আরশিযুগল প্রেম
পর্ব ০৪
নৌশিন আহমেদ রোদেলা
.
.
.
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রতা। টিনের জানালাটা বাতাসের তান্ডবে অদ্ভুত রকম শব্দ করে চলেছে সেই কখন থেকে। কিন্তু সেই শব্দ কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না শুভ্রতার। দৃষ্টি বৃষ্টিহীন অন্ধকারে স্থির। মাথায় চলছে হাজারো প্রশ্ন। কি হবে এরপর? এই ইন্সিডেন্টের বিয়ের কথাটা কোনোভাবে মা-বাবার কানে গেলে তারা কি ছেঁড়ে কথা বলবে তাকে? সারাজীবন ব্যাপী দিয়ে আসা স্বাধীনতায় তারা কি আফসোস করবে না? তাছাড়া,ছেলেটাই বা কি করবে এবার? সুযোগ পেয়ে হামলে পড়বে না তো তার ওপর। স্বামীর অধিকারের প্রশ্ন তুলে জোরজবরদস্তি করবে না তো?শুভ্রতার ভাবনার মাঝেই ভেতরে ঢুকলো সাদাফ। হাতে ভেজা কাপড়। মাত্রই ভেজা কাপড় বদলেছে সে। একহাতে দরজায় ছিটকানি দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই কথা ছুঁড়লো শুভ্রতা,
---"দেখুন,বিয়ে হয়েছে মানে যে স্বামীর অধিকার ফলাতে আসবেন তা কিন্তু হবে না। আমি এই বিয়ে মানি না। সো আমার আশেপাশে আসার চেষ্টাও করবেন না।"
একদমে কথাগুলো বলে থামলো শুভ্রতা। সাদাফ ভেজা কাপড়গুলো টিনের বেড়ার সাথে ঝুলানো দড়িটাতে মেলে দিয়ে শুভ্রতার দিকে তাকালো। ঘরের এককোণে একটা চার্জার লাইট জ্বালানো। ঘরময় আবছা মৃদু অন্ধকার। সাদাফ ভ্রু কুঁচকে "বুঝতে পারে নি" এমন ভাব নিয়ে বললো,
---"মানে?"
শুভ্রতা এবার সরাসরি তাকালো। আলো আধারীতে দু'জনের মুখই অস্পষ্ট। শুভ্রতা শক্ত গলায় বললো,
---" মানেটা খুবই সহজ। আপনি আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করবেন না। নয়তো ব্যাপারটা ভালো হবে না।"
সাদাফের মেজাজ এমনিতেই তেতে ছিলো। শুভ্রতার কথায় রাগটা এবার ষোল কলায় পূর্ণ হলো। কপট রাগ নিয়ে বললো,
---" অদ্ভুত! আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনাকে ছোঁয়ার জন্য আমি নেচে বেড়াচ্ছি।"
শুভ্রতা আগের মতোই শক্ত গলায় বললো,
---"অবশ্যই নেচে বেড়াচ্ছেন। একমাত্র আপনার জন্য এতোসব কাহিনী হয়ে গেলো। কি দরকার ছিলো আমাকে বউ বলার? সত্যিটা বললে আজ এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।"
---" বউ বলার যথেষ্ট কারণ ছিলো শুভ্রতা। গ্রামের লোকেরা ব্যাকডেটেড হয়। এতো রাতে একা একজোড়া ছেলে-মেয়েকে নিশ্চয় ভালো চোখে দেখতো না ওরা। তাছাড়া আপনি আমার কোনো রিলেটিভও নন। তখন, আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন ছিলো। স্বামী-স্ত্রী না বলে যদি বলতাম অপরিচিত সহযাত্রী তাহলে তারা সাহায্য তো দূর উল্টো সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতো। তাছাড়া আমি কি জানতাম যে ওরা এমন একটা অ্যাকশন নিবে?"
---"তখন নয় জানতেন না বা বুঝতে পারেন নি। কিন্তু যখন বিয়ের কথা বললো তখন তো এটলিস্ট সত্যটা বলতে পারতেন।"
সাদাফ বিরক্ত গলায় বললো,
---"হ্যাঁ তাই তো। একবার বলি স্বামী-স্ত্রী তো আরেকবার স্বামী-স্ত্রী নই। তাহলে ব্যাপারটা কি বিশ্বাসযোগ্য হতো? তখন দেখা যেত আমাদের সব কথায় অবিশ্বাস করছে তারা। তাছাড়া বিয়েটা আমিও ইচ্ছে করে করি নি। ওদেরকে বোঝানোর চেষ্টাও করেছি বাট কাজে না লাগলে আমি কি করতে পারি?"
শুভ্রতা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে আবারও জানালার বাইরের অন্ধকারের দিকে চোখ রাখলো। তর্ক করার ইচ্ছে বা শক্তি কোনোটাই নেই তার। মৃদু গলায় প্রশ্ন করলো,
---"এখান থেকে ঢাকা যাওয়ার উপায় কি?"
সাদাফ বিছানার এক কোণায় বসে বললো,
---"বাড়ির সাথেই তো রাস্তা। উনারা বললো রাস্তা থেকে অটোরিকশা দিয়ে বাস স্টেন্ড পর্যন্ত গেলে ওখান থেকে বাস ধরে ঢাকা। ঢাকার বাস নাকি এভেইলএবল।"
শুভ্রতা ছোট্ট করে জবাব দেয়,
---"ওহ্"
সাদাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। শুভ্রতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
---" চাইলে বিছানায় ঘুমাতে পারেন আপনি। চিন্তা করবেন না, আমি বিছানায় শুবো না। ঘরের কোণে একটা পাটি গুটানো আছে। আমি ওতেই ম্যানেজ করে নিবো।"
শুভ্রতার উত্তরের অপেক্ষা না করে গুটানো পাটি মেঝেতে বিছিয়ে নিলো সাদাফ। বিছানা থেকে একটা কাঁথা আর একটা বালিশ নিয়ে চোখ-মুখ ঢেকে সটান শুয়ে পড়লো সে। সাদাফের ঠান্ডার ধাঁচ ভালো না। একবার ঠান্ডা লেগে গেলে দীর্ঘদিন জ্বরে ভুগতে হয় তাকে। এই জ্বর আর ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচতে এই মুহূর্তে এন্টিবায়োটিক, এক কাপ কড়া কফি আর চমৎকার একটা ঘুম প্রয়োজন তার। ভ্রমণপ্রিয় সাদাফের কাছে মেডিসিন থাকলেও কফি খাওয়ার জোগার নেই। তাই কফির আশা বাদ দিয়ে চমৎকার একটা ঘুমের প্রস্ততিতে মেতে উঠলো সে। কিন্তু শুভ্রতার চোখে ঘুম নেই। এখনোও জানালার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সে। অযাচিত এক পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় লাগছে তার। যেভাবেই হোক এখান থেকে বের হতে হবে তাকে। নয়তো বাবা-মার সামনে দাঁড়ানোর সাহসটুকুও যোগাতে পারবে না সে। বিয়ে নামক ঝঞ্জাট থেকে বাঁচতে, মুক্তপাখির মতো উড়তেই মামুর বাসা থেকে একরকম পালিয়ে এসেছে শুভ্রতা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বিয়ে নামক ঝঞ্জাটেই বাঁধতে হলো তাকে।
___________
সারারাতের ঝড়-বৃষ্টির পর সকালটা যেন সোনালী আলোয় মেতে উঠেছে। গাছগাছালি গুলো সারারাতে ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে সূর্যের নরম আলোয় নিজেদের স্নিগ্ধ রূপ দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পাখির কিচিরমিচির আর মানুষের ব্যস্ত কথাবার্তার কলরবে ঘুম ছুটে গেলো সাদাফের। আড়মোড়া ভেঙে চোখ পিটপিট করে তাকালো। ডানপাশের টিনের জানালাটা খোলা। সেদিক থেকেই রোদের ঝিলিক এসে লাগছে তার চোখে। জানালার বাইরে ঝকঝকে নীল আকাশে কয়েক সেকেন্ড দৃষ্টি নিবদ্ধ করে উঠে বসে সাদাফ। সচেতন চোখে বিছানার দিকে তাকায় ---- বিছানা ফাঁকা। সাদাফের কপাল কুঁচকে আসে। বালিশের পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে সময় দেখে ---- ৮ঃ২০। গ্রামের ঘড়িতে আটটা মানেই অনেক বেলা। সাদাফ তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়। দরজার ছিটকানি খোলা। সাদাফ সতর্ক চোখে এদিক ওদিক তাকায়। কাঁথা আর বালিশটা বিছানায় তুলে রেখে পাটি গুটিয়ে দরজার পাশে রাখে সে। মনে মনে শুভ্রতাকে খুঁজে। কোথায় গেলো মেয়েটা? দড়িতে শুকাতে দেওয়া কাপড়গুলো গুছিয়ে ব্যাগে রাখতে গিয়ে ব্যাগের পাশেই ভাজ করা কাগজ চোখে পড়ে তার। কাপড়গুলো ব্যাগের পাশে রেখে কৌতূহল নিয়ে কাগজটা মেলে সাদাফ। চিঠিটা শুভ্রতার। ডায়েরির রুল টানা কাগজের মাঝ বরাবর তিনটা মাত্র লাইন,
" আমাকে এই পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। বাকি রাস্তাটুকুর দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। আপনাকে ওই লোকগুলোকে আবারও জবাব দিতে হবে জানি। আশা রাখছি সামলে নিবেন।"
এক পলকে তিনটি লাইন পড়ে নিয়ে আগের জায়গাতেই কাগজটা রেখে দিলো সাদাফ। শুভ্রতা চলে গিয়েছে জেনে কোনো ভাবাবেগ হলো না তার। যেন এমনটায় আশা করেছিলো সে। শুভ্রতার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে কাপড়গুলো ব্যাগে গুছিয়ে রাখতে রাখতে এই লোকগুলোকে কিভাবে ম্যানেজ করা যায় তাই ভাবছে সাদাফ। "মিথ্যা" খুবই ক্রিটিক্যাল একটি পার্ট। সত্যের মতো হুট করে থমকে দাঁড়াতে পছন্দ করে না মিথ্যা। সে আপন গতিতে এগিয়ে যায়। একবার মিথ্যা বললে সেই মিথ্যাকে শক্তপোক্ত করতে গুটি গুটি অসংখ্য মিথ্যের জন্ম দিতে হয়। তারপর সরে যেতে হয় সত্য থেকে অনেক দূরে। ব্যাগ গুছানো শেষ করে জানালা ভেদ করে আকাশের দিকে তাকায় সাদাফ। কি একটা অদ্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে সে আর শুভ্রতা। কয়েকঘন্টার পরিচয়ে না চাইতেও স্বামী-স্ত্রীর মতো পবিত্র বন্ধনে বেঁধে গেছে তারা। অথচ,শুভ্রতার চেহারাটা ঝাপসাভাবেও মনে পড়ছে না সাদাফের। হয়তো কখনো পড়বেও না। দ্বিতীয়বারের মতো দেখাও হবে না আর। তাদের এই সম্পর্কের কথা জানতেও পারবে না কেউ। পৃথিবীর বুকেই রাতের অন্ধকারের সাথে ধামাচাপা পড়বে সব। কি অদ্ভুত এই পৃথিবী, কতোই না অপ্রকাশ্য, গোপন গল্প ধেবে আছে তার বুকে।সাদাফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে তাকে।
.
.
.
চলবে...........................