মানিয়ে নেওয়া - ইশরাত জাহান সুপ্তি - অনু গল্প


মানিয়ে নেওয়া 
ইশরাত জাহান সুপ্তি 



'আমার মনে হয় আমি এখনো বিয়ের জন্য প্রস্তুত হই নি।'

হবু বউয়ের মুখে এই কথা শুনে আমি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই।আমি আকাশ।প্রাইভেট কোম্পানির একটি ভালো পোস্ট এ জব করি। বাবা মার জোরাজুরিতে তাদের পছন্দ করা এই মেয়েকেই আমি দেখতে যাই।মেয়ের নাম নিতু।অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী।মেয়েকে দেখার পর পছন্দ না হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাই নি।সম্মতি পাওয়ার পর আমার একমাত্র মা সময় নষ্ট না করে হাতের আংটি খানা খুলে মেয়ের হাতে পরিয়ে দেয়।আর ফিরে আসার সময় আমার বেস্টু ফাহাদ একটা এভারেস্ট জয় করা হাসি দিয়ে আমার হাতে মেয়ের ফোন নাম্বার গুঁজে দেয়।
আর সেই নাম্বার থেকেই এইমাত্র এই কথাটি ভেসে আসল।
ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা সামলিয়ে আমি বললাম,'মানে?'

মেয়েটি বলল,
'মানে হল আমি হয়তো এখনও বিয়ের জন্য তৈরি না।কারণ এখনও আমি মাছের লেজটা খাওয়া শিখি নি।কলেজ আর রান্নাঘর একসাথে সামলানো শিখি নি।এখনও সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই মায়ের হাতের পরোটা মুখে দিয়ে কলেজের জন্য বেড়িয়ে পড়ি।বিয়ে করার আগে নিজেকে প্রথম শ্বশুরবাড়ির রাধুঁনী হিসেবে তৈরি তো করে নেই!
জানেন! এখনও রোজার মাসে সেহরির সময় ঘুম ঘুম চোখে ঢুলতে ঢুলতে সবার শেষে গিয়ে টেবিলে বসি। যেখানে বিয়ের পর সবার আগে উঠে সবার জন্য সব আমাকেই তৈরি করতে হবে।এখনো একটু শরীর খারাপ লাগলে সারাদিন বিছানায় পরে থেকে বাবা মার আদরের ছায়ায় জড়িয়ে থাকি।যেখানে শ্বশুরবাড়ি যতই যা হোক,প্রতিদিন দায়িত্বের চাকায় ঘুরতেই হবে।এখনও প্রতিরাতে মাথায় মায়ের হাতের তেল মালিশ ছাড়া ঘুমই আসে না।যেখানে বিয়ের পরে নিজেকে ভুলে শ্বশুর বাড়ির সবার মন বোঝে চলাটাই হতে হবে প্রধান ধর্ম।এখনও মুখে নকল হাসি আনাটাই শিখতে পারি নি।কিন্তু বিয়ের পর যে ভালো না থেকেও ভালো আছি বলাটা পারতেই হবে।বিয়ের আগে,নিজেকে প্রথমে খোটা শোনার জন্য প্রস্তুত তো করে নেই।এখনকার মত না আবার মুখ ফসকে কিছু বলে ফেলি।
হেঁটে চলা থেকে শুরু করে বেঁচে থাকাটাও যে বাবা মা শিখিয়ে দিল বিয়ের পর সেই বাবা মাই যে আমায় কিছুই শিখায় নি কথাটা শোনার জন্য আগে নিজেকে শক্ত তো বানাতে হবে নাকি?কারণ মুখ বুজে সব সহ্য করাটাই তো আদর্শ বউয়ের 
গুণ।এখনই কি করে বিয়ে করি বলেন তো?
আমি তো এখনও নিজেকে ভুলতেই শিখলাম না।এখনও যে ছোটো ছোটো স্বপ্নে বিভোর বাবার রাজকুমারীটা আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে।আগে থেকে যদি প্রস্তুত না থাকি তবে যে দায়িত্বের ভারে যখন হঠাৎ করে আকাশ থেকে মাটিতে পরে যাব তখন নিজেকে সামলাবো কি করে বলেন?'

মেয়েটি খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথাগুলো বলল।কিন্তু আমি যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলাম এতগুলো তেতো বাস্তবতা একসাথে শুনে।কি বলব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।শুধু মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেরোলো,
'বিয়ে মানে কি এই?'

মেয়েটি একটু হেসে জবাব দিল,
'হ্যাঁ,মেয়েদের জন্য এই।বিয়ের জন্য মেয়েদের প্রস্তুত হতে হয়,আত্মসম্মানকে পঙ্গু করে,ন্যায়-অন্যায়বোধকে অসাঢ় করে দিয়ে।আর এটা কিন্তু আমার কথা না বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কথা।'

আমার গলা দিয়ে আবারো কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বেরোলো,
'তাহলে এখন?'

মেয়েটি বলল,'এখন দেখি কি করা যায়!'

মেয়েটি সম্ভবত কিছুই করতে পারে নি।কারন আমার সাথে তার বিয়েটা হয়েই যায়।

আজ আমাদের একমাত্র মেয়ের জন্মদিন।দেখতে দেখতে আমাদের মামুনিটার তিন বছর হয়ে গেল।বাসায় একটি ছোটখাটো আয়োজন করা হয়েছে।তখন থেকে ঘড়ি টা খুঁজে যাচ্ছি কিন্তু পাচ্ছি না।তাই নিতু কে ডাকতে গিয়ে হঠাৎ থমকে যাই ভেতরের কথা শুনে।নিতুর এক খালাতো ভাবি তাকে সেই বিয়েতেই দেখে ছিলাম।অাজ মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে তাকে নিতু দাওয়াত দিয়েছে।সেই ভাবিই নিতুকে জিগ্যেস করছে,

'কিরে নিতু,শ্বশুর বাড়িতে ঠিকঠাক মত মানিয়ে নিতে পেরেছিস তো?'

নিতু হেসে জবাব দিল,
'জানি না ভাবি।মাছের লেজটা এখনও আমায় প্রতিদিন খেতে হয় না।মাঝে মাঝে সে খায় আবার মাঝে মাঝে আমি খাই।যখন আমি খাই তখন সে আমায় কাটা বেছে দেয়।যখনই সময় পায় আমাকে রান্নাঘরে সাহায্য করে।সেহরির সময় আমার সাথে সেও আগে উঠে।মাঝে মাঝে তো দেখি আমার উঠার আগেই সব রেডি।ইফতারের সময় কাজ গুলো আমার সাথে ভাগ করে নেয়।অফিস থেকে ফেরার পর তার হাতে শরবতের গ্লাস দিলে আমার হাত টা টেনে আমাকেও তার পাশে বসিয়ে অর্ধেক খাইয়ে দিয়ে বলে,'সারাদিন কাজ তো তুমিও করেছো তাহলে যত্ন শুধু আমার একার কেনো?আসো তোমার মাথায় তেল মালিশ করে দেই।'
জানো মাঝে মাঝে মাথার উকুনও মেরে দেয়।প্রতিদিন রাতে আমাদের গল্পের আসর বসে রান্নাঘরের বেসিনের সামনে,দুজনে মিলে বাসনপত্র ধোয়া মোছা করতে করতে।প্রথম প্রথম আমি বাঁধা দিতাম।কিন্তু সে কি বলত জানো,'বিয়েটা যেহেতু আমরা দুজনে করেছি আর সংসার টাও যেহেতু আমাদের দুজনের তাহলে দায়িত্বের ভারটা তুমি একা নিবে কেনো?যেখানে তোমার সব সুখের ভাগটা আমাকে দিয়েছো সেখানে তোমার কষ্টের ভাগ থেকে আমাকে বঞ্চিত কর না নিতু।নিজেকে যে বড্ড স্বার্থপর মনে হবে!'
আমাকে যদি এখানে কেউ কিছু বলে আমি চুপ করেই 
থাকি।কারণ আমাকে কিছু বলতে হয় না সে জবাব দিয়েই সবাইকে চুপ করিয়ে দেয়।তার ভয়ে আমাকে কেউ কিছু আর বলেও না।আর যদি কখনো এতটুকুও শরীর অসুস্থ হয় তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই।সারাদিন অফিস বাদ দিয়ে আমার পাশে বসে থাকবে।ওঁ একদিন আমায় কি বলে জানো?
'নিতু,আমার কাছ থেকে কখনো কোনো কিছুর জন্য তোমায় অনুমতি চাইতে হবে না।তোমার যখন যা ইচ্ছা তুমি করবে।যেখানে যেতে ইচ্ছা যাবে।শুধু কোথাও গেলে আমাকে একটু জানিয়ে দিও নাহলে যে দুশ্চিন্তা হবে।'
আমার মুখে কখনো নকল হাসি আনতে হয় নি।কারণ এখনও আমার মুখে সবসময় আসল হাসিই লেগে থাকে,আগের চেয়েও বেশি।সে আমার নিজেকে আরো বেশি চিনতে শিখিয়েছে।
আমার সব স্বপ্নগুলো খুব যত্ন করে সে পূরণ করেছে।
তাই তো বলি শ্বশুরবাড়ি মানিয়ে নেওয়া মানেটা কি সেটা আমি এখনো বুঝতে পারি নি।আমার স্বামী আমায় ভালোবাসা মানে কি সেটা বুঝিয়েছে,মানিয়ে নেওয়া মানে কি সেটা বোঝায় নি।'

নিতুর কথাগুলো শুনে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিলো
তাই তারাতারি রুমে চলে আসলাম।যেদিন আমাদের বিয়ে হলো সেদিন বিদায়ের সময় দেখেছিলাম একজন বাবাকে তার কলিজা অন্যের হাতে দিয়ে দিতে।একজন মেয়েকে তার চিরচেনা সব কিছু ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণ অচেনায় পারি দিতে।কতটা কষ্টের সেই অশ্রু!কতটা কষ্টের সেই মুহূর্ত!
যদি কোনো ছেলে সেই মুহূর্তটাকে অনুভব করতে পারে,তবে কখনো তার স্ত্রীকে মানিয়ে নিতে দেবে না।ওর চোখের পানি খুব বিঁধে ছিল এই বুকে।সেদিন নিতুর চোখের চাহনি ছিল খুবই অসহায়।শুধুমাত্র আমার ভরসাতেই তো ও ওর সবকিছু ছেড়ে
এসেছে।যদি সেই ভরসাই না রাখতে পারলাম তবে নিজেকে স্বামী হিসেবে পরিচয় দেই কি করে!
সেদিন মনে মনে ঠিক করেছিলাম,বাবার রাজকুমারী টাকে এই ছোট্ট বুকের রাণী বানাবোই।শুধুমাত্র একটি মেয়েকে বিয়ে করে তার উপর অধিকার ফলালেই স্বামী হওয়া যায় না। মেয়েটির অশ্রুকে আপন করে,তার মুখের হাসি ফোটানোরও দায়িত্ব নিতে হয়।সাথে তার সুখের পাশাপাশি দুঃখের ভাগটাও নিয়ে তবেই না স্বামী হওয়া যায়।আর অধিকার মানে শিকল নয়।
আমাদের স্ত্রীরা যেই কষ্ট সহ্য করে আমাদের অস্তিত্বকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসে,আমরা স্বামীরা তার পরিবর্তে পুরো পৃথিবীটাকে তাদের পায়ে এনে দিলেও তো তা কম হয়ে যায়!
আর সেখানে এই পাগলী মেয়েগুলো এতটুকুতেই নাকি স্বর্গসুখ পায়!

একটু পরেই নিতু রুমে এসে হাসতে হাসতে বলল,দেখোনা সবাই নিচে কি বলছে,মেয়ে নাকি দেখতে দেখতে কিভাবে বড় হয়ে যাবে তা নাকি বুঝতেও পারব না।তাই এখনই শ্বাশুড়ি হওয়ার প্রস্তুতি নিতে।কিন্তু আমি তো এখনও বিয়ের জন্যই প্রস্তুত হতে পারলাম না।'
আমি ওর নাক টেনে ভ্রু কুঁচকে বললাম,'মানে?'
নিতু বলল,'মানে আবার কি?সবসময় শুনে আসা বিয়ের পরের মানিয়ে নেওয়ার কিছুই তো হল না।তাই তো বিয়ের আগে কি শিখবো,বিয়ের পরেও মানিয়ে নেওয়া শিখতে পারলাম না।
আচ্ছা আমাদের মেয়েটা বিয়ের পরে কি করবে?'

আমি ওকে হাত দিয়ে আগলে কাছে টেনে বললাম,
'কি আবার!তোমার মতো মানিয়ে নিবে।'

নিতু আমার বুকে মাথা রেখে ঠোঁটে গভীর প্রশান্তির হাসি ফুটিয়ে বলল,হ্যাঁ!মানিয়ে নেবে,না চাইতেই পাওয়া অপরিসীম ভালোবাসায়।'



সমাপ্ত.....................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন