ভিনা রক্তাক্ত হয়ে মেঝেতে পরে আছে।মাথায় আঘাত পেয়ে ফেটে গেছে।প্রিতি মচকে যাওয়া হাত নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চেষ্টা করছে ভিনাকে জাগিয়ে তোলার।দুজনই বাথরুমে বন্ধ,যে রুমের বাথরুমে বন্ধ,সেরুমের দরজা কিছুক্ষণ পরেই হয়ত ভেঙে যাবে।
অনেক্ষণ চেষ্টা করার পর ও ভিনার সেন্স ফিরলো না,এদিকে অশ্রাব্য গালাগাল আর দরজায় ধাক্কার শব্দ বেড়েই চলছে।প্রিতি ভিনার জামার ভেতর থেকে ছোট কিপ্যাড মোবাইল বের করে প্রথম ৯৯৯ এ ফোন দিলো,এরপর পালাক্রমে রেহান এবং সোহেলকে।ততক্ষণে ঘরের দরজা ভেঙ্গে গেছে।এত শব্দ হচ্ছে কিন্তু বাইরে থেকে একটা মানুষ ও এগিয়ে আসেনি।প্রিতি ফুঁপিয়ে কাঁদছে,মানুষের অমনুষ্যত্ব দেখে।
রাত দেড়টার দিকে তিনজন মুখোশ পরা লোক গেট খুলে প্রবেশ করে প্রিতির বাসায়।সেদিন প্রিতি আর ভিনা লিভিং রুমে মুভি দেখতে দেখতে ওখানেই ঘুমিয়েছিলো।সাধারণত প্রিতি ভিনা আলাদা রুমে ঘুমায়।অনেক রাত জেগে পড়ার এবং কাজ করার অভ্যাস ভিনার,তাই লাইট জ্বালানো থাকে সে রুমে।মুভি দেখে ঘুমানোর পর প্রিতি যেয়ে লিভিং রুমের লাইট বন্ধ করে দিয়ে কাউচেই শুয়ে পরে,ভিনা ফ্লোরিং করে নিচে ঘুমায়।পুরো ফ্ল্যাট অন্ধকার ছিলো।রাতের বেলায় যখন সেই তিন আগন্তক ঘরে ঢুকে,তখন কেউ কোনো সাড়াশব্দ পায়নি,কারণ তারা চাবি দিয়ে গেট খুলেছে...
ঘরে ঢুকে প্রথমেই সম্ভবত তারা টার্গেট করা রুমে গিয়েছিলো,ভিনার পাশের রুমে।সেখানে কাউকে না পেয়ে চাপা স্বরে কথা বলার সময়ই প্রিতির ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্ন বা হ্যালুসিনেশন মনে করে আবার ঘুমাতে গেলে বুঝতে পারে,এটা স্বপ্ন নয়,সত্যিই কেউ বাসায় ঢুকেছে।প্রিতি প্রচন্ড ভয়ে চিৎকার করতে নিলেও নিজের মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে,ধীর পায়ে লিভিং রুমের কাচের স্লাইড ডোর লক করে দেয়,কিন্তু শব্দ হয় খানিকটা।প্রচন্ড ভয়ে ভিনার কাছে এসে ঘুম থেকে জাগায় ভিনাকে,গভীর ঘুম থেকে উঠে ভিনা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারে না কিন্তু ততক্ষণে লিভিং রুমের দরজা খোলার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ভিনা থম ধরে বসে থাকে,আশে পাশে তাকায়।কাচের দরজা,ভেঙে যাবে এক্ষনি।সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হলো,কারো কাছেই মোবাইল নেই এখন।মোবাইল নিয়ে এ রুমে ঘুমালেও কাউকে ফোন দেয়া যেত।এতক্ষণে নিশ্চয়ই ওরা রুমগুলো থেকে মোবাইল সরিয়ে নিয়েছে।ভিনা সময় নষ্ট না করে প্রথমেই কাচের দুইটা শোপিস একটা প্রিতির হাতে,আরেকটা নিজের হাতে রাখলো।এরপর লিভিং রুমের কোণায় রাখা শোকেস সড়িয়ে জলদি সেখানে লুকিয়ে পরলো।
-আমরা এখানে বেশিক্ষণ লুকাতে পারবো না আপু,যখনি ওরা ঘরে ঢুকবে,দেখতে হবে কয়জন।এখন আমাদের একটাই কাজ,আমার ছোট কীপ্যাড মোবাইলটা নিয়ে আসা।এই অন্ধকারে আমাদের খুঁজতে বড়জোর দুই-তিন মিনিট লাগবে।আর যদি লাইট জ্বালিয়ে দেয়,তাহলে এক মিনিট।যাই হোক না কেন,যখনি আমাদের দেখবে,জাস্ট শোপিস ভেঙে দ্রুত গতিতে হাত পায়ে আঘাত করে আমার ঘরে চলে যাবা।বিছানায় ডান পাশে বালিশের নিচে আমার মোবাইল আছে।ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিবা,যেভাবেই হোক।আমি সামলে নিবো বাইরে।
-পাগল হয়ে গেছিস!
তখনি গেট ভাঙার শব্দ হলো।ভিনা ইশারা করলো চুপ থাকার জন্য। দুইজন বিশাল দেহী মানুষ,আরেকজন মোটামুটি গোছের হ্যাংলা লোক,টর্চ লাইট দিয়ে এদিক সেদিক খুঁজছে।হ্যাংলা লোকটা হাত দিয়ে ইশারা করে বাকী দুইজনকে কাজ করাচ্ছে।
-এমুন ও তো হইতে পারে,হ্যারা ঘরেই নাই।এর লাইগা দরজা বন্ধ কইরা রাখসে।
-ঘরেই আসে,বান্দির পুত।রাইসুল কইসে,এরা ঘরেই আসে,দেহস না অন্য দরজাডি খুলা।
ভিনা অন্তঃসারশূন্য হয়ে গেছে,এদের সাথে সহজে পেরে ওঠা যাবে না।আল্লাহর নাম নিয়ে ভিনা ভয়ানক এক পদক্ষেপ নিলো।ইচ্ছা করে শো কেসে ধাক্কা মেরে শব্দ করলো।প্রিতি বিস্ফোরিত চোখে তাকালো ভিনার দিকে।তিনজন এগিয়ে আসছে ধীর পায়ে।
-কইসিলাম না,ইন্দুরনীগুলা এহানেই আসে।
দাঁত খিচিয়ে কথাগুলো বলে হ্যাংলামতো লোকটা।সেই এগিয়ে আসছে সবার আগে।তার পিছে সেই দুই চ্যালাগুলো।যখনি একদম শো কেসের কাছাকাছি আসলো,ভিনা আল্লাহর নাম নিয়ে গায়ের সব শক্তি দিয়ে কাচের শোপিস ভর্তি শোকেস ওদের গায়ের উপর ফেলে দিলো।মুহূর্তের মধ্যে ঐ হ্যাংলা লোক আর তার আরেক চ্যালা শোকেস নিয়ে মাটিতে পরে গেলো।
-কাশেম ভাই!আল্লাগো!এই তালেব!
-দাঁড়ায় আসোস ক্যান বান্দির পুত,নটিগুলারে ধর!।
ভিনা হাতে থাকা শোপিস ভেঙে ধারালো অংশ অক্ষত থাকা লোকের দিকে তাক করে ধরলো।
-এহ!আইসে কত বড় চুতমারানি! কাশেম ভাই দেহেন না,এড্ডুক মাইয়ার ত্যাজ কত!
-সোফায় ফেলায়ে রস বাইর কইরা ফেলা নুরুল!গরম বাইরায়ে যাবে।
কোঁকাতে থাকা হ্যাংলা লোক,যার নাম কাশেম,সে কোমরে হাত দিয়ে কোনোমতে উঠে দাঁড়ালো।ভিনা প্রিতিকে ধাক্কা দিয়ে ঐ রুমে পাঠাতে গেলে নুরুল নামের লোকটা পেছন থেকে হাত টেনে ঘুরিয়ে ফেললো।ভিনা ভাঙা শোপিসের অংশ দিয়ে নুরুলের হাতে ঘচ করে ঢুকিয়ে দিলো।আর্তচিৎকারে পুরো ফ্ল্যাট কেঁপে উঠলো।প্রিতি ব্যাথা পাওয়া হাত নিয়ে বসে পরেছে ফ্লোরে,নাড়াতে পারছে না সেই হাত,এছাড়াও ধস্তাধস্তির সময়ে কোমরেও ব্যথা পেয়েছে।
নুরুলের হাতে মারার পরই আরো ধরাশায়ী করার জন্য ভিনা দুই পায়ের মাঝখানে সজোরে লাত্থি মারলো।প্রিতিকে চিৎকার করে বললো ঘরে যেতে,যেকোনো সময়ে তালেব নামের তৃতীয় লোকটাও উঠে দাঁড়াতে পারে,তখন তিনজনকে সামলানো অসম্ভব হয়ে পরবে।প্রিতি ভিনাকে এই নরপশুদের মুখের সামনে রেখে যেতে চাচ্ছিলো না,এরা অনেক ভয়ংকর,কোনো অঘটন ঘটানো বড় ব্যাপার হবে না।প্রিতি তৎক্ষনাৎ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না,নিজে মেয়ে হয়ে কীভাবে ভিনাকে রেখে যাবে!এই মুহূর্তে অন্তর্দ্বন্দ্বের জন্য মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে যেন।
-আপু কেন যাচ্ছো না!প্রবলেম কী!?
কাশেম এসে তখনি ভিনার চুলের মুঠি ধরে এক টান দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো।নুরুল দুই পায়ের মাঝখানে হাত দিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে,তালেব শো কেস আর কাঁচ সড়িয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
-এত্ত গরম ক্যান!মাগীগো মতো একলা ফ্ল্যাটে থাকোস আবার ত্যাজ দেহাস শুয়োরের বাচ্চা।দেখ তোরে কী করি।
কাশেম মাটিতে ফেলেই ভিনার বুকে জঘন্যভাবে থাবা দিলো।লজ্জা অপমানে ভিনা শ্বাসনালি ছিড়ে যেন বেড়িয়ে এলো চিৎকার । প্রিতি এগিয়ে এসে ধরতে গেলে পায়ে কাঁচ বিধে পরে গেলো।
-খবরদার আপু!এখানে আসবা না,যা বলছি করছো না কেন!ঘরে যাও তুমি!তোমার জন্যই আমরা দুইজন মরবো,যাও তুমি।
প্রিতি কিছু করার আগেই তালেব দাঁড়িয়ে প্রিতি ধরে ফেললো।প্রিতি ব্যাথা পাওয়া হাত দিয়ে বেশি প্রোটেস্ট করতে পারছে না।এদিকে নুরুল ভিনার জামার একাংশ ছিড়ে ফেলেছে।ঐ অবস্থায় ভিনা প্রিতিকে বললো-
-ইউজ ইওর হেড!এটাক উইথ ইওর স্কাল এন্ড স্ম্যাশ হিস নোজ।দেন ইউজ ইওর এলবো এন্ড হিট হিজ আইজ!
ভিনা ইংলিশে সব বললো যেন তালেব ঘুণাক্ষরেও কিছু না বুঝে।প্রিতি খেয়াল করলো,ভিনা চাইলেই নুরুলকে একিভাবে আঘাত করতে পারে,কিন্তু করছে না।ভিনা ইচ্ছা করেই ঝুঁকি নিয়ে ধস্তাধস্তি করে যাচ্ছে,শুধুমাত্র প্রিতিকে বাঁচানোর জন্য।প্রিতি বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে সোজা নিজের কপাল দিয়ে তালেবের নাক বরাবর বারি মেরে নাক ফাঁটিয়ে দিলো।এরপর দেরি না করে কনুই দিয়ে ডান চোখে আঘাত করে মাটিতে দিলো ফেলে।ভিনার দিকে অন্ধকারে একবার তাকিয়েই বুকে সাহস নিয়ে কাচের উপর দিয়েই যথাসম্ভব দ্রুত দৌড়ে ঘরের দিকে গেলো।কাশেম দেখলো নুরুল তালেব দুইজনের কেউই অন্তত পনের মিনিট উঠতে পারবে না।সে ভিনাকে টেনে ধরে দাঁড় করিয়ে সোজা দেয়ালের সাথে মাথার পেছনের দিক আঘাত করলো।সাথে সাথে আশেপাশের সবকিছু যেন অন্ধকার হয়ে এলো।ভিনা দুই হাত দিয়ে মাথা ধরে নিচে পরে গেছে।এরপর কাশেম ভিনার বুক ও তলপেটে লাত্থি দিয়ে বললো-
-চুতমারানি ইংরাজি মারায়,খানকি মাগী একটা।যত নাটের গুরু এই নটি,তোরে আমি আইসা খাইতেসি।
কাশেম ঘর থেকে বের হয়ে প্রিতিকে গেলো ধরতে।ভিনা মাথার পেছনে হাত দিয়ে দেখলো রক্ত পরছে।মাথা ঝিমঝিম করছে,দাঁড়াতে গেলেও পরে যাবে।ভিনার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় এবং ক্ষুদ্র প্রাণি মনে হলো।এখন যদি প্রিতিকে ধরে ফেলে নুরুল অথবা প্রিতির হাত থেকে ছোট মোবাইল নিয়ে নেয়,কিছুই করার থাকবে না শেষে। লাশ হয়ে বের হওয়া লাগবে এখান থেকে,কারণ তিনজনের মধ্যে দুইজনের মুখই দেখে ফেলেছে।ভিনা চোখ বন্ধ করে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করলো।এরপর মনে পরলো,ভার্সিটিতে কোর্স ছিলো এথিকস এবং কালচারের উপর।সেখানে বলা ছিলো মানুষের সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা স্ব আরোপিত ও স্বসৃষ্ট। মানুষের শক্তির আসল উৎস তার দেহ নয়,তার চেতনা।আর বিশ্বাস এমন এক শক্তির প্রতীক,যার কোনো যৌক্তিক সীমা নেই।এই মুহূর্তে ভিনা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে এবং গভীর বিশ্বাস নিয়ে নিজেকে বললো-
-'সৃষ্টিকর্তা আছেন আমার সাথে।আলৌকিক কিছু হবেই,আমি আর প্রিতি আপু সুস্থ,জীবিত এবং নিজেদের সম্মান নিয়ে এই ফ্ল্যাট থেকে বের হবো।হবোই।'
ভিনা নিজের এই বিশ্বাসে কোনো খাদ রাখলো না।সে ধীরে ধীরে দেয়াল ধরে দাঁড়ালো।জিনিসপত্র আছড়ে পরার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে,প্রিতি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে ডিফেন্ড করার।ভিনা নুরুল এবং তালেবকে পার করে ডাইনিং রুমে যাওয়ার পথে নুরুল খামচে ভিনার ডান পা ধরলো,ভিনা শরীরের সব শক্তি দিয়ে বাম পা দিয়ে নুরুলের মুখে লাত্থি মারলো।এরপর টলতে টলতে ডাইনিং রুমে আসলো।কাশেম আর প্রিতি ভিনার ঘরে আছে।দরজা খোলা,ভিনার বিশ্বাস বালিশের নিচে রাখা মোবাইল কাশেমের হাতে লাগে নি।ঘরে পৌঁছেই ভিনা কাশেম কে টেনে মাটিতে ফেলার চেষ্টা করলো।আঘাত নিয়ে সহজে পেরে উঠলো না যদিও।এর মাঝে প্রিতিও ব্যাথা পেয়েছে আরো।ভিনা সাহস না হারিয়ে যতটুকু পারা যায় অনবরত কাশেম কে আঘাত করতে লাগলো।কাশেম পকেটে রাখা ছুড়ি দিয়ে ভিনার হাতে পোচ মারলো,আশ্চর্যজনক ভাবে লাগলো শুধু আচড়,গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হলো না।পোঁচ খাওয়ার পর ভিনার রাগ সপ্তম আসমানে উঠে গেছে,সে নিচে ঝুকে কাশেমের চুল মুঠি করে একাই টেনে ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসলো।দরজা লাগানোর সময় কাশেম উঠে দাঁড়িয়ে সব শক্তি দিয়ে দরজায় ঠেস দিলো,ভিনা শুনতে পেলো লিভিং রুম থেকে দুইজনের একজন উঠে আসছে।শেষ সুযোগ,এর মাঝেই দরজা বন্ধ করা লাগবে।ভিনা আর্তনাদ করে উঠলো-মা!বাঁচাও আমাকে!আমাকে বাঁচাও মা প্লিজ!
ছোটবেলায় দুঃস্বপ্ন দেখে যেভাবে ভিনা নিজের মাকে খুঁজতো,ঠিক সেভাবেই খুঁজতে লাগলো।তখনি মনে হলো,মিষ্টি কোনো ফুলের ঘ্রাণে পুরো ঘর ভরে গেছে।অদ্ভুতভাবে ভিনা আরেকটু জোর দিতেই বন্ধ হয়ে গেলো ঘরের দরজা।ভিনা এক আকাশ পরিমাণ বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ফুলের ঘ্রাণ তখনো আছে,কিন্তু মিইয়ে যাচ্ছে যেন।
ভিনা ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রাখলো,খুব আপন কেউ এসেছিলো ঘরে...ভিনা বিছানায় বালিশের নিচ থেকে মোবাইল বের করে জামায় রেখে প্রিতিকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো।ধীরে ধীরে দরজায় আঘাতের পরিমাণ বাড়ছে।বাথরুমে যাওয়ার পর লাইট জ্বালিয়ে দিতেই প্রিতি চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পরেছে।ভিনার জামাসহ পুরো শরীর রক্তে ভিজে গেছে।ভিনা নিজেকে একবার আয়নায় দেখলো,সেই মুহূর্তে মনে হলো আঘাত আসলেই অনেক বেশি পেয়েছে,এত রক্ত দেখে ভিনা পরে গেলো মাটিতে।জ্ঞান হারানোর আগে বিড়বিড় করে বললো-
'মা আমাকে বাঁচিয়ে নিবে'
•••••••••••••
-আমার মেয়েটা,তোমাকে বলেছিলাম সোহেল,ওকে একা পাঠিয়ো না।এটা তো কমনসেন্সের ব্যাপার।দুইটা মেয়ে একা ফ্ল্যাটে কীভাবে থাকে?
সোহেল কিছু বলছে না।ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ভিনার বেডের সামনে।পনেরটা সেলাই পরেছে মাথায়,আঘাতের মাত্রা দেখে ডাক্তাররা নিজেরাও শঙ্কায় আছে।পাশের বেডেই প্রিতি,সোহেল মেয়ের কাছে কিছুক্ষণ থেকে প্রিতির কাছে গেলো।হাজার হোক,এই মেয়ের কোনো দোষ নেই।কষ্টকর ব্যাপার হলো,বাড়ি থেকে এখনো পর্যন্ত প্রিতিকে কেউ দেখতে আসেনি।তাই সোহেল ভিনার পাশাপাশি প্রিতির দিকেও খেয়াল রাখছে।মুনা কান্না করে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে।ভিনার আজকের এই পরিণতির জন্য নিজেকে ভীষণ ভাবে দায়ী মনে হচ্ছে।মাতৃস্নেহে জড়িয়ে রাখলে কখনোই এই দিন আসতো না।
হস্পিটালে এখন রেহান,রুশান,সোহেল আর মুনা আছে।মোট চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।বাসার দাঁড়োয়ান রাইসুলই এর সাথে জড়িত।রাইসুলই এই বিল্ডিং এর সব ফ্ল্যাটের খবর সেই সন্ত্রাসী দলের কাছে পাচার করতো।ভিনা প্রিতি একা থাকায়,এর সুযোগ নিতে চেয়েছে ভালোমতো।ভিনার সাহসিকতার জন্য পারেনি।প্রিতিকে দুইদিন পরই হাস্পাতাল থেকে রিলিজ করে দিয়েছে।ভিনাকে আরো দুইদিন পর,সেই দুইদিন প্রিতি ভিনার সাথেই ছিলো।
ভিনা রিলিজ হওয়ার পর প্রিতি যেন মহাসমুদ্রে পরে গেলো।কেউ নেই যার বাসায় যেতে পারবে।কোনো আত্মীয় নেই,যার সাথে যোগাযোগ আছে।নিজের মাকে বাধ্য হয়ে অনেকবার ফোন দিয়েছে,কিন্তু কথা বলার সুযোগ হয়নি।
-তুমি আমাদের সাথে চলো মা,আমাদের বাসায় থাকো কয়দিন।
-না মুনা আন্টি,আপনারা নিজেরাই অনেক বড় ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন,আমি এখন বাড়তি ঝামেলা করতে চাইনা।
-ভিনাকে এতদিন খেয়াল করে রেখেছো তুমি।আমরা পরিবারের মতই।কয়দিন আমাদের সাথেই থাকো।এরপর ব্যবস্থা করা যাবে।
প্রিতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মলিন হাসি দিয়ে সায় জানালো।ভিনা এসব শুনে রাগ করে কথাই বলছে না।প্রিতি চোখের কোণে জমা পানি মুছে কেবিন থেকে বের হয়ে আসলো।রেহান বাইরেই দাঁড়ানো।
-এখন কেমন আছো?
-ভালো।হাতে সামান্য ফ্র্যাকচার হয়েছে,ঠিক হয়ে যাবে।
-তোমার মা কে জানিয়েছো?
-হ্যাঁ,এ্যট লাস্ট গতরাতে তার হাজবেন্ড কল রিসিভ করেছে।তাও মামাকে আগে জানিয়েছি দেখে,নাহলে বোধহয় কন্ট্যাক্ট করতে পারতাম না।মামার ফ্ল্যাট ছিলো এটা।উনি রেগে আছেন ভালোই।
রেহান স্তব্ধ হয়ে গেছে সব শুনে।পৃথিবীতে কেউ এতটাও একা হতে পারে নাকি যে মায়ের সাথেও যোগাযোগ করতে তদবির করতে হয়?
-কিছু ভেবেছো কী করবে?
প্রিতি কান্না চেপে রেখে বললো-
-কী ভাববো বলো।এখন মনে হচ্ছে মরে গেলেই বেঁচে যেতাম যেন।জানো কী?আমার মনে হয় এইখানে শুধু দাঁড়োয়ানের সম্পৃক্ততা নেই,এখানে আমার চাচাও কোনো না কোনো ভাবে সম্পৃক্ত।
ভরা চোখে আকাশের দিকে তাকালো প্রিতি।রেহান চুপ করে থাকলো।ফারজানার ঘটনার পর প্রিতি,ভিনার সাথে নিজের এবং রুশানের সম্পর্ক অনেক ভালো হয়ে গিয়েছিলো।গত তিন মাসে বেশ কিছু জায়গায় ঘুরেছে চারজন একসাথে।প্রিতি ভার্সিটিও যাওয়া শুরু করেছিলো। প্রতিদিন বিকেলে যখন রেহান চকো আর বেরিকে প্রিতির কাছে ফেরত দিতে আসতো,তখন ঘন্টাখানেক সময় একসাথে কাটাতো। কিন্তু প্রিতি কখনোই বুঝতে দেয়নি,নিজের জীবনে এত খরা চলছে,কখনো ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যাগুলো বলে আলাদা সিম্প্যাথি নেয়ার চেষ্টা করেনি।হয়তবা চায়নি নিজে ছোট হতে।পারিবারিক সম্পর্ক আলগা থাকা মানুষের নিজের অস্তিত্বের ভিত্তি আলগা থাকা।খুব সহজে মানুষ নিজের কুৎসিত এই দিক তুলে ধরতে পারে না,যদি না তার ব্যক্তিত্ব ঠুনকো হয়।রেহান কিছু না বলেই প্রিতিকে জড়িয়ে ধরলো।এরপর মাথায় থুতনিটা প্রিতির কপালের কাছে রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
•••••••••••••
-ইউ আর সাচ এ কেয়ারলেস প্রিতি।কতবার তোমাকে বলেছি আমার সাথে লন্ডনে চলো,ইউ উইল হ্যাভ এ গ্রেট লাইফ!ইউ ডিডন্ট লিসেন টু মি।বাপের কাছে থাকতে চাইলে।কই তোমার বাপ কি পেরেছে খেয়াল রাখতে?ঠিকি তো সাদেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েই তোমাকে চালানো লাগলো।
ভিনা ড্রয়িং রুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সব শুনছে।সেই ঘটনার উনিশদিন পর প্রিতির মা রাইমা এসেছেন।কিন্তু মেয়ের প্রতি কোনো মায়া মমতার জন্য না,একান্তই দায়িত্ববোধের মিথ্যে লেবাস গায়ে চড়ানোর জন্য।প্রিতির মা রাইমা চৌধুরী দামী বটল গ্রিণ কালারের কূর্তির সাথে কালো প্যান্ট এবং মিডিয়াম হিল স্যান্ডেল পরে এসেছেন।তার হাতে মাইকেল কোর্সের লিমিটেড এডিশনের ব্যাগ।স্যান্ডেল কেলভিন ক্লেইনের।দুই হাতে রুবি আর ডায়মন্ড রিং এর ছড়াছড়ি।দেখে মনে হওয়ার উপায় নেই উনি নিজের আহত মেয়েকে সাত বছরে এই প্রথম দেখতে এসেছেন। কন্ঠে একরাশ বিরক্তি ছাড়া কিছুই নেই।
-মম,আমি তোমাকে ঠিক আসার জন্য ফোন করিনি।আমি ফোন করেছিলাম এই ঘটনা জানানোর জন্য।
-জেনে কী করতাম আমি?সাদেক কতবার করে বলেছিলো তোমাকে আসার জন্য।আসলে না তুমি।তোমার বায়োলজিকাল ফাদার না হয়েও কত চিন্তা করেছে তোমার।
প্রিতি ঠোঁট কামড়ে ধরলো দাঁত দিয়ে।নিজের মা কে এই মুহূর্তে সহ্য হচ্ছে না।সাদেক,তার অতি প্রেমের দ্বিতীয় স্বামী যে আসলে একজন লম্পট সেটা বলতে পারছে না প্রিতি।বিয়ের পরপর বেশ কয়বার সেই লোক বাজেভাবে গায়ে হাত দিয়েছিলো।নিজের নব্য স্ত্রীর মেয়েকে সে এক ভেসে আসা লালসার বস্তু ব্যতিত কিছুই মনে করেনি।
-মম,তুমি চলে যাও।আমার চিন্তা করতে হবে না।
-চিন্তা তো চাইনা করতে।শান্তিতে কোথায় বাঁচতে দিলে আমাকে!রাইসা কে একা রেখে এসেছি আমি।হার এক্সাম ইজ নকিং এ্যট দা ডোর।পুওর গার্ল,কীভাবে কী সামলাচ্ছে কে জানে।
রাইসা প্রিতির দশ বছরের সৎ বোন।রাইসার জন্য আলাদা ন্যানি আছে,এছাড়া তার দাদা দাদিও আছে।তবুও রাইমার অহেতুক চিন্তা দেখে প্রিতির হাসিই পেলো।
-আমি ম্যানেজ করে নিবো।তোমাকে অহেতুক বিরক্তির জন্য আই এম রিয়েলি স্যরি।
-স্যরি?হাহ্!তোমার মামার ফ্ল্যাটের লাখ খানেক টাকার জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে তোমার কারণে।সাদেক হ্যাজ টু পে ফর দ্যাট।আর তোমার মামাও আর রাখতে চাচ্ছে না তোমাকে।শুনলাম তুমি নাকি অন্য মেয়ে নিয়ে থাকতে?এইসব কালচার তো বাইরের দেশে আছে।বাংলাদেশে থেকে এত বাজে ব্যাপার কীভাবে ঘটালে?
প্রিতি হতবাক হয়ে গেলো নিজের মায়ের কথা শুনে।নিতান্তই পাগল না হলে কেউ নিজের মেয়েকে নিয়ে এসব কথা বলতে পারে?
-আর ইউ কিডিং মম!শি ইজ মাই সিস্টার।
-ওহ শাট আপ প্রিতি।এনাফ অফ দিজ বুলশিট।চার বছর আগেও তোমাকে নেয়ার কথা বলেছিলো সাদেক। কী বললে তুমি?কোনো এক ছেলের সাথে পরিচয় হয়েছে,বিয়ে করবে।ভাবলাম ঠিকাছে,একটা সেটেলমেন্ট তো হলো।সারপ্রাইজিংলি কী হলো?ব্রেক আপ হয়ে গেলো। এখন কী করবো তোমাকে নিয়ে আমি?আমার ফ্যামিলি আছে ওখানে।এইখানেই কতদিন পরে থাকবো?
ভিনা আর দাঁড়াতে পারলো না সেখানে। একজন মায়ের এমন রূপ বড্ড অচেনা এবং অগ্রহণযোগ্য ওর কাছে।কীভাবে পারে মানুষ এমন করতে?ভিনার ভয় হতে লাগলো,এভাবে আশ্রয়হীন হয়ে না আবার কিছু করে বসে!ভিনা দেরি না করে ড্রয়িং রুমে এসে বললো-
-আন্টি,ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড,ক্যান আই আস্ক ইউ সামথিং?
-হু
-আপনি কি সন্ধ্যা পর্যন্ত কাইন্ডলি থাকতে পারবেন?আই বেগ ইউ আন্টি।
-হুয়াই?
-প্লিজ?আই উইল এক্সপ্লেইন ইউ লেটার।
-হাহ্!হু।আই উইল স্টে।
ভিনা নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই রেহানকে ফোন দিলো।
-খুব সংক্ষেপে কিছু কথা বলবো ভাইয়া।প্রিতি আপুর মা গত পরশু দেশে এসেছেন।চলে যাবেন দ্রুতই।এরপর কবে আসবেন ঠিক নেই।আপনি কি আপুকে বিয়ে করবেন?আজকে সন্ধ্যায়?
-আজ সন্ধ্যায়?
-হ্যাঁ। দেখুন ভাইয়া,প্রিতি আপুর অবস্থা আমরা দুইজনই ভালোমতো জানি।তবুও আমি চাইনা আপনি আপুর প্রতি অনুগ্রহ করুন।কারণ কোনো প্রয়োজন নেই।সে চাইলে আমার বাসায় বছরের পর বছর থাকতে পারবে।কিন্তু আপনি যদি সত্যিই তাকে পছন্দ করেন,তাহলে আজকেই বিয়ে করুন।কারণ আন্টি বোধহয় মেয়ের বিয়ের অজুহাতে আর দেশে ফিরবেন না।আমি আপনার উপর সব ছেড়ে দিলাম।তবে এতটুকু কথা দিতে পারি,আপনি অনেক সুখী হবেন।যারা কষ্ট পেয়ে জীবন কাটায়,তারা কষ্ট দিতে জানে না।আমাকে জানাবেন দুই ঘন্টা পর,ভেবেচিন্তে।
-আমি বিয়ে করবো।তুমি প্রিপারেশন নাও।
সেদিন খুবই অনাড়ম্বর আয়োজনে রেহানের বাবা আর প্রিতির মার উপস্থিতিতে বিয়ে হয়ে গেলো দুইজনের।
.
.
.
চলবে........................................................................