শেষ থেকে শুরু - পর্ব ০৬ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


___খাবার টেবিলে বসে আয়ান নিজের পছন্দের খাবার দেখে,শিরিনের দিকে তাকিয়ে, কী ব্যাপার শিরিন? হঠাৎ আমার পছন্দের খাবারগুলো রান্না করেছ কেনো?

আমি করিনি ভাইয়া,ভাবী করছে।শুধু আপনার জন্য না, সবার জন্য।

আয়ান আর কিছু বলল না,প্রাপ্তির দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হেসে খেতে শুরু করলো।
নিলিমা বেগম খেতে খেতে বলল, আমার মনে হয় তোদের এইবার বিয়েটা করা উচিত।
কথাটা শুনেই প্রাপ্তি বিষম খেলো।আয়ান পানি এগিয়ে দিয়ে নিলিমা বেগমকে চুপ করতে বললেন।
খাওয়া শেষ করে, আয়ান উঠে গিয়ে সোফায় বসে হসপিটাল আবার ফোন দিয়ে কথা বলে প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে বলল,প্রাপ্তি তোমার মা কোথায়?

কথাটা শুনেই প্রাপ্তি থমকে গেল।আয়ানকে কি বলবে বুজতে পারছেনা।তার মায়ের সাথে যে তার কোনো যোগাযোগ নেই এইটা আয়ানকে কীভাবে বলবে?

-প্রাপ্তি আমি তোমায় কিছু জিজ্ঞেস করছি।তোমার মা কোথায়?

প্রাপ্তি স্বাভাবিক ভাবেই বলল,শুনেছি উনি নিজের বাসায় একাই থাকেন।আমি মেজ আন্টির কাছেই থাকি।উনি আমার কোনো খবর নেয় না।আগে আমি নিতাম কিন্তু উনি আমাকে যা ইচ্ছা তাই বলতেন।

আয়ান একটু অবাক, কেনো?

-তুমি সেইদিন চলে আসার কিছুদিন পর তোমার আর আমার বিয়ের কথাটা মা জেনে গিয়েছিল।

-তুমি বলেছো?

-না,মা আর আমি শপিংএ গিয়েছিলাম।তোমার বন্ধু নিলয়ের সাথে হঠাৎ দেখা।সেই বলল।

-ওহ্,আচ্ছা শুনো তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে নিয়ে যাব।আমি রেডি হয়ে আসি, তুমি বসো।

প্রাপ্তি আরিয়ার কাছ থেকে অনেক কষ্ট করেই ছুটে এসেছে।আয়ান প্রাপ্তিকে হসপিটাল নিয়ে আসলো।
গাড়ি থেকে প্রাপ্তি নেমে অবাক হয়ে,আমাকে এইখানে নিয়ে এলে কেনো? 
আয়ান কিছু বলল না।প্রাপ্তির হাত ধরে হসপিটাল ঢুকতেই আয়ানের পিএগুলো দৌড়ে এসে আয়ানের পিছন পিছন হাঁটতে থাকলো।আয়ান পাশে ফিরে, রিয়ান, পারভীন বেগমের ফাইলগুলো নিয়ে আসো।
কথাটা শুনে প্রাপ্তি অবাক হয়ে আয়ানের দিকে তাকিয়ে, মা!

আয়ান আইসিইউর সামনে প্রাপ্তিকে দাঁড় করিয়ে,আমি চেইঞ্জ করে আসছি।

আয়ান আইসিইউতে ঢুকে, এভরিথিং ইজ ওকে মিনু?
- ইয়েস স্যার?
-ওকে,

প্রাপ্তি বাহিরের থেকে দাঁড়িয়ে চোখের পানিগুলোকে ঝরিয়ে যাচ্ছে।মায়ের কী হয়েছে? আমি এতোটাই পর হয়ে গেলাম যে আমাকে কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি?কেমন মা তুমি?প্রাপ্তির চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
পিছন থেকে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে, ফিরে তাকিয়ে, মামা? মায়ের কী হয়েছে?আমাকে কেনো জানালে না?কথাগুলো বলতে বলতে প্রাপ্তি কান্না করে যাচ্ছে।
প্রাপ্তির মামা সান্ত্বনা দিয়ে বলল,চিন্তা করিস না।কেনো কাঁদছিস তুই?তোর মা দেখবি কয়েকদিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে।ডাক্তার আয়ান, এই শহরের নামি গুনী একজন। উনিই অপারেশন করেছে তোর মাকে।দেখবি তোর মা ভালো হয়ে যাবে।আল্লাহ উপর ভরসা রাখ। 
প্রাপ্তি কাঁদতে কাঁদতে পাশে চেয়ারে বসে পড়লো।
আয়ান কিছুক্ষণ পর বাহিরে এসে প্রাপ্তির মামাকে দেখে আর কিছু বললেন না।নিজের চেম্বারে গিয়ে বসলেন।
সুমনাও বসলো সামনে, 
-ওনার সব ঠিক আছে। জ্ঞান যখন ফিরেছিল কথা বলার চেষ্টা করেছে?
-জ্বি স্যার। 
-হুম।
দুজনে অনেক কথা বলে সুমনা আয়ানের চেম্বার থেকে বাহির হয়ে গেলেন।আয়ান নিজের কাজে মন দিল।
সারারাত প্রাপ্তির সাথে কাটিয়ে দিলো হসপিটাল।দুজনেই কেউ কারো সাথে একটা কথাও বলেনি।রাফি হসপিটাল এসেছে সুমনাকে নিতে,কিন্তু প্রাপ্তিকে দেখেই সে থমকে গেল। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে প্রাপ্তির কাছে গিয়ে পাশের চেয়ারটায় বসলো।
প্রাপ্তি পাশে ফিরে রাফিকে দেখে চমকে,ভাইয়া আপনি? 
-হুম,কেমন আছো?
-প্রাপ্তি শান্ত গলায় বলল, জ্বি ভালো।
-এতো ভোর বেলায় বসে আছো,হসপিটাল কী কোনো কাজে এসেছো?
প্রাপ্তি ভেজা গলায় বলল, মা আইসিইউতে। 
আপনি এইখানে?
-আমার ওয়াইফকে নিতে এসেছি।
-ওহ্।
রাফি কিছু বলতে যাবে সামনে তাকিয়ে দেখে আয়ান দুইকাপ চা নিয়ে এসেছে,আরে রাফি তুই কখন এলি?
-এইতো কিছুক্ষণ। সুমনা কই? 
-প্রাপ্তির দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে,স্যরিরে,,সুমনাকে আমিই আটকিয়ে রেখেছিলাম।প্রাপ্তির মায়ের জন্য।বুঝিসইতো আমি উনার কাছে বেশি থাকলে প্রবলেম। আর সুমনাকে ছাড়া আমি কারোর উপর ভরসাও করতে পারি না।কথাগুলো বলে আয়ান রিয়ানকে ডেকে আরেক কাপ চা দিতে বলে প্রাপ্তির আরেক পাশে বসলো।রাফিকে গম্ভীর হয়ে থাকতে দেখে,এ্যানি প্রবলেম রাফি?
রাফি মাথা নাড়িয়ে না বুঝিয়ে,আচ্ছা তোর সাথে প্রাপ্তির আবার দেখা হয়েছে আমাকে একটু জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না?
-রাফি তুই আমাকে ভুল বুঝছিস।তুই আমার কথা শুন,,,আয়ান সব কথা খুলে বলল রাফিকে।
রাফি হা হা হা করে হাসি দিয়ে,দেখেছো প্রাপ্তি? এইটাই ভাগ্যের লিখন।কাউকে কখনো তুচ্ছ ভাবতে নেই।কে কখন কি হবে তা এক আল্লাহ ছাড়া কেউ বলতে পারে না।

-বাহ্ আমাকে রেখে সব কথা হয়ে গেছে? আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম মেয়েটাকে দেখে।
রাফি সুমনা আসতেই,দেখো না সুমনা, আয়ান প্রাপ্তিকে ফিরে পেয়েছে।এই সেই প্রাপ্তি যার জন্য আয়ান বিয়েটিয়ে সব বাদ দিয়ে ফেলেছে।
-রাফি তুই কিন্তু ভুল বলছিস,আমরা কিন্তু হ্যাজবেন্ড ওয়াইফ।এইটা তোর থেকে ভালো কেউই জানে না।

সুমনা গালে হাত দিয়া হা করে আছে,
রাফি মুচকি হেসে, আজ তোমাকে সব বলা যায়।এতোদিন আয়ানের ব্যাপারে জানতে ছেয়ে আমার মাথা পাগল করে দিয়েছো।
আয়ান প্লিজ তুই বলে আমার বউটাকে মন শান্ত কর।

আয়ান একগাল হাসি দিয়ে, প্রাপ্তির সাথে যেদিন আমার প্রথম দেখা হয় সেদিন একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল।ভোরের কুয়াশায়,চারেদিকে হাজারও ফুলের মাঝে খিলখিল হাসির শব্দ শুনে পিছনে তাকালাম,দশ এগারোটা মেয়ের মাঝে একজনের দিকেই আমার চোখ আটকে গেল।আকাশী রং আর সাদা মিলিয়ে যেন এক অপ্সরী, সবার মাঝে থেকেও সে আলাদা।তার সেই হাসিটা আজও মনকে উতালপাতাল করার জন্য যথেষ্ট। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম।রাফি আমায় অনেক বার ডাকলো কিন্তু আমার কোনো হুশ ছিল না।রাফির ধাক্কায় যেন আমি পৃথিবীতে নতুন করে ফিরে এসেছি।

-ওই কী হয়েছে ওই দিকে তাকিয়ে কী দেখছিস?
তখন রাফিকে দেখিয়ে বললাম,ওই দেখ। 
রাফিকে দেখাতে গিয়ে আমাদের বন্ধু নিলয় বলল,আরে মাম্মা ওইদিকে তাকিয়ে লাভ নাই।
আমি বললাম, কেনো?
-কার মেয়ে জানিস?পারভীন বেগমের মেয়ে।এইগ্রামের যাকে শ্রেষ্ঠ ধনী বলেই জানে।এই মেয়ের দিকে যে তাকায় দ্বিতীয় বার তাকানোর সাহস হয় না।তুই ভাই তাকানোর আগে তোর গ্রামে ফিরে যা।এটাই ভালো হবে।এই এলাকায় এসেছিস কিছু না জেনেবুঝে কোনো দিকে চোখ বাড়াস না।
রাফিও নিলয়ের কথায় সায় দিল।
-আয়ান নিলয় ঠিক বলেছে।তুই আমাদের এলাকায় কয়েকদিনের জন্য এসেছি বেড়াতে, ভালো ভালো দিন কাটিয়ে মেডিকেলে ফিরলেই ভালো।

স্কুলের শহীদমীনার রাফি নিলয় এদের সাজানোর দ্বায়িত্ব পড়েছিল।তখন আমরা মেডিকেলে তৃতীয় বর্ষে।হঠাৎ ছুটি পাওয়াতে রাফি আর নিলয় তাদের এলাকায় নিয়ে গেল আমায়। আসলে তখন আমাদের গ্রামেও আমার তেমন বন্ধু ছিল না।গরীব ঘরের ছেলে ছিলাম বলে কেউ আমার সাথে এতোবেশি মিশতো না।
পড়ালেখাটা তখন চালিয়েছিলাম আমার দূর সম্পর্কে এক চাচা আর মা মাঝে মাঝে মামাদের কাছথেকে নিয়ে দিতো।বলতে পারো পরের টাকায় আজ আমি এইখানে।আয়ান তাচ্ছিল্য করে হাসি দিয়ে, বলতে পারো আজকে আয়ান শুধু মাত্র আমার মায়ের ওই চাচার। সারাজীবন তাদের ঋণ শোধ করার মতো ক্ষমতা আমার নেই।অবশ্য মায়ের ঋণ শোধ করা এমনিতেও যায় না।
সুমনা আয়ানের কথার মাঝে হারিয়ে গেছে,সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছে।আয়ান দীর্ঘ শ্বাস ফেললো, আবার বলা শুরু করলো সে,আমি রাফিকে বললাম ও কোন ঘরের মেয়ে আমার জানার দরকার নেই।আমি শুধু বুঝি ওকে আমি ভালোবাসি।
রাফি বলল,আয়ান তুই এইসব বাদ দে।চল স্যারদের সাথে দেখা করে এইখান থেকে কেটে পড়ি।
রাফি টেনে আমায় নিয়ে গেল।স্যারেরা সবাই প্রশংসায় মেতে উঠলো। স্যার তখন মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের ব্যাপারে উচ্ছ্বসিত গলায় আবারও প্রসংশা করলেন।কিন্তু আমি ভিড়ের মাঝে ওই একটাই মুখ খুঁজেছি সেটা হলো প্রাপ্তি।

দুইদিন কেটে গেল,রাফি আমার জিদের কাছে হার মেনে নিয়ে প্রাপ্তির রুটিন সম্পর্কে জানলো। 
প্রাপ্তি নবম শ্রেণীতে পড়তো।রাফি আমায় বলল,আয়ান মেয়েটা কিন্তু অনেক ছোট। এই বয়সে প্রেমটেম মাথায় ঢুকিয়ে পড়াটা নষ্ট করা ঠিক হবে না।এবং তোরও নষ্ট হবে।

-রাফি তুই এখনো তাহলে আমাকে চিনতে পারিসনি।পড়ালেখা আগে তারপর প্রেম।চিন্তা করিস না।তুই শুধু আমায় সাহায্য করে যা।

পরের দিন সকালে আমি স্কুলের পাশে ছোট্ট দোকানে বসে তাকে দেখছিলাম।আরও দুইদিন এইভাবে পার করলাম।কিন্তু না এইভাবে আমি এগুতে পারছি না।তাই রাফি আর আমি বুদ্ধি বাহির করতে লাগলাম।ওর কাছাকাছি থাকতে হলে এমন কাউকে যে আমাদের সাহায্য করতে পারবে। রাফি বলল তার কাজিন ওই স্কুলের শিক্ষকতা করেন এবং কোচিং সেন্টারও আছে। আর প্রাপ্তি সেখানেও পড়ে। রাতেই চলে গেলাম তাদের বাসায়।এবং সব বুঝিয়ে ওকে হাত করে নিলাম।তারপর প্ল্যান করলাম ও যখন কোচিং করে তখন আমি আর রাফি যাওয়ার জন্য।
পরের দিন সকালে তাই করলাম।রাফির কাজিনের কোচিং সেন্টারে গেলাম তখন ও আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলো প্রাপ্তির সাথে।মেডিকেলে পড়ি প্রাপ্তি শুনে বলল,সেও বড় হয়ে মেডিকেলে পড়তে চায়।সেইদিন ভালোভাবে প্রাপ্তির কিছুটা কাছে এগিয়ে গেলাম।মানে প্রেমের এক ধাপ এগুলাম।
.
.
.
চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন