___আয়ান বিয়ে করেই সেদিন ঢাকায় চলে গেল।প্রাপ্তিকে শুধু বলল আমাকে আরেকটু সময় দাও।আজ তোমার মায়ের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা আমার হয়নি।কারণ আমি চাইতে পারবো না তোমাকে ওনার কাছ থেকে।
এইটুকু বলেই আয়ান ভাবনার জগত থেকে ফিরে এলো। সুমনা বিস্ময়কর চোখে তাকিয়ে, তোমরা স্বামী স্ত্রী?
আয়ান মুচকি হেসে, হুম।সেইজন্যই তো মা বিয়ের করার কথা বললেই আমার প্রাপ্তির কথা মনে হয়ে যেতো।
-তারপর কী হলো ভাইয়া?
প্রাপ্তির দিকে আয়ান তাকাতেই এইবার প্রাপ্তি বলতে লাগলো,
এসএসসি পরীক্ষা শেষ আমার,,,পারভীন বেগম চাইছেন মেয়ের বিয়ে দিলেই প্রেমের ভূত মাথা থেকে নেমে যাবে।কিন্তু প্রাপ্তিকে রাজি করাতে পারছে না পারভীন বেগম।ছেলে পক্ষ দেখতে আসছে,তারা বসে আছে ড্রইংরুমে।তাদেরকে নাশতা দেওয়া হয়েছে।পারভীন বেগম তাদের সামনে থেকে উঠে গিয়ে,
কিরে তুই এখনো রেডি হসনি?
-মা তুমি কেনো আমার সাথে এমন করছো? আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি আমি আয়ানকে ভালোবাসি। তারপরও কেনো এদেরকে নিয়ে এসে ঝামেলা করছো?
-প্রাপ্তি তুই কিন্তু আমার সম্মান নিয়ে খেলা করছিস।ওদের সামনে আমাকে ছোটো করার কোনো অধিকার আমি তোকে দিইনি।
-আজ আমার বাবা থাকলে এইদিন আমায় কোনো দিন দেখতে হতো না।তুমি সারাজীবন টাকার অহংকারে আমার বাবাকেও কোনো শান্তি দাওনি।নিজের বড়লোক বাবার অহংকার আমার বাবাকে তুমি মানুষই মনে করনি।আজ আমার বাবা আমার কাছে নেই তারজন্য তুমিই দায়ী।
কথাটা বলতেই পারভীন বেগম প্রাপ্তির গালে থাপ্পড় দিয়ে,তোর ছোটোলোক বাবাকে বস্তিতেই মানায়।আমার এইবাড়িতে নয়।
প্রাপ্তি গালে হাত দিয়ে,
-তুমি কি ভেবেছো ওদের সামনে আমাকে নিলে তোমার সম্মান বাড়বে?আমি যেইভাবে আছি এইভাবেই যাব।আমার বড়লোক মায়ের সম্মান বাঁচাতে।
প্রাপ্তির চিৎকার করে কান্না করে বলতে ইচ্ছে করছে,আমি আয়ানের স্ত্রী। আমার বিয়ে হয়ে গেছে।আমি আয়ান ছাড়া কাউকেই স্বামী হিসেবে মানতে পারবো না।কিন্তু সেই কথা হয়তো পারভীন বেগমের কান পর্যন্ত পৌঁছাবে না।
পাত্রপক্ষের সামনে বসে আছে প্রাপ্তি। চুপচাপ বসে আছে সে।পাত্রের একনজরেই প্রাপ্তিকে পছন্দ করে ফেলল।
যাওয়ার সময় পারভীন বেগমকে বলে গেল মুরুব্বিরা কাল এসে কথা বলে যাবে।
প্রাপ্তি রুমে এসেই সবকিছু ভাঙচুর করতে লাগল।
পারভীন বেগম দরজায় দাঁড়িয়ে,
যতই পাগলামি ছাগলামি করো। কোনো লাভ হবে না।বিয়ে তোকে করতেই হবে।
প্রাপ্তি পিছনে ফিরে তাকিয়ে কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।পরেরদিন সকালে মায়ের ফোন থেকে আয়ানকে ফোন দিল সে।এই প্রথম আয়ানের সাথে ফোনে কথা বলবে সে।কাললের ঘটনার সবকিছু বলে শেষ করে ফোন রাখতেই পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে পারভীন বেগম দাঁড়িয়ে আছে।
পারভীন বেগমকে দেখেই বুকের ভেতর ধুপধাপ শব্দ করতে লাগল।প্রাপ্তি ঢোক গিলে, মা!
ছেলেটাকে ফোন দে আবার,
প্রাপ্তি চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে,পারভীন বেগম ধমক দিয়ে, কি হলো ফোন দে।
প্রাপ্তি কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন দিতেই ছোঁ মেরে ফোন নিয়ে নিলো পারভীন বেগম।
-হুম প্রাপ্তি বলো? তখন কেটে দিয়েছিলে কেনো? আমি তো ভয় পেয়েছিলাম ভেবেছিলাম তোমার রাক্ষসী মা হয়তো তোমাকে ধরে ফেলেছে।
-ওই ছেলে আমি রাক্ষসী? তোর কতো বড় সাহস আমাকে রাক্ষসী বলছিস?
-স স স্যরি,আসলে,,,
-চুপ বেয়াদব কথাকার।
তুই কালকেই আমার সাথে দেখা করবি।তুই যদি দেখা না করিস মনে করবি সারাজীবন তোকে প্রস্তাতে হবে।
আয়ানের কিচ্ছু করার নেই। পরেরদিন আয়ান রাফিকে নিয়েই প্রাপ্তিদের বাড়ির সামনে দাঁড়ালো।প্রচন্ডভাবে বৃষ্টি হচ্ছে।আয়ান আর রাফির দুজনের দুইটা ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে।রাফি আয়ানের দিকে তাকিয়ে, এইভাবে আসাটা কী ঠিক হয়েছে?
-আমি কিচ্ছু জানি না রাফি।কিন্তু আমার মনে হয়েছে প্রাপ্তি খুব কষ্টে আছে।আমি না আসলে হয়তো ও আরও কষ্ট পাবে।
-কিন্তু আয়ান এমন একটা সময় প্রাপ্তিকে তো এইখান থেকে নিয়েও যেতে পারবিনা।ওনি যদি বলে সারাজীবন তোকে প্রাপ্তিকে ছাড়তে হবে তখন?
-না রাফি,,,আমি তাহলে শেষ হয়ে যাব।আমি কী মনে করি জানিস? আমি পরীক্ষায় বা কোনো কিছু একবার মিস্টেক হয়ে গেলে আমি সেটা আবার দিতে পারবো।কিন্তু প্রাপ্তিকে হারালে সেটা আমি আর পাবো না।
প্রাপ্তির মন যেন বলছে আয়ান তার আশেপাশেই আছে।তার মন অস্থির হয়ে উঠেছে।খাট থেকে নেমে পাগলের মতো করে দৌড়ে ড্রইংরুমের দিকে যাচ্ছে সে।সকাল থেকে তার উপর কম ঝড় যায়নি। পারভীন বেগম অনেক মেরেছেও তাকে।ড্রইংরুমে গিয়ে দেখে পারভীন বেগম বসে আছে।পেপারে চোখ বুলাচ্ছেন।প্রাপ্তিকে হকচকিয়ে আসতে দেখে,সকালের কথা মনে আছে তো?
প্রাপ্তি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে নিজের রুমের কাছাকাছি যেতেই আয়ানের গলায় সালামের শব্দ শুনতে পেলো।ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে আয়ানকে জড়িয়ে ধরে বলতে আয়ান আমাকে এইখান থেকে নিয়ে চলো।কিন্তু কী করে যাব।নিজের বাবার কসম খেয়ে কীভাবে যাব?
পারভীন বেগম ভালো করেই জানতেন আয়ান আসবে। তাই আয়ান আসলে যেন প্রাপ্তি আয়ানের সামনে না যায় সেই জন্য তিনি প্রাপ্তির বাবার কসম দিয়ে বসেন।
প্রাপ্তি মন চটপট করছে।বাহিরে বৃষ্টি, বিদ্যুৎ যেভাবে চমকাচ্ছে সেভাবে তার মনের ভিতরে একি অবস্থা হচ্ছে।
পারভীন বেগম আয়ানকে দেখে কে তুমি? এইভাবে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লে?
-আমি আয়ান।আর ও রাফি।
পারভীন বেগম ভ্রু কুঁচকে, ওহ্ তাহলে তুমি করিম ভাইয়ের ছেলে রাফি? বসো, বসো।
দুজনেই চুপচাপ হয়ে বসলো।
পারভীন বেগম কোনো বনিতা না করে সোজাসাপ্টায় বললেন,কী করো তুমি?
আয়ান বলল,আমাকে বললেন?
-রাফির সম্পর্কে আমি সব জানি।তার মানে তোমাকেই বলছি।
-আয়ান নিচের দিকে তাকিয়ে, মেডিকেলে পড়ি।
-বাবা কী করে?
-আমার বাবা নেই।মা আছে।আর এই দুনিয়াতে মাই আমার সব।
-ওহ্, ফ্যামিলি চলে কীভাবে? তোমার পড়ার খরচ?সংসার?
-জ্বি! আমার মা প্রাইমারি স্কুল শিক্ষিকা।সেটা দিয়েই আমাদের সংসার চলে। আর পড়ার খরচ বলতে আমার এক কাকা আছেন উনিই চালায়।
-এইভাবে কতদিন চালাবে?
আয়ান চুপ করে আছে।অপমান বোধ করলেও চুপ করে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
পারভীন বেগম আবার বললেন,আমার মেয়েকে বিয়ে করলে তাকে কীভাবে চালাবে? অন্যের টাকায়? ভিক্ষা করে?
-আন্টি আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন।
আজ হয়তো আপনার টাকা আছে কিন্তু একদিন নাও থাকতে পারে।আজ হয়তো আমার নেই কিন্তু সেইদিন হয়তো আমার টাকার অভাব থাকবে না।
-ছোটো লোকেরা বড়বড় কথা ভালোই বলতে পারে।তোমার সাহস কি করে হয় তোমার মতো ফকিরের বাচ্চা আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়ানোর?
তোর যদি আমার টাকার এতোই লোভ হয়ে থাকে আমাকে বলতে পারতি তোদের মতো ছোটো লোকদের কিছু দিলে আমার কম পড়তো না।
আয়ান শান্ত গলায় বলল, আন্টি এইসব বাংলা ছবির ডায়লগ হিসেবেই মানায়। কিন্তু বাস্তব জীবনে এইসব মানায় না। আমি এইখানে শুটিং করতে আসিনি আপনার ডায়লগগুলো শুনবো। আপনি কী বলতে চান সোজাসুজি বলেন।
-তুমি আমার মেয়ের কাছ থেকে সরে যাও। আমার মেয়ে তোমাকে চায় না।আমার মেয়ে নিজেই আমাকে বলেছে তুমি তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে প্রেমের ফাঁদে ফেলেছো।
-আন্টি আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি না।প্রাপ্তি এইকথা কখনো বলবে না।
-তুমি বিশ্বাস করো আর না করো এতে আমার কিছুই যায় আসেনা।তবে এটাই সত্যি।
ও নিজেই আমাকে বলেছে ও তোমার সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখতে চায় না।
রাফি এতোক্ষণ চুপ করেই ছিল।কিন্তু আর পারলো না।চাচী একটা কথা বলি? আপনি যেহেতু আমাদের গ্রামের, এবং বাবাও আপনাকে চিনেন।সেই জায়গায় আমার আপনার পক্ষেই কথা বলা উচিত। কিন্তু আমি সেটা না পেরেই বলছি।এক হাতে কী তালি বাজে?
বাজেনা।আপনার মেয়ে যদি সাড়া না দিতো তাহলে আয়ান কি পারতো আপনার মেয়েকে পটাতে। অন্য জেলা থেকে আসা একটা ছেলে আপনার মেয়ের টাকা দেখে প্রেম করবে এইটা আপনার ধারণা কীভাবে হলো? ও কী ভবিষ্যত দেখতে পায়,স্বপ্নে দেখে কোন জেলায় আপনার মেয়ে আছে সেখানে গিয়ে আপনার মেয়ের সাথে প্রেম করে আপনার টাকার আত্মসাৎ করবে?
আয়ান রাফিকে থামতে বলছে,কিন্তু উল্টো রাফি হাত উঠিয়ে আয়ানকে থামিয়ে,আপনাদের মতো লোককে আল্লাহ টাকা দেয় কেনো জানেন? পরীক্ষা করার জন্য।আপনি যে টাকার অহংকারে ওকে এইভাবে অপমান করছেন ঠিক একদিন আসবে ওর কাছেই আপনাকে ছুটে যেতে হবে।কারণ আল্লাহ আপনার একার নয়।একদিন না একদিন আপনাকে মাশুল দিতে হবে হয়তো অন্য কোনো উপায়ে।
পারভীন বেগম রাফির কথাগুলো হজম হলো না।ঝাঁঝালো গলায় বলল,তোমার সাহস কী করে হয় আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকেই অপমান করার?
রাফি তাচ্ছিল্য গলায় বলল,আরে চুপ করেন তো,আপনার মেয়ে কী দোয়া তুলসীপাতা? ডাকুন তো আপনার মেয়েকে।আপনার মেয়ে যে বলল আয়ান ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে এইসব করেছে, আমি ওকে থাপড়িয়ে জিজ্ঞেস করবো ভুলানো কী জিনিস?
প্রাপ্তি দরজার আড়ালে থেকে সব কথাই শুনছে।কান্নায় তার বুক ফেঁটে যাচ্ছে কিন্তু সামনে যাওয়ার সাহস তার নেই।আজ আমি সব ভাগ্যের উপর নয় তোমার হাতেই ছেড়ে দিলাম মা।যত পারো আয়ানের কাছে আমাকে খারাপ বানাও।তাতে যদি তোমার জ্বলা মিটে।
.
.
.
চলবে....................................