অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৩৮ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


জেবা দরদর করে ঘামছেন,ঘন এবং দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিচ্ছেন।পাশে বসা ফারুক সাহেব নির্লিপ্তভাবে বসে থাকলেও বুকে ভয়াবহ চাপ অনুভব করছেন।সামনে আলগোছে বড় ওড়না পড়া মেয়েটা তাদের পুরো পরিবারের বিভীষিকা হয়ে গেছে।এখন রাত সাড়ে এগারোটা বাজে,এইসময়ে পুরো শহরে নিরবতা বিরাজ করে শান্তি থাকলেও,মাহমুদ মেনশনে চলছে অনাকাঙ্ক্ষিত বিধ্বংসী ঝড় । 

-এখন কী চাও তুমি?

প্রচন্ড ক্রোধে রেহান জিজ্ঞেস করলো।

-আমার জীবন ভিক্ষা চাই,আমাকে বিয়ে করিয়ে ঘরে তুলুন,নাহলে কারো মান সম্মানই থাকবে না।

-বিয়ে করবে মানে?একটা বাইশ বছরের ছেলে তোমাকে বিয়ে করবে কীভাবে?পাগল হয়ে গেছো?
জেবা চিৎকার করে কথাগুলো বললেন।

-এসব করার আগে আপনার ছেলের সেটা ভাবা দরকার ছিলো।

রুশান দোতালা থেকে সব দেখছে।পুরো শরীর অবশ হয়ে মাথা ফাঁকা হয়ে গেছে।কোনোকিছু মাথায় কাজ করছে না,মনে হচ্ছে সবকিছু হ্যালুসিনেশন বা দিবাকল্প,কিছুক্ষণ পরেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

নিচতলায় ফারজানা এসেছে, নিজের ব্যাগ নিয়ে।ওর সাথে বসে আছে রেহান,জেবা,ফারুক।রাত সাড়ে দশটায় হুট করেই ফারজানা চেঁচামেচি করে মেইন গেটের সামনে। দারোয়ান ঢুকতে না দিলেও পরে রুশান আসায় ঢুকতে দেয়।এরপর যা শুনে,তাতে নিজের রাগ দমন না করতে পেরে চড় মেরে বসে ফারজানার গালে।ব্যাস,সেখান থেকে শুরু হয় মহাপ্রলয়।ফারজানার দাবী রেহান আর্থিক সহায়তার বিনিময়ে অবৈধ সম্পর্ক করেছে ফারজানার সাথে,সাথে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিয়ে করার। বাসা থেকে বের করে দিয়েছে ফারজানাকে,উপায়ন্তর না দেখে এখন রুশানের কাছে এসেছে,দাবী একটাই,বিয়ে করতে হবে।কমবয়সী রুশান এমন বিশ্রী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে একদম অনুভূতিহীন হয়ে গেছে।কথা বলতে পারছে না।এতবছর মেয়েদের সম্মান করার ফল এটা পাবে,কল্পনায় ছিলো না।গত এক ঘন্টা ধরে রুশানের পুরো পৃথিবী তছনছ হয়ে গেছে।জেবার অবস্থা ভালো না,বয়স হয়েছে,বেশি মানসিক চাপ নিতে পারেন না।একটু রাগারাগি করলেই ব্লাড প্রেশার হাই হয়ে শরীর খারাপ হয়ে পরে।আজকের ঘটনার পর জেবার অবস্থা শোচনীয়, রুশানের মনে হচ্ছে আর কয় ঘন্টা পরই জেবা স্ট্রোক অথবা হার্ট এ্যটাক করবেন।বিনা অপরাধে মাকে খোয়াতে হবে।সারাজীবন দুশ্চরিত্রের খেতাব গায়ে লেগে যাবে।রুশানের মনে হলো,এই গভীর রাতে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে সব নাটক এখানেই শেষ করতে। পরক্ষণেই মনে হলো তিনতলা ছাদ থেকে পরলে পঙ্গু হলেও মারা যাওয়ার সম্ভাবনা কম।এই কলঙ্ক গায়ে লাগার পর কেউ সেই পঙ্গু শরীর টানবে না,মলমূত্রযুক্ত দূর্গন্ধময় নিষ্ঠুর জীবন ছাড়া বিনিময়ে কিছুই পাবেনা।
তার মানে তো এইনা যে বেঁচে থাকতে হবে,মারা যাওয়ার অনেক পন্থা আছে।রুশানের চোখ থেকে অনবরত পানি পরছে,ভিনার সেই মায়াবী মুখ আর কখনোই দেখা হবে না।তার চেয়েও বড় কথা ভিনা ওর কথা মনে করবে না,সারাজীবন ঘৃণা করে যাবে। 

-করুক ঘৃণা,তবুও সত্যিটা ভিনার জানা দরকার।

নিজেকে নিজে বললো রুশান।নিজের ঘরে যেয়ে ঝাপসা চোখে ভিনার নাম্বার ডায়াল করলো।সারাদিন অনেক ব্যস্ত থাকায় ঘুমিয়ে পরেছিলো অন্যদিনের চেয়ে বেশ আগেই।অসময়ে ফোন পেয়ে ঘুম গলায় বললো-

-রুশ?কী হয়েছে?

ভিনার গলায় নিজের অন্য নাম শুনে রুশানের মন ভেঙে গেছে।কী সুন্দর করে বললো 'রুশ'।অথচ এই নাম শোনার মতো কোনো জীবন আর বাকী নেই।রুশান ভাঙ্গা গলায় অনেক কষ্টে বললো-

- আমি ভালো ভিনা,আমাকে বিশ্বাস করো,আমি কখনো কারো ক্ষতি করিনি।কখনো না....

-মানে?কী বলছিস,কী হয়েছে?

-আমি মারা যাবো,এত চাপ নিতে পারছিনা।প্লিজ ভিনা,আমাকে ঘৃণা করো না,আমি সহ্য করতে পারবোনা।অন্তত তুমি বিশ্বাস করো আমাকে।

-আমাকে খুলে বল।কান্না থামা। হয়েছে কী?

রুশান সব খুলে বললো,সময় লাগলো অনেক।কথা আটকে যাচ্ছিলো,ইতস্ততা কাজ করছিলো।সব শুনে ভিনা চুপ করে থাকলো।এত সেন্সিটিভ ইস্যুতে কথা বলা অনেক কঠিন।সে নিজে মেয়ে,নিজেও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে,তাই ভালোমতো জানা আছে এ সময়ে মানসিক অবস্থা কেমন থাকে।

-প্লিজ ভিনা!আমাকে বিশ্বাস করো।

-আমি কী করবো আমাকে বল তুই?

-আমি একটাবার তোমাকে দেখতে চাই,শুধু একবার।

এতটুকু বলেই রুশান কান্নায় ভেঙে পরলো।ভিনা মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব কাজ করছে।কী করবে এখন?ফারজানাকে বিশ্বাস করবে,নাকি রুশানকে?একজন মেয়ে কি নিজের জীবন নিয়ে স্বেচ্ছায় ছিনিমিনি খেলতে পারে?আদৌ সম্ভব?যদি ঘটনা সত্যি হয়ে থাকে,তাহলে ফারজানার মানসিক অবস্থা অনেক নাজুক থাকবে এখন,আর মিথ্যা হলে রুশানের।

ভিনা একমিনিট ভেবে ঘড়ির দিকে তাকালো।

-এখন ড্রাইভার আছে তোমাদের?

-হ্যাঁ 

-গাড়ি পাঠাও।আমি আসবো।

মুহূর্তের মধ্যে রুশানের কান্না থেমে গেলো।আত্মবিশ্বাস আর ভরসার জায়গা ফিরে পেয়েছে যেন।দ্রুত বললো,

-ঠিকাছে,এখনি পাঠাচ্ছি।

ভিনা ফোন রেখেই জলদি জামা বদলে ফেললো।কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় চোখ লাল হয়ে ফুলেও আছে।ঢোলা পায়জামা আর গেঞ্জি পরা ছিলো,শুধু গেঞ্জি বদলে সুতির মেরুন সালোয়ার কামিজ আর শিফনের ওরনা পরে নিলো।ব্যান্ড লাগিয়ে চুল টেনে খোপা করলো।এরপর একটা ছোট ব্যাগে স্মার্টফোন,আরেকটা এক্সট্রা ফোন আর টাকা ভরে নিলো।এই ব্যাগ খুঁজতে গিয়ে শব্দ হওয়ায় প্রিতি পাশের ঘর থেকে উঠে এসেছে।প্রিতির ঘুম খুবই পাতলা,সামান্য শব্দে ঘুম ভেঙে যায়।মাঝরাতে ভিনা এই অবস্থায় দেখে প্রিতি ভয় পেয়ে গেলো।

-ভিনা!সোনা আমার কই যাচ্ছিস?আঙ্কেল ঠিকাছে তো?বাসায় কিছু হয়েছে?

-না আপু,অনেক বড় সমস্যা হয়েছে,রুশানের বাসায় যেতে হবে।

প্রিতি চোখ কপালে তুলে বললো-

-রুশানের বাসায়?এই সময়ে?বলিস কী?

-হ্যাঁ আপু।ঘটনা অনেক জটিল। 

-কী হয়েছে?

-সত্যিটা আমি নিজেও জানি না।

-কীসব বলছিস তুই!একা যাবি নাকি এই রাতে?

-গাড়ি পাঠাবে রুশান। 

-তাও একা যাবি নাকি?ড্রাইভার যদি ভালো না হয়? না না,একা যাবি না।তুই দাঁড়া,আমি আসছি।

ভিনার ঠোঁটে হাসি খেলে গিয়েছে।একজন বড় বোন যতটুকু নিজের ছোট বোনকে আগলে রাখে,প্রিতি তার কোনো অংশে কম করেনা।প্রিতি নিজেও সাদামাটা জামা পরে এসেছে।কী ঘটনা নিজেও জানে না,শুধু জানে ভিনা বলেছে সমস্যা আছে আর সে একা যেতে দিবে না।

•••••••••••••

সবার সামনে এভাবে ঘন্টাখানেক বসে থাকতে ফারজানার অস্বস্তি লাগছে।আর যেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এসেছে,সেটা আরো অস্বস্তিকর।কিন্তু একদম নিরুপায় হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে ফারজানাকে।সেদিন ভার্সিটি থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কৃত হওয়ার পর বাসায় কাউকে জানায়নি।দশদিন পর্যন্ত ঘরেই ছিলো বসে,বাইরে যাওয়ার অবস্থা ছিলোনা।এভাবে ঘরে বসে থাকতে দেখে কাকনের সন্দেহ হয়।ফারজানাকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেও কোনো সদ্বুত্তর না পাওয়ায় মনে সন্দেহ দানা বাঁধে।এর আরো দুইদিন পর তিথিকে পড়াতে বললেও ফারজানা পড়ায় না।তখন তিথি নিজে এসে বলে-

-আমি পড়বো না ওর কাছে।

-কেন মা?

তিথি ভয় পাওয়া গলায় জানায়,দুই সপ্তাহ আগে ফারজানাকে আলমারি খুলতে দেখে ফেলেছিলো তিথি,তখন ফারজানা এমনভাবে চোখ রাঙিয়েছে যে ভয় পেয়ে গেছে।শেষ যেদিন ভার্সিটি থেকে এসেছে,সেদিন তিথি যখন এটা নিয়ে খোঁচা মারতে গিয়েছে,ফারজানা তিথির হাত শক্ত করে ধরে বলেছে-

-জানে মেরে ফেলবো একদম।

এরপর কান্না শুরু করতে গেলে ফারজানা তিথির দুই গালে জোরে থাপ্পড় মেরে বলেছে

-সবার অনেক সহ্য করেছি,আর না।

তিথির মুখে এসব শুনে কাকন আকাশ থেকে পরলো।ফারজানা যে এমন করতে পারে,ধারণাই ছিলোনা।এরপর প্রচন্ড রাগে ফারজানার ঘরে গিয়ে ফারজানাকে ঘর থেকে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে এসে ঘর লাগিয়ে দেয়।প্রায় পনেরমিনিট তল্লাশির পর কাকন পাঁচ হাজার টাকা,একটা স্মার্টফোন আর কিছু জুয়েলারি উদ্ধার করে।এরপর ফারজানার গালে সশব্দে চড় মেরে বলে-

-কীরে হারামজাদি! আমার বাড়িতে থেকে আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলিস!আবার চুরিও করিস।এসব কিছুর জন্য আপা তোকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলো?হ্যাঁ? কী উত্তর দিস না কেন ফকিন্নির বাচ্চা,অনেকদিন খেয়াল করেছি ব্যাগে টাকা নাই,তারপরও ধরি নাই তোকে,আর তুই এসব করলি?কী মনে করসিস আমি দেখিনাই প্রতিদিন কতো রঙ্গো করে ভার্সিটি যাইতি?গরম অনেক শরীরে?তো শরীরের গরম বাপের টাকায় মিটানা মাগী,আমার ঘরে আসছিস কেন?তোকে আর একদিনও এই বাসায় রাখবো না আমি।

কাকন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফারজানাকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে আসলো।সেখানে বসেই ফারজানার মামা কবির আর ফারজানার মা বাবাকে ফোন দিয়ে সব জানালো।ফারজানার মাকে বললো যেভাবেই হোক আজকের মধ্যে মেয়ে নিয়ে যেতে,ফারজানাকে ঘরে রাখবে না। ফারজানার মামা কবির বিকালেই এসে পরলেন,ভাগ্নির সব অপকর্ম শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসা ছাড়া উপায় ছিলোনা।কাকন আগে অনেক করে বলেছিলো ফারজানাকে এখানে না আনতে,কিন্তু উনি প্রায় যুদ্ধ করে এখানে এনেছিলেন।তার প্রতিদান দেখে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় নেই।ভাগ্নির দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে মনে মনে বললেন-

-ফারজানা এত বোকা!এত যুদ্ধ করে ঢাকায় এসে তাও মামির বাসায় থেকেই এসব করা লাগলো?নিজের কপাল কেউ এভাবে পুড়ায়?

ফারজানা পুরো সময় চুপ করেছিলো।ওর বাবা মা আসতে অনেক ঘন্টা সময় লাগবে।এর মধ্যেই কিছু করতে হবে,নাহলে একবার যদি এখান থেকে নিয়ে যায়,ওর পুরো জীবন জেলখানায় বন্দির মতো কাটাতে হবে।রাতে যখন সবাই খেতে বসবে,তার আগে নিজের ব্যাগে যা পারে সব নিয়ে ঘর থেকে পালিয়ে যায়।পালানোর আগে সব পরিকল্পনা করে নেয়,এত কঠিন অবস্থায় ও মাথা ঠিক রেখেছে।এরপর সেজান কে ফোন দিয়ে অনেক কাকুতি মিনতি করে রুশানের বাসার ঠিকানা নিয়ে নেয়।এরপরের ঘটনা তো জানাই।ফারজানা একদম প্রস্তুতি ছাড়া এসেছে তা না।সেদিন অডিটোরিয়াম এর বাইরে ইচ্ছা করে টাকা নিয়েছিলো যেন সিসিটিভিতে স্পষ্ট সব বোঝা যায়।সিসিটিভি ফুটেজের ক্ষমতা কত সেটা ঐদিন ভিনার ঘটনাতেই আন্দাজ হয়ে গেছে।সেদিন যদি জানতো তিনতলায় ক্লাস না থাকলেও সিসিটিভি সচল থাকবে,তাহলে সেসব করতোও না,আজকে এত দ্রুত নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা লাগতো না।ভার্সিটিতেও যেতে পারতো।

যা হয়েছে,হয়েছে।এখন হলো আসল সময়,এখন সফল হলে পুরো জীবন বদলে যাবে।রুশানের বয়স কম তাতে সমস্যা নেই,পারিবারিক ভাবে যথেষ্ট স্বচ্ছল।একজন মেয়ের বাড়তি দায়িত্ব গায়েই লাগবে না,আর সম্মান বাঁচাতে এর বাইরে কিছু করতেও পারবে না।

ফারজানার ভাবনায় ছেদ পরলো কারো আগমনের শব্দে।পেছনে তাকিয়ে দেখলো ভিনা এসেছে।রেহান অনেক্ষণ আগেই এই নাট্যমঞ্চের সামনে থেকে উঠে গেছে,রেহানই ভিনাকে ভেতরে নিয়ে আসলো,এরপর নিজে গেটের বাইরে চলে গেলো।ভিনাকে দেখেই রুশান আলোর গতিতে সিড়ি থেকে নেমে এসেছে।দৌড়ে আসতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে ব্যাথা পেয়েছে,কিন্তু সেখানে ভ্রুক্ষেপ নেই।ডুবন্ত মানুষের কাছে লাইফ এক টুকরো কাঠ যেমন সব আশার আলো,ভিনাও রুশানের কাছে তাই।

জেবা আঁচল দিয়ে ঘাম মুছে করুণ গলায় বললেন-

-এটা আবার কে?হায় খোদা!

রুশান ফারুকের দিকে তাকিয়ে বললো-

-ও ভিনা,আমার সাথে একসাথেই পরে।

ফারুক একটু নড়েচড়ে বসলেন।এরপর রুশানের দিকে তাকিয়ে বললেন-

-এত রাতে কেন এসেছে মেয়েটা?তুই ডেকেছিস?

-হ্যাঁ.... 

-কেন?

রুশান উত্তর দিলোনা।ভিনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলো।বাইরের দিকে এর মাঝে দুইবার উঁকি দিলো,প্রিতি বাইরেই আছে,ভেতরে ঢুকেনি।কিন্তু চিন্তা লাগছেনা,রেহান বাইরে প্রিতির সাথেই আছে।

-বসো মা,দাঁড়িয়ে আছো কেন?

ফারুক নম্র গলায় ভিনাকে বসতে বললেন।কেমন দিন এলো জীবনে,সব ওলট পালট লাগছে।ভিনা ত্রস্ত পায়ে সোফায় জড়োসড়ো হয়ে বসলো।বসার পর প্রথমেই ফারজানার দিকে তাকালো,আশ্চর্য হলেও সত্যি যে ভিনা তার মাঝে সেই নির্যাতিতের ছায়া দেখতে পেলো না,চোখে কোনো ভয় নেই,আতঙ্ক নেই,লজ্জা নেই।এর পরিবর্তে খুব ক্রূরতা দেখছে।কিন্তু চোখের চাহনি দেখে সিক্সথ সেন্সের বেসিসে কাউকে বিচার করার ভুল করলো না।যৌন হয়রানির ট্রমা ভাষায় প্রকাশের মতোনা।

ভিনা নীরবতা ভেঙে বললো-

-আঙ্কেল আমি সবই জানি।সব জেনেই এখানে এসেছি,পুরো বিষয়টা অনেক কঠিন।

ফারুক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।রুশান এর জন্য এইদিন দেখার কথা ভাবেন ও নি।সবসময় ঠোঁটের মাঝে কথার ছুড়ি নিয়ে চলা জেবাও আজকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি নিশ্চুপ।দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত। ভিনার সবকিছু অনেক নেতিবাচক মনে হচ্ছে,মনে হচ্ছে কোথাও বড় ভুল হচ্ছে।ভিনা সরাসরি ফারজানার কাছে চলে গেলো-

-সব কি সত্যি ফারজানা?

ফারজানা ন্যাকা গলায় বললো-

-বললেও কি বিশ্বাস করবা তুমি?তাতো করবা না।রুশান তোমার ফ্রেন্ড, আর শেষেরদিন যা হয়েছে,এরপর তো আরো বিশ্বাস করবা না।

-তার মানে এই না যে আমি অন্ধ।তুমি সত্যি হলে,আমি তোমার পাশেই থাকবো।আমাকে বলো,রুশান কী কী করেছে?

ফারজানার গা জ্বলছে ভিনাকে দেখে।তবুও কিছু করার নেই,মাতম করে ভিনার হাত ধরে ফারজানা বলতে লাগলো-

-আমার সব শেষ, রুশান আমার সব শেষ করে দিয়েছে রে বোন।জানোই তো,বাসা থেকে কী চাপ নিয়ে পড়াশোনা করি,টাকা পয়সা দেয়না।আর একটা কোর্স রিটেক এসেছে।হেল্প চাইলাম রুশানের কাছে,করলোও,কিন্তু বিনিময়ে আমার সব নিয়ে নিয়েছে!আমাকে ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলেছে,নষ্ট করে দিয়েছে আমাকে।

ভিনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো-

-কবে করেছে এসব?

ফারজানা থতমত খেয়ে বললো-

-এইত,কয়দিন আগেই।

-কয়দিন আগে?কয়বার এসব করেছে? 

ফারজানা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।ঠোঁট চেপে বললো-

-ছি ভিনা!কেমন প্রশ্ন করছো আমাকে?আমার এই অবস্থায়...

-ছি ছি না,তুমি এ বাসায় উঠে এসেছো,কারণ কী সবাই জানে,লুকানোর কিছু নেই।যা হওয়ার হয়েই গেছে,লজ্জা করে কী করবা?সত্যি করে বলো সব।

ফারজানা ঢোঁক গিলে বললো-

-এইত...দশদিন বারোদিন আগে।

-কয়বার ডেকেছে এসব করতে?

-এইইই...মনে করো...তিন চার বার...

-ডাকলো আর তুমি গেলে?

-ঋণের বোঝায় কী করতাম?

-সম্মানের চেয়ে টাকা বড় হয়ে গেলো?

-কখনো তো আর্থিক কষ্ট দেখোনি তুমি...

-একবারের পর,যখন দ্বিতীয় বার ডাকলো,ছুড়ি নিয়ে যেতে পারলে না?বা সঙ্গে কিছু নিয়ে যেতে পারলে না?কেন করতে দিলে বারবার?

-কীভাবে পারতাম আমি?

-চেষ্টা করছিলে আটকানোর?

-না মানে....

-থামো,এখন বলো কোথায় নিয়ে গিয়ে এসব করেছে?

-হো...হোটেলে...

-কোন হোটেলে?

-আমার নাম মনে নেই,একেকসময় একেক জায়গায়...

-কোথায় ছিলো সেইগুলো?

-তোমাকে কেন বলবো আমি?
ফারজানা চেঁচিয়ে উঠলো।

-আমাকে বলবা কারণ এসব পুলিশ বা অন্য কাউকে জানাতেই হবে।এর জন্য।বিশ্বাস করো,আমি তোমার সাহায্য করবো।তুমি বলো আমাকে।

-জানি না কোথায় সেগুলো।আমি খেয়াল করিনি।

-প্রথমবার খেয়াল না করতে পারো,পরের বার ও করোনি?

-না....

-তুমি রুশানের থেকেই টাকা নিলে কেন বলো তো?আমাকে অন্তত জানাতে।আমাকে বাদ দাও,ভার্সিটিতে স্টুডেন্টদের জন্য ফিনানশিয়াল এইড আছে,এটা তো জানো।তারপর ও কেন রুশানের থেকে নিলে?

-তখন আমার ভালো বন্ধু ছিলো...তাই।

-যখন টাকার জন্য এভাবে চাপ দিচ্ছিলো,অন্য কারো কাছে সাহায্য চাওনি যাতে টাকা পরিশোধ করতে পারো?যেন এসব থেকে মুক্তি পাও?

-না...আমাকে ভয় দেখিয়েছিলো।

-কী ভয়?মেরে ফেলবে?তার চেয়েও তো জঘন্য কাজ করেছে,তুমি কেন কাউকে জানাওনি?

-বললাম তো,ভয় পেয়েছিলাম।

-প্রমাণ আছে টাকা দেয়ার?ব্ল্যাকমেইলের?

-হ্যাঁ আছে,সিসিটিভি ফুটেজ থাকবে,টাকা দেয়ার।

ভিনা ভ্রু কুচকালো।এরপর কাঠিন্য নিয়ে জিজ্ঞেস করলো-

-প্রক্টরের কাছে মেইল করেছো?ভার্সিটি অথোরিটিকে জানিয়েছো?

-ছি ছি!সবাই জেনে গেলে কী বলবে?আর এখন কি ঐ ভার্সিটিতে পড়ি যে আমার অভিযোগ নিবে?

-কিন্তু রুশান তো পড়ে,ওর ব্যাপারে তো কম্পলেইন হবেই।সবচেয়ে বড় কথা সিসিটিভি ফুটেজ আছে প্রমাণের, অপেক্ষা কেন করছো?

জেবা ভয়ে থরথর করে কাঁপছেন,গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না।ফারুক সাহেব চুপ চাপ শুনে যাচ্ছেন সব,আর রুশান করুণ চোখে তাকিয়ে আছে।

-আমি জানাজানি চাইনা।আমাকে বিয়ে করে নেক,তাহলেই হবে।

ভিনা চোয়াল শক্ত করে বললো-

-যে ছেলে এমন নোংরামি করতে পারে,তাকে বিয়ে করবা তুমি?

-হ্যাঁ,করবো।

-না,করতে পারো না।কী সমস্যা তোমার?তুমি কেস করবা ওর নামে।

-না,আমি পারবো না।ঘরের ঝামেলা ঘরেই মিটমাট হোক,কাজি ডেকে বিয়ে পড়ায় দেক।আমার কোনো অভিযোগ থাকবে না।

-কেন?নারী নির্যাতনের কেস করবা তুমি,আনবেইলেবল সেটা।কেস চালানোর টাকা নাই?আমি দিবো টাকা,আমার পরিবার দিবে।থাকার জায়গা দিবে না তোমার পরিবার?আমার সাথে থাকবা,আমি ব্যবস্থা করে দিবো।আমার পরিচিত আছে লইয়ার আছে যে তোমাকে সাহায্য করতে পারবে,রুশানের কঠিন শাস্তি হবে।তোমাকে কথা দিলাম আমি।

-আমার এত কিছু লাগবে না।বিয়ে করলেই হবে।

ভিনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে সশব্দে ফারজানার গালে চড় মারলো।চড়ের শব্দ শুনে জেবা ফারুক দুজনেই চমকে উঠলেন,এট্টুক মেয়ের গায়ে এত জোর?

-নিচে নামার লেভেল থাকে।সত্যিকার অর্থে তোমার সাথে কিচ্ছুই হয়নি।হলে সেটা অবশ্যই আমি ধরতে পারতাম,কারণ আমি নিজে এসল্টের ভিক্টিম।আমার সাহায্যের কথা শুনে তুমি খুশি হতে,কিন্তু না,সেগুলো কিছুই হয়নি।তার মানে শুধু বিয়ে করার জন্য তুমি এসব করেছো,নাথিং এলস!তোমার মেইন উদ্দেশ্য রুশানকে বিয়ে করা,সেটা যেভাবেই হোক!ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু হলে,তুমি কখনোই এমন করতে পারতে না।যে মানুষকে ঘৃণা হয়,তাকে এত সহজে বিয়ে করা যায়না।

জেবা খুশিতে কেঁদে দিলেন।ফারুক সাহেব প্রশান্তির হাসি হাসলেন।রুশান বাচ্চাদের মতো কাঁদতেই থাকলো।ফারজানা হতভম্ব হয়ে সোফায় বসে রইলো।শুধু ভিনা প্রচন্ড রাগ নিয়ে তাকিয়ে থাকলো ফারজানার দিকে।এরপর ভিনাই ফারজানার কাছ থেকে জোর করে ওর পরিবারের নাম্বার নিয়ে জানিয়ে দিলো ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।ফারজানা অনেক করে বুঝানোর চেষ্টা করলো,এতে ওর জীবন নষ্ট হয়ে যাবে,ঘরে বন্দি হয়ে যাবে,পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে।ভিনা ভ্রুক্ষেপ করলো না।রাতেই ফারজানার বাবা মা এসে ওকে নিয়ে গেলো।ফারজানাকে নিয়ে যাওয়ার পর ভিনা প্রফেসর রুদমিলাকে মেসেজ দিলো-

-একজন মেয়ের দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে,তাকে পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।আমার বিনীত অনুরোধ। আপনি ছাড়া কেউ পারবে না এটা করতে।

সব মেলোড্রামা শেষে ভিনা যখন বের হবে বাসা থেকে,জেবা তাকে জড়িয়ে ধরলেন।কিছু বললেন না,শুধু শক্ত করে ধরে থাকলেন।ফারুক নিজে ভিনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

মেইন গেট থেকে রেহান প্রিতি সব দেখলো।রেহান প্রিতিকে নিঃশব্দে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে ভেতরে আসলো।এখানে কী হয়েছে জানা নেই,কিন্তু বোঝা যাচ্ছে,সমাধান হয়েছে সব।এই মেলোড্রামা ত্যাগ করে রেহান জীবনের চমৎকার কিছু সময় উপহার পেয়েছে প্রিতির সাথে। এত অমায়িক মেয়ে খুব কমই দেখেছে।ভিনার জবাবদিহিতা যেন করতে না হয়,তাই তিন ঘন্টা বাড়ির বাইরেই দাঁড়িয়ে থেকেছে।যে মানুষ একজন বাইরের মেয়ের জন্য এত করে,সে নাজানি তার ভালোবাসার মানুষের জন্য উজার করে দিবে!

সেদিনের পর, রুশান আর ভিনার পথ চলার সমীকরণ বদলে গেলো অপ্রত্যাশিতভাবে।
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp