শেষ থেকে শুরু - পর্ব ০৩ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


__আয়ান তুই তো দেখছি একেবারে রেডি হয়ে এসেছিস।
-হ্যাঁ মা,হসপিটাল যাব বলেই তো রেডি হয়ে নিচে আসলাম।

-এখন কী করে যাবি? আমার মনে হয় তোর আজকে না যাওয়াটাই ভালো হবে।

-মা ভয় পেওনা,আমি ব্যান্ডেজ লাগিয়ে নিচ্ছি।

-যে রোগী দেখবে তারও কিছু যত্নের প্রয়োজন হয়। তোর আজ কোথাও যাওয়া হচ্ছে না আয়ান।
কথাটা বলে শিরিনকে ডেকে বলল তাকে রুমে দিয়ে আসতে।

আয়ান পায়ে ব্যান্ডেজ করতে করতে বলল,দেখছিস আরিয়া তোর জন্য আজ হসপিটাল যাওয়া হচ্ছে না।
এতে অনেক মানুষের সমস্যা হবে।এমন জেদ কেনো কর মা যার জন্য অন্যকে প্রস্তাতে হয়?
জীবনে এমন কোনো কাজ কর না যার মাসুল অন্যকে গুনতে হয়।

আরিয়া মন খারাপ করে,স্যরি বাবাই।আর কখনো এমন হবে না।
আয়ান আরিয়াকে কেছে টেনে কপালে চুমু দিয়ে,ওকে মা মা'মণি এখন নাশতাটা খেয়ে নাও।
-বাবাই তুমি কী হসপিটাল যাবে? 
-না মা'মণি,আমি হসপিটাল ফোন করে বলে দিচ্ছি আজকে যাব না।সারাদিন আমার মা'মণির সাথেই খেলা করব।

আয়ান আর আরিয়ার ভালোই সময় কেটে যাচ্ছে।শিরিন দুপুরে সবাইকে খাইয়ে দিয়ে নিজের রুমে গেল।আয়ান বই পড়ছে আর আরিয়া পাশে বসে খেলছে।আরিয়া আজ ঘুমাবেই না।বাবার সাথে খেলবে বলে জেদ ধরেই আছে।
সাড়ে তিনটা বাজে,আয়ান বইটা রেখে উঠতে যাবে সে সময়টায় ফোন বাজতেই আয়ান আবার বসে ফোন ধরলো।হসপিটাল থেকে ফোন না ধরেও উপায় নেই।

-স্যার আপনি তো আজ বিকেলে রোগী দেখার কথাছিল আসবেন না?

-রিয়ান আমি তো সকালেই জানিয়ে দিয়েছি।

-কিন্তু স্যার প্রাপ্তি নামের যে ম্যাডাম কাল আপনাকে দিখিয়েছে ওনি এখন এসেছে রিপোর্ট দেখানোর জন্য।
আয়ান ভুলেই গিয়েছিল প্রাপ্তির রিপোর্টের কথা।কিন্তু এই সময় একটা রিপোর্টের জন্য হসপিটাল যাবে তাও সম্ভব না।
-রিয়ান এককাজ করো,ওনাদের আমার বাসার ঠিকানা দিয়ে দাও।আর বলবে বাসায় এসে রিপোর্টগুলো দেখিয়ে নিতে।
আয়ান ফোন রেখে দিয়ে আরিয়াকে রেখে নিজের রুমে গেল।

রিয়ান ফোন রেখে,আমি ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি আপনারা স্যারের বাসায় চলে যান।
প্রাপ্তি কথাটা শুনেই হতভম্ব হয়ে গেল। কপাল কুঁচকে রিয়ানকে বলল,আমি ওনার বাসায় যেতে পারবো না।

-সেটা আপনাদের ব্যাপার। আমাকে ঠিকানা দিতে বলেছে আমি দিচ্ছি যাবেন না থাকবেন সেটা আপনাদের ব্যাপার।

প্রাপ্তির খালা ঠিকানাটা নিয়ে,প্রাপ্তি এককাজ কর তুই এই ঠিকানায় চলে যায়।আমার কিছু কাজ আছে আমি সেইগুলো সেরে বাসায় চলে যাব।
প্রাপ্তি যেন এইবার পুরোই বিড়ম্বনায় পড়ে গেল।কাউকে বুঝাতেও পারছে না।কেনো সে ডাক্তার আয়ানের বাসায় যেতে রাজি না।কিন্তু এখন না গিয়েও উপায় নেই।আন্টির হাজারটা প্রশ্ন ফাঁকে পড়ার ছেয়ে আয়ানের বাসায় যাওয়াই ভালো।অবশ্য একপর্যায়ে ভালোই হয়েছে।ওর মাকে গিয়ে একটু দেখে আসতে পারবো।

বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে প্রাপ্তি যেন থমকে গেল।এতো বড় বাড়ি কার এইটা।আয়ান কি ভাড়া থাকে এইখানে।কিন্তু না ভাড়া বাসা বলে মনে হচ্ছে না।গেইটের বাহিরে মোজাইক পাথরের খোদাই করা, ডাঃ আয়ান মাহমুদ। 
প্রাপ্তিকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে,একজন বয়স্ক ব্যক্তি বেরিয়ে এসে বলল,মা আপনি কারে চান মা? ডাক্তার সাহেব কে?
প্রাপ্তি বুঝলো ইনিই এই বাড়ির দারওয়ান। প্রাপ্তি উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো।
-যাও মা ভিতরে যাওগা।কোনো ডর নাই।ডাক্তার মানুষটা খুবি ভালা।এইরকম ডাক্তার এ-যুগে পাইবা না।গরীব মানুষগো লাগি জানপ্রাণ দিয়া পালায়।

প্রাপ্তি মুখে মুচকি হাসি ফুটিয়ে, বাড়ির ভিতরে ঢুকলো।অনেক সুন্দর করে সাজানো বাড়ির সামনেটা।নানা রকম ফুল গাছে ফুটে উঠেছে আরও বেশি।বাতাসের সাথে ফুলের গন্ধ নাকে এসে লাগে।উপরের দিকে তাকাতেই বারান্দায় এককোণে চোখ আটকে গেল প্রাপ্তির।আয়ানের মা হুইলচেয়ার বসে চা খাচ্ছে,আর পাশে একজন মেয়েও বসে কথা বলছে।
প্রাপ্তি চোখটা সরিয়ে,একটু হেঁটে সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলো।ভিতরে নিরিবিলি হয়ে আছে।কতবড় ড্রইংরুমে বসে ছোট্ট একটা মেয়ে খেলা করছে।শত শত খেলনা যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।মেয়েটা ছোট্ট সাইকেলে উঠতে গিয়ে সাইকেল সহ পড়ে গেছে।আরিয়া পড়ে যেন কান্নার আওয়াজে পুরো বাড়িটা কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে।প্রাপ্তি দৌড়ে গিয়ে হাতের রিপোর্টটা রেখে আরিয়াকে কোলে নিয়ে থামানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।আয়ান নিজের রুম থেকে দৌড়ে নিচে এসে থমকে গেল।প্রাপ্তির কোলে আরিয়া।আয়ান ডিস্টার্ব করল না।মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে।আয়ান তো এইরকম কিছুরই স্বপ্ন দেখেছিল একদিন। আয়ান আর প্রাপ্তির পুতুলের মতো একটা মেয়ে হবে।প্রাপ্তি আয়ানের সাথে সংসার করবে।দুজনের সংসারের রাগ অভিমান সবি থাকবে।তবে সব থেকে যেটা বেশি থাকবে সেটা হলো ভালোবাসা।শিরিনও এসে আয়ান কে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিজেও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
আরিয়া একপর্যায়ে কান্না থেমে, আয়ানের দিকে চোখ পড়তেই,বাবাই,বাবাই,দেখোনা আমি পড়ে গেছি।কথাটা শুনে প্রাপ্তি পিছনে ফিরে আয়ানকে দেখে করুন চোখে তাকিয়ে আছে।আরিয়া প্রাপ্তির কোল থেকে নেমে দৌড়ে আয়ানকে ঝাপটে ধরে,ওই আন্টিটা কে বাবাই?
প্রাপ্তি অন্য দিকে তাকিয়ে নিজের চোখে জমে আসা পানিগুলো লুকাতে চাইছে।
হুম এটাই তো হওয়ার কথা ছিল।সব কিছু যে থেমে থাকবে তাতো না।আমিও যেন কাল থেকে উল্টো ভেবে বসে আছি।আসলে আমি বিয়ে করেনি মানে এই নয় আয়ানও বিয়ে করবে না।এতো বড় ডাক্তার, এতো এতো খ্যাতি, এতো নাম ডাক যার সেই বিয়ে করবে না এইটা কি হয়।হয়তো ভুল আমিই ছিলাম।
আয়ান শিরিনের কাছে আরিয়াকে এগিয়ে দিয়ে,প্রাপ্তিকে ইশারা করলো বসতে।নিজেও গিয়ে বসলো।
-আপনার রিপোর্ট কই?
প্রাপ্তি রিপোর্টগুলো আয়ানের দিকে এগিয়ে দিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
আয়ান অনেকক্ষণ রিপোর্টগুলো দেখে,রিপোর্ট সবগুলোই নরমাল এসেছে।তবে আমি যেটা সন্দেহ করেছি আল্লাহ মাপ করার কারণে হয়তো তেমন কিছু হয়নি।কথাটা বলে রিপোর্টগুলো পাশে রেখে,শিরিন দুইকাপ চা আর আমার রুম থেকে পেইডটা নিয়ে আসো।

প্রাপ্তি আস্তে করে বলল,আপনার ওয়াইফ কে তো দেখছি না।
প্রাপ্তির কথা শুনে আয়ান প্রাপ্তির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে,ওয়াইফ মানে? 
-আপনার মেয়েটা অনেক কিউট এবং অনেক লক্ষ্মী। 
হয়তো আপনার ওয়াইফের মতো তাই না?
-স্যরি মিস প্রাপ্তি,আপনার ধারণা ভুল।ও ওর মায়ের মতো হয়েছে কিনা আমি জানি না।কারণ,,,,,, 

-কারণ?

-কিছু না।
শিরিন চা নিয়ে এসেছে,সাথে নাশতা। আয়ান প্রাপ্তির দিকে চায়ের কাপটা এগিয়ে নিজেরটা নিয়ে হেলান দিয়ে বসে,
আমি কিছু মেডিসিন দিয়ে দিব সেগুলো খাও।আর আমার মনে হয় তুমি অনিয়মে চলো।সেগুলো ঠিক কর।

-আপনি কী রোগী বাসায় আসলে চা দেন?

-হঠাৎ এইকথা?

-না আমাকে দিলেন তো তাই জিজ্ঞেস করলাম।

আয়ান দীর্ঘশ্বাস নিয়ে,সবার সাথে নিজেকে তুলনা নায় বা করলে।কথাটা থামতেই আরিয়ার এসে আয়ানের পাশে বসে,বাবা এই নতুন আন্টি খুব মিষ্টি দেখতে।রেখে দাওনা আমাদের সাথে।

আয়ান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে,মা'মণি আন্টি আমাদের মতো গরীবদের বাড়িতে থাকে না।আন্টির একদিনের খরচ আমাদের সারাজীবনের। 

কথাগুলো শুনে প্রাপ্তি নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।আরিয়া পাশে এসে দাঁড়িয়ে তুমি থাকো না আমাদের সাথে।

প্রাপ্তি মাথা উঠিয়ে পাশে ফিরে, আরিয়াকে কোলে উঠিয়ে বসিয়ে,না মা, অন্য একদিন থাকবো।আজ আমার বাসায় যেতে হবে। 

-তোমার অহংকারী মা এখন কেমন আছে প্রাপ্তি? যার কাছে আমি ছিলাম রাস্তার একটা ছেলে।প্রাপ্তি তোমার মনে আছে সেই শেষ দিনের কথা? আমি প্রচন্ডরকম ঝড়বৃষ্টির মাঝে তোমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।প্রাপ্তি বৃষ্টি এখনো হয়,এখনো সেদিনের মতো মন হাহাকার করে তোমায় একটা বার দেখতে।কিন্তু আমার প্রাপ্তি আমায় বলেছে অন্যের বউ দেখার ইচ্ছাকে আমি সারাজীবন মাটি চাপা দিতে।
আমার কথা বাদ দাও তুমি পেরেছো আমাকে ভুলতে?

প্রাপ্তি সেই উত্তর না দিয়ে,আন্টি কোথায়? কেমন আছে উনি? উনাকে একটু ডেকে দিন।আমি দেখা করে চলে যাব। 

আয়ান হা হা হা করে হাসি দিয়ে তুমি আমার মাকে মনে করাতে চাইছো নাকি যে তোমার কারণেই আমার মায়ের আজ সাত/আট বছর প্রতিবন্ধীদের মতো জীবন কাটাতে হচ্ছে?
আসলে প্রাপ্তি আজ তোমায় দেখে আমার কী মনে হচ্ছে জানো?

প্রাপ্তি করুন চোখে তাকিয়ে আছে। 
ওইভাবে তাকালে এখন আর আয়ানের মন কাঁদে না।একটা সময় ছিল। তোমার সামান্য মন খারাপে আমার দুনিয়াটাই অন্ধকার হয়ে যেতো।কিন্তু আজ দেখো দুজন দুই সিমান্ত। 
প্রাপ্তির চোখে কোনো পানি নেই।এতো বছরে হয়তো সব শুকিয়ে গেছে।আর কতো? নাকি আজকের জন্যই শুকিয়ে গেছে? তবে একদিক থেকে ভালোই হয়েছে।আমার চোখের পানি তাকে আর দেখতে হলো না।

শিরিন আয়ানের মাকে ড্রইংরুমে নিয়ে এসেছে।
প্রাপ্তিকে দেখে একটু চমকালেও স্থির হয়ে, তুমি এইখানে?
প্রাপ্তি কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে,কেমন আছেন মা?

-অনেক দিন পর এই ডাকটা তোর মুখ থেকে শুনলাম।
এইতো দেখছিস না? আমার আবার থাকা।তোর কি অবস্থা বল? সংসার কেমন চলছে তোর? তোর হ্যাজবেন্ড কি এখন দেশে থাকে? ছেলে মেয়ে নাই?

-মা এইসব প্রশ্ন কাকে করছো? যার বিয়েই হয়নি তাকে? 

নিলিমা বেগম এইবার অবাক হয়ে প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে, আয়ান কী বলছে মা?

-উনি সত্যিই বলছে।এখন আমার কথা বাদ দাও। তোমার ছেলের বউ কই? তবে তোমার নাতনি কিন্তু বেশ আদুরে মা।

-পাগলি মেয়ে ওর বউ আসবে কোথায় থেকে?
এইদিকে আয়ান তার মাকে চোখে ইশারা দিচ্ছে কিছু না বলতে বিয়ের ব্যাপারে। কিন্তু তবুও নিলিমা বেগম বলল,ও তো বিয়েই করেনি মা।তোমাকে হারানো পর অনেক বুঝিয়েছি,কিন্তু কে শুনে কার কথা।ওর এক কথা, মা জীবনে মন একবারই একজনকে দেওয়া যায়।দ্বিতীয় কাউকে দিতে গেলে নাকি তোকে তোর ভালোবাসাকে অসম্মান করা হবে।

আয়ান এইবার ধমকিয়ে বলল,মা এইবার চুপ করবে? অনেক কথা হয়েছে।আমি তো ভেবেছিলাম ওর সাথে তোমার দেখা হলে রাগে ঘৃণায় ওর সাথে কথায় বলবেনা।কিন্তু না উল্টো ওরে আদর করেই কথা বলে যাচ্ছো।
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন