নিয়ে খারাপ মন্তব্য করার? আপনি কী ভেবেছেন আপনি এইসব বলবেন আর আমি এইসব বিশ্বাস করে আমার স্বামীকে ভুল বুঝে আমি ওকে ছেড়ে চলে যাবো? আর আপনি আমার জায়গাটা দখল করে নিবেন।
আপু আপনার এসব সিনেমা মার্কা বুদ্ধি দেখে আমার খুব হাসি পাচ্ছে। আপনি যাই করেন না কেনো আমি আমার স্বামীকে অবিশ্বাস করি না। বুঝেছেন?
আপনি যান। আপনাকে আমি আমার বাড়িতে যেন আর কখনো না দেখি। এবং কী আয়ানের আশেপাশেও না।
নয়না কিছু বলতে যাবে, তার আগেই প্রাপ্তি থামিয়ে দিয়ে করুন গলায় বলল, থাপ্পড়টা আমি মারতে চাইনি আপু। কোনো স্ত্রী তার স্বামীর নামে এমন অপবাদ কখনো সহ্য করবে না। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আপু বিশ্বাস করেন, আমি ওকে হারাতে পারবো না। অনেক কষ্টে আমি তাকে পেয়েছি। আপনি আপনার স্বামী সংসার নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করুন। শুধু শুধু কেনো আরিয়ার জীবনটাও নষ্ট করতে চাইছেন?
অনেক রাতে আয়ান বাড়ি ফিরে এলো। প্রাপ্তি অভিমান করে আগেই গিয়ে শুয়ে পড়লো। আয়ান ফ্রেশ হয়ে এসে, প্রাপ্তির পাশে বসে, তোমার মা আজ হসপিটালে এসেছে। শরীর ভালো নেই উনার। একবার গিয়ে ওই বাড়িতে ঘুরে আসতেই তো পারো।
প্রাপ্তি আয়ানের দিকে ঘুরে শুয়ে, কেন? নয়না আপুকে এই বাড়িতে কয়েকদিন এনে রাখার জন্য?
আয়ান প্রাপ্তির কথা শুনে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে, কী আবল তাবল বকে যাচ্ছ? কী হয়েছে তোমার?
- কিচ্ছু হয়নি। আমি কাল সকালেই আরিয়াকে নিয়ে মায়ের কাছে চলে যাবো। গিয়ে কয়েকটা দিন থেকে আসবো।
আয়ান বিস্মিত হয়ে, থেকে আসবে মানে? আমি বলেছি ঘুরে আসতে। তুমি গিয়ে ওইখানে থাকলে আমি তোমায় ছাড়া কীভাবে থাকবো?
প্রাপ্তি মুখ বাঁকিয়ে, ওই যে বললাম, নয়না আপুকে নিয়ে থাকবে।
- প্রাপ্তি আমার কথাটা শুনতে ভালো লাগছে না।
কাল ওই বাড়িতে গেলে তোমার মায়ের সাথে দেখা করে চলে আসবে। এটাই আমার শেষ কথা। এখন উঠো খেতে দাও।
প্রাপ্তি উঠে গিয়ে দেখে শিরিন আগেই টেবিলে খাবার দিয়েছে। শিরিন আপু তুমি ঘুমাওনি?
- না, ভাইয়া আসছে তাই ভাবলাম খাবারটা দিয়ে যাই।
আয়ান এসে শিরিনকে দেখে, কিরে তুই আবার উঠে আসতে গেলি কেনো? প্রাপ্তিই দিতে পারতো।
শিরিন কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রাপ্তি আয়ানের দিকে তাকিয়ে, তুমি খাও আমি মায়ের ঘর থেকে আসছি।
প্রাপ্তি নিলিমা বেগমের ঘরের দিকে যেতেই, ভাইয়া আমার একটা কথা ছিল।
আয়ান অবাক হলো শিরিনের কথা শুনে। কারণ শিরিন মুখ ফুটে কিছু বলে না। কিন্তু আজ নিজে থেকেই বলছে।
আয়ান খেতে খেতে বলল, বল, এখানে অনুমতি নেওয়ার কি আছে। তোকে আমি আমার বোনের চোখেই দেখি। বল কী বলবি?
- ভাবী আজ নয়না আপুরে থাপ্পড় মারছে।
কথাটা শুনেই আয়ান বিষম খেয়ে পানির গ্লাস টেনে নিয়ে ঢকঢক করে এক নিশ্বাসে সব পানি খেয়ে নিলো। তারপর শিরিনের দিকে তাকিয়ে, কখন দিয়েছে? কেনো?
শিরিন শান্ত গলায় বলল, আজকে, তবে ভাবির কোনো দোষ ছিলো না। নয়না আপু তোমার নামে বানিয়ে বানিয়ে যে ভাবে মিথ্যা বলা শুরু করছিল ভাবি সহ্য করতে পারেনি। একদম প্রতিবাদী স্ত্রী হয়ে যোগ্য জবাব দিয়েছিলো।
আয়ান চুপ করে বসে আছে। তার আর খেতে ইচ্ছে করছে না। খাবার রেখে হাত ধুয়ে, আরিয়া কোথায়?
- একি ভাইয়া তুমি না খেয়ে উঠে গেলে? ভাবি এসে দেখলে তো বকাবকি করবে।
- তুই এইগুলো সরিয়ে নে, তাহলেই হয়। আরিয়া কী তোর সাথে ঘুমিয়েছে?
- হু, , অনেক আগেই ঘুমিয়েছে।
- আচ্ছা তাহলে খেয়াল রাখিস। আমি রুমে গেলাম। সকাল বেলায় মা আর আরিয়ার সাথে দেখা করে নিবো।
নয়নাকে ফোন দিয়ে ডেকেছে আয়ান। নয়না হসপিটাল এসে অপেক্ষা করছে আয়ানের জন্য।
কিছুক্ষণ পর আয়ান নিজে এসে, কীরে কখন এলি?
- অনেকক্ষণ। কিন্তু তুই কেনো ডেকেছিস আমাকে?
আয়ান নয়নার সামনে বসে, তুই শুরু করেছিসটা কী?
- আমি আবার কী করলাম?
- তুই কিছুই বুঝতেছিস না? তুই কাল প্রাপ্তিকে কী বলে এসেছিস?
- তোর বউ তোকে নিয়ে অনেক অহংকার করে। অবশ্য আমার ভালো লেগেছে। কিন্তু এই অহংকার বেশিদিন টিকবে না
- তোর এইসব আজগুবি কথাবার্তায় বাদ দে। তুই আমার সাথে মিথ্যা কথা কেনো বললি?
- কী বলেছি আমি?
- তোর স্বামী সন্তান সব আছে। তুই দেশের বাহিরে চলে যাচ্ছিস। এইসব মিথ্যা নয়?
- আমার ইচ্ছে। তোর কী?
- আমার কিছু না। তোকে শেষবারের মতো একটা কথা বলি, আমার আশেপাশে যেন তোকে আর না দেখি। তোর মতো মিথ্যাবাদীর সাথে আমার কোনো বন্ধুত্ব নেই। আমার মেয়ে আর স্ত্রীর কাছে তো দূরের কথা তাদের নামও তুই মুখে আনবি না। আয়ান আর কিছু না বলে শান্ত হয়ে উঠে চলে গেল। নয়নাকে জোর করে কিছু বলাও যাবে না। কারণ তার মেয়ে এখন আমার কলিজা। আমি আরিয়াকে ছাড়া থাকতেও পারবো না।
তীক্ষ্ণতায় কথা বললে হয়তো আরিয়াকে আমায় হারাতে হবে।
বিয়ের একটা বছর কিভাবে যে পূর্ণ হয়ে গেল টেরি পায়নি দুজনে। আয়ান কাল বিকেলে একটা ইনভাইটেশনের কার্ড পেয়েছে। হসপিটালের ঠিকানায় এসেছে কার্ডটা। আর সেখানে নিজেকে প্রধান অতিথি হিসেবে দেখে নিজের কাছেই খুব ভালো লাগছে। অবশ্য ওই স্কুলটা অনেক বছর আগে গড়ে তোলার কথা ছিলো। স্কুলের নাম করে সরকারের কাছে থেকে অনেক টাকাও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু গ্রামের স্কুল পরিচালক কমিটির সভাপতি বার বার টাকাটা নিজের পকেটেই ঢুকিয়েছেন, গ্রামের মানুষদের নয় ছয় বুঝিয়ে। পরে কোনো একজন ব্যক্তি স্কুলটা নিজ দায়িত্ব নিয়ে করতে চাইছেন। আর তিনিই আয়ানকে ইনভাইটেশন কার্ড পাঠিয়েছেন। অবশ্য নিজের কোনো নাম তিনি উল্লেখ করেননি কার্ডে। আয়ান মনে মনে ঠিক করলো সেই গ্রামে যাবে স্কুলের জন্য কিছু ডোনেশন দিবেন এবং মহৎ সেই মানুষটাকেও একবার দেখে আসবেন। অবশ্য ওই গ্রামের মানুষগুলো আয়ানের অনেক কাছের মানুষ। কারণ ওই গ্রামেই আয়ান তার মায়ের কোলে জন্ম নিয়েছে। সেই গ্রামের মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে পারলেও আয়ানের ভালো লাগবে।
প্রাপ্তি রুমে এসে আয়ানকে দেখে, তুমি কখন এলে হসপিটাল থেকে?
- কিছুক্ষণ।
- আমাকে ডাকলে না কেনো?
আয়ান হাতের কার্ডটা রেখে, উঠে শার্ট খুলতে খুলতে বলল, দেখলাম আরিয়াকে পড়াচ্ছিলে তাই আর বিরক্ত করিনি।
- কাল ওর স্কুলে একবার যেতে হবে। তুমি যাবে?
- না কাল আমি অন্য জায়গায় যাবো। ভাবছি সাথে তোমাকেও নিয়ে যাবো।
প্রাপ্তি আয়ানের হাতে তোয়ালে দিয়ে কোথায় যাবে?
- কাল গেলেই বুঝতে পারবে। বিয়ের পর তোমাকে নিয়ে কোথাও যেতে পারিনি হসপিটালের ঝামেলার কারণে। আসলে ডাক্তারদের কোনো আলাদা জীবন নেই। কোনো শখ আহ্লাদ নেই। সারাবছর রুগীর সেবা করো আর চুন থেকে পান খসে পড়লেই সব দোষ ডাক্তারদের। বিয়ের পর দুইটা ঈদ গেল পারিনি তোমাকে তেমন সময় দিতে। রাত বিরাতে যখন তখন হসপিটালে যেতে হয়। আমি জানি আমার উপর তোমার খুব রাগ হয়। মাঝ রাতে যখন তোমাকে আমার বুকের উপর থেকে ডেকে তুলে তোমাকে একা রেখে চলে যাই। হয়তো ইচ্ছে করে তোমার এই জামাইটাকে অনেক বকা দিতে কিন্তু ভালোবাসার খাতিরে তা পারো না।
কথাটা শুনে প্রাপ্তি পিছন থেকে আয়ানকে জড়িয়ে ধরলো। তা দেখে আয়ান মুচকি হেসে, প্রাপ্তির ডান হাতটা টেনে নিজের সামনে এনে বুকের সাথে জাড়িয়ে, স্যরি তোমাকে এতোটা কষ্ট দেওয়ার জন্য।
বর্ষার মৌসুমে নদীতে যখন পানিতে টইটম্বুর হয়ে থাকে তেমনি প্রাপ্তির চোখ দুটোরও সেই অবস্থা। চোখ বন্ধ করলে ঝরে পড়বে সব।
- চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে? কিছু বলতে ইচ্ছে করে না? আমার উপর তোমার রাগ দেখাতে ইচ্ছে করে না?
প্রাপ্তি ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে, মাথা নেড়ে না বুঝিয়ে, এতোদিন যা ছিলো আজ সেটাও নিমিষেই দূর হয়ে গেছে। হ্যাঁ আমার কষ্ট হয় যখন তুমি আমাদের সময় দিতে পারো না। আমাদের মা মেয়েকে ঘুরতে নিয়ে যেতে পারো না। হ্যাঁ প্রচন্ড ভাবে রাগ হয় যখন গভীর রাতে তুমি ফোনের শব্দ পেয়ে আমার বুকের উপর থেকে উঠে যাও নয়তো তোমার বুকের উপর থেকে আমাকে সরিয়ে দিয়ে হসপিটালে চলে যাও। সেইদিন আমার জন্মদিন ছিলো এক ঝলক দেখা দিয়ে পুরোটা রাত তোমাকে কাছে পাইনি। সেইদিন হসপিটাল যখন ফোন দিলাম তখন শুনলাম তুমি টানা চারটি অপারেশন করে শেষ করতে হবে। তখন মুখে হাসি ফুটিয়ে গর্ববোধ হয়, আমি এমন একজনের স্ত্রী যে নিজের কথা, নিজের আনন্দের কথা না ভেবেই মনুষের কথা ভাবে, অনুভব করে। তুমি আমাকে যতোটা ভালোবাসো আমিও তোমায় ততটাই ভালোবাসি। আমি জানি তোমারও কষ্ট হয় আমাদের সাথে সময় কাটাতে না পেরে। তোমার কষ্টের চেয়ে আমরা কি কষ্ট বেশি করি? না করিনা। তোমার উপর যখন মানুষ আস্থা রেখে নিজের পরিবারের মানুষগুলো তোমার হাতে তুলে দেয়। আর তখন সেই মানুষগুলোর আস্থা ভরসা রাখতে তোমাকে কতটা যুদ্ধ করতে হয় তা আমার থেকে আর কেউ বেশি জানে না।
আয়ান প্রাপ্তির কথাগুলো মুগ্ধ হয়ে শুনছে। এই ছোট্ট মেয়েটার মাথায় এতো ভাবনা নিয়ে ঘুরে সারাক্ষণ। আমাকে বুঝার প্রতিনিয়ত এতো চেষ্টা করে। প্রাপ্তি আমি তোমাকে যতই দেখছি বারবার তোমার প্রেমে পড়ে যাচ্ছি।
প্রাপ্তি খানিকটা সময় নিয়ে আবার বললো, যেদিন তোমার রোগী বেশি সিরিয়াস অবস্থায় থাকে তখন ওই রোগীর পরিবার বাড়ি এসে আমার শোবার ঘরে এসে যদি একবার তোমায় দেখতো তাহলে তারা আর চিন্তা করতো না। কারণ তাদের সব চিন্তা আমার মনে হয় তুমি একাই করো। তবে তুমি শুধু একটার চিন্তাই করো না। সেটা তোমার পরিবার। তুমি সফল একজন ডাক্তার। দেশ বিদেশে তোমার এতো নাম খ্যাতি কিন্তু তুমি তোমার বউয়ের কাছে কী? প্রাপ্তি কথাটা বলতেই গলাটা ভারি হয়ে এলো, চোখ দুটো আবার টইটম্বুর।
আয়ান কথাটা শুনে মনের ভিতরে হাহাকার করে উঠলো। তবে কথাগুলো একটাও মিথ্যা বলেনি প্রাপ্তি। এই কয়েকটি মাস প্রাপ্তিকে আমি সময় দিতে পারি না। প্রাপ্তি আসার পর থেকে মাকেও তার ভরসায় রেখে নিজে খালি মানুষের কথায় ভেবে যাচ্ছি। আজ প্রাপ্তির এইসব প্রশ্নের কোনো আনসার তার কাছে নেই। নিরব নিস্তব্ধ থাকা ছাড়া।
প্রাপ্তি আয়ানকে এখনো চুপ থাকতে দেখে আবার বললো, আমার কোনো পরিবর্তন তোমার চোখে পড়েনি? অবশ্য পড়ার কথাও না। আমি সেটা নিয়ে ভাবি না। আমি তো যানি আমার স্বামী যতো কিছুই হোক আমাকেই ভালোবাসে।
কথাটা বলে প্রাপ্তি আয়ানের কাছ থেকে সরে গিয়ে, যাও ফ্রেশ হয়ে আসো, আমি খাবার দিচ্ছি।
কথাটা বলে প্রাপ্তি রুমের দরজার দিকে পা বাড়াতেই, আমি যে বাবা হচ্ছি এইকথাটা আজকেও বলবা না? সন্তান শুধু তোমার একার?
কথাটা শুনে প্রাপ্তি তড়িৎ ভাবে পিছনে ফিরে আয়ানের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে আছে।
- এইটা ঠিক আমি তোমার দিকে আগের মতো খেয়াল রাখতে পারি না। কিন্তু তাই বলে এইটা নয় আমার প্রাপ্তি মা হচ্ছে আর আমিই বুঝতে পারবো না? তোমার সবগুলো পরিবর্তন আমার চোখে দুইমাস আগেই ধরা পড়েছে। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম আমার বউ নিজের মুখে আমাকে বলুক আমি বাবা হচ্ছি। কেনো জানো? তোমার মনে আছে প্রাপ্তি? যেদিন প্রথম তোমায় চিঠি দিয়ে ছিলাম, তুমি আমার মুখ থেকে শুনার জন্য আমাকে হ্যাঁ বলোনি। তাই আমিও চেয়েছি জীবনে শ্রেষ্ঠ একটা উপহার তোমার মুখ থেকে শুনতে।
প্রাপ্তি দৌড়ে এসে আয়ানকে শক্ত করে জাপটে ধরে, স্যরি। তোমাকে এতোগুলো কথা শুনানোর জন্য।
আয়ান মুচকি হেসে, মাফ করে দিতে পারি এক শর্তে।
- কী?
- একবার আয়ান বলে ডাকো। তোমার মুখ থেকে আমি আমার নামটা শুনতে চাই।
- না আমি পারবো না।
- না হলে স্যরি বলে লাভ নেই। তুমি আমার পিছনে নাম ধরে ডাকতে পারো সামনে ডাকলে কী হয়?
- না, তুমি আমার ডাক্তার সাহেব।
- না, নাম বলো।
প্রাপ্তি এইবার বিরক্তি নিয়ে, ওহ্ আয়ান এমন করছো কেনো?
- এইবার ঠিক আছে। মায়ের পরে যদি কেউ আমার নামটা সুন্দর করে ডেকে থাকে সেটা হলে তুমি।
যাইহোক কালকের কথাটা মাথায় রেখো। আমরা কাল এক জাগায় যাচ্ছি।
- আরিয়া যাবে না?
- না, আমরা যাবো আর আসবো।
- হুম তাও তো ঠিক। আচ্ছা তুমি তাড়াতাড়ি খেতে আসো। আমি মায়ের রুম থেকে একটু ঘুরে আসি, দেখি মেয়েটা ঘুমালো কিনা।
রাতের খাওয়া খেয়ে দুজেনেই এসে শুয়ে পড়লো। প্রাপ্তি আয়ানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে।
- মা জানে?
- কোনটা?
- তুমি যে মা হচ্ছো।
- না ভাবছি আরও কয়েকটা দিন পরে বলবো।
- কেনো? এতো বড় একটা খবর মাকে জানাবে না?
- মাকে জানালে মা আমায় পুরো মুক্তি বানিয়ে দিবে। কোনো কাজ করতে দিবে না তাই ভাবছি আরও কয়েকটা দিন পরে বলবো।
আয়ান আর কথা না বাড়িয়ে প্রাপ্তিকে বুকের সাথে আরও শক্ত করে জড়িয়ে নিলো।
শিরিন সকালে নাশতা বানিয়ে আরিয়াকে স্কুলের জন্য তৈরি করে দিলো।
- ফুফি বাবা এখনো উঠেনি?
- না।
- মাও উঠেনি?
শিরিন কিছু না বলে নিলিমা বেগমের দিকে তাকালেন।
নিলিমা বেগম মুচকি হেসে, এতো দাদুভাই তোমার মা এসে পড়বে। কথাটা শেষ করতেই প্রাপ্তি গাঢ় সবুজ রঙের একটা জামা পরে নিচে নেমে এলো। নিলিমা বেগম কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, মাশাল্লাহ! তোকে তো অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। আমি শাশুড়ী হয়ে চোখ ফিরেতে পারছি না আমার ছেলে সে কী পেরেছে ফিরাতে?
- মা তুমিও না। আজ তোমার ছেলের সাথে বাহিরে যাবো। তাই এই জামাটা পরেছি। তোমার ছেলে কখন নিয়ে এসেছে আমি জানি না। একটু আগে এইটা আমাকে দিয়ে বললো জামাটা পরে নিতে।
আরিয়া এতোক্ষণ সব শুনে, মা তুমি আর বাবাই কোথায় যাচ্ছো?
- একটা স্কুলে মা। তোমার মতো কতোগুলো বাচ্চা নিজেদের পড়ালেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নিজেদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আজ তোমার বাবাই তাদের একটু খানি হলেও সাহায্য করবে সে আশায় তারা একটু খানি বুকে আশার আলো জাগিয়েছে।
- ওকে মা তাহলে তোমরা যাও, আমি স্কুলেই যাচ্ছি।
আয়ান এতোক্ষণ প্রাপ্তির কথাগুলো শুনছিলো, আয়ান বিস্মিত হযয়ে ভাবছে প্রাপ্তি এতোকিছু কি করে জানলো? জিজ্ঞেস করবো তাকে? না থাক ওইখান থেকে ফিরে এসেই জিজ্ঞেস করবো।
আয়ান এসে নাশতা করতে বসে নিলিমা বেগমের দিকে তাকিয়ে, মা, আজ কোথায় যাচ্ছি জানো?
- প্রাপ্তি তো বললো কোনো এক স্কুলে যাচ্ছিস।
কথাটা শুনে প্রাপ্তি আয়ানের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে, ইশ্! আয়ান আবার আমাকে ধরে ফেলবে নাতো? আমি যে তাকে সারপ্রাইজ দিতে যাচ্ছি এইটা আয়ান বুঝে ফেলে?
কিন্তু ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আয়ান নিজে থেকেই বললো, মা' আমি আর প্রাপ্তি আমাদের গ্রামে যাচ্ছি।
কথাটা শুনেই নিলিমা বেগমের চোখে মুখে বিস্ময়ে ছোঁয়া ফুটে উঠেছে। কিন্তু কিছু না বলে আবার মন খারাপ করে চায়ের কাপে চুমুক দিলো।
- আমি জানি মা, তোমার মনে এখন কী চলছে। নিজের গ্রামের কথা ভিষণ মনে পড়ছে তাই তো?
- নারে বাবা, আমার তেমন একটা মনে পড়ে না। যারা বিপদের সময় ছিলো না। সুখের সময় তারা থাকুক আমি চাই না। তবে আসার সময় তোর ওই চাচার সাথে একবার দেখা করে আসিস। মানুষটা তোর জন্য অনেক করেছে। উনি না থাকলে আমি তোকে নিয়ে এতোদূর আসতে পারতাম না।
কথাগুলো বলতেই চোখ মুছলেন তিনি।
প্রাপ্তি নিলিমা বেগমকে সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে, মা তাহলে আসি?
নিলিমা বেগম প্রাপ্তির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, যা মা, সাবধানে থাকিস। গ্রামে যাচ্ছিস দুজনেই একে উপরে খেয়াল রাখিস।
প্রাপ্তি হেসে আচ্ছা মা তুমি দোয়া করো। আয়ান সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে, প্রাপ্তি তোমার হয়েছে? আরিয়াকে স্কুলে নামিয়ে আমাদের যেতে হবে।
নিলিমা বেগম মুচকি হেসে, আয়ান আমার মেয়েটার দিকে খেয়াল রাখিস।
- মা আমি তোমার কিছু না?
- পাগল ছেলে তোরা দুজনেই আমার কাছে সমান। বুঝলি?
- আচ্ছা ঠিক আছে মা, শিরিন' মায়ের দিকে খেয়াল রাখিস। আমাদের আসতে দেরি হলে কিছু লাগলে রাফিকে ফোন দিয়ে বলিস। প্রাপ্তি এইবার আসো।
আয়ান আরিয়াকে কোলে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে নিজে বসলো। প্রাপ্তিও এসে বসে আয়ানকে বললো, হসপিটাল ফোন দিয়ে বলেছো আজ যে যাবে না?
- হু।
আরিয়াকে স্কুলের সামনে নামিয়ে , প্রাপ্তি আরিয়ার কপালে চুমু দিয়ে, স্কুল ছুটি হলে ড্রাইভার আসলে চলে যেও, আর মা না আসা পর্যন্ত ভদ্র মেয়ে হয়ে থাকবা। বাসায় গিয়ে দাদীকে একদম জ্বালাবে না।
আরিয়া মাথা নাড়িয়ে চলে গেল।
আয়ান আবার ড্রাইভ করতে লাগলো।
কিছু দূর যেতেই আয়ান একহাত প্রাপ্তির হাতের উপর রাখতেই প্রাপ্তি আয়ানের দিকে ফিরে তাকালো।
- প্রাপ্তি' আমাদের ছেলে চাও না মেয়ে?
প্রাপ্তি আয়ানের একদম কাছে এগিয়ে এসে আয়ানের কাঁধে মাথা রেখে, আমি ছোট্ট আয়ান চাই। আমাদের তো মেয়ে আছেই। তাই আমাদের মেয়ের জন্য তার একটা ভাইয়ের দরকার।
আয়ান মুচকি মুচকি হাসছে। আর পুরোটা পথ প্রাপ্তির একহাত ধরে অন্য হাতে ড্রাইভ করছে। মাঝে মাঝে প্রাপ্তির কপালে ভালোবাসার একটুকরো পরশ দিচ্ছে।
সবাই আয়ানকে বরণ করার জন্য এগিয়ে এসেছে। কেউ ফুলের মালা, কেউ ফুলের গুচ্ছ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আয়ান গাড়ি থেকে নামার আগেই, সবাই প্রাপ্তিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো,
সামিরা নামের একজন এসে, ম্যাডাম আপনার আসতে এতো দেরি কেনো?
প্রাপ্তি কিছু না বলে মুচকি হেসে সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে চলছে তো?
- জ্বি ম্যাডাম আপনি একবার দেখুন।
আয়ান এইসব কিছু দেখে খুবি অবাক! তারা সবাই প্রাপ্তিকে আগে থেকেই চিনে? কিন্তু কীভাবে?
আয়ান আসতেই সবাই এগিয়ে গিয়ে ফুলের মালা পরাচ্ছে। প্রাপ্তি এগিয়ে এসে আয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে, একগুচ্ছ রজনীগন্ধার নিয়ে এসে, স্যার আপনার জন্য।
আয়ানের বিস্ময় যেন আরও বেড়ে গেল। আয়ানকে সবাই এগিয়ে নিয়ে স্টেজে বসালো।
সামিরা মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে, আমরা যাদের জন্য এতোক্ষণ অপেক্ষা করেছি তারা এসে গেছে। এতোটা দিন আমাদের সাথে থেকে আমাদের সাহস যুগিয়ে যিনি এখন আবার নতুন করে এই স্কুলের প্রাণ ফিরিয়ে দিচ্ছে তিনি আর কেউ নয় আমাদের প্রধান অতিথির পাশেই বসে আসছেন মিফতাহুল জান্নাত প্রাপ্তি। কথাটা শুনে আয়ান অবাক হয়েই পাশে ফিরে প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে আছে। প্রাপ্তি উঠে সবাইকে সালাম দিয়ে সামিরাকে সরিয়ে , আজ আপনাদের মাঝে এসে আমারও খুব ভালো লেগেছে। আমি আপনাদের একজন হয়ে এভাবে সবসময় থাকতে চাই। যাই হোক আজ আমাদের প্রধান অতিথি ডাক্তার আদনান মাহমুদ আয়ান। আমার যতটুকু জানা, তিনি আপনাদের গ্রামেরই সন্তান।
প্রাপ্তির কথায় আয়ান রাগ করবে নাকি অভিমান কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে কেনো জানি আজ গর্ববোধ করছে সে প্রাপ্তিকে নিয়ে। যে কাজটা তার করার কথা ছিলো আজ তার প্রাপ্তি করছে। খুব ভালোলাগছে তার। চোখ যেন সরাতেই ইচ্ছে করছে না তার।
প্রাপ্তি কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে লাগলো, আমি উনার ব্যাপারে এখন আর কিছু বলবো না। উনার মুখ থেকেই আমরা শুনবো উনার অর্জনের কথা। আসুন মিস্টার আয়ান।
আয়ান মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, আমি এই গ্রামের সন্তান এইটা এইখানের অনেকেরই জানা। আমি ডাক্তার আয়ান মাহমুদ হওয়ার পিছনে দুজন মানুষের সবচেয়ে অবদান বেশি সেটাও অনেকের জানা। তবে আমার যা মনে হলো এতোক্ষণ এইখানে বসে, সেটা হলো আমার আগে যে মানুষটা আমার পরিচয় করিয়ে দিলো এইখানের বাহিরেও উনার সাথে আমার একটা সম্পর্ক আছে সেটা হলো, উনি আমার অর্ধাঙ্গিনী, উনি আমার সহর্ধমিনী, আমার স্ত্রী, আমার ভালোবাসার মানুষ এবং আমার সবচেয়ে কাছের একজন বন্ধু।
সবাই অবাক হলেও আয়ান আবার বললো, আমি আজ এইখানে এসেছি শুধু উনার কারণেই। যিনি আমায় পথ দেখিয়ে এখানে নিয়ে এসেছেন। আমার মস্ত বড়ো ভুল থেকে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
পাশে ফিরে, অনেক ধন্যবাদ আমাকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য।
আয়ান অনেক কথায় বললো তাদের। সেখানে ডোনেশন হিসেবে বিশ লাক্ষ টাকাও দিলো।
সেখান থেকে বিদায় নেওয়ার সময় সবাই যেন প্রাপ্তিতে মুগ্ধ। আয়ান প্রাপ্তির বাহুডোরে জড়িয়ে ভিড়ের থেকে বাহির করে গাড়িতে বসিয়ে সেখান থেকে বিদায় নিয়ে সেই চাচার বাসায় গেল। সেখানে গিয়ে যা শুনলো আয়ান একদমই প্রস্তুত ছিলো না।
তাড়াহুড়ো করে আয়ান গ্রামের হসপিটাল গিয়ে চাচা মিজান সাহেবের কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে, চাচা আসবো? কথাটা শুনেই মিজান সাহেব নিভুনিভু চোখ দিয়ে তাকানোর একটু চেষ্ট করে চশমাটা খুঁজেই দরজার দিকে তাকিয়ে করুন গলায় বললো, আয়ান!
আয়ান কাছে গিয়ে পাশে বসে, হ্যাঁ চাচা আমি।
আয়ানকে পেয়ে কলিজাটা যেন বড় হয়ে গেল মিজান সাহেবের। আয়ানকে বুকে নিয়ে, বাবা' তোর এতোদিন পর মনে হলো আমার কথা?
চাচা মা এখনো তোমাদের কথা ভুলেনি। আসলে আমি ভাবতাম তুমি ভালোই আছো আর নিজের ব্যস্ততার কাছে হার মেনেও যোগাযোগ করা হয়নি।
মিজান সাহেব প্রাপ্তির দিকে চোখ পড়তেই প্রাপ্তি সালাম করলো।
- চাচা, ও প্রাপ্তি, আমার স্ত্রী।
মিজান সাহেব প্রাপ্তির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
- তোর মা কেমন আছেরে আয়ান?
- চাচা মা ভালো আছে। আপনি হসপিটাল পড়ে আছেন আপনার ছেলেরা আসে না?
মিজান সাহেব দীর্ঘশ্বাস নিয়ে, সবার কপালে সব সুখ থাকে না। তোর চাচী মারা গেছে তিন বছর হয়ে গেল। সেই থেকে এই সরকারি হসপিটালেই পড়ে আছি। আজ এই সমস্যা কাল ওই সমস্যা। ছোটো মেয়েটা আসে সেই দেখে আমাকে। তবে আমার যখন টাকা ছিলো তখন ছেলেগুলোও আমার ছিলো। মেয়েটার অবস্থাও তেমন স্বচ্ছল না। যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করে।
আয়ান কিছু না বলে, রাফিকে কল দিয়ে নিজের হসপিটালে মিজান সাহেবকে নেওয়ার সব ব্যবস্থা করে ফেললো আয়ান। এইখানকার ডাক্তারদের সাথে কথা বলে বিকেলে নেওয়ার ব্যবস্থা করলো। চাচা আমি তাহলে এখন যাই। আপনাকে বিকেলে শহরে নিয়ে যাওয়া হবে আমার হসপিটালে। ভালো ডাক্তার দেখিয়ে এখন থেকে আপনি আমাদের সাথে থাকবেন আমার বাড়িতে। ছেলের সুখ কপালে আপনার আছে চাচা। মনে করবেন আমিই আপনার ছেলে। এতোদিন মা ছিলো আজ থেকে বাবাও পেয়ে গেলাম।
আয়ানকে জড়িয়ে চুপ করে আছেন মিজান সাহেব।
আয়ান আবার বললো, চাচা আমাকে ক্ষমা করে দিন। এতোটা দিন আপনাকে কষ্ট করতে হয়েছে। নিজের খ্যাতি লাভের ব্যস্ততায় আমি যে সব ভুলে বসতে ছিলাম। আজ আপনার বউমা না থাকলে বুঝতেই পারতাম না আমি কতো বড় ভুল করে যাচ্ছি এতোদিন।
- নারে বাবা, তোর কোনো ভুল নেই। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করে।
আয়ান আরও কিছুক্ষণ মিজান সাহেবের সাথে কাটিয়ে শহরে উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।
গাড়িতে বসে প্রাপ্তির দিকে বার বার তাকাচ্ছে আয়ান।
- কী হলো এইভাবে কী দেখছো?
- আমার বউটাকে। যে আমাকে না জানিয়ে এতোকিছু করে ফেললো।
প্রাপ্তি মুচকি হেসে, তোমার একটুও রাগ হয় না আমার উপর? আমাকে বকতে ইচ্ছে করে না?
- হুম অনেক করে, তোমার এই শরীর নিয়ে সংসার সামলিয়ে, আরিয়াকে সামলিয়ে বাহিরের কাজও সামলাচ্ছো। এতে যদি তোমার কোনো ক্ষতি হয়? তাহলে আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো প্রাপ্তি?
তোমাকে ছাড়া আমার সামনের দিকে পা বাড়ালেই অন্ধকার মনে হয়।
- ধ্যাৎ, তুমি এইসব বাজে চিন্তা বাদ দাও। তুমি থাকতে আমার কিচ্ছু হবে না। তোমার ভালোবাসা আমায় কখনো কেড়ে নিতে পারবে না। সারাজীবন তোমার এই বুকে মাথা রেখে কাটিয়ে দিবো।
আয়ানের গাড়িটা গ্রাম পথ শেষ করে শহরের রাস্তায় আসলো। দুজনেই নানান কথা নিয়েই ব্যস্ত।
আয়ানের ইচ্ছে করছেনা আজ বাড়িতে যেতে। প্রাপ্তিকে নিয়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে তার। এই মানুষটাকে জনম জনম দেখলেও মিটবেনা তবু তার স্বাদ।
তুমি মনে জনমও ভরে,
থেকো মোর প্রাণে।
সারাটি জীবনও ভরে,
মিটিয়ে নিও যেন স্বাদ।
প্রাপ্তি মন ভরে আয়ানের কবিতা শুনছে।
.
.
.
চলবে..............................