জেহের সার্ভিং ট্রলি নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। ইনশিতা পালানোর চিন্তায় বিভোর তখন। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে সেদিকে তাকাল ইনশিতা। খাবার দেখে হা হয়ে গেল সে। এত এত খাবার! এগুলোর নাম কী? সে জীবনেও এমন নাম না জানা খাবার দেখেনি। কাছে আনতেই দেখল বেশিরভাগই তরল। স্যুপ! এত রাতে স্যুপ খাবে? তারপর এই পাশের প্লেট টায় লতাপাতার মতো এগুলো কী? আবার টুকরো টুকরো কী একটা আছে।
-“এগুলো কী এনেছেন?”
-“তোমার ডিনার। কেন পছন্দ হয়নি?”
-“এগুলো মানুষে খায়? এগুলো তো গরু ছাগলেও খায় না বোধহয়। আমার জন্য ভাত আনুন। ডাল আর আলু ভর্তা দিয়ে।”
-“এসব হাবিজাবি খাওয়া চলবে না তোমার। যা এনেছি তা খাও।”
-“বললাম তো, এসব আমি খেতে পারবো না। আমার পেট ভরবে না। আর হাবিজাবি এগুলা, ভাত না।”
-“এসব ছাড়া আর কিছুই পাবে না তুমি। আর এগুলোই আমি খাই সবসময়, তাই তোমাকেও খেতে হবে।”
জেহেরের কথা শুনে বিরক্তিতে মুখ তেঁতো হয়ে গেল ইনশিতার। ভেংচি কেটে বলল,
-“ওহ হো! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আপনি মানুষ না। আপনি তো পশু, আর পশুরাই এগুলো খায়। আর কী বলুন তো, আমি না আপনার মতো পশু না। তাই এসব পশুর খাবার আমার চলবে না।”
জেহের দপ করে জ্বলে উঠল। সূর্য অস্ত যাওয়ার আগ মুহুর্তের মতো চোখের চারপাশ লাল হয়ে গেছে। ইনশিতার গাল চেপে বলল,
-“আমাকে ইনডাইরেক্টলি পশু বলা তাই না? তাহলে এই পশুর পশুত্বটাও দেখিয়ে দেই নাকি? কেমন হবে দেখালে? হু?”
বলেই নিজের শার্টের বোতাম খোলা শুরু করল। ইনশিতা ভয় পেয়ে চিৎকার করে বলল,
-“না না না, আই এ্যাম সরি। আর কখনো বলবো না, প্লিজ। ভুল হয়ে গেছে আমার। এগুলোই খাবো আমি। দিন দিন, তাড়াতাড়ি দিন।”
গোলাপী ঠোঁট বাঁকা করে হাসল জেহের। ট্রলিটা ইনশিতার সামনে এনে সেও চেয়ারের পাশের সোফায় বসে পড়ল।
-“আমার হাত খুলে দিন, আমি নিজের হাতেই খাবো।”
-“এখন থেকে আমার হাতেই খাবে।”
-“আমার হাত আছে কী করতে? হাত যতক্ষণ আছে ততক্ষণ আমি নিজ হাতেই খাবো।”
-“যদি হাতটাই না থাকে?”
জেহেরের এমন ধমকানি তে ঢোক গিলল ইনশিতা।
-“থাক, খাইয়ে দিন।”
খাবার গুলো মুখে নিতেই মনে হল বমি করে দেবে ইনশিতা। ছিঃ! স্বাদটা কেমন যেন! খেতে খেতে ইনশিতা প্ল্যান করতে লাগল। জেহের তো তাকে ভালোবাসে, এই ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে সাইকোটার থেকে যদি ভালো খাবার পাওয়া যায়। এতে একটু অভিনয় করতে হলেও করবে সে। ইনশিতা দুঃখী দুঃখী মুখ করে জেহেরের দিকে তাকাল। কোমল কন্ঠে বলল,
-“আপনি আমাকে খুব ভালোবাসেন তাই না?”
-“জীবনের থেকেও বেশি।”
-“আমার কষ্ট হলে আপনার ও খুব কষ্ট হয় তাই না?”
-“খুব।”
জেহের ইনশিতার খুব কাছে এসে উত্তর দিল। ইনশিতার মনে হলো জেহের গলে যাচ্ছে। জেহের কেমন জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। ব্যস, আরেকটু গলালেই চলবে। আবেগী কন্ঠে বলল,
-“তাহলে এই যে আমার হাত দুটো বেঁধে রেখেছেন, এতে তো আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। হাতে প্রচন্ড ব্যথা পাচ্ছি। এতে তো আপনার কষ্ট হচ্ছে না। আপনি তো উল্টো আনন্দ পাচ্ছেন।”
ইনশিতার কথা শুনে জেহের দ্রুত ইনশিতার হাতের বাঁধন খুলে দিলো। হাতে অসংখ্য চুমু দিয়ে ইনশিতার মুখটা নিজের দুহাতে তুলে বলল,
-“আমি একটুও আনন্দ পাচ্ছিলাম না রোজ। আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু, ত-তুমি যদি আমার থেকে দুরে সরে যাও সেই ভয়ে তোমাকে আটকে রাখি। তুমি দুরে সরে গেলে আমার খুব কষ্ট হয় রোজ।”
ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড বিরক্ত হলো ইনশিতা। এতো আবেগ পায় কোথায় পাগলটা? জেহেরের ছোঁয়ায় যেন তার গায়ে আগুন লেগে গেল। তবুও নরম কন্ঠে বলল,
-“তাহলে এখন যে এসব ছাইপাশ খাওয়াচ্ছেন এতে তো আমার আরও বেশী কষ্ট হচ্ছে। এসব খাওয়ার অভ্যাস নেই আমার; আর না কোনোদিন খেতে পারবো। আপনি যদি আমার কষ্টে কষ্ট পেয়ে থাকতেন তাহলে আমার পছন্দের খাবার এনে দিতেন। এতেই বুঝা যায় আপনি আমাকে একটুও ভালোবাসেন না।”
ভালো না বাসার কথা শুনে জেহের উতলা হয়ে পড়ল। সে তো তার রোজকে খুব ভালোবাসে। আর এই খাবারগুলো হেলদি বলেই খাওয়াচ্ছে। কিন্ত তার রোজ যে তার ভালোবাসা নিয়ে কথা বলবে সেটা কী সে জানতো? রোজের মুখ দুহাতে আরো শক্ত করে ধরল, কপালে আর গালে চুমু দিতে দিতে অস্থির হয়ে বলল,
-“আমি এগুলো হেলদি বলেই খাওয়াচ্ছিলাম। এগুলো না খেতে চাইলে খেও না। আমি এক্ষুনি তোমার পছন্দের খাবার এনে দিচ্ছি সোনা। এক্ষুনি দিচ্ছি। কী খাবে বলো আমায়। সব, সব এনে দিবো সোনা।”
-“আগে আমাকে সোনা রুপা ডাকা বন্ধ করুন।”
জেহের যেন সে কথাটা শুনতেই পেল না। সে তো চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে তার রোজের গাল, কপাল, চিবুক। অচেনা ছেলেটির এমন স্পর্শে ইনশিতা কেঁপে কেঁপে উঠছে। তবে সেটা রাগে আর বিরক্তিতে। কোনোদিন কোনো অচেনা ছেলে তাকে টোকা অবধি দেয়নি, আর এই ছেলে তো বেশি অ্যাডভান্স। অনেক কষ্টে বলল,
-“ভাত নিয়ে আসুন। ভাতের সাথে যেকোনো তরকারি থাকলে নিয়ে আসুন।”
জেহের নির্বিকার। ইনশিতা জেহেরকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,
-“কী হলো যান।”
জেহের কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো ইনশিতার দিকে। জেহেরের চোখ দেখে দৃষ্টি নিচে নামিয়ে ফেলল ইনশিতা। কেন যেন হঠাৎ জেহেরের চোখে চোখ মেলাতে পারছে না সে। কালচে নীল চোখের দৃষ্টিতে এক ধরনের উন্মাদনা দেখতে পাচ্ছে সে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না সেই দৃষ্টিতে। চোখ ঝলসে যায়।
জেহের দরজা আটকে ইনশিতার খাবার আনতে চলে যায়। ইনশিতা জেহেরের মোবাইল খুঁজতে লাগল। ইনশিতার মোবাইল আগেই জেহের নিয়ে নিয়েছিল। সে দেখল সোফার এক কোণায় জেহেরের মোবাইলটা পড়ে আছে। লক না থাকায় ইনশিতার উপকার হলো। সে দ্রুত বাবার নাম্বারে কল দিলো। অনেক্ষণ কল দেওয়ার পরও তার বাবা ধরছে না। আর একটু পর তো জেহেরও এসে পড়বে। উফফ! আবারও কল দিলো সে। কল কেটে যাবে যাবে তখনই ইনশিতার বাবা ফোন ধরল।
-“হ্যালো বাবা।”
ইনশিতার বাবা অবাক হয়ে বলল,
-“কিরে মা! এটা কার নাম্বার? আর তোর নাম্বারে কল ঢুকছে না কেন?”
-“বাবা শুনো, আমি বিপদে পড়েছি।”
-“কী হয়েছে ইতু?”
-“একজন আমায় তার বাড়িতে তুলে নিয়ে এসেছে। তাকে আমি ভালো করে অবধি চিনিও না। আর এই ছেলেটা পাগল। মাথার তার ছিঁড়া। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো, পারলে পুলিশও নিয়ে এসো।”
-“কী! কোথায় তুই? জায়গাটা কোথায়? হ্যালো, হ্যালো!”
আর কিছু বলতে নিবে সেই মুহুর্তে জেহেরের প্রবেশ। জেহেরকে দেখে ইনশিতা বলার আর কিছুই পেল না। রীতিমত তার হাত পা কাঁপছে। জেহের ইনশিতার হাতে মোবাইল দেখে দ্রুত দৌড়ে এসে মোবাইলটা নিয়ে কেটে দিলো। অগ্নিশর্মা চোখ নিয়ে ইনশিতার দিকে তাকাল। হুট করে ইনশিতার গলা চেপে ধরল। এত জোরে চেপে ধরেছে যে ইনশিতার মনে হচ্ছে সে আর নেই, সে মরেই গিয়েছে। দম আটকে যায় যায় অবস্থা তখন জেহেরের মা জেসমিন চৌধুরী আর জিহাদ এসে জেহেরকে ছাড়িয়ে নিলো। আর একটু থাকলে ইনশিতা বোধহয় মারাই যেত। জেসমিন চৌধুরী বলল,
-“কী করছিস জেহের? মেয়েটাকে মেরে ফেলবি নাকি?”
জেহের কিছুই বলছে না। ইনশিতার দিকে তাকিয়ে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তার মাথায় একটা কথাই ঘুরছে, তার রোজ তার কাছ থেকে দূরে যেতে চাইছে। জিহাদ ইনশিতাকে পানি খাওয়াল। ইনশিতা এখনও গলা ধরে কাশছে। জেহের রাগান্বিত কন্ঠে জেসমিন চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“সকালেই যেন আমি কাজীকে দেখতে পাই মিসেস চৌধুরী।”
কাজী ডাকার কথা শুনে সকলেই চমকে গেল। জিহাদ বলল,
-“কাজী ডেকে কী করবি?”
জেহের বিরক্তি নিয়ে তাকাল।
-“কাজী ডেকে কী করে? বিয়ে করে। কাল আমার আর রোজের বিয়ে হবে।”
ইনশিতা তখন পানি খাচ্ছিল। বিয়ের কথা শুনে বিষম খেল সে। জিহাদের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। জেহেরের সামনে গিয়ে বলল,
-“এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? এভাবে একটা মেয়েকে আটকে জোর করে বিয়ে করে সুখে থাকতে পারবি তো?”
জেহের জিহাদের কলার টেনে ধরল।
-“আই লাভ হার। আমার ভালোবাসাকেই আমি বিয়ে করবো। আর আমার সুখ নিয়ে তোর ভাবতে হবে না।”
জিহাদ নিজের রাগকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। চিৎকার করে বলল,
-“তোর মতো পাগলের সাথে কেউ কখনোই সংসার করতে পারবে না। তুই একটা পাগল ছিলি, আছিস আর থাকবি।”
পাগল শব্দটি শুনে জেহেরের পায়ের রক্ত মাথায় চড়ে গেল। ঘাড় কাত করলো সে। আর সেই চিরচেনা ভয়ংকর বাঁকা হাসি দিলো। এই আচরণের মানে ইনশিতা সহ সকলে বুঝলেও জিহাদ সেই ধ্যানে নেই। ইনশিতা আর জেসমিন চৌধুরী খুব ভালো করেই জানে জেহেরকে আটকাতে না পারলে ফর সিওর সে জিহাদকে মেরে ফেলবে। কী করবে, কী করবে ভাবতে ভাবতে ইনশিতা জেহেরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কারণ সে বুঝে গেছে জেহেরকে বশে আনার একমাত্র টোটকা হলো তার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করা। কারণ জেহের রোজ বলতে পাগল। জেহেরের সামনে গিয়ে জেহেরের হাত ধরল সে। জেহের এখনো রক্তিম চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে জিহাদের দিকে। ইনশিতা জেহেরের গালে হাত রাখল। জেহের তাকাল ইনশিতার দিকে। জেহেরের চোখ দেখে ইনশিতার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। দ্রুত দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল সে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
-“আ-আমি, মানে, কালকে আপনার সাথেই আমার ব-বিয়ে হবে।”
জেহের জিহাদের কলার ছেড়ে দিলো। সে ভাবতেই পারেনি রোজ এত সহজে মেনে নেবে। ইনশিতার বাহু ধরে কাছে এনে বলল,
-“সত্যি রোজ? তুমি সত্যি আমাকে বিয়ে করবে?”
- ...
-“বলো।”
-“হু, সত্যি।”
জিহাদ পা দিয়ে ফ্লোরে জোরে বারি দিলো। ইনশিতার দিকে একবার রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই দ্রুত বেরিয়ে গেল সে। যাওয়ার সময় দরজাটা জোরে ধাক্কা মেরে গেল। জেহেরের সেদিকে খেয়াল নেই। সে আছে তার রোজকে নিয়ে। পাশে জেসমিন চৌধুরীর দিকে নজর যেতেই চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-“আপনাকে কি যাওয়ার জন্য ইনভাইটেশন দিতে হবে?”
জেসমিন চৌধুরী দেরি না করে দ্রুত চলে গেল। জেহেরকে নিজের মায়ের সাথে এভাবে কথা বলায় চমকে গেল ইনশিতা। নিজের মায়ের সাথে এমন রুড বিহেভ কেউ করে? সে যাক গে। জেহেরকে তো সে বলে দিয়েছে বিয়ে করবে। এখন যদি সত্যি সত্যিই কাজী ডেকে আনে? কী করবে সে? হে আল্লাহ! সহায় হও। কালকে যাতে অনেক বড় একটা মিরাকেল ঘটে। প্লিজ!
.
.
.
চলবে.........................