শেষ থেকে শুরু - পর্ব ১৮ - রাবেয়া সুলতানা - ধারাবাহিক গল্প


___নয়না এখন আর বাড়িতে থাকে না। নিজের বাবার কথায় প্রতিদিন অপমানিত হতে তার ভালোলাগে না। তাই নিজেই আলাদা বাসা নিয়েছে ঢাকার বাহিরে। তবে আশেক মাহমুদের এইটা মাথায় আসে না। মেয়েটাকে যাই বলি না কেনো কখনো বাড়ি ছেড়ে যায় না। নিশ্চিত এমন কোনো পাপ কাজে জড়িয়েছে আবার।

এই মেয়েটা আমায় কখনো শান্তিতে দুনিয়ায় ছাড়তে দিবে না। তবে না! আমায় খবর নিয়ে দেখতে হবে।

কথাটা মনে মনে ভেবেই চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিলেন।

আরিয়া স্কুল থেকে আসতেই শিরিন গোসল করিয়ে খাওয়াতে বসালো। ড্রইংরুমের দেওয়ালে থাকা প্রাপ্তি আর আয়ানের ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে, আচ্ছা ফুফি মা বাবাই আর কখনো আসবে না? কথাটা আরিয়া বলতেই শিরিন হাতের কাজটা রেখে আরিয়ার পাশে এসে বসে, আসবে মা।

- কখন আসবে?

- তাতো জানি না মা। কিন্তু আমার বিশ্বাস তোমার বাবাই আর মা একদিন ঠিক ফিরে আসবে। দুটো মানুষ যদি মারাই যেতো তাহলে একটা লাশ অন্তত কেউ না কেউ পেত। হাওয়ায় তো আর মানুষ উড়তে পারে না। নিশ্চয়ই তোমার বাবাই আর মায়ের সাথে খারাপ কিছু হয়েছে। কেউ হয়তো দূর থেকে এই পরিবারকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করার ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রাখার ফন্দি আঁটেছিল।

কিন্তু আয়ান ভাইয়া কী আগে থেকে কিছুই টের পায়নি? কথাটা ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস ফেললো শিরিন।

নিলিমা বেগমের শরীর যেন আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়ছে দিনদিন।

এই কয়েকটা দিন আয়ান নিজেকে অনেক বুঝিয়েছে। অনেক ভেবেছে। তার মাথায় একটা কথায় ঘুর ঘুর করছে নয়না কী তারপর কোনো কারণে প্রতিশোধ নিলো নাতো? সত্যিই কী নয়না কিছু ঘটিয়েছে?

আয়ান ভেবেও ভাবনার মিল খুঁজে পায় না। রাতে অন্ধকারে ছাদে বসে নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন খুঁজে বেড়াচ্ছে সে।

আরমিন ফোন করে অবশ্য আমাকে একটা অফার করেছে। সেটা হলো, সে যে হসপিটাল আছে সেখানে আমাকেও যোগ দিতে বলছে। কিন্তু আমার তো মন সায় দিচ্ছে না। আমি জানি আরমিন কেন আমায় এইকথা বলেছে। কিন্তু আরমিন তুমি হয়তো এইটা জানো না। আমার অতীত ভুলে যাওয়া আমার সম্ভব নয়। পাশ থেকে আলো ভেসে আসতেই আয়ান তাকিয়ে দেখে আশরাফুল ইসলাম তার কাছেই আসছে।

আয়ান তাকিয়ে আছে, আশরাফুল ইসলাম পাশে বসে,

- বাড়ির কথা মনে পড়ছে বাবা?

আয়ান মুচকি হাসলো। আশরাফুল ইসলাম আবার বললেন, তোমাকে একটা কথা বলবো বলে বলাও হচ্ছে না। তুমি কীভাবে কথাটা নিবে আমি জানি না।

- আপনাদের কাছে আমার অনেক ঋণ। সেটা যদি শোধবোধ করার উপায় থাকে তাহলে বলতে পারেন।

আশরাফুল ইসলাম আচমকাই আয়ানের হাত দুটো জড়িয়ে, এক বাবা তোমার কাছে ভিক্ষা চাইতে আসছে বাবা। তুমি তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিওনা।

আয়ান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। তারপর নিজেকে একটু সংযত করে, আপনি কী বলবেন আঙ্কেল? আপনাকে দেওয়ার মতো আমার কিছুই নেই। কারণ আমি যে আমার পরিবারের কাছে মৃত। হয়তো এতোদিনে আনাচেকানাচে কথাটা ছড়িয়েও পড়েছে। এখন আপনিই বলুন আমার কাছে কিছু দেবার মতো আছে?

- আছে বাবা আছে!

কথাটা শুনে আয়ান একটু অবাক হলো। তারপর বললো কী আছে?

- তুমি! আমার মেয়েটাকে বিয়ে করবে তুমি? এক অসহায় বাবা তার মেয়ের জন্য তোমাকে ভিক্ষা চাইছে।

আয়ান কথাটা শুনে, হা হা হা হাসতে হাসতে মাথা নাড়িয়ে স্থির হয়ে, আপনার মেয়ে কী আমার কাছে শান্তিতে থাকবে? থাকবে না। কারণ আমার সবটা জুড়ে যে মানুষের বসবাস, সে মানুষটা সত্যি আমাকে এই দয়ামায়াহীন পৃথিবীতে একা রেখে চলে গেছে কিনা আমি জানি না। আপনার মেয়ে আমাকে বিয়ে করলে কিছুই পাবে না। না পাবে স্বামীর অধিকার না পাবে ভালোবাসা। তাহলে জেনে শুনে আপনি আপনার মেয়েটার জীবন নষ্ট করতে চাইছেন কেনো?

আমি কিছুদিন পর ফিরে যাবো বাংলাদেশে। আমার মেয়ের জন্মদিন সামনে। আমি সেদিনই চলে যাচ্ছি। আমি চাই না আমাকে ছাড়া আমার মেয়ের জন্মদিনে সে মন খারাপ করে বসে থাকুক।

কথাটা শুনে আশরাফুল ইসলাম বললেন, তোমার মেয়ে আছে?

- জ্বি।

- বুঝলাম। আচ্ছা তোমার মেয়ের মা হয়ার জন্যও তো একজন লাগে তাই না? তাহলে তোমার মেয়ের মা হয়েই!

আয়ান হাত উঠিয়ে আশরাফুল ইসলামকে থামিয়ে, একজন ওর মা হতেই আমার পরিবারে এসেছিলো। কিন্তু সে হারিয়ে গেছে। আমার মেয়েটা রক্তমাংসের গড়া একটা নিষ্পাপ প্রাণ। তাকে এইভাবে কষ্ট দেওয়ার অধিকার আমার নেই। কথাটা বলেই আয়ান ছাদ থেকে নেমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই দেখে আরমিন দাঁড়িয়ে আছে। আয়ান নিশ্চুপ হয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

আরমিন এসে আশরাফুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে, স্যরি আব্বু। আমার জন্য তোমাকে ওর কাছে এতো অপমান আর লাঞ্চিত হতে হয়েছে। আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ।

আশরাফুল ইসলাম আরমিনের চোখের পানি মুছে দিয়ে, পাগলি মেয়ে কান্নার কী আছে? আমরা আবার চেষ্টা করবো। তুই ছেলেটাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছিস তাই নারে মা?

আরমিন আশরাফুল ইসলামের কথার জবাব না দিয়ে অন্ধকারে মিশতে চাইছে। চাইছে আকাশে চাঁদের সাথে একা একা সময় কাটাতে। আশরাফুল ইসলাম বুঝতে পেরে মেয়েকে ছাদে একা রেখেই চলে আসলেন।

অন্ধকারের আড়ালে নিজের তীব্র কান্নায় ভাসিয়ে দিচ্ছে নিজেকে।

আরিয়ার জন্মদিন, কিন্তু বাড়িতে তেমন কোনো আনন্দের রেখা নেই। পুরোটা বাড়ি যেন নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে। শিরিন সকালে উঠে পায়েস বানিয়ে এনে নিলিমা বেগমের হাতে দিলেন আরিয়াকে খাওয়ানোর জন্য। এরমধ্যেই রাফি আর সুমনা এসেছে আরিয়াকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য। রাফি আরিয়াকে কোলে নিয়ে সুমনাকে বললো সাথে করে নিয়ে আসা অনেকগুলো চকলেট আর খেলনাগুলো বের করে দিতে।

আরিয়া এতো এতো খেলনা দেখেও মুখে হাসি ফুটলো না। নিলিমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিরিন কে বললো রুমে দিয়ে আসতে। আরিয়া রাফি আর সুমনার সাথে কিছুক্ষণ একা সময় কাটাক। শিরিন নিলিমা বেগমকে নিয়ে রুমের কাছাকাছি যেতেই, মা!

শব্দটা শুনেই নিলিমা বেগম শিরিনের হাত ধরে থামিয়ে তড়িৎ ভাবে ঘাড় ঘুরে পিছনে ফিরে তাকালো। সাথে রাফি সুমনাও।

আরিয়া তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে, বাবাই!

রাফির কোল থেকে নেমে, দৌড়ে আয়ানকে জাপটে ধরে, বাবাই তুমি কোথায় ছিলে আমাদের ছেড়ে? ও বাবাই কথা বলছো না কেনো?

আয়ান আরিয়াকে কোলে নিয়ে অনেকগুলো চুমু দিয়ে, বাবাই অনেক দূরে ছিলাম মামণি। অনেক দূরে।

নিলিমা বেগম তাকিয়ে আছে পলকহীন চোখে। আয়ান নিলিমা বেগম কে সালাম করে পায়ের কাছে বসলো।

নিলিমা বেগম হাত বাড়িয়ে মুখের সামনে আলতো করে স্পর্শ করে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।

আয়ান নিলিমা বেগমকে ঝাপটে ধরে, মা তোমার ছেলে ফিরে এসেছে মা! তোমার আয়ান ফিরে এসেছে।

- আমি জানতাম বাবা, আল্লাহ আমার প্রতি এতো বড় অবিচার করবে না। তুই ছাড়া এই দুনিয়াতে যে আমার কেউ নেইরে। তাই আল্লাহ দয়া করে তোকে ফিরিয়ে দিয়েছে।

রাফি এসে আয়ানকে জড়িয়ে ধরলো। মিজান সাহেবও চোখ মুছতে মুছতে এসে আয়ানকে জড়িয়ে ধরছে। এইরকম দৃশ্য যেন বিরল। আরমিন সবকিছু দেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। আল্লাহর কাছে সে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলো, আল্লাহ তাকে এমন একটা দিন দেখার সৌভাগ্য করে দিয়েছেন।

নিলিমা বেগম নিজেকে কিছুটা সামলিয়ে, আরমিনের দিকে চোখ পড়তেই, আয়ান, মেয়েটা কে?

আয়ান চোখ মুছে আরমিনকে এগিয়ে আসতে বলে, মা ও আরমিন। তোমাদের পরে সব বলবো।

- কিন্তু আয়ান, আমার মেয়ে? আমার মেয়েটা কী আর ফিরে আসবে না?

আয়ান নিলিমা বেগমের পাশে গিয়ে বসে, আসবে মা। আমার বিশ্বাস তোমার মেয়ে আমাদের একা রেখে যেতে পারেনা। তোমার ভালোবাসা, আমার ভালোবাসা, আরিয়ার মাতৃত্বের বোধ থেকে সে ফিরে আসবে।

আয়ান ফিরে এসেছে খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। সাংবাদিক থেকে গণমাধ্যমে সব জাগায় একটাই খবর বিখ্যাত ডাক্তার আয়ান মাহমুদ ফিরে এসেছে।

খবরটা টিভিতে দেখেই পারভীন বেগম আর মাহবুব ছুটে এসেছে আয়ানের বাড়িতে।

আয়ানের সাথে আরমিনকে ভালো চোখে না দেখলেও খারাপ কিছুও বলেনি। আয়ান আশ্বাস দিয়েছে যেই করে হোক প্রাপ্তির খবর সে বের করবে।

আরিয়া আস্তে আস্তে আরমিনের সাথে একটু একটু করে মিশতে লাগলো। আরমিনও চায় আরিয়া তাকে মা বলে ডাকুক। আরমিন নিলিমা বেগমের কাছে আয়ান আর প্রাপ্তির অনেক গল্প শুনেছে। একটা মেয়ে কতটা ভালোবাসতে পারে তার স্বামীকে এইটা এখানে না আসলে আরমিন জানতেই পারতো না। নিলিমা বেগমের কাছে আরমিন জানতে পেরেছে প্রাপ্তি এসএসসি পাশ করে আর পড়ালেখা করেনি। নিলিমা বেগম আর আয়ানের মুখ থেকে যা শুনেছে আরমিন পুরোই অবাক। আসলে আমরা উচ্চশিক্ষায় নিজেকে গড়তে গিয়ে পরিবারের কাছ থেকেই বিছিন্ন হয়ে পড়ি। একটা মেয়ে চাইলে কি না করতে পারে তা প্রাপ্তির অতীত না জানলে জানতেই পারতাম না। আয়ানের বাড়িতে আনাচে কানাচে সবখানে যেন প্রাপ্তি মিশে আছে। প্রাপ্তির হাতে গড়ানো সংসার আরমিনের ভালোই লাগেছে।

আয়ান কয়েকদিন বাড়িতে কাটিয়ে আজ হসপিটালে যাবে সেই জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আরমিন আয়ানের রুমে এসে, আপনি হসপিটাল যাচ্ছেন?

- হু।

- কখন আসবেন?

- রাতে ছাড়া ফিরা হবে না। কারণ বুঝতেই পারছেন অনেক দিন পর যাচ্ছি। সবকিছুই এলোমেলো হয়ে আছে হয়তো।

- হুম। তবুও তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন।

কথাটা অনেক দিন পর শুনেছে আয়ান। বারবার যেন প্রতিধ্বনি হতে লাগলো কানে। কিন্তু আরমিনকে কিছু না বলে নিজের চোখ দুটোকে লুকিয়ে নিয়ে গেল।

হসপিটালের সব রোগীকে আয়ান একবার দেখে রাফির সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে রাফিকে নিয়ে যেখানে এক্সিডেন্ট হয়েছে সেখানে গেল।

- আচ্ছা রাফি তুই বলছিস পুলিশ এখান থেকে গাড়িটা উদ্ধার করেছে। গাড়িতে আমি বা প্রাপ্তি কাউকেই পুলিশ পায়নি। আমাকে না হয় আরমিন পেয়েছে, কিন্তু প্রাপ্তি? তাকে তো পায়নি।

তবে আমি একটা জিনিস ভেবে পাই না। সেদিন গ্রামে যাবো কারো কাছে বলে যাইনি। তাহলে কে করতে পারে এমন কাজ?

- আয়ান, হয়তো এমন কেউ আছে যাকে তুই চিনিস জানিস। কারণ, কাছের লোক ছাড়া এমন কাজ কেউ করতে পারে না।

- ঠিক বলছিস আমরা যা দেখি তার বাহিরেও অনেক কিছু দেখার আছে, বুঝার আছে।

তবে আমি ভাবছি অন্য কথা, আমাকে যদি এখন থেকে নদীর ধারে নিয়ে যেতে পারে তাহলে প্রাপ্তিকেও নেওয়া অসম্ভব কিছু না। রাফি আমাদের এমন কাউকে খুঁজে বের করতে হবে যে এক্সিডেন্ট হওয়ার সময় দেখেছে এবং শেষ অবধি ছিলো।

- তুই এমন কাউকে পাবি কোথায়?

- সব সম্ভব। তুই এককাজ কর, আশেপাশে বাড়ি দোকান সব খোঁজ নিয়ে দেখ এবং কথা বল। এমন কেউ তো আছে যে এক্সিডেন্ট হওয়ার সময় দেখেছে।
.
.
.
 চলবে..................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন