প্রহেলিকা - পর্ব ০৪ - আশফি শেহরীন চিত্রা - ধারাবাহিক গল্প


ইনশিতাকে পাশে না পেয়ে নয়নিকা পিছন ফিরে দেখল চোখ বড় বড় করে দাঁড়িয়ে আছে। বিরক্তি নিয়ে বলল, 

-“উফ! ছাতার মাথা। চোখগুলা আলুর মতো করে দাঁড়ায় আছিস কেন? তাড়াতাড়ি চল বইন। আমার খুদা লাগছে।”

তবুও কোনো নড়চড় হলো না ইনশিতার। হুশ আসতেই দ্রুত পাশের দোকানের পিছনে লুকালো। ইনশিতার কর্মকাণ্ডে অবাক না হয়ে পারলো না নয়নিকা। এমন করছে কেন ইতু? কিছু জিজ্ঞেস করতে নিবে তার আগেই নয়নিকাকে টেনে দোকানের আড়ালে নিয়ে চুপ থাকতে ইশারা করলো ইনশিতা। ইনশিতার মুখ বেয়ে ঘাম ঝরছে। ফিসফিস করে বলল, 

-“আমি শেষ দোস্ত, আমি শেষ।”

-“আরে কি হইছে? এমন করতেছিস কেন? বলবি তো!”

-“ও..ওই..পাগলটা। ওই পাগলটা এদিকে এসেছে। আমি শেষ এবার। এবার না জানি কি করে।”

-“কোন পাগল? তোর সাথে আবার কে কি করবে?”

-“আরে..তোকে কালকে বললাম না, জেবার বাড়ির কথা? ওই জেহের পাগল ছেলেটার কথা? সেই জেহের এখন এখানে। কি করবো আমি এখন? উনি যদি কিছু করে? আমাকে যদি আবার নিয়ে যায়?”

ইনশিতা ক্রমশ অস্থির হয়ে পড়ছে। নয়নিকাও এবার চোখ বড় বড় করে বলল, 

-“ঐ সাইকোটা? দাঁড়া দাঁড়া, দেখে নেই একবার।”

নয়নিকা দোকানের পাশ থেকে বেরিয়ে এলো। নয়নিকাকে থামাতে যেয়েও পারলো না ইনশিতা। হাত পা কাঁপছে তার। এই পাগলটা এখানে কেন এসেছে? তার খোঁজে নয়তো? 

নয়নিকা রাস্তায় আসতেই দেখে ভার্সিটির গেটের ঠিক কিছুটা দূরে সাদা মার্সিডিজ গাড়ি দাঁড় করানো। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুঠাম দেহের অধিকারী একজন সুপুরুষ। মনে হচ্ছে এদিক ওদিক কাউকে খুঁজছে। নয়নিকা হা হয়ে আছে। এত সুন্দর একটা ছেলে কিনা পাগল! নাকি এটা সেই ছেলে না? নয়নিকা ফিরে গিয়ে জোর করে ইনশিতাকে ধরে রাস্তায় আনালো। 

-“দোস্ত, এটাই সেই ছেলে।”

ইনশিতা দেখলো জেহের ছেলেটি এদিক ওদিক কাউকে খুঁজছে আর মাথার পিছনের চুল টেনে ধরে বিড়বিড় করছে। মুখে বিরক্তি আর রাগের ছাপ স্পষ্ট।  

-“কিরে বল!”

-“আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, এটাই সেটা। ছাড় আমারে কচু। দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”

নয়নিকা অবাক হয়ে বলে, 
-“আমার বিশ্বাস হয় না এই ছেলে পাগল। ইয়ার, হি ইজ সো সুইট অ্যান্ড হ্যান্ডসাম।”

ইনশিতার ইচ্ছে করছে এখুনিই নয়নিকাকে কোথাও চুবিয়ে মারে। এই ছেলেটা যতটা সুন্দর ততটা ভয়ঙ্কর। একেবারে ভয়ঙ্কর সুন্দর। সেটা যদি একবার নয়নিকা উপলব্ধি করতে পারতো তাহলে শান্তি পেত ইনশিতা। 

নয়নিকা আবারও বলল, 
-“তুই কেন যে এই ছেলেটার থেকে পালালিরে? ইশ, এমন সুইট, কিউট ছেলেকে কেউ হাতছাড়া করে নাকি!”

-“তুই তোর সুইট, টক, ঝালকে দেখ। আমি গেলাম।”

ইনশিতা যেতে চাইলে নয়নিকা যেতে দেয় না, জোর করে আটকে রাখে আর জেহেরের সৌন্দর্যের গুণগান গেয়ে চলছে। 

ঘুম থেকে উঠেই জেহের গোপনে ইনশিতার খোঁজ চালালো। সমস্ত তথ্য হাতে পেয়েই সে সবার আগে ভার্সিটিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। ভার্সিটিতে গিয়ে দেখলো সকল স্টুডেন্ট বেরিয়ে আসছে। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরও যখন পেল না তখন তার রাগে মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। বিড়বিড় করে বারবার বলছে,‘আমার কাছ থেকে কোত্থাও পালাতে পারবে না রোজ, আমি মুক্তি না দিলে তুমি কখনোই মুক্তি পাবে না।’তখন হঠাৎ চোখ যায় তার রাস্তার মোড়ে। যেখানে সে তার রোজকে দেখতে পায় আর সাথে একজন মুখ হা হয়ে থাকা মেয়েকে। রোজকে দেখামাত্রই জেহেরের চোখে মুখে খুশির ঝিলিক দিয়ে উঠে। কিন্তু সেই খুশিটা মুহুর্তেই উবে যায় যখন দেখলো রোজের পাশের মেয়েটা তার রোজের হাত চেপে ধরে আছে। আরো বেশি রেগে যায় জেহের। তার রোজের হাত চেপে ধরার শাস্তি তো এই মেয়েটাকে দিবেই তবে আগে তার রোজকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে হবে। সে এগিয়ে যায় তার রোজের দিকে। 

ইনশিতা আচমকা লক্ষ্য করলো জেহের তার দিকে তাকিয়ে আছে, আর একটু পর এগিয়ে আসছে। বুকের মধ্যে ভয় ঝেঁকে ধরেছে। এখন কি করবে সে? কিছু না ভেবেই নয়নিকাকে ধাক্কা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ভোঁ দৌড় দেয়। ইনশিতাকে দৌড়ে যেতে দেখে আর সময় নষ্ট করে না জেহের, সেও সমানতালে দৌড়ায়। তাকে যে করেই হোক, তার রোজকে ধরে তার কাছে আনতে হবে। যে করেই হোক... 

একটা গলির মাঝখান দিয়ে ইনশিতা দৌড়াচ্ছিলো। দৌড়াতে দৌড়াতে পিছনে লক্ষ্য করে দেখলো তার বেশ খানিকটা পেছনে জেহেরও দৌড়ে আসছে। আঁতকে উঠলো ইনশিতা। জেহেরের দৌড়ের সাথে তো সে পারবে না, তার চেয়ে ভালো কোথাও লুকিয়ে পড়া। যেই ভাবা সেই কাজ। গলির একটা ঘরের মধ্যে লুকিয়ে পড়লো। চিপাচাপা গলির মধ্যে জেহেরের দৌড়াতে বেশ বেগ পেতে হলো। গলির মোড় পাল্টাতেই দেখলো তার রোজ কোথাও নেই। সামনে, পিছনে সব জায়গায় দেখলো, তাও পেলনা। না পেয়ে রেগে হিংস্র বাঘের মতো গর্জন করে উঠলো। সামনে থাকা কাঠের ড্রাম জোরে লাথি মেরে ভেঙ্গে ফেললো। কপালের রগ ফুলে উঠেছে। গজরাতে গজরাতে চিৎকার করে বলল, 

-“এখন পালাতে পারলেও ভবিষ্যতে আর পারবে না রোজ। অল্প সময় আছে তোমার হাতে, যত পারো উড়ে নাও। তারপর আমার কাছেই বন্দী হয়ে থাকতে হবে তোমার।”

জেহেরের গর্জে ওঠা কন্ঠে এমন কথা শুনে ইনশিতার ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো। এই জেহেরের হাতে একবার পড়লে তার পুরো জীবন নরক বানিয়ে দেবে এতে সন্দেহ নেই তার। এখন কোনোরকমে বাসায় গিয়ে চাচিমার সাথে এই শহর ত্যাগ করলেই বাঁচবে সে, এর আগে নয়। 

জেহের চলে যাওয়ার পর ইনশিতাও লুকিয়ে চলে আসে বাড়িতে। এসেই তাড়া দিতে থাকে চাচিমাকে। ইনশিতার বাবা তো অবাক। এই সকালেই তো মেয়েটা যেতে চাইছিলো না, এখন আবার হঠাৎ করে যাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলো কেন? আর মেয়েটাকে দেখেও মনে হচ্ছে অনেক ভয় পেয়ে আছে। 
ইনশিতার মাথায় হাত রেখে বললেন, 

-“কিছু হয়েছে কি মা? চোখমুখ এমন দেখাচ্ছে কেন?”

ইনশিতা হাসার চেষ্টা করে বলল, 
-“কিছুই হয়নি বাবা, কি কি নিবো সেই চিন্তায় আছি তাই হয়ত এমন দেখাচ্ছে।”

ইনশিতা মনে মনে বলল,‘আমি তোমাকে কিছুই বলতে পারবো না বাবা, ক্ষমা করে দিও। কালকের আর আজকের ঘটনা বললে তুমি অনেক টেনশন করবে যা আমি চাই না।’
ইনশিতার বাবা আর কিছু বললেন না। তবে মনে খচখচ রয়েই গেল। 

চাচিমা তো ইনশিতাকে পেয়ে অনেক খুশি। নিজের মেয়ে নেই বলে ছোটবেলা থেকে ইনশিতাকেই মেয়ের মতো আদর করেছেন। চাচিমার সাথে রওয়ানা হলো ইনশিতা। নয়নিকার সাথেও দেখাটা হলো না তার। দীর্ঘ দুই ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছালো তারা। ইনশিতার চাচিমা উচ্চ মধ্যবিত্ত। কিছুটা বড়লোকই বলা চলে। একটাই ছেলে তার। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। পাশাপাশি ছোটখাটো চাকরিও করছে। টাকা পয়সার যদিও কমতি নেই তাও শখের বশে চাকরিটা করে। নাম রাফিদ। বাবা আর্মি থেকে রিটায়ার্ড হয়েছেন চার বছর। 

ছিমছাম দোতলা একটা বাড়ি। নিচতলা ভাড়া দেয়া। ঘরের ভিতরের সবকিছুই পরিপাটি করে গোছানো। ইনশিতাকে একটা রুমে থাকতে দেয়া হলো। রাফিদ বাসায় নেই, সন্ধ্যায় আসবে। ইনশিতা ফ্রেশ হয়ে বাবাকে ফোন করে কথা বলে নিল। নয়নিকাকে ফোন করতেই নাম্বার বন্ধ পেল সে। রাতে আরেকবার ফোন করে নিবে ভেবে ঘুমিয়ে পড়লো সে। বড্ড ক্লান্ত এখন।  

সন্ধ্যায় ঘুম ভাঙলো কারো চেঁচামেচির আওয়াজে। ইনশিতা ঘুম থেকে উঠে ডাইনিংয়ে যেতেই দেখতে পেল রাফিদ চিল্লাচিল্লি করছে। তার কারণ তার মা তাকে না বলে এতদূর পর্যন্ত কেন গিয়েছিল। রাফিদকে একটাবার ইনফর্ম করলেই তো পারতো। সেটা না করাতেই সে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিয়েছে। আর কাকিমা ব্যস্ত তাকে থামাতে। 

-“তোমাকে কতবার বলেছি কোথাও গেলে আমাকে বলবে আমি নিয়ে যাবো। একা একা কেন যেতে গেলে? কোনো বিপদ আপদ হলে?”

-“কিছু তো হয়নি তাই না। এখন থাম না বাবা।”

ইনশিতা খেয়াল করে বলল, 
-“আমি ছিলাম তো ভাইয়া, কোনো সমস্যা ছিলো না।”

ইনশিতাকে রাফিদ কিছু বলতে নিবে তার আগেই থেমে গেল। কিছুক্ষণের জন্য হার্টবিট মিস করল সে। ঘুম জড়ানো কন্ঠ, ঘুমু ঘুমু চোখ, ফোলা গাল, এলোমেলো চুলের ইনশিতাকে দেখে রাফিদের হৃৎস্পন্দন থমকে যাওয়া প্রায়। কাঁধের জামাটা কিছুটা নামানো যার ফলে পুরো কাঁধ উন্মুক্ত হয়ে আছে। কানের লতি গরম হয়ে গেল রাফিদের, মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। চাচির ডাকেই তার ঘোর কাটলো। 

-“ইতু তো ঠিকই বলছে। এখন রাগ করিস না তো। মাত্র এসেছিস, গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়। আর ইতু, তুই ও তো কিছু না খেয়ে আছিস। এসে খেয়ে নে, আমি রান্নাঘরেই আছি।”

এই বলে চলে গেল হাসনা বেগম। ইনশিতা গিয়ে রাফিদের সাথে কুশল বিনিময় করলো। 

-“কেমন আছ ভাইয়া? আগে তো আমাদের বাসায় যেতে আর এখন তো অমাবস্যার চাঁদ হয়ে গেছ।”
 
এরকম আরো অনেক কথা বলতে লাগল ইনশিতা। আর রাফিদ মাথা নিচু করে হু হা করতে লাগল। একটু পরেই ফ্রেশ হতে যাবে বলে দ্রুত চলে গেল।খানিকটা অবাক হলো ইনশিতা। তবুও কিছু বললো না। 

সকলে খাবার খেতে বসে পড়ে। খাওয়ার মাঝেই ইনশিতার ফোন বেজে ওঠে। স্ক্রিনে তুহিন নাম ভেসে উঠলে হাসিমুখে রিসিভ করে ইনশিতা। তুহিন নয়নিকার ভাই, ইন্টারে পড়ে। ওপাশ থেকে তুহিনের কথা শুনতেই মুখ কালো হয়ে গেল তার। আঁতকে উঠলো ইনশিতা। 
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন