শেষ থেকে শুরু - পর্ব ০২ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


___আয়ান একটু ধমকিয়ে,এই মেয়ে, তুমি কথা বলছো না কেনো? আমি কী ঠিক বলছি নাকি ভুল?

প্রাপ্তির বুক ফেটে যাচ্ছে,কিন্তু আয়ানকে বুঝাতে পারছেনা আজ আয়ান কে দেখে প্রাপ্তি কতটা খুশি কতটা আনন্দ লাগছে।সে তো চেয়েছিলো আয়ান এইরকম খ্যাতি লাভ করুক।সবাই তাকে চিনবে, জানবে,এবং তার যত কষ্ট সব কিছুকে আয়ান তার অর্জন দিক দিয়ে ভুলিয়ে নিবে। 
আল্লাহ এত বছর পর কেনো আমাকে তার সামনেই নিয়ে আসতে হলো? দেশে কী আর কোনো ডাক্তার ছিল না?
আয়ান দরজার দিকে একবার তাকিয়ে আবার প্রাপ্তির দিকে তাকালো,
'বিয়ে করোনি মানে বুঝলাম না।তুমি নিজেই তো সে দিন আমাকে ফোন দিয়ে বললে তোমার বিয়ে হয়েছে,হাজবেন্ড বাহিরে থাকে। কিন্তু আজ? 

প্রাপ্তি নিজেকে একটু সামলিয়ে,আমার কোনো টেষ্ট করাতে হবে না।আর আমার ডাক্তার দেখানোর দরকার নেই।দরকার হলে আমি অন্য কাউকে দেখিয়ে নিবো।কথাটা বলে প্রাপ্তি উঠতে গিয়েও মাথাটা কেমন ঘুরতে লাগলো।সে আবার চেয়ারে বসে মাথাটা চেপে ধরে, আমার আন্টিকে ডেকে দিন প্লিজ। 

-আজও ত্যাড়ামি গেল না।
মিনু আসলো রুবিনা বেগমকে নিয়ে।আয়ান প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিয়ে রুবিনা বেগমের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে,এই টেষ্ট গুলো করে নিবেন।কাল বিকেলে আমি এসে দেখে পরে মেডিসিন লিখব।এখন জ্বরের জন্য একটা মেডিসিন দিয়েছি সেটাই চলবে।
আয়ান উঠে নিজেই আগে বেরিয়ে গেল।
পিছন পিছন প্রাপ্তিরাও বেরিয়ে এলো।আয়ান রিয়ান নামের একটা ছেলেকে কিছু বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেল।
রিয়ান প্রাপ্তিদের দিকে এগিয়ে এসে, চলুন আমার সাথে।

হুইলচেয়ারে বসে আছে নিলিমা বেগম।ড্রইংরুমেই অপেক্ষা করছে ছেলের জন্য।ছেলেটা সকালে যেতে কথা দিয়েছিল আজ সে তাড়াতাড়ি আসবে।আজ আমার জন্মদিন একসাথে কেক কাটবে বলে কথা দিয়েছিল।কিন্তু কই? সাতটা বেজে গেছে এখনো তো এলো না।কাজের মেয়ে শিরিনকে ডেকে বললো পায়েস টা নিয়ে এসে টেবিলে রাখতে।আয়ান আসলেই যেন সামনে পায়।শিরিন এই বাড়িতে আছে চার বছর থেকে।বিয়েও হয়েছে কিন্তু সংসার তাকে চাইনি বলে আয়ান আর তার মায়ের সংসারের এসে নিজেই তাদের পরিবারে একজন হয়ে আছে।এই সংসারে আরেকজন আছে সে হলো সবার আদরের আরিয়া।
শিরিন পায়েস এনে রাখতেই আয়ানের গাড়ির হর্ন শুনে, খালা' ভাইয়া মনে হয় এসে গেছে।
নিলিমা বেগম চোখের জলগুলো মুছে, আয়ান আমার কথা রেখেছে? 

আরিয়া সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামছে আর হাতে তালি বাজিয়ে বলছে,বাবা এসেছে, বাবা এসেছে।
আয়ান সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই আরিয়া ঝাপটে ধরে,বাবা এসে গেছে।
আয়ান আরিয়াকে কোলে নিয়ে,তুমি কি করে বুঝলে আমি এসেছি?
-আমি তো তোমার রুমে ছিলাম।আর তুমি এসে যখন গাড়ি থামালে আমি তো বুজে ফেলেছি আমার বাবাই এসেছে।কারণ আজ দাদীর জন্মদিন। আর বাবা তো দেরি করবেই না।
আরিয়ার কথা শুনলে চার বছর বয়স কেউই বলবে না।বলবে পাক্কা বুড়ি।আয়ান আরিয়াকে কোলে নিয়ে নিলামা বেগমের সামনে আরিয়াকে দাঁড় করিয়ে মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে,শুভ জন্মদিন মা।তারপর মায়ের কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে।

নিলিমা বেগম আয়ানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে, আরিয়াটা অনেক পাঁকা বুড়ি হয়ে গেছে।তবে অবশ্য একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। তোই যে সারাক্ষণ বাজে কথা নিয়ে চিন্তায় ডুবে থাকিস আরিয়া এখন আর তা হতে দেয় না।

আয়ান এই কথার পিঠে নিলিমা বেগকে কথা না ছুড়ে মাথা উঠিয়ে, নিলিমা বেগমের মুখের দিকে তাকালো।
-মা, প্রাপ্তি!
কথাটা শুনেই নিলিমা বেগম চোখে মুখে ভয়ের চিহ্ন ফুটিয়ে, প্রাপ্তি?
-হুম মা,প্রাপ্তি।যে আমার সব কিছু ছেড়ে চলে গেছে। সেদিন আমার অপরাধ কি ছিল মা? আমি গরীব? সেটাই? আমার মাথার উপর কোনো ছায়া ছিল না। এটাই?
নিলিমা বেগম ছেলের কথার উত্তর না দিয়ে,গম্ভীর গলায় বললো,কোথায় দেখেছিস ওকে?
-আমার রোগী। শরীরে জ্বর নিয়ে এসেছে।অনেক দিন থেকেই নাকি অসুস্থ। 

আরিয়া বাবা আর দাদী গম্ভীর হয়ে আছে দেখে,বাবা তুমি কাঁদছো কেনো? আজ না দাদীর জন্মদিন?
কেক কাটবে না?
আয়ান উঠে দাঁড়িয়ে চোখের পানিগুলো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে,মা আরিয়া ঠিক বলেছে,চলো কেক কাটি।
আয়ান নিলিমা বেগমকে কেক খাইয়ে দিয়ে,তুমি শুধু আমাদের নিয়ে কেক কাটো। সবাইকে ইনভাইট করে কেক কাটলেই ভালো হতো না?

-না আয়ান,এই সময়টা শুধু আমি তোদের নিয়ে কাটাতে চাই।আমার ছেলেকে নিয়ে।আমার নাতনিকে নিয়ে।শিরিন কে নিয়ে।আর কাউকে এইদিনটায় আমার ভালো লাগে না।
আয়ান কিছু বললো না।আরিয়াকে কোলে নিয়ে সোফায় এসে বসলো।শিরিনকে ব্যাগপত্র নামাতে দেখে,
-কিরে এই গুলো নামিয়ে এনেছিস কেনো? 
-ভাইয়া,তুমিতো আজকে দশটার সময় চলে যাবা তাই আমি নিয়ে এসেছি।শুধু শুধু তোমার কষ্ট করে নামাতে হবে না।
-কিন্তু শিরিন, আমি তো যাচ্ছিনা।
শিরিন মুখে হাসি ফুটিয়ে, সত্যি তুমি যাচ্ছ না? কিন্তু তাহলে এইগুলো গুছিয়ে রাখলে কেনো? 
-হুম, কিন্তু এখন আর যাচ্ছিনা।কয়েকদিন পরেই যাব।কথাটা বলে আয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে,যাকে এতোটা বছর পর কাছে পেয়েছি তাকে আরেকটা বার না দেখে চলে যাব? এতোটা বছর ওই একটা নাম বুকে নিয়ে কাটিয়েছি।আর সেই মানুষটা আজ আমার সামনে এসেছে।বৃষ্টি এখনো হয় প্রাপ্তি কিন্তু তুমি ফিরে আসো না।
কথাটা বলে শিরিনের কোলে আরিয়াকে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো আয়ান।

-কিরে,খাসনা কেনো? ভাতের চেহারা দেখলে পেট পুরাবে না।নে খেয়ে নে।
প্রাপ্তি রুবিনা বেগমের কথা শুনে,চমকে উঠে,হ্যাঁ খাচ্ছি তো।
-কি হয়েছে তোর? প্রাপ্তির পাশে এসে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রেখে,ওই ডাক্তারকে চিনিস তুই?

প্রাপ্তি অনিবার্য একটা হাসি দিয়ে, ওহ্ আন্টি? আমি ওই ডাক্তারকে চিনবো কিভাবে? আমি ফাস্ট টাইম গেছি। আর হ্যাঁ তুমিও তো ফাস্ট টাইম আমাকে নিয়ে গেছো তাই না?

রুবিনা বেগম কিছু বললেন না।
প্রাপ্তি অর্ধেক ভাত খেয়েই হাত ধুয়ে উঠে চলে এলো।
প্রাপ্তির চোখের উপর ভাসছে সেই দিনের ঘটনা।আয়ানের চোখে মুখে ছিল প্রাপ্তিকে দেখার বিশাল এক নেশা।মনে হচ্ছে একটা বার দেখলেই সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে সে।কিন্তু আড়ালে থাকা প্রাপ্তি আয়ানকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে আর কান্নায় নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করছে।পারছেনা একটা বার সামনে গিয়ে বলতে,আয়ান তুমি যেওনা।আমি আছি। আমি থাকবো।তোমাকে ছাড়া আমার প্রতিটি সেকেন্ড অচল।
কথাগুলো ভাবতেই চোখ ভেজে যায়।চোখেরই বা দোষ কি? সেতো তার গতিতেই চলে।কথায় আছে না আমার খেয়ে আমার পরে অন্যের হয়ে কথা শুনে।
প্রাপ্তির মনে হয় শরীরের দুইটা অংশ নিজের করা যায় না।চোখ আর মন।যতই বুঝাকনা কেনো তারা নিজের মতই চলবে।

আয়ানের আরেকটা নির্ঘুম রাত কাটলো।সকাল বেলা উঠেই আরিয়ার রুমে গেল।দাদীর সাথে ঘুমায় সে।মাঝে মাঝে আয়ানের সাথে।অবশ্য সে চায় আয়ানের সাথেই ঘুমাতে। কিন্তু আয়ান নিলামা বেগমকেই তার অভ্যস্ত করতে চায়।আয়ানের বেশির ভাগ সময় বাড়িতে থাকা হয় না।
আরিয়ার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে উঠে যেতেই, আয়ান হাত ধরে আছে আরিয়া।আয়ান পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে, খিলখিল করে হাসছে সে।আয়ান আবার তার পাশে বসে,শুভ সকল আরিয়া।

-শুভ সকাল বাবাই। 
আরিয়া উঠে বসতে বসতে,কিন্তু বাবাই দাদী কোথায়? আমার পাশে না ছিল?

-তোমার দাদী নামাজ আদায় করে ।এখন চলো ফ্রেশ হয়ে রেডি হবে।বাবাই আবার হসপিটাল যেতে হবে।চলো,চলো।

আরিয়া খাট থেকে নামতে নামতে,আচ্ছা বাবাই তুমি যখন বাড়িতে থাকো তখন রোজ সকালে আমার কপালে ভালোবাসা এঁকে দাও।কিন্তু যখন বাহিরে থাকো তখন কি করো?
কথাটা বলেই খিলখিল করে হাসছে আরিয়া।
কিন্তু আয়ান গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
আরিয়াকে শিরিনের কাছে যেতে বলে,নিজে রুমে চলে গেল।
মাঝে মাঝে আরিয়ার প্রশ্নগুলোর আনসার তার জানা নেই।তবে মেয়েটাকে পেয়ে যে সে সব ভুলে গেছে এটাই হচ্ছে বড় কথা।কিন্তু সে ভুলে থাকতে পারিনি বেশি দিন।কাল প্রাপ্তিকে দেখার পর তার অতীত আবার সামনে এসে নাড়া দিয়েছে।আয়ান রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই চিৎকারের শব্দ কানে ভেসে আসতে লাগলো।সে মাথা ডানে-বামে নাড়িয়ে, নাহ্ আরিয়াকে গিয়ে সামলাতে হবে।তড়িঘড়ি রেডি হয়ে আয়ান নিচে এসে ডাইনিং টেবিলের সামনে এগুতেই, আরিয়া চায়ের কাপ ছুড়ে ফেলতেই আয়ানের পায়ে এসে পড়ে।গরম চা আয়ানের পায়ে পড়তেই লাল হয়ে যায়,সাথে কাপ ভাঙা কাচটা আয়ানের পায়ে গিয়ে লাগে।
- উঁহু,আরিয়া!
শিরিন আয়নের এই অবস্থা দেখে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। আরিয়ারও নজর পড়তে,বাবাই তোমার পা,,,,

-শিরিন, আয়ানকে নিয়ে বসা।কতো করে বললাম খেয়ে নিতে শান্ত ভাবে তানা,,এখন দেখেছো তোমার রাগের কারণে তোমার বাবার পায়ের কি অবস্থা হয়েছে?
শিরিন আয়ানের দিকে এগুতেই আয়ান বললো, সে নিজেই গিয়েই বসতে পারবে।
-শিরিন ঠান্ডা পানি নিয়ে এসো।আর মেডিসিন বক্সটাও নিয়ে এসো।
আয়ান শিরিনকে কথাটা বলে আরিয়ার দিকে তাকিয়ে, কী হয়েছে? রাগ করেছ কেনো?

-বাবাই আমি ফুফিকে কত করে বললাম,কত করে বললাম আমি বাবার হাতে খাব, বাবার হাতে খাব কিন্তু আমার কথা শুনেই না।

আয়ান আর কিছু বলল না।কিন্তু নিলিমা বেগম গম্ভীর হয়ে বলল,আমার ছেলেটার তো আর কোনো কাজ নাই, সারাদিন তোকে নিয়েই পড়ে থাকবে।

আরিয়া চিৎকার দিয়ে,হ্যাঁ আমাকে নিয়েই থাকবে।আমার বাবা আমাকে নিয়ে থাকবে।
কথাটা বলেই দৌড়ে এসে আয়ানের গলায় জড়িয়ে ধরলো।
.
.
.
চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন