শেষ থেকে শুরু - পর্ব ১০ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


___দুপুরের আগেই আয়ান আরিয়াকে নিয়ে বাহির হলো।আরিয়াকে গাড়িতে বসিয়ে ড্রাইভ করছে আয়ান।আরিয়ার বকবকানি যেন থামছেই না।
-আচ্ছা বাবাই,মা তোমাকে ছাড়া আমাকে ছাড়া কোথায় থাকে বলো তো?
আয়ান গম্ভীর হয়ে বলল,তোমার মা তোমার মায়ের বাড়িতে থাকে।
-আমাদের সাথে থাকে না কেনো? তুমি মাকে রাগ ভাঙিয়ে নিয়ে আসো বাবা।আমরা সবাই এক সাথে থাকবো।
- ওকে মা'মণি তুমি চুপ করে বসো।আজকে আমরা তোমার মাকে বুজিয়ে আসার সময় নিয়ে আসবো।এইবার ঠিক আছে?

কিছুটা এগিয়ে যেতেই,কেউ একজন গাড়ি থামানোর জন্য ইশারা করল।আয়ান একটু সামনেই গাড়ি থামালো।মেয়েটা দৌড়ে আয়ানের গাড়ি পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ইশারা করলো দরজা খুলতে।
আয়ান মেয়েটাকে দেখে যেন হতভম্ব হয়ে আছে,মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরুচ্ছে না।মেয়েটা ঢোক গিলে বলল,আয়ান তুই আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি নয়না!
আয়ান মনে মনে বলল সেই জন্যই তোকে না চিনার চেষ্টা করছি।
-আসলে আপনি কোন নয়না?আমি সত্যিই চিনি না।
কথাটা বলে আয়ান গাড়িতে উঠতে যাবে তখনি নয়না হাত ধরে,আয়ান আমি জানি তুই আমাকে চিনতে পেরেছিস।কিন্তু না চিনার ভাণ করে এড়িয়ে যাচ্ছিস।
-তো?
-আয়ান আমি এতো বছর পর এসেছি আর তুই আমার সাথে এমন করছিস? 
-দেখ নয়না আমার হাতে সময় নেই।আমার হসপিটাল যেতে হবে। তুই শুধু শুধু,,, 

বাবাই আসো না আমরা মাকে আনতে যাব তো।দেরি হলে মায়ের কিন্তু রাগ আরও বেড়ে যাবে।প্লিজ আসো বাবাই।
কথাটা শুনে নয়না ভ্রু কুঁচকে আয়ানকে সরিয়ে, আরিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে কিছুক্ষণ, আ,,আয়ান ও আমার,,,,, 
নয়না আর কিছু বলতে পারলো না।আয়ান এর আগেই বলে ফেললো,আমার আর প্রাপ্তির মেয়ে আরিয়া।আরিয়া'আন্টিকে সালাম দাও।
কথাটা নয়নার হজম হলো না।নয়না কিছু আরও বলার আগেই, প্লিজ সর।
কথাটা বলে নয়নাকে সরিয়ে দিয়ে আয়ান তড়িৎ ভাবে গাড়ি নিয়ে চলে গেল।নয়না সে জাগায় দাঁড়িয়ে আছে।পুরোটা শরীর যেন হ্যাং হয়ে গেছে।
আয়ান হসপিটাল এসে আরিয়াকে নিজের চেম্বারে নিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে নিজেও ধপাস করে বসে পড়লো।সে যেন ঘোরে ভিতর ছিল এতক্ষণ। কীভাবে যে গাড়িটা চালিয়ে এসেছে শুধু সেই জানে।
কিছু কিছু মানুষ জীবনে এলে জীবনকে একঝাটকায় পাল্টে ফেলে।কপালে হাত দিয়ে হেলান দিয়ে বসে আছে আয়ান। আরিয়া স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। আর আয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখছে।মিনু এসে, 
স্যার আপনি কখন এলেন?
আয়ান স্থির হয়ে আগের মতোই আছে।কেনো জানি বাহির কোনো আওয়াজ তার কানকে স্পর্শ করছে না।শুধু নয়নার একটা কথায় কানে বার বার স্পন্দিত হচ্ছে।ও আমার,,,,নয়না কি বুঝাতে চেয়েছে? নয়না কি বুজে ফেলেছে আরিয়া,,,,,নানা আমি এইসব কি ভাবছি।আরিয়া শুধু আমার আর প্রাপ্তির মেয়ে। প্রাপ্তি আমার জীবনে ফিরে এসেছে।আমি চাই না প্রাপ্তিকে আবার হারিয়ে ফেলি।

মিনু আর কিছু বলল না।আরিয়ার দিকে মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে দিতেই আরিয়া চেয়ার থেকে নেমে মিনুর কোলে আসলো।মিনু চোখ দিয়ে ইশারা করলো বাহিরে যেতে।আরিয়াও রাজি হয়ে গেল।বাবার মন খারাপ হয়েছে কিছুক্ষণ একা থাকলে ঠিক আগের মতো হয়ে যাবে।এইটা আরিয়া ভালো করেই বুঝে।মিনুর হাত ধরে ঘুটিঘুটি পায়ে হাঁটছে আরিয়া।মিনু বাড়িতে যাবে ভেবেছিল।কিন্তু আরিয়াকে এইভাবে রেখে যাওয়াটা ঠিক হবে না।এরচেয়ে বরং রোগীদের ঔষধগুলো দিয়ে আসি। মিনু একেক করে সবাইকে ঔষধ দিয়ে পারভীন বেগমের কেবিনে গেল।
-কেমন লাগছে ম্যাডাম? 
পারভীন বেগম মাথা নাড়িয়ে, এই তো মা চলছে। হঠাৎ মিনুর পিছনে নজর পড়তেই পারভীন বেগম খেয়াল করলেন,নীল ফ্রগে, নীল জুতা, চুলগুলো সিল্কের মতো, চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে একটা বাচ্চা মেয়ে উঁকি দিচ্ছে। মিনুর পিছনের থেকে কাত হয়ে পারভীন বেগমের দিকে তাকাচ্ছে বার বার আরিয়া। 
পারভীন বেগম মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে,মিনু এইটা কী তোমার মেয়ে? 
-না ম্যাডাম।আয়ান স্যারের মেয়ে।স্যারের মন খারাপ তাই আমিই ওকে আমার সাথে নিয়ে এসেছি।
আয়ান! নামটা তার আগের ভালো করেই চিনা।দীর্ঘশ্বাস ফেলে,বাচ্চাটা পরীর মতো।অনেক মিষ্টি দেখতে।
মিনু ইনজেকশন ঠিক করতে করতে কথাগুলো শুনলেন।
কই আপনার ওই হাত দিন।স্যার আসছে আমাকে বাড়ি যেতে হবে।আপনার জন্য তো স্যার আমাকে বাড়িতেও যেতে দিচ্ছে না।কিন্তু আজ না গিয়ে উপায় নেই।আমার ছেলেটা হোস্টেল থেকে আসছে চার মাস পর।ইনজেকশন দিয়ে শেষ করে, মিনু আরিয়ার হাত ধরে চলে গেল।পারভীন বেগম অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে।নিজের মেয়েটার কথা মনে পড়তেই চোখ দুটো ভেজে গেল।আমার এমন অবস্থা তবুও মেয়েটা আমায় একবার দেখতে এলো না।বাবার মতো পুরোই বেঈমান। সে আমার রাগের একটা কথায় বাড়ি ছেড়ে ছিল।কিন্তু আমার মন থেকে যে বলিনি সেটা একটাবার খেয়াল করলো না।মেয়েটাও বাবার মতো রাগ করে বলেছি যোগাযোগ না করতে সত্যিই আর করেনি।প্রাপ্তি তুই তোর মাকে এইভাবে ভুলে গেলি? একটা বার ভাবলি না কতো কষ্ট করে তোকে জন্মদিয়েছি।ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছি।আর তুই এখন একটা বার আমাকে দেখতে আসলি না।

আয়ান হঠাৎ খেয়াল করলো আরিয়া নেই।তড়িঘড়ি করে উঠে গিয়ে রিয়ানকে ডাকলো।
-রিয়ান আরিয়া কোথায়? 
-স্যার মিনুর সাথে তিনতলায় গেছে।
-তুই নিজে দেখেছিস?
-আমি বাহিরে ছিলাম।জাহেদ বলল স্যারের মেয়ে এসেছে।মিনুর সাথে উপরে গেছে।আমি আপনাকে ডাকতে গেছি কিন্তু আপনি অন্যমনস্ক ছিলেন বলে আর ডাকিনি। 
আয়ানের মন বুঝ মানলো না।নিজেই চলে গেলেন তিন তলায়।
মিনু পারভীন বেগমের রুম থেকে একটু হেঁটে আসতেই মনে পড়লো ফোনটা সে রেখে এসেছে।আরিয়াকে নিয়ে আবার ফোন আনতে গিয়ে দেখে পারভীন বেগম নিজের চোখের পানি মুছছেন। 
-ম্যাডাম কোনো সমস্যা?  
পারভীন বেগম নিজেকে সামলিয়ে, নাহ্। তুমি আবার ফিরে এলে?কথাটা শেষ করতেই আয়ান তড়িৎ ভাবে রুমে ঢুকেই আরিয়াকে কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো।আয়ানের মনে হয়েছিল আরিয়া তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে।এক মূহুর্তের জন্য না দেখতে পেয়ে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। পারভীন বেগম আয়ানের দিক থেকে চোখের পলক সরাচ্ছেন না।তাকিয়ে আছে কপালটাকে ভাঁজ করে।পারভীন বেগমের চিন্তে একটুও অসুবিধা হয়নি আয়ানকে।কিন্তু আয়ানের সেইদিকে খেয়াল নেই।নিজের মেয়েকে পেয়ে যেন সব ভুলে গেছে। পারভীন বেগম এখনো তাকিয়ে আছে। সেইদিনের আয়ান? তারমানে এই আয়ানই আমাকে অপারেশন করেছে? আমার এতোযত্ন নিচ্ছে? আমাকে জেনেশুনে? 
রিয়ান দৌড়ে এসে মিনুকে ধমকিয়ে বলল,তুমি আরিয়াকে নিয়ে আসছো স্যারকে বলে আনবে না? 
মিনু হতভম্ব হয়ে, আমি স্যারকে ডেকেছি।কিন্ত,,, 

-ওকে মিনু নো প্রবলেম।আসলে আমি একটু ডিপ্রেশনে ছিলাম।আরিয়াকে কোল থেকে নামাতেই পারভীন বেগমের দিকে চোখ পড়তেই দেখে পারভীন বেগম তাকিয়ে আছে তার দিকে।
সেইদিকে গুরুত্ব না দিয়ে,মিনু ইনজেকশন দিয়েছো তো?
-জ্বি স্যার।
-আপনার কেমন লাগছে? 
পারভীন বেগমের মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয়ে আসছে না।বার বার সেইদিন রাফির বলা কথাগুলো মনে পড়তে লাগলো।আজ তাই সত্যিই হলো।
আয়ান পারভীন বেগমকে অস্তিত্বে পড়বে দেখে,আমি ডাক্তার আপনি রোগী। এখানে এরচেয়ে বেশিকিছু না।
আয়ান কথাটা বলে আরিয়ার হাত ধরে পা বাড়াতেই পারভীন বেগম পিছন থেকে ডেকে বলল,বাবা আমার কথাটা একটু শুনবে?
আয়ান থমকে দাঁড়ালো।পিছনে ফিরে এগিয়ে গিয়ে,জ্বি বলুন?
সেইদিনের জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি বাবা।হয়তো সেই শাস্তি আল্লাহ আমাকে প্রতিনিয়ত দিয়ে যাচ্ছেন।আমার মেয়েটাও আমার কাছে নেই।তোমার অপেক্ষায় সে বিয়েটাও করেনি।তবে আমি এইটা দেখে খুব খুশী হয়েছি,তুমি বিয়েসাদী করেছো বড় ডাক্তার হয়েছো।অবশ্য কারো জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না।
মাঝখানে আমি নিজেই মেয়ের ভালো করতে গিয়ে মেয়েটার সুন্দর ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিয়েছি।কথাটা বলেই পারভীন বেগম কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
-দেখুন, এইটা হসপিটাল।জীবন নিয়ে হিসাবে নিকেশ করার জায়গা নয়।আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন আমরা এইসব নিয়ে পরে কথা বলবো।
আরিয়াকে নিয়ে আয়ান হসপিটালের নিচে এসে প্রাপ্তিকে ফোন দিল।কাল অনেক কষ্টে নাম্বারটা নিয়েছে আয়ান।কিন্তু একবারও ফোন দেওয়া হয়নি সকাল থেকে। প্রাপ্তিকে বলে দিয়েছে আরিয়ার বায়না তার মায়ের সাথে সে রেস্টুরেন্টে খাবে।আরিয়ার কথা শুনলে প্রাপ্তি আর না করবে না।এইটা আয়ান ভালো করেই জানে।
প্রাপ্তি আর না করলো না।ঠিক সময় আয়ানের বলে দেওয়া রেস্টুরেন্টে চলে আসলো।
.
.
.
চলবে......................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন