আরশিযুগল প্রেম
পর্ব ০৫
নৌশিন আহমেদ রোদেলা
.
.
.
মাঘের মাঝামাঝি। শীতের তান্ডব শেষ হয়ে ফাল্গুনী রঙে সাজতে প্রস্তুত প্রকৃতি। তবে ঢাকায় গ্রীষ্ম,বর্ষা,শীত ---- এই তিন ঋতু ভিন্ন অন্যকোনো ঋতু বোঝার উপায় নেই। পহেলা ফাল্গুনে বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়ে রাস্তাঘাট,পার্ক,রেস্টুরেন্টে মেয়েদের বহর না ছুটলে ফাল্গুন মাসের খোঁজটাও ঠিকঠাকভাবে জুটে না সাদাফের। বনানীর আট তলা এপার্টমেন্টের সাত তলায় বসে ফাগুনের সুবাসটাও খুব একটা পায় না সে। অফিসের এতো ঝঞ্জালের ভীরে ঋতু গুণার সময় আছে নাকি তার? তবুও বর্ষাটাকে বেশ মনে পড়ে। এই বর্ষার এক রাতেই তো ঘটে গেলো অদ্ভুত এক ঘটনা। কাজের অবসরে দু -তিন মাস অন্তর হুটহাট সেই রাতটার কথা মনে পড়ে সাদাফের। খানিকবাদে ভুলেও যায়। মাঝেমাঝে নিজের মনে হাসে আর ভাবে, তারও একটা বউ আছে। অন্ধকারে ঢাকা বউ! শীতের সকালের মিষ্টি আমেজ কাটিয়ে কম্বল ঠেলে উঠে বসলো সাদাফ। কাঁচের জানালা ভেদ করে সোনালী রোদ এসে পড়ছে মেঝেতে। চারকোণা আকারের রোদ। রোদের এই চারকোনা রূপের কারণটা ঠিক ধরতে পারলো না সাদাফ। বিছানা গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালো সে। আড়চোখে ড্রয়িংরুমের ঘড়িতেও চোখ বুলালো ---- ৭ঃ২০। তাড়াহুড়ো করে চায়ের পানি গরম দিয়ে ডিমের অমলেট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কড়াইয়ে তেলটা গরম হয়ে আসতেই কোকিলের ডাক কানে এলো। একবার,দুবার, তিনবার। কোকিলের ডাক কানে যেতেই দরজার দিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সাদাফ। দরজার কলিংবেলের আওয়াজটা শুনে মাঝে মাঝে নিজেই কনফিউজড হয়ে পড়ে সে। অবিকল সত্যিকারের কোকিল! দরজা থেকে চোখ ফিরিয়ে দক্ষ হাতে অমলেট করা শেষ করলো সে। চুলো নিভিয়ে দরজার দিকে এগোলো। দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলো আরাফ। সাদাফ দরজা খুলতেই দাঁত কেলিয়ে হাসলো সে। সাদাফ বিরক্তি নিয়ে সরে দাঁড়ালো। ব্রেকফাস্ট রেডি করতে করতে বললো,
---" কাহিনী কি? এত্তো সক্কাল সক্কাল আমার বাসায় হানা দেওয়ার একজেক্ট কারণটা কি?"
আরাফ দাঁত বের করে হাসলো। হাসার সাথে সাথেই বামদিকের অসম্ভব ত্যাড়াব্যাকা দাঁতগুলো মুহূর্তের জন্য ঝিলিক দিয়ে উঠলো। হাতে একটা পাকা টমেটো তুলে নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে বললো,
---" অফিস যাবি নাকি দোস্ত?"
সাদাফ স্থির দৃষ্টিতে তাকালো।সাদাফ যে সাড়ে আটটার মধ্যে অফিসের জন্য বেরিয়ে যায় , আরাফ তা জানে। নিশ্চয় এই কথাটা বলতে এতো সকালে বাসায় আসে নি সে? সাদাফের চাহনী দেখে খানিক হাসার চেষ্টা করলো আরাফ। তবে লাভ বিশেষ হলো না। সাদাফকে সে ভালো করে জানে, এভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলতে গেলেই ক্ষেপে যায় সে। তারপর তার হাতের সেই মাইর। উফফ! পুরাতন স্মৃতি আওড়িয়ে আসল কথা পাড়লো সে,
---" আসলে দোস্ত। আজ সন্ধ্যায় কি তুই ফ্রী?"
সাদাফ ভ্রু নাচিয়ে বললো,
---" কেন বল তো?"
---" না মানে। আম্মা আসছে।"
সাদাফ ভ্রু কুঁচকে বললো,
---" তোর মা আসছে তো আমি কি করতাম?"
আরাফ ইতস্তত গলায় বললো,
---" না মানে। মেয়ে দেখতে যাবো।"
সাদাফ বাঁকা হেসে বললো,
---" বিয়ে করবি নাকি মামু?"
আরাফ লাজুক হাসি দিয়ে বললো,
---" বিয়ার বয়স হইছে না? এখনও বিয়ে না করলে তো ঝামেলা। তুমি তো মামা বিয়ের নামটাও মুখে নেও না। তোমারে ফলো করতে গেলে তো নির্ঘাত চিরকুমার থাকা লাগবো দোস্ত।"
সাদাফ মৃদু হাসলো। চেয়ার টেনে বসে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিতে নিতে বললো,
---"বেশ তো, কর বিয়ে।"
তাড়াহুড়ো করে সাদাফের মুখোমুখি বসলো আরাফ। মুখ কালো করে বললো,
---" বিয়ে কর বললেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না। বিয়ে করতে হলে আগে মেয়ে দেখতে হয়, পছন্দ করতে হয় তারপর না বিয়ে। আমি কিছু জানি না তুই আমার সাথে মেয়ে দেখতে যাচ্ছিস, ব্যস। বুঝিসই তো দোস্ত, ফার্স্ট টাইম! মেয়ের সামনে গিয়ে নার্ভাস হয়ে গেলে ঝামেলা না?"
সাদাফ ভ্রু কুঁচকে বললো,
---" বাসর ঘরেও তো ফার্স্ট টাইমই যাবি তখন নার্ভাস লাগবে না? নাকি তখনও সাথে নিবি আমায়?"
আরাফ আমতাআমতা করে বললো,
---" পেঁচাও কেন দোস্ত? তুমি আমার জন্য এইটুকু করতে পারবা না? তোর জন্য সারাটা জীবন কতো কিছু করছি আমি। আর আজ..."
সাদাফ কপাল কুঁচকে বললো,
---" হইছে আর সেন্টি খায়ও না, মামা। তুমি আমার জন্য বহুত করছো। আমারে বিপদের মধ্যে ফেলে নাক ডেকে ঘুমাইছো তা কি ভুলে গেছি আমি? কেয়ারলেস!"
আরাফ অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। মুখটা ছোট করে বললো,
---" ওমন করোছ কেন? সেইদিন এলার্জির টেবলেট খেয়েছিলাম বলেই না ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নয়তো তোরে বিপদে রেখে কি আমি ঘুমিয়ে পারতে পারি, বল?তাছাড়া সেই ৭/৮ মাস আগের কথা এখন কেন টানছিস বল তো?"
সাদাফ জবাব দিলো না। ব্রেকফাস্ট শেষ করে রুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
---" অফিসে কাজের চাপ। ফিরতে ফিরতে দশটা বেজে যাবে।"
সাদাফের পেছনে হাঁটতে হাঁটতে নাছোড়বান্দা গলায় বলে উঠলো আরাফ,
---"প্লিজ দোস্ত। চল না। একটু ম্যানেজ কর। দোস্ত..."
সাদাফ বিরক্ত গলায় বললো,
---" তুই ভালো করেই জানিস মেয়ে দেখা বিষয়টা একদমই পছন্দ নয় আমার। তারপরও জোর করছিস কেন, বল তো?"
আরাফ বাচ্চাদের মতো মুখ করে বললো,
---" তোর জন্য তো আর দেখতে যাচ্ছিস না। যাচ্ছিস তো আমার জন্য..."
সাদাফ অফিসের শার্ট গায়ে জড়াতে জড়াতে বললো,
---" পারবো না।"
---" আম্মাও তোকে সাথে নিতে বলছে সাদাফ। আম্মা তোরে ছাড়া যাবে না দেখিস।"
সাদাফ টাইয়ের নাট বাঁধতে বাঁধতে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললো। ডানহাতের কব্জিতে বড় ডায়ালের ঘড়িটা পড়তে গিয়ে বললো,
---" মেয়ের বাড়ি কই? কয়টাই যেতে হবে?"
আরাফ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
---" বেশি দূর না তো...এইযে উত্তরা মডেল টাউনের পাশেই বাসা। সাতটা নাগাদ গেলেই চলবে। ডিনারের দাওয়াত দিয়েছে ওরা।"
সাদাফ অদ্ভুত চোখে তাকালো। বিস্মিত গলায় বললো,
---" উত্তরা? বনানী থেকে উত্তরা খুব কাছে মনে হচ্ছে তোর? ডাফার একটা।"
আরাফ বোকা হাসি হাসলো। জানালার কাঁচ ভেদ করে আসা রোদে আবারও ঝিলিক দিয়ে উঠলো তার বাঁকা দাঁত।
____________________
কলিংবেলের প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো শেফার। ঘুমুঘুমু চোখটা কয়েকবার পিটপিট করে আবারও উপুর হয়ে শুয়ে পড়লো সে। খানিকবাদে আবারও সেই বিরক্তিকর শব্দ। শেফা বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে বিছানায় উঠে বসলো। গায়ের টি-শার্টটা টেনে ঠিক করে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো সে। এলোমেলো চুলগুলোকে হাতখোপা করতে করতে দরজার ফুটোই চোখ রাখলো। ফুটো থেকে চোখ সরিয়েই তাড়াহুড়ো করে দরজা খুললো শেফা। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ২০/২১ বছরের তরুনী। গায়ে লেমন কালারের টপস আর ব্ল্যাক স্কার্ট। গলায় ঝুলছে বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রনে তৈরি পাতলা ওড়না। গায়ে জড়ানো কালো রঙের শাল। মেয়েটাকে দেখেই উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠলো শেফা। দু'হাতে শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
---" হোয়াট আ প্রেজেন্ট সারপ্রাইজ শুভ্রতা। তুই হঠাৎ?"
শুভ্রতা মৃদু হেসে বললো,
---" উফফ্ আপু। মেরে ফেলবে নাকি? ছাড়ো তো।"
শেফা শুভ্রতাকে ছেড়ে সরে দাঁড়াতেই ভেতরে ঢুকলো শুভ্রতা। কাঁধের ব্যাগটা সোফায় রাখতে রাখতে বললো,
---" খালামনি কই আপু?"
শেফা সোফায় পা তুলে আরাম করে বসলো। শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো,
---" মা তো ছোট ফুপির বাসায় গেছে। দুপুরের দিকেই চলে আসবে। ছোট খালামনি কেমন আছে রে?"
শুভ্রতা গায়ের শালটা খুলে রাখতে রাখতে বললো,
---" সবাই ভালো আছে। আগে বলো ব্রেকফাস্টে কি আছে। প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে, আপু । না খেয়েই বেরিয়ে এসেছি, বুঝলে?তাড়াতাড়ি খেতে দাও তো... "
শেফা সন্দেহী চোখে তাকালো। আগ্রহ নিয়ে বললো,
---" না খেয়ে বেরিয়ে এসেছিস মানে? পালিয়ে এসেছিস নাকি?"
শুভ্রতা কঠিন চোখে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে বললো,
---" পালাবো কেন? আর পালালে ঢাকার বাইরে না গিয়ে ধানমন্ডি থেকে উত্তরায় কেন আসবো? তাও আবার বড় খালামনির কাছে? পাগল?"
শেফা হেসে বললো,
---" তোর তো পালিয়ে বেড়ানোর ধাঁচ আছে, তাই বললাম। বিয়ে করবি না বলে এতো দৌড়াদৌড়ির কি আছে? এর থেকে একটা ছেলে পছন্দ করে বিয়ে করে ফেললেও তো পারিস। ছোট খালু যেমন মানুষ তোকে কিচ্ছুটি বলবে না।"
শুভ্রতা প্রতিউত্তরে নিশ্চুপ বসে রইলো। শেফা আরেকটু আরাম করে বসে সামনের দিকে সামন্য ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বললো,
---" সত্যি করে বল তো, তোর কি সত্যিই কোনো বিএফ নেই ? মানে সেইম এইজ রিলেশনশিপ টাইপ কিছু?"
শুভ্রতা মুখ বাঁকিয়ে বললো,
---" তুমি একটু বেশিই ভাবো আপু।"
শেফা হতাশ গলায় বললো,
---" তো? বারবার পালাস কেন?"
---" বারবার কোথায় আপু? সেই তো সাত/আট মাস আগে মামুর সাথে রাগারাগি করে চলে এলাম। তারপর আর কবে পালিয়েছি আমি?"
---" এরপর বিয়ের কথা হয়নি বলেই পালাস নি। নয়তো ঠিক পালাতি। ওটা নিয়ে দু'দুবার এ কান্ড করেছিস তুই। কি লাভ হয় বল তো? আমি হলে তো নেচে নেচে বিয়ে করে ফেলতাম।"
শুভ্রতা মৃদু হেসে বললো,
---" আম্মুর জন্যই তো এমনটা হয়। বাবা তো চাইছে না বিয়ে দিতে। তাহলে এতো বাড়াবাড়ি কেন? তাছাড়া, আমার ইচ্ছে পুরো বাংলাদেশ চষে বেড়ানোর। স্বাধীন চোখে সবটা দেখা। এইসব আবালদের বিয়ে করে দু'তিন বছরে দুই তিনটা বাচ্চা ফুটিয়ে চুলো গুঁতোতে বলো আমায়? কখনো নয়। নেভার।"
শেফা হেসে ফেললো। শুভ্রতাকে বেশ বোকা বলে মনে হয় তার। এতো ভালো ভালো পাত্রকে কেউ এই ঠুনকো কারণে রিজেক্ট করে? শেফা তো কখনো করতো না। কি আছে এই বাংলাদেশে? যা দেখার জন্য এতো পাগলামো শুভ্রতার। "প্রকৃতি" নামক ভারি শব্দটা বোধগম্য হয় না শেফার। তারকাছে তো বিয়ে,বর, বাচ্চা এই নিয়েই জীবন। সুখী জীবন! এবার একটা মনের মতো ছেলে পেলেই হলো তার। আর কি চাই? শেফার ভাবনার মাঝেই বলে উঠলো শুভ্রতা,
---" শীতের শেষের দিকেও কি ভীষণ ঠান্ডা পড়েছে দেখেছো,আপু? রাস্তায় যা একটু রোদ আছে ঘরে তো একদম কাঁপা-কাঁপি অবস্থা। আচ্ছা? খালামনি হঠাৎ জরুরি তলবে ডেকে পাঠালো কেন বলো তো? সিরিয়াস কিছু?"
শেফা অবাক হয়ে বললো,
---" মা ডেকে পাঠিয়েছে তোকে?"
শুভ্রতা মাথা নেড়ে বললো,
---" কেন, জানো না তুমি?"
---" না তো। আমায় তো কিছু বলে নি। সকাল থেকে তো বাজারপাতি নিয়েই ব্যস্ত ছিলো। কাহিনী কি বল তো?"
শুভ্রতা হতাশ চোখে তাকালো।
.
.
.
চলবে.........................