শেষ থেকে শুরু - পর্ব ১১ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


___নয়না বসে আছে আয়ানের ড্রইংরুমে। এতো সকাল কোনো রোগী তো আসার কথা নয়।শিরিন এসে একবার ডেকে গেছে আয়ানকে।আয়ান উঠে ফ্রেশ হয়ে তোয়ালেটা ঘাড়ের উপর ফেলে নিচে নামতে নামতে শিরিনকে চা দিতে বলল।
নিচে এসেই নয়নাকে বসে থাকতে দেখে আয়ান থমকে গেল।প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে নয়নাকে বিস্মিত হয়ে দেখছে।
নয়না আয়ানকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসে,আমার বাচ্চা কোথায় আয়ান? 
আয়ান নিশ্চুপ। গলা থেকে কোনো কথা বের হয়ে আসছে না।
নয়না আবার জিজ্ঞেস করলো,আয়ান আমার বাচ্চা কোথায়? কথাটা করুণ গলায় বলল নয়না।
আয়ান সেদিন কি এইটা কথা ছিল তোর সাথে আমার?
-নয়না তুই আমার বাড়ি চিনলি কী করে?
-একজন বিখ্যাত ডাক্তারের বাড়ি চিনা কী কঠিন কাজ?যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দিবে।
-নয়না,আমরা এইভাবে কথা না বলে বাহিরে একদিন দেখা করি। বাড়িতে বসে এইসব কথা বলা ঠিক না।
-না আয়ান যা হবে এই বাড়িতে হবে।তোর মা কোথায়? উনাকে ডাক আমি ওনার সাথে কথা বলবো।
আয়ান নয়নার হাত ধরে টেনে সোফায় বসিয়ে, প্লিজ তুই শান্ত হও।
নয়না কিছু না সাপের মতো ফসফস করছে।শিরিন চা দিয়ে চলে গেল।আয়ান আর নয়নার ব্যাপারটা শিরিনের চোখ এড়িয়ে যায়নি।
কিন্তু শিরিনের মনে একটাই ভাবনা, যা হয়ে যাক না কেনো আয়ান কোনো খারাপ কাজ করতে পারে না।

আয়ান নয়নাকে বসিয়ে শিরিনকে বলল নাশতা দিতে।নিজে আরিয়ার কাছে গেল। নয়না সেখানেই বসে আছে।
আরিয়ার মাথার পাশে বসে কপালে চুমু দিতেই আরিয়া চোখ খুললো।আরিয়া যেন এতোক্ষণ এই অপেক্ষাই ছিল। 
-শুভ সকাল বাবাই।
আয়ান মুচকি হেসে, হুম।
আরিয়া উঠে আয়ানের গলা জড়িয়ে ধরে,বাবাই আজ তুমি হসপিটাল যাওনি?
-না মা।চলো ফ্রেশ হবে।নিচে তোমার এক আন্টি এসেছে তোমাকে দেখতে।
আরিয়াকে ফ্রেশ করিয়ে আয়ান কোলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতেই আরিয়া বলল।বাবাই কাল মা তো আমাদের সাথে আসলো না।কিন্তু আজতো মা কে নিয়ে আসতে পারো। বাবাই মাকে আজ আনবে তো?
আয়ান নয়নার সামনে আরিয়াকে দাঁড় করিয়েছে।
আরিয়া নয়নাকে দেখে,বাবাই কালকের আন্টিটা তাইনা?
আয়ান অনিচ্ছুক ভাবে ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে, মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালো।
নয়না দৌড়ে এসে আরিয়ার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, আস্তে করে আরিয়ার গালে হাত দিয়ে,চোখের পানিগুলোকে মুছে তোমার নাম কী মা?
আয়ান অন্যদিকে ফিরে আছে।তার বুকের ভিতর ধুপধাপ শব্দ করছে।হারানোর ভয় কতোটা জ্বালা সে তো আগে থেকেই জানে।
-আরিয়া।তোমার নাম? ও হে বাবাই কলতো তোমায় নয়না বলে ডেকেছে।
আরিয়ার কথা শুনে নয়না মিষ্টি হেসে,তোমার বাবাই তোমাকে অনেক আদর করে তাই না?
আরিয়া খিলখিল করে হাসি দিয়ে,আমার বাবাই বেষ্ট বাবাই।জানো আমার মাও অনেক বেষ্ট। কিন্তু বাবাইয়ের সাথে রাগ করেছে বলে এখন আসে না।
-আচ্ছা আরিয়া, আমাকে তোমার ভালো লাগেনি?
-হে,,,লেগেছে।কিন্তু মায়ের মতো না।মা যেদিন প্রথম আমাদের বাড়িতে এসেছে সেদিন থেকেই,,,, 
আয়ান আরিয়াকে চুপ করিয়ে দিয়ে,শিরিন ওকে নিয়ে যাও। আরিয়া যাও শিরিনের সাথে যাও।বাবাই এসে নাশতা খাইয়ে দিবো।
নয়না বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে, থ্যাংকস আয়ান আমার মেয়েটাকে এতোটা ভালো রাখার জন্য। 
কথাটা শুনেই আয়ান নয়নার দিকে তাকালো অবাক হয়ে।আমি এইখানে আমার মেয়েটাকে নিতে আসিনি আয়ান। শুধু এসেছি একটা নজর ভালো করে দেখে একটু আদর করেই চলে যাবো।

প্রাপ্তি আজ সকাল বেলা উঠেই রুবিনা বেগমকে বলে আরিয়ার সাথে সময় কাটাতে আসছে।কাল রাতে সে রুবিনা বেগমকে আয়ানের ব্যাপারে সব ঘটনা খুলে বললেন।রুবিনা বেগম ঘটনা আগে থেকে জানলেও কিন্তু এই সেই আয়ান এইটা ভাবতে পারিনি।
একটা রিকশা নিয়ে প্রাপ্তি আয়ানের বাড়িতে আসলো। দারোয়ান চাচা এখন প্রাপ্তিকে দেখলেই হাসি মুখে কথা বলে।
আজও ব্যতিক্রম হলো না।
-মা আইজকা আপনি সক্কাল সক্কাল? কোনো সমস্যা অইছে?
-না চাচা।আরিয়ার সাথে সময় কাটাতে আসছি।আপনি কেমন আছেন?
-আমি ভালাই আছি মা।আইচ্ছা মা যাও ভিতরে যাও।

নয়নার কথা শুনে আয়ান, করুন স্বরে বলল,নয়না প্লিজ মেয়েটাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিস না।
নয়না মুচকি হেসে, আরে পাগল আমি তো ওকে নিতে আসিনি।আমি তোকে কৃতজ্ঞ জানাতে আসছি।তুই আমার মেয়েটাকে এতোটা ভালো রেখেছিস।আমি কোনো দিন এই দাবি নিয়ে আসবো না।আমি কাল চলে যাচ্ছি দেশের বাহিরে।আমার স্বামী আরিয়ার কথা শুনে কিছুদিন আগে আমাকে দেশে নিয়ে এসেছে।কিন্তু আমার আরেকটা বেবি দেশে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।তাই তোর কাছে আসতে আমার অনেক দেরি।
যাইহোক প্রাপ্তি কই ওকে ডাক আমি দেখা করেই চলে যাবো।আয়ান কিছু না বলে চোখমুখ মুছে নয়নাকে কিভাবে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবে বুঝতে পারছে না।হঠাৎই নয়নাকে জড়িয়ে ধরে, থ্যাংকস নয়না, অনেক অনেক থ্যাংকস। নয়নাকে ছেড়ে দাঁড়িয়ে কিছু বলতেই দেখে প্রাপ্তি পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।
আয়ান প্রাপ্তিকে দেখে, প্রাপ্তি! প্রাপ্তি কিছু না বলে দৌড়ে বাহিরে যেতেই আয়ান তড়িঘড়ি করে পিছন থেকে হাত ধরে, পিছনের জিনিস না দেখেই চলে যাবে?
-চোখে দেখার পরেও কিছু থাকে?ঝাঁঝালো গলায় বললো প্রাপ্তি।
নয়না এগিয়ে এসে,এই তাহলে প্রাপ্তি?
তোমার কথা অনেক শুনেছি।কিন্তু দেখার ইচ্ছাটা আজ সম্পুর্ণ হলো। 
প্রাপ্তি নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
আয়ান বলল,ও নয়না,আমার বন্ধু। একসাথেই মেডিকেলে পড়তাম।কিন্তু নয়না ডাক্তারি পড়াটা শেষ করতে পারিনি। প্রাপ্তিকে নিজের কাছে টেনে এনে,মেয়ে তোমার ভাগ্য ভালো আমার পাল্লায় পড়েছো না হলে নয়নার মতো ঘটলে সব জাগায় আয়ান পাওয়া যায় না।
প্রাপ্তি কথার আগামাথা কিছুই বুঝলো না।আয়ানের দিকে তাকিয়ে, তাহলে তুমি উনাকে জড়িয়ে ধরলে কেনো? 
আয়ান আর নয়না হা হা হা করে হাসতে থাকলো। প্রাপ্তি তাদের হাসি দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে, মন খারাপ করে আছে।
আয়ান হাসি থামিয়ে,বুঝলে নয়না কারো যে এতোটা জ্বলবে সেটা কিন্তু আমি ভাবিনি।
আসলে প্রাপ্তি আমাদের আরিয়ার আসল মাই নয়না। 
প্রাপ্তির মনে যেনো ধুপধাপ করছে।তার মানে তোমরা,,,,,ছিঃ 
-প্রাপ্তি তুমি আয়ানকে ভুল বুঝছো।আরিয়া শুধু আমার সন্তান আয়ানের নয়।আয়ান এমন একটা মানুষ এইরকম নোংরা কাজ সেই করবে না।আসলে আরিয়া আমার আর মৃদুলের মেয়ে।মৃদুল আর আমি একে ওপরকে ভালোবাসতাম।সেই ভালোবাসার ফল আরিয়া।কিন্তু আমি প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর মৃদুল আমাকে ছেড়ে চলে যায়।মানে সে অস্বীকার করে আমার বাচ্চাকে।কিন্তু এইদিকে আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।আত্মহত্যা ছাড়া কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না।বাচ্চাটা নষ্ট করার ইচ্ছাও ছিল না আমার।কিন্তু আমার বাবা মা তো আর সেটা মানবে না।তখন আয়ান আমার পাশে দাঁড়ায় এবং আমার বাবা মাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করালো সে।আমার বাচ্চার বাবা সে হবে।তবুও যেন বাচ্চাটা নষ্ট না করে।
সত্যি সত্যিই আমার বাচ্চার বাবা হলো আয়ান।আর আমার বিয়ে ঠিক হয় অন্য জাগায়।সে দেশের বাহিরে থাকে আমিও ওর সাথেই থাকি।আমাদের একটা মেয়েও হয়েছে।কিন্তু বিয়ে পর আমার হ্যাজবেন্ডকে সব বলার পর ও মেনে নিয়েছে। এবং সে নিজে থেকেই দেশে এসেছে আমাকে নিয়ে আমার বাচ্চাটাকে দেখার জন্য।সেই জন্যই আজ আমার এইখানে আসা।
প্রাপ্তি সব শুনে আয়ানকে কিল-ঘুষি মেরে,তুমি আমাকে আগে বলোনি কেনো এইসব। আমার কষ্ট হয়না? আর কতো কষ্ট তুমি আমায় দিবে?
-প্রাপ্তি ব্যথা পাচ্ছি তো।বলার সময় পেলাম কখন? কতো কান্ড এই কয়েকদিনে ঘটে যাচ্ছে বলো?
আরিয়া বাহিরে এসে,মা এসেছে?
দৌড়ে কোলে উঠে, মা তোমার রাগ ভেঙ্গেছে?
আরিয়াকে চুমু দিয়ে হ্যাঁ মা আজ সব রাগ ভেঙ্গে গেছে।আয়ানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে,সামনে থেকে সরো।তাড়াতাড়ি আমাকে এই বাড়িতে আনার ব্যাবস্থা করো।আর নয়না আপু আজ আপনার কোথাও যাওয়া হচ্ছে না।ভাইয়াকে ফোন দিন আমি রান্না করছি দুজনে মিলে খেয়ে তারপর যাবেন।
প্রাপ্তি ঘরে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দুজনে মুচকি হেসে,আয়ান নয়নার দিকে তাকিয়ে, তোর হ্যাজবেন্ডকে ফোন দে তাড়াতাড়ি, না হলে আবার রেগে যাবে।
প্রাপ্তি শিরিনকে বলে রান্নার জোগাড় করে নিলিমা বেগমের রুমে এসে,মা তুমি এখনো রুমে আছো? 
-হে রে।শিরিনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
-আচ্ছা চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি।
প্রাপ্তি হুইলচেয়ারের পিছন থেকে ধরে,নিলিমা বেগমকে বলল,মা যেদিন প্রথম তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো সেইদিনের কথা মনে আছে?
নিলিমা বেগম উচ্ছ্বসিত হয়ে,থাকবে না আবার?তোর বাবা তোকে নিয়ে এসেছিল।তুই আমার সাথে সময় কাটিয়ে চলে যেতি।কিন্তু আয়ান জানতে পারতো না।তোর ভয়তো বলতে পারিনি আমি।তুই যে না হলে আর আসবিনা।সত্যিই তুই আর আসিসনি।হারিয়ে গেছিস আমাকে একা ফেলে।তুই জানিস আমি তোকে কতটা মিস করতাম।আমি ভাবতাম তুই আসবি।একদিন না একদিন তুই ঠিক চলে আসবি।তুই আসিস না দেখে একদিন আয়ানকে তোর কথা জিজ্ঞেস করতেই বলল বিয়ে হয়ে গেছে।আমিও ভাবলাম হয়তো তাই হবে।কিন্তু এখন বুঝলাম আয়ান না না জেনেশুনেই আন্দাজে বলেছে।প্রাপ্তি কথাটা শুনে মুচকি হেসে নিলিমা বেগমের সাথে খোশগল্প জুড়ে বসলো। 
.
.
.
চলবে.................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন