শেষ থেকে শুরু - পর্ব ১৩ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


___পারভীন বেগম সুস্থ হয়ে প্রাপ্তিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।পারভীন বেগম আসার সময় আয়ানের সাথে দেখা হলো না।কারণ তাকে চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হসপিটালে যেতে হয়েছে। সেখানে মেডিকেল বোর্ড বসেছে আশরাফুল ইসলামকে নিয়ে।ওনার স্ত্রী হালিমা বেগম আয়ানের সম্পর্কে অনেক শুনেছেন।তাই তিনি অনেক কষ্ট করে আয়ানের ঠিকানা জোগাড় করে নিজেই এসেছেন বাংলাদেশে।তাই হঠাৎ করেই আয়ানকে হালিমা বেগমের সাথে যেতে হয়েছে চেন্নাইয়ে। সাথে সুমনাকেও নিয়ে গেছে আয়ান।প্রাপ্তির সাথে হসপিটাল থেকে আসার সময় একবার দেখা করে এসেছে সে।আসার সময় প্রাপ্তির মন খারাপ দেখে আয়ানেরও ভালো লাগেনি।কিন্তু কিছু করার নাই।একটা মানুষ তার উপর ভরসা করে চেন্নাই থেকে বাংলাদেশে এসেছে।তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিলে সারাজীবন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না সে।নিজের মায়ের ইচ্ছেটা কখনো পূরণ করতে পারবে কিনা আয়ানের জানা নাই।চেন্নাই থেকে আসার সময় মায়ের বিষয়টাও খুতিয়ে দেখে আসবে।যাওয়ার সময় তাই নিলিমা বেগমের প্রেসক্রিপশন থেকে রিপোর্ট সবগুলোই সাথে নিয়ে গেল।

এয়ারপোর্টে বসে আছে হালিমা বেগম, আয়ান আর সুমনা।আয়ান বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে।প্রাপ্তিদের আজ বাড়ি যাবার কথা।গিয়েছে কিনা তাও জানেনা সে।কিছুক্ষণ পর রিয়ানের কথা মনে পড়তেই রিয়ানকে ফোন দিয়ে জেনেছে প্রাপ্তিরা সকালেই চলে গেছে।
সুমনা আয়ানকে চিন্তুত দেখে চুপ করে থাকতে পারলো না,স্যার আপনি কী প্রাপ্তিকে নিয়ে কোনো চিন্তা করছেন?
আয়ান সুমনার দিকে বিষন্নতার চোখ নিয়ে তাকিয়ে,সুমনা'আসলে প্রাপ্তি বাড়ি গিয়ছে, কী করছে কে জানে?এইদিকে আরিয়া!আরিয়াকে নিয়ে আমার খুব ভয় হয়।মেয়েটা আসার সময় বুকের ভিতর মিশে ছিল।মনে হলো যেন আমি সারাজীবনের জন্য ওর কাছথেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি।অন্য সময় আমি দেশের বাহিরে গেলে আমকে লিষ্ট ধরিয়ে দিবে।শিরিনের হাতে নিজের মনের মতো খেলনা, চকলেট,কসমেটিক সব লিখিয়ে আমাকে এনে দিয়ে বলবে বাবাই এইগুলো সব আমার জন্য নিয়ে আসবে।আর তুমি ভালো ভালোই ফিরে আসবে।কিন্তু এইবার তার কিছুই করলো না।যখন লিষ্টের কথা জিজ্ঞেস করলাম তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল,বাবাই আমি শুধু তোমাকেই চাই।তুমি ভালোভাবেই ফিরে এসো।

-স্যার হয়তো ও এখন বড় হয়েছে,আপনাকে সত্যিই অনেক মিস করে।তাই হয়তো বলেছে।
আয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুমনাকে কিছু না বলে, নিজে নিজেই বলল,নয়না ফিরে আসার পর থেকেই আরিয়া চেইঞ্জ। সেদিন নয়না বলল সে পরেরদিন বিদেশে চলে যাবে কিন্তু কই সে এখনোতো গেলো না।উল্টো মাঝে মাঝে আরিয়ার সাথে এসেই সময় কাঁটায়।নয়না কী আরিয়াকে কিছু বুঝাচ্ছে? না আমি দেশে ফিরে এসেই প্রাপ্তিকে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসবো আরিয়ার জন্য।আরিয়া তার মাকে ফেলে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।

আয়ান চেন্নাই এসেছে একদিন হয়ে গেল।আশরাফুল ইসলামের সাথে দেখা করলেন এবং ডাক্তারদের সাথে।আয়ান মেডিকেল বোর্ডে বসে তিনদিনের সময় নিয়েছেন অপারেশনের জন্য।এবং এই তিনদিন তার আন্ডারেই থাকবে আশরাফুল ইসলাম।
হালিমা বেগম নিজের বাসায় নিয়ে গেলেন আয়ান আর সুমনাকে।আশাফুল বাংলাদেশ ছেড়ে চেন্নাইতে এসেছেন ছাব্বিশ বছর হয়ে গেল।তবে তিনি আজও বাংলাদেশের মায়া কাটিয়ে উঠতে পারেননি।তাই মাঝে মাঝে বাংলাদেশ গিয়ে ঘুরে আসেন।তাদের একমাত্র মেয়ে আরমিন ইসলাম।লন্ডনে থাকে এবং সেখানেই পড়াশোনা করে।তবে সে বাবার মতো বাংলাদেশকে ভুলতে পারেনি।পারেনি নিজের দেশের সংস্কৃতি। 
হালিমা বেগম আয়ানের জন্য রান্না করেছেন নিজের হাতে।আয়ান আর সুমনা হোটেলে থাকবে বলেছে কিন্তু হালিমা বেগম রাজি হননি।তাই তিনি সুমনা আর আয়ানকে নিজের বাড়িতেই নিয়ে এসেছেন।ডুপ্লেক্স বাড়িতে তিনি একাই থাকতে হয়।কাজের লোক আছে তাদের সাথে তেমন একটা কথা বলেন না তিনি।নিজের একমাত্র মেয়েটাও নেই আজ পাশে।বাবার এমন অবস্থা শুনে আরমিন আসতে চেয়েছে কিন্তু তার পরীক্ষার কারণে সে আসতে পারিনি।
হালিমা বেগম আয়ানের বরাবর সামনের সোফটায় বসে,মিস্টার আয়ান আপনি এই বাড়িতে নিজের মতো করেই থাকুন আর কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলবেন।
আয়ান একটু লজ্জিত হয়ে মুচকি হেসে,আন্টি আপনাকে আবারও বলছি আমি আপনার ছেলের মতো।আপনি আমাকে আয়ান আর তুমি করে ডাকতে পারেন।
-আসলে বাবা ভুলে যাই কথাটা, তুমি যে বাংলাদেশ থাকার সময় বলেছো।

-জ্বি আন্টি।আপনি আমাকে আয়ান বলেই ডাকবেন।

-আমি অনেক ভরসা করে তোমাকে এইখানে নিয়ে এসেছি।এইখানে ডাক্তাররা যখন আমায় বলল, আমার নিজের পছন্দের কোনো ডাক্তার আছে কিনা আমি সাথে সাথেই তোমার নামটাই বলে দিলাম।আমি তাদের অপেক্ষা করতে বলে সেদিনই বাংলাদেশে চলে গিয়েছিলাম।আয়ানের দিকে আস্বস্ত চোখে তাকিয়ে,ইনশাল্লাহ আমার বিশ্বাস তুমি পারবে।
কথাটা বলেই নিজের রুমে চলে গেলেন হালিমা বেগম।
আয়ানও স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আরিয়ার কথা ভাবতেই নিলিমা বেগমকে ফোন দিলেন।

-কেমন আছিস বাবা? কখন গিয়ে পৌঁছালি?

-মা! আমি সকালে এসেই আগে হসপিটালে গিয়েছি।সেখানের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরলাম।

-কার বাসায় গেলি বাবা?

-যিনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন।আচ্ছা মা,আরিয়া কোথায়? আমার মেয়েটার সাড়াশব্দ পাচ্ছি না কেনো?

নয়না তুই যাওয়ার পরেই এসেছে।তার সাথেই আছে।নয়না বলছে তুই না আসা পর্যন্ত এইখানেই থাকবে।সে নাকি আরিয়ার দেখাশোনা করবে।

-কিন্তু মা! নয়না থাকবে মানে? তুমি কিছু বলোনি?

-কী বলবো বল,তুই যাওয়ার পর থেকেই তোর মেয়ে আমাদের সাথে কথা বলে না।যেই নয়না আসলো দৌড়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো।তাই আমি ভাবলাম শিরিনকে দিয়ে হবে না।নয়না যখন নিজে থেকে এসেছে সেইজন্য আর না করলাম না।
আয়ান মনে মনে চিন্তিত হলেও নিলিমা বেগমকে বুঝতে না দিয়ে,ওকে মা তোমার যা ভালো মনে হয়।আর হ্যাঁ নিজের খেয়াল রেখো সাথে আরিয়ার।রাতে কিন্তু আরিয়াকে তোমার কাছেই ঘুম পাড়াবা।

আয়ান ফোন রাখতেই সুমনা জিজ্ঞেস করলো,স্যার কোনো প্রবলেম?  

আয়ান কথা ঘুরিয়ে, সুমনা যাও একটু বিশ্রাম নাও।সারাদিন অনেক দখল গেছে।রাফিকে একটা ফোন দিয়েও।না হলে বেচারা অনেক চিন্তা করবে।

পরেরদিন আশরাফুল ইসলামের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আয়ান।ওপেন হার্ট সার্জারী করা হবে তাকে।আয়ান দাঁড়াতেই,আস্তে আস্তে শান্ত গলায় বলল,আপনি কাল এসেছেন আমার জ্ঞান ছিল না।
আপনি তো ডাক্তার আদনান মাহমুদ আয়ান তাই না?যার উপর আমার স্ত্রীর এতো ভরসা। 

-আয়ান মুচকি হেসে,জ্বি আমি আয়ান।কিন্তু আপনি আমাকে তুমি করেই বলবেন?

-আচ্ছা ডাক্তার আমি বাঁচবো তো? কিন্তু আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে আমি আর বাঁচবো না।

-আয়ান একহাত নিজের হাতের উপর রেখে,উপরে দিকে তাকিয়ে, আল্লাহ যার সহায় হন সে যেই করেই হোক আগুনের ভিতর থেকেও বেঁচে যায়।আর আপনার হার্ট সার্জারি করে হবে।চিকিৎসা বিজ্ঞান এখন অনেক এগিয়ে।দেশ বিদেশ ওপেন হার্ট সার্জারি হরহামেশাই হয়ে থাকে এতে ভয় পাবার কিচ্ছু নেই।শুধু আল্লাহকে ডাকুন,যা হবার সব ভালোই হবে।

প্রাপ্তির এখন নিজের মায়ের সাথে ভালোই কাটছে তার দিন।মায়ের সেবা আর সংসার সামলানো সব একা হাতেই করছে সে।আয়ান যাওয়ার পর থেকে একবারের জন্যও ফোন দেয়নি তাকে।
পারভীন বেগম মেয়েকে নিয়ে এখন মনে যেন আনন্দের সীমা নেই।মনে মনে মেয়ের বিয়ের কথাও চিন্তা করেছেন তিনি।নিজের ভাইকে খবর দিলেন আসার জন্য।শরীরের যা অবস্থা নিজে একটু সুস্থ থাকতেই মেয়েটাকে বিয়ে দিতে চান তিনি।যার জন্য মেয়েটা অপেক্ষা করে কাটিয়েছে সে তো ঠিকি বিয়ে করে বউ বাচ্চা নিয়ে সুখেই আছে।
পারভীন বেগমের ভাই মাহবুব এসেছে। 
পারভীন বেগম আর মাহবুবের কথার মাঝে প্রাপ্তি চা নিয়ে এসেছে মাহবুবের জন্য।নিজের বিয়ের কথা শুনেই থমকে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপটা হাতের থেকে নিচে পড়ে চুরমার হয়ে গেল। সাথে যেন তার কলিজাও একি অবস্থায় চুরমার হলো।পারভীন বেগম আর মাহবুব আচমকা ভয়ে পেয়ে তাকিয়ে,

-কিরে,তোর আবার কী হলো?

-মা তুমি আবারও সেই একি ভুল করতে যাচ্ছ?

-কী ভুল করলাম বল তো?তখন তোর বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি ভুল করেছি আমি নিজেও স্বীকার করছি।কিন্তু এখন?  
নিজের গলাটা নরম করে করুণার স্বরে বলল,যার জন্য এতোদিন অপেক্ষা করেছিলি সেতো নিজে বিয়ে করে সংসার করছে, ওর একটা ফুটফুটে মেয়ে আছে। তার জন্য কী আর জেনে-বুঝে অপেক্ষা করা যায়?তাই আমি তোর বিয়ে দিয়ে শান্তিতে দুনিয়ায় থেকে বিদায় নিতে চাই।তুই পাগলামি করিস না।

প্রাপ্তির এতোক্ষণে মাথায় আসলো তার মা হসপিটাল থেকে আসার পর থেকেই বার বার আয়ানের সংসারের কথা কেনো বলছিল।প্রাপ্তি নিজেকে কিছুটা শান্তনা দিয়ে এগিয়ে এসে,মা'তুমি আরিয়ার কথা বলছো তাই না?নিশ্চয়ই আরিয়াকে দেখে তুমিও ভেবেছো আরিয়া আয়ানের নিজের মেয়ে, তাই না?
কিন্তু মা'আরিয়া আমারও মেয়ে, সে আমায় মা বলেই ডাকে।তার জন্য কী আমি তাকে পেটে ধরতে হয়েছে? আমি যেইরকম ওকে জন্ম না দিয়ে মা হয়েছি তেমনি আয়ানেও।
প্রাপ্তির কথায় পারভীন বেগমের মাথার কিছু জট খুলল। সত্যিই কি তাহলে তিনি আবারও মেয়ের সাথে মস্তবড় ভুল করতে যাচ্ছিলেন? ছিঃ ছিঃ ছেলেটা শুনলে কীভাবে মেনে নিবে।প্রাপ্তিকে কাছে বসিয়ে,মাহবুবের দিকে তাকিয়ে, আয়ান দেশে আসলে তুই আয়ানদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবি।আমি চার হাত এক করে দিতে চাই খুব শীগ্রই।আমি চাইনা আমার মেয়েটা তিলে তিলে এইভাবে শেষ হয়ে যাক।
.
.
.
চলবে....................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন