পিচ ঢালা রাস্তায় সাইকেল ধরে বসে হাঁপাচ্ছে ইনশিতা। সাইকেল চালানোর মতো শক্তি বা ইচ্ছে আর কোনোটাই নেই তার। আর সাইকেলের চাকার হাওয়াও শেষ হয়ে গিয়েছে। পাশের টং থেকে এক গ্লাস পানি চেয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। তপ্ত রোদের কারণে কপালে জমে থাকা ঘাম ওড়নার এক কোণা দিয়ে মুছে নিলো সে। বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে রাস্তার পাশের বেঞ্চিতে খানিকক্ষণ বিশ্রামের জন্য বসলো।
তার মনে হচ্ছে এইমাত্র কোনো বাঘের খাঁচা থেকে পালিয়ে এসেছে। আসলেই তো সে এক হিংস্র মানুষের আস্তানা থেকে পালিয়ে এসেছে। সেটা বাঘের খাঁচা থেকে কম কিসে? ঘটনাটা ভাবলেই গা শিউরে উঠে তার। বিশ্রাম শেষে সাইকেলটা রেখেই এদিক ওদিক তাকিয়ে পা এগিয়ে নিলো বাড়ির পথে।
.
.
মিসেস জেসমিন চৌধুরী ফার্স্ট এইড বক্স হাতে সিঁড়ি বেয়ে ছুটে চলেছে ছেলের রুমে। আলিশান এক রুমের মেঝেতে কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দামী ফুলদানী, ড্রেসিং টেবিলের আয়না, কাঁচের টেবিল, শোপিস, ট্রফি সবকিছুর খন্ডাংশের দেখা মিলছে ঝকঝকে সাদা ফ্লোরে। সাথে টকটকে লাল রঙের তরল পদার্থও ভেসে বেড়াচ্ছে। আফজাল চৌধুরী নিজের ছেলেকে থামাতে গিয়েও পারছেন না। কারণ সেই ছেলের কাছে গেলে নির্ঘাত নিজের জন্মদাতা বাপকে আঘাত করতে একবারও ভাববে না সে। এইমাত্র সে কি করছে না করছে কিছুতেই হুশ নেই। যেই না টিভি আছাড় দিয়ে ভাঙ্গবে সেই সময়ে সেই ছেলের বয়সী আরেকজন ছেলে সাহস নিয়ে গিয়ে তাকে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আটকে নিলো। আর বলতে লাগলো,
-“ভাই প্লিজ, থাম তুই। দেখ, তোর হাত পা কেটে রক্ত বের হয়ে গেছে, তোর ইনফেকশন হয়ে যাবে। প্লিজ একটু থাম।”
তাও যেন থামার নাম নিচ্ছে না ছেলেটি। টিভিটা শেষ পর্যন্ত আছড়েই দিলো। হাতের কাছে ভাঙ্গার মতো আর কিছু না পাওয়ায় রাগটা যেন আরো বেড়ে গেল তার। জড়িয়ে ধরে থাকা ছেলেটির দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাতেই ছেড়ে দিলো সে। তারপর রাগে গজরাতে গজরাতে বিছানায় গিয়ে বসলো। বসেই বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো।
পুরো রুম জুড়ে নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে ছেলেটির বড় বড় নিঃশ্বাস রুমকে এক ভয়ঙ্কর পরিবেশে পরিণত করেছে। মনে হচ্ছে কোনো সিংহ গজরাচ্ছে। আর রুমের অন্যান্য লোকেরা সেই সিংহের গুহায় ভয়ে না চাইতেও দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটির চোখ অসম্ভব রকমের লাল হয়ে রয়েছে। ফর্সা মুখটাও লাল বর্ণ ধারণ করেছে। ঘাড়ের রগ ফুলে উঠেছে, মুখ দিয়ে কিছু একটা বিড়বিড় করছে। বাম হাত দিয়ে নিজের চুল টেনে ধরে রেখেছে। মিসেস জেসমিন দৌড়ে গিয়ে ছেলেটির কাঁটা হাত ধরে ব্যান্ডেজ করতে নিলে ছেলেটি একটানে হাত সরিয়ে নেয়। মিসেস চৌধুরী বললো,
-“জেহের, বাবা আমার। তুই বিশ্বাস কর। দরজাটা আমরা কেউই খুলিনি। মেয়েটি কীভাবে পালালো সেটাও জানিনা আমরা। হয়তো সে বারান্দা দিয়ে পালিয়েছে।”
জেহের গর্জে উঠে,
-“শাট আপ মিসেস চৌধুরী। বারান্দার দরজা দিয়ে কখনোই পালানো সম্ভব নয়। বারান্দার নিচে গার্ডরাও বলেছে যে বারান্দা বেয়ে কেউ নামেনি। সো আমাকে মিথ্যে বলার আগে ভেবে নেবেন। আর রুমে শিফা কিভাবে ঢুকলো? ও কেন ঐ মেয়েটার জামা পরেছিলো? আই এম ড্যাম শিওর কেউ ওকে পালাতে সাহায্য করেছে। আর ও পালিয়ে যাবেই বা কোথায়? সেই ফিরতে তো হবে এই জেহের চৌধুরীর কাছেই।”
শেষের কথাটা জেহের বাঁকা হেসে দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
জেহেরের সমবয়সী ছেলেটা জিহাদ। জিহাদ গিয়ে মায়ের হাত থেকে ঔষধের বক্সটা নিয়ে জেহেরের হাত ব্যান্ডেজ করতে লাগলো। জেহের হাত সরাতে গিয়েও সরালো না। তার মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা। কিছুক্ষণের মধ্যেই জেহের অনুভব করলো তার দুচোখে নিদ্রা ভর করছে। চোখদুটো বন্ধ করে ঢলে পড়লো নিদ্রার রাজ্যে।
জেহেরকে ঠিক মতো বিছানায় শুইয়ে উঠে দাঁড়ালো জিহাদ। জেহেরের অজান্তেই সে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দিয়েছিলো। মিসেস জেসমিন একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। যেই শ্বাসে মিশে আছে কষ্ট, বেদনা আর আর সন্তানের ভালোবাসা না পাওয়ার হাহাকার। পরিচারিকাকে রুমটা পরিষ্কার করার দায়িত্ব দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই রুমে প্রবেশ করে শিফা। মিসেস জেসমিন একপলক শিফার দিকে তাকিয়েই আচমকা চড় বসিয়ে দিলেন তার গালে। ঘটনার আকস্মিকতায় আফজাল সহ জিহাদ দুজনেই চমকে উঠলো। শিফা কিছু বলতে নিবে তার আগেই তাকে থামিয়ে মিসেস জেসমিন বলতে লাগেন,
-“ঐ মেয়েটাকে পালাতে তুমিই সাহায্য করেছিলে তাই না? আর ওর জামা পরে এমন ভাবে সেজেছিলে যাতে জেহের তোমাকে ঐ মেয়েটা মনে করে। তাইতো? আর তোমাকে কতবার বারণ করবো যে জেহেরের সামনে না আসতে? তোমার সাহস কি করে হয়? তোমাকে সহ্য করতে পারে না জেহের সেটা তো ভালো করেই জানো। তাও জেহেরকে রাগানোর মতো কাজ করো কেন তুমি? আজ যদি ঐ মেয়েটাকে পালাতে না দিতে তাহলে হয়তো জেহের এত রেগে যেত না। আর না নিজের ক্ষতি করতো। বেয়াদব মেয়ে কোথাকার। লজ্জা থাকলে আর কখনোই জেহের কেন, এ বাড়িতেই আসবে না তুমি।”
শিফা মাথা নিচু করে আছে আর মিসেস জেসমিন ক্রমশই রাগে উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে। জিহাদ তাড়াহুড়ো করে মিসেস জেসমিনকে ধরে বললো,
-“মম, তুমি এখন আর কথা বলো না। তোমার প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। রুমে যাও প্লিজ।”
আফজাল চৌধুরীকে ইশারা করতেই তিনি মিসেস জেসমিনকে ধরে জোর করে রুমে নিয়ে যেতে লাগলেন। মিসেস জেসমিন আর আফজাল চোখের আড়াল হতেই শিফা রেগে তাকালো জিহাদের দিকে। অথচ জিহাদ নির্বিকার। সে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে জেহেরের রুম ত্যাগ করলো। পিছন পিছন শিফাও তাকে অনুসরণ করে।
.
.
বারান্দায় পাতা ছোট চেয়ারটিতে বসে অন্ধকার আকাশে তাকিয়ে আছে ইনশিতা। পুরো নাম ইনশিতা আফাফ রোজ। রোজ নামটি তার মামার দেওয়া হলেও কেউ এই নামে ডাকে না। জন্মসনদে রোজ উল্লিখিত থাকলেও সকলের কাছে তা অদৃশ্য। সকলের কাছেই না-কি রোজ নামটা বিদেশী বিদেশী লাগে। তাই সকলেই ইনশিতা বলে ডাকে। অথচ ইনশিতার কাছে রোজ নামটাই সবচেয়ে প্রিয়। কিন্তু আফসোস কেউই রোজ বলে না। কাঁধে কারো হাতের ছোঁয়া পেতেই আঁখিজোড়া মেলে তাকালো ইনশিতা। দেখলো তার বেস্ট ফ্রেন্ড নয়নিকা চিন্তিত বদনে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই মাথা না নাড়িয়ে কিছুই হয়নি বলে নয়নিকা। উল্টো ভ্রূকুটি কুঁচকে ইনশিতাকে জিজ্ঞেস করলো,
-“তোর কি হয়েছে সেটা বল।”
-“আমার আবার কি হবে?”
-“দেখ! ভণিতা আমার একদমই পছন্দ না, সেটা তুই জানিস। আমাকে দেখলে যে কিনা ঝগড়া মারামারি শুরু করে দেয় সে আজ চুপচাপ? মানা যায় না। আর তুই নাকি রুমে এসেই কিছু না খেয়ে বসে আছিস? কারো সাথে নাকি ঠিকমতো কথাও বলছিস না? কি হয়েছে বলবি?”
-“আরে নয়ন! কিছুই হয়নি আমার। মথাটা একটু ধরেছিলো শুধু তাই আর কি..”
-“দেখ ইতু। তুই বলবি নাকি আমি আমার কায়দা অবলম্বন করে কথা বের করবো?”
জবাবে কিছুই না বলে চুপ করে রইলো ইনশিতা। নয়নিকা নাছোড়বান্দা। সে কথা বের করেই ছাড়বে। তার থেকে বরং নিজেই বলে দেওয়াটা ভালো। আর এমনিতেও ইনশিতার মনে অজস্র কৌতুহল জমা হয়ে আছে। সেই কৌতুহলকে মিটাতে হলেও নয়নিকাকে সবটা বলা দরকার। নয়নিকার হাত ধরে টেনে আরেকটা চেয়ারে বসিয়ে দিলো সে। শূন্যে তাকিয়ে মনে করতে লাগলো আজ সকালে ঠিক কি কি ঘটেছিলো তার সাথে!
সকালবেলা..
—————
ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজছে ইনশিতা। পরনে কালো শাড়ি, হাতে কালো চুড়ি, চোখে কাজল আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। একদম সিম্পল সাজ যাকে বলে। আজ ভার্সিটির সকলে মিলে পিকনিকে যাওয়ার প্ল্যান ছিলো। তাই সে শাড়িটাকেই বেছে নিলো। এছাড়া আর কোনো জামাও ছিলো না তার। বাবাকে বলতেও পারছে না সে। বাবার কাছে বাড়তি টাকা নেই সে জানে। গতমাসের কারেন্ট বিল পর্যন্ত বকেয়া আছে। আর টিউশনির টাকাটাও বাজারে খরচ করে ফেলেছে। শাড়িটা বাবা একবছর আগে কিনে দিয়েছিলো। কোনোদিন পরেনি সে। আজকে পরার জন্য উপযুক্ত সময় ভেবে পরে নিলো। পিকনিক শেষ করে বিকেলে ফেরার পথে তার সহপাঠী অনু এসে বললো,
-“ইতু, শোন।”
-“কিরে! কিছু বলবি?”
-“একটা কাজ করতে পারবি?”
-“কি?”
-“জেবাদের বাসায় গিয়ে এই ব্যাগটা জেবাকে দিয়ে দিস প্লিজ। ও চলে গিয়েছে আর এই ব্যাগটাও আমার কাছে ভুলে রেখে গিয়েছে। এখানে নাকি ওর কিসের ইমপর্টেন্ট জিনিস আছে।”
-“তাহলে কালকে দেখা হলেই দিয়ে দিস।”
-“আমিও ভেবেছিলাম, তবে জেবা এখন ফোন করে বলেছে ব্যাগটা ওদের বাসায় দিয়ে যেতে। আর আমি তো এখন অরুণের সাথে উল্টোপথে যাবো। আর কাউকে পাচ্ছিও না। তাই তুই যদি একটু দিয়ে আসিস। প্লিজ।”
অনুর মিনতিভরা দৃষ্টি উপেক্ষা করতে পারলো না ইনশিতা।
-“আচ্ছা ঠিক আছে, দিয়ে আসবো। কিন্তু ওর বাসাটা কোন পথে? আমি তো আগে কখনো যাইনি।”
অনু জেবার বাসার এড্রেস বলে দিয়ে ব্যাগটা ইনশিতার হাতে ধরিয়ে কৃতজ্ঞতার গলায় বললো,
-“অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ রে ইতু।”
-“মেনশন নট।”
ঠিকানা অনুযায়ী সেই পথে হাঁটা দিলো ইনশিতা। এই রাস্তায় আগে কখনো আসেনি সে। রাস্তার পাশে বিশাল বড় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইনশিতা। হা হয়ে গিয়েছে তার মুখ। গেটটা এতো বড় যে ভিতরের ঘরের টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। গেটের দুপাশের নিচ থেকে বেয়ে উপরে উঠেছে লতানো গাছ। তার মধ্যে ফুটে রয়েছে শুভ্র সাদা অপরাজিতা। পুরো গেট জুরে সাদা অপরাজিতা যেন গেটের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তার পাশে বেশ বড়সড় একটি নেমপ্লেটে লেখা‘চৌধুরী মহল’। জেবা তার সহপাঠী হলেও পড়ালেখা ছাড়া আর কোনো কথা হয় না তার। এমনকি ভালো করে চিনেও না তাকে। গেটের কাছে যেতেই দারোয়ান হাত দিয়ে আটকে ধরলো তাকে।
-“কাকে চাই?”
-“ইয়ে আসলে, জেবা চৌধুরীর বাড়ি তো এটা তাই না! ওর সাথেই দেখা করতে এসেছি।”
দারোয়ান ইনশিতাকে দাঁড় করিয়ে রেখেই কাকে যেন ফোন দিলো। দুমিনিট পর ইনশিতাকে ভেতরে যাওয়ার জন্য গেট খুলে দিলো।
বড় গেট পেরোতেই ইনশিতা অবাক। অবাক বিস্ময়ে তার মুখ হা থেকে এত্ত বড় হা হয়ে গিয়েছে। সে কি স্বপ্ন দেখছে! চোখ দু'টোকে একবার দুহাত দিয়ে কচলে নিলো। নাহ, কোনো স্বপ্ন নয় এটা। নির্মল নিস্তব্ধ পরিবেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক অট্টালিকা। এইরকম বাড়িগুলো সে টিভিতে দেখেছে। সামনাসামনি যে দেখবে এটা হয়তো আশা করেনি। গেট থেকে ঘরে যাওয়ার জন্য সুদীর্ঘ কংকর বিছানো রাস্তা। ঘরের দেয়াল জুড়ে সাদা রঙ করা। শিল্পী যেন নিজের সবটা ভালোবাসা উজাড় করে তৈরি করেছে ঘরটা। ঘরের বেশ খানিকটা অংশে দেয়ালের জায়গায় কাঁচ দিয়ে আটকানো। কাঁচে দিয়ে ভেতরটা কিছু কিছু দেখা যাচ্ছে। ঘরটার চারপাশে ফুলগাছ দিয়ে জড়ানো। রাস্তার দুপাশে সবুজ ঘাসে ঢাকা বড় এক উঠান। উঠোনের একপাশে বেতের সোফা, টেবিল সুন্দর ভাবে পাতানো। আরেকপাশে বড় একটি দোলনা। উঠোনের কোণায় ছোট্ট একটি ঘর দেখা যাচ্ছে। পুরো উঠোনের চারপাশে গাছের ছড়াছড়ি। যার ফলে কিছুটা ছায়া কিছুটা বিকেলের রোদে ঢেকে আছে পুরো বাড়িটা।
ইনশিতা ধীরপায়ে প্রবেশ করলো ঘরের ভেতরটায়। মেইন দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই আরেকদফা চমকালো ইনশিতা। শুনশান নীরবতায় ছেঁয়ে আছে পুরো ঘর। এতো বড় প্রাসাদের মতো বাড়ি অথচ কারোর দেখাই মিলছে না! বেশ ভাবালো ইনশিতাকে। চোখ বুলিয়ে একবার দেখে নিলো পুরো ঘরটাকে।মেইন দরজা থেকে নামার সময় চওড়া দুটো সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়। বিশাল বড় ড্রয়িংরুমের মাঝখানে ইয়া বড় বড় সাদা রঙের সোফা। সোফাগুলাও তার কাছে নতুন ঠেকলো। সে তো কাঠের চার পায়া সোফা দেখেছে। অথচ এই সোফাগুলো মনে হচ্ছে পুরোটাই ফোম দিয়ে ঢাকা আর কিছুটা নিচু হয়ে সবটা ফ্লোরের সাথে মেশানো। তার উপর রয়েছে ফোমের কুশন। আর উপরের দিকে চোখ নিতেই দেখলো বিশাল বড় ঝাড়বাতি। দুপাশের সোফার মাঝখানে একটি কাঁচের টি-টেবিল। টি-টেবিলের কাঁচটি তাদের আয়না থেকেও ঝকঝকে পরিষ্কার। কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হলো ইনশিতা। সোফার ঠিক কিছুটা দুরে একপাশ দিয়ে বেয়ে উঠেছে সিঁড়ি। উপরের তলার চারপাশ দিয়ে কাঁচের রেলিং দিয়ে বেঁধে রাখা। ড্রয়িংরুমের ডানসাইডে রান্নাঘর। রান্নাঘর দেখে ইনশিতা ভাবলো তাদের দুটো রুম একত্র করলেও এই রান্নাঘরটার সমান হবে কিনা! রান্নাঘরটার ঠিক কিছুটা দুরে অবস্থান করছে কাঁচের বড় ডাইনিং টেবিল। চেয়ারগুলো কেমন রাজকীয় সাজে সজ্জিত রয়েছে।
সোফার কাছে এসে ডাইনিং টেবিল পর্যবেক্ষণ করতেই চোখ গেল ঘরের আরেকপাশটায়। ডাইনিং টেবিলের পাশে আর পুরো ড্রয়িংরুমের সামনাসামনি অর্ধেক দেয়ালটা কাঁচে ঢাকা। অর্থাৎ উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পুরোটাই কাঁচ। কাঁচের পাশটাতেই আরো কয়েকটা চেয়ার রাখা। বাহির থেকে আশা প্রাকৃতিক আলোয় পুরো ড্রয়িংরুম আলোকিত প্রায়। সাথে রয়েছে বাতাসের ছুটোছুটি। কাঁচ ভেদ করে ওপাশে রয়েছে বড় সুইমিং পুল। তাতে নীল পানি ঢেউ খেলে যাচ্ছে। সুইমিং পুলের পাশে ফুলের বাগান। সেখানে কসমস ফুল ছাড়া আর কোনো ফুলই চিনলোনা সে। নিশ্চয়ই বিদেশী ফুল। উপরতলাটাও নিশ্চয়ই আরো সুন্দর করে সাজানো! এই বাড়িটা একদিনে ঘোরা সম্ভব না। দু’তিনদিন তো নিশ্চিত লাগবে। আর মনে মনে ভাবলো ভালোই হয়েছে অনুর কথা শুনে এখানে এসেছে। নাহলে এতো সুন্দর একটি বাড়ি কি তার চোখে পড়তো? ইশ! তার যদি এমন একটা ঘর থাকতো! এসব ভাবতে ভাবতেই ইনশিতার মনে হলো কেউ তাকে ডাকছে। পিছনে ফিরেই দেখলো জেবা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। উজ্জ্বল শ্যামলা মেয়েটার মুখ থেকে যেন সৌন্দর্য উপচে পড়ছে।
জেবা এগিয়ে আসলো।
-“কেমন আছো ইনশিতা? অনু আমায় ফোন করে বলে দিয়েছিল যে তুমি আসছো। তোমার মূল্যবান সময় নষ্ট করছি আমি তাই না? এর জন্য সত্যিই আমি সরি। আসলে ব্যাগটাতে আমার অনেক জরুরী কিছু কাগজ আর জিনিস ছিলো যেগুলো আজকেই লাগতো।”
ইনশিতা হাসিমুখে জবাব দিলো,
-“সরি বলার কিছুই নেই। আর আমার বাসার রাস্তাটাও প্রায় কাছাকাছি।”
যদিও ইনশিতার বাসার রাস্তা একদম বিপরীতে তবুও মিথ্যে বলে দিলো। জেবা ব্যাগটা নিয়ে ইনশিতাকে বসতে বলে চলে গেল। ইনশিতা সোফায় বসেই তলিয়ে যেতে সামলে নিলো। বাপরে! কি নরম সোফা! একদম মাখনের মতো নরম যাকে বলে। সোফাতে বসেই চোখ গেল কিছুটা দুরের টি-টেবিলে। যেখানে রাখা হয়েছে অনেকগুলো কালোগোলাপ। ঠোঁটে ফুটে উঠলো মুচকি হাসি। কালোগোলাপ খুব পছন্দের তার। এগিয়ে চললো গোলাপ নিতে। কয়েকটা গোলাপ কানের পিছনে গুঁজে দিলো। হঠাৎ মনে হলো পিছন থেকে কোনো পুরুষালী গম্ভীর কন্ঠে কেউ কিছু বললো। ইনশিতাকে দেখে কথা বলা ব্যক্তিটি বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো,
-“রোজ। ব্ল্যাক রোজ...মাই ব্ল্যাক কুইন।”
.
.
.
চলবে............................