শেষ থেকে শুরু - পর্ব ০৭ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


___আরো দুই দিন কেটে গেল।আমারও ছুটি ঘনিয়ে আসছে।যেই করেই হোক প্রাপ্তিকে কথাটা আমাকে বলতেই হবে।কিন্তু সমস্যা একটাই তখনও পারলাম না।
একদিন রাফি আমায় বলল এক কাজ কর ওকে চিঠি লিখে জানা তোর মনে সব কথা।তাহলেই তো হয়।সারারাত বসে চিঠিটা লিখেও ফেললাম।
ঢাকায় ফিরার আগের দিন নিলয়ের হাতেই চিঠিটা দিলাম।
প্রাপ্তি স্কুল ছুটির পর বাড়ির পথে কিছুটা আসতেই,নিলয়ের ডাকে পিছনে ফিরলো,আরে ভাইয়া আপনি?
-হুম আমি, কেমন আছো?
-জ্বি ভালো।
-পড়ালেখা ঠিকঠাক চলছে তো?
-জ্বি।
নিলিয় চিঠিটা বাড়িয়ে দিয়ে, এই নাও এইটা তোমার জন্য।
-কী এইখানে?
-বাসায় গিয়ে দেখ।নিলয় চিঠির খামটা প্রাপ্তির হাতে দিয়ে দৌড়ে পালাল।
প্রাপ্তি বাড়ি এসে ফ্রেশ হয়ে সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে বসতেই নিলয়ের দেওয়া খামের কথা মনে পড়তেই খামটা খুলে দেখে একটা চিঠি।
বেশি লিখা ছিল না। অল্প কয়েকটি লাইন।

"তুমি যখন সূর্যের দিকে তাকাও সূর্য তোমায় দেখে মুচকি হেসে।
কেনো জানো?
তুমি তার থেকেও বেশি সুন্দর।
তোমার খিলখিলিয়ে হাসিটা ভোরের কুয়াশায় যেদিন প্রথম দেখেছি আমি সেদিন নিজেকেই নিজে ভুলে গেছি।তোমাকে ভালোবাসার অধিকার হয়তো আমার নেই।কারণ তোমার সাথে আমার যায় না।প্রাপ্তি! আমি গুছিয়ে লিখতে পারি না। আমি কোনো কবি বা মহাকাব্যিক নয়।তবে আমি ভালোবাসতে জানি মন থেকে।দিবে তুমি সাড়া আমার এই চিঠি পেয়ে?

                                                     ---আয়ান

আর কিছুই লিখা ছিল না সেই চিঠিতে।প্রাপ্তি কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিল।
আয়ান আমায় চিঠিটা লিখেছে? কিন্তু,,,,
প্রাপ্তির মাথায় কিছুই ঢুকছেনা।পরেরদিন স্কুলে গেল আয়ানকে স্কুলের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে,কেমন আছেন ভাইয়া?
-হুম ভালো।আজ আমরা চলে যাচ্ছি তাই তোমাকে বলতে এলাম।
-ওহ্ আচ্ছা ভালো থাকবেন।
কথাটা বলে প্রাপ্তি পা বাড়াতেই আয়ান পিছন থেকে আবার ডাকলো,প্রাপ্তি?
প্রাপ্তি এগিয়ে এসে, জ্বি ভাইয়া বলেন?
-তোমার কিছু বলার নাই?
-কোন ব্যাপারে ভাইয়া?
আয়ান মন খারাপ করে, কিছু না যাও।
প্রাপ্তি আবাও পা বাড়াতেই আয়ান আবার পিছন থেকে ডাকলো,প্রাপ্তি?
-ভাইয়া আপনি কী কিছু বলতে চান?
-না মানে তোমার সত্যিই কিছু বলার নেই?
-কী বলবো?
-কিছু না।ঠিক আছে নিজের যত্ন নিও।আয়ান ফিরে গেল।প্রাপ্তি মনে মনে হাসছে আর বলছে,আমাকে চিঠি পাঠানো? যতদিন মুখে না বলছে কোনো উত্তর নাই।শালার মুখ থেকে বাহির করে ছাড়বোই।
বিকেলের বাসে আয়ান চলে গেল ঢাকায়।
ঢাকায় এসে পড়ার চাপ।মেডিকেলের স্টুডেন্ট মানে জীবনে সব ভুলে বই নিয়ে বসে থাকো।কিন্তু আয়ানের সেইদিকে মন দিতে পারছে না।এতো ভালো স্টুডেন্ট অমনোযোগী থাকা সেটা স্যারদেরও সহ্য হয়নি।প্রতিনিয়ত আয়ান বকা খেতে হচ্ছে ক্লাসে। এইভাবে চলে গেল আরও সাত মাস।চার দিনের জন্য ছুটি পেয়েছে তারা।আয়ান রাফিকে বলল,আমি তোর সাথে যাব।সেদিনের উওর পেয়ে গেলেই ওইখান থেকে মায়ের কাছে চলে যাব।
রাফিও রাজি।
বাড়িতে এসেই পরেরদিন রাফি আর আয়ান একসাথেই প্রাপ্তির সাথে দেখা করল।আয়ান প্রাপ্তিকে সরাসরিই জিজ্ঞেস করল,তুমি আমার চিঠির উত্তর দিলে না কেনো?
প্রাপ্তি শান্ত গলায় বলল, আমি চিঠি লিখতে পারি না।
-চিঠিতেই যে উত্তর দিতে হবে আমি কোন জায়গায় লিখে দিয়েছিলাম?
প্রাপ্তি কিছু না বলেই উঠে চলে গেল।
আয়ান যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না তার।হয়তো প্রাপ্তি রাজি না।তাই সরাসরি বলছেনা আমি কষ্ট পাবো বলে।
কেটে গেল আরেকটা দিন।আয়ান সব কিছু রেডি করল বাড়ি চলে যাবে।স্কুল থেকে রাফিদের বাড়ির দূরত্বটা বেশি না।রাফিদের বাড়ি পার হয়ে মেইন রাস্তা। দুই তিন মিনিট পথ ধরে এগিয়ে আসলেই স্কুল।
আয়ান ব্যাগ নিয়ে মেইন রাস্তায় আসতেই দেখে প্রাপ্তি দাঁড়িয়ে আছে।
আয়ানকে দেখে, কি ব্যাপার চলে যাচ্ছেন নাকি আয়ান সাহেব?
আয়ান গম্ভীর হয়ে বলল,হুম,মায়ের কাছে।
-আমাকে নিবেন আপনার সাথে?
কথাটা শুনে আয়ানের মনে একটু আশার আলো ফুটলো।
-কী নিবেন না?
-কেউ কি আমাদের গরীবের বাড়িতে যাবে?
-যেতেও পারি যদি কেউ নিতে চায় তবে সারা জীবনের জন্যই নিতে হবে।
কথাটা শুনে আয়ানের মনে আনন্দের ঝলক দেখা দিয়েছে। প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে, সারাজীবন কাটাতে পারবে?
-হুম।
-শুনেছি তোমার মায়ের অনেক টাকা। কিন্তু আমার কোনো টাকা নেই।পারবে এইসব প্রাচুর্যের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে আমার মতো একজনের হাত ধরে জীবনপার করতে?
-আচ্ছা আপনি কী এইসব বলেই আমাকে কষ্ট দিবেন?
আপনার এইগুলো শুনতে আমার মোটেও ভালো লাগছে না।
আয়ান একগাল হাসি দিয়ে,আচ্ছা ওকে।
আয়ানের ছুটি শেষ চলে যাবে ঢাকায়।কবে আবার প্রাপ্তিকে দেখবে তারও কোনো ঠিক নেই।
তবে আসার সময় প্রাপ্তিকে কথা দিয়েছে প্রতি মাসে যেই করে হোক তাকে একটা করে চিঠি পাঠাবে।
কয়েকটা মাস তাই হলো।সুন্দর করেই কাটছে তাদের দিন।একদিন হঠাৎ একটা চিঠি প্রাপ্তি পড়ার সময় তার মাও পিছন থেকে পড়ে নিলো।
প্রাপ্তির ভয় মনে আঁতকে উঠল। পিছনে ফিরে দেখে তার মা।প্রাপ্তি সাথে সাথেই উঠে দাঁড়িয়ে, ম ম ম্মা!
পারভীন বেগম কিছু না বলেই প্রাপ্তির হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে তিনি চিঠিটা পুরো পড়ে থমথমে হয়ে চেয়ারে বসে পড়লেন ।মেয়ের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে আছে। প্রাপ্তি নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।ভয়ে তার চোখের নোনাপানিগুলো অঝোরে ঝরছে।
পারভীন বেগম শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,কে ছেলেটা?
প্রাপ্তি নিশ্চুপ,
-আমি জিজ্ঞেস করছি ছেলেটা কে? কথাটা বলে চেঁচিয়ে উঠলো পারভীন বেগম।
-আয়া য়া ন।
-শুধুই আয়ান? থাকে কোথায়? বাড়ি কই?
-আমাদের এলাকার নয়।আমাদের গ্রামের রাফি ভাইয়ার বন্ধু।
-করিম ভাইয়ের ছেলে রাফি?
প্রাপ্তি মাথা নাড়লো উপর নিচে।
-ওতো মেডিকেলে পড়ে শুনেছি।তুই এই ছেলেটাকে কীভাবে চিনলি?
-রাফি ভাইয়ার সাথে আমাদের গ্রামে বেড়াতে এসেছে।
সেইখান থেকেই।
-হুম। তোর সাথে কীভাবে যোগাযোগ হয়? শুধু চিঠিতেই?
-প্রাপ্তি আবারও মাথা নাড়লো।
-ঠিক আছে আমি ছেলেটাকে তাহলে আসতে বলি? করিমকে বলবো ওর ছেলেকে ফোন দিতে।এবং আমার সাথে কথা বলার জন্য
পারভীন বেগম নিজের কথা মতোই কাজ করলেন।কিন্তু রাফি জানিয়েছে সামনে পরীক্ষা,আর পরীক্ষা শেষ না করে আসা সম্ভব না।
প্রাপ্তিরও সামনে এসএসসি পরীক্ষা।যেখানে মনোযোগ দিয়ে পড়ার কথা সেখানে কোনো ভাবে পড়ে দিন কাটাচ্ছে।সারাক্ষণ মাথায় চিন্তা থাকে কখন আয়ান আসবে? আয়ান আসলে মা কি করবে কে জানে!
পরেরদিন সকালবেলা স্কুলে যাবার পথে আয়ানকে দেখে দৌড়ে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে করুন চোখে তাকিয়ে আছে।
-আয়ান প্রাপ্তির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে,চেহারাটার কি অবস্থা বানিয়েছো?
-আয়ান মা তোমাকে ফেলে ছাড়বে না।আমাদের সম্পর্কটা কী তাহলে আর কখনো থাকবে না? আমি পারবো না তোমাকে ছাড়তে।তুমি ছাড়া আমার এক মূহুর্তের জন্য বেঁচে থাকা মানে জীবন্ত লাশ বেঁচে থাকা।
তুমি তো চিঠিতে বলেছিলে,আমাকে ছাড়া তোমার এক পা সামনে এগুলেই অন্ধকার হয়ে যায়।তাহলে তখন কী ভাবে থাকবে?
-প্রাপ্তি প্লিজ এইভাবে বলো না।শুনো,আমি এইখানে এসেছি তোমার মা যেনো না জানে।কাল সকালে তোমার সাথে আমার আবার দেখা হবে।তুমি রাফির কাজিনের কোচিং-এ চলে যেও।আমি সেখানেই থাকবো।
আয়ান প্রাপ্তিকে স্কুলের দিকে এগিয়ে দিয়ে চলে গেল।
পরেরদিন সকালে প্রাপ্তি কোচিং-এ আসতেই,রাফি, নিলয়কে দেখে একটু অবাক হলো।
আয়ানের কথা জিজ্ঞেস করতেই রাফি বলল, তুমি বসো আয়ান আসছে।
কিছুক্ষণ পর আয়ানের সাথে একজন হুজুর নিয়ে আসলো।প্রাপ্তি আয়ানকে ইশারা করল কে ইনি?
আয়ান মুচকি হেসে,আজ তোমার বিয়ে,ইনি কাজী সাহেব।
-আমার বিয়ে মানে?
-তুমি না আমাকে সারাজীবনের জন্য চাও? তাই তোমার মায়ের কাছে যাওয়ার আগে আমি বিয়েটা করতে চাই।তাহলে তোমাকে আর হারানোর ভয় থাকবে না।
প্রাপ্তি আয়ানের এককথায় রাজি হয়ে গেল।
কাজি সাহেব মেয়ের বয়স কম দেখে প্রথমে একটু নারাজ হলেও পরে বিয়েটা সম্পূর্ণ করলেন।
.
.
.
চলবে................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন