প্রহেলিকা - পর্ব ০৮ - আশফি শেহরীন চিত্রা - ধারাবাহিক গল্প


সকালে কাজী না আসলেও ইনশিতার বাবা ঠিকই হাজির হয়েছেন জেহেরের আলিশান বাড়িতে। সাথে অবশ্য একগাদা পুলিশ আনতে ভুলেননি। নিচে চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙে জেহেরের। সামনে তাকিয়ে দেখল তার রোজ খাটে গুটিগুটি মেরে বসে আছে। বিরক্তিকর ভঙ্গিতে মুখ বানিয়ে বিড়বিড় করছে। নিশ্চয়ই জেহেরের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছে! কাল রাতে ইনশিতা যতই জোর করেছিল অন্য রুমে ঘুমানোর, জেহের কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। শেষমেষ বলে কয়ে ইনশিতাকে খাটে শুইয়ে জেহের সোফায় ঘুমিয়ে পড়ল। তবে সারারাত্রিরে এক ফোঁটাও ঘুমোয়নি ইনশিতা। চোখ, কান খোলা রেখেছে। পাগলটা কখন কী করে বসে তার ঠিক ঠিকানা আছে নাকি! 

জেহেরের চোখে চোখ পড়তেই ভেংচি কাটল ইনশিতা। বিনিময়ে মিষ্টি হাসল জেহের। এই হাসিটাই যেন ইনশিতার পাহাড় সমান বিরক্তিকে মুহুর্তেই মাটিতে তলিয়ে দিলো। এত সুন্দর হাসি ছেলেদের! জেহের মিষ্টি হাসি বজায় রেখেই ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, 

-“গুড মর্নিং মাই ব্ল্যাক কুইন।” 

ইনশিতার এক মুহুর্তের জন্য হার্টবিট মিস হলো। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল। তার মনে হলো, পৃথিবীতে ছেলেদের ঘুম জড়ানো কন্ঠের চেয়ে মাদকতাময় কন্ঠ, আর ঘুমু ঘুমু চোখের মিষ্টি হাসির চেয়ে বোধহয় সুন্দর দৃশ্য আর কোনোটাই হয় না! 

নিচের চেঁচামেচি ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছে। সেখানে ইনশিতা নিজের বাবার কন্ঠস্বর পেয়ে চমকে উঠল। বাবা এসেছে! এবার সে নিশ্চয়ই ছাড়া পাবে জেহের থেকে! 

ইনশিতার বাবা জেহেরের বাবা মায়ের সাথে চেঁচামেচি করছিল। তার কারণটা হলো জেসমিন চৌধুরী চাচ্ছেন ইনশিতাকে জেহেরের বউ করতে। কারণ তিনি ইনশিতার মাঝেই জেহেরের খুশি খুঁজে পেয়েছেন। আর ইনশিতাই পারবে জেহেরকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে, এটা তার ধারণা। কিন্তু ইনশিতার বাবা কিছুতেই তা চান না। ইতিমধ্যে জেহেরের সম্পর্কে অবগত তিনি। আর কোনো বাবাই চাইবে না তার মেয়েকে কোনো পাগলের কাছে বিয়ে দিতে। 

তখন জেহের আর ইনশিতা নেমে আসে। ইনশিতার চোখে গভীর সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো পানি টলমল করছে। ছুঁয়ে দিলেই বোধহয় কপোল বেয়ে গড়িয়ে পড়বে ঈষৎ নোনাজল। ছুটে যেতে চাইল ইনশিতা, কিন্তু পারলো না। কারণ তার কোমল হাত আবদ্ধ হয়ে আছে শক্ত হাতের মুঠোয়।

জেহের ইনশিতার কানে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, 
-“বেশি চালাকি করবে না রোজ। কোনোরকম উল্টোপাল্টা কাজ করলে তোমার কিছুই হবে না, তবে তোমার পরিবারের টিকিটারও দেখা পাবে না জীবনে। তোমার প্রিয় বাবার মরা মুখ দেখতে নিশ্চয় ভালো লাগবে না তোমার!” 

জেহেরের ঠোঁট ইনশিতার কান স্পর্শ করতেই কেঁপে উঠল ইনশিতা। ফিসফিস করা শব্দগুলো কর্ণকুহরের ভিতর দিয়ে গিয়ে হৃদয়ে ধাক্কা দিচ্ছে। শেষ কথাটা শুনতেই ভয় পেয়ে গেল ইনশিতা। জেহের যা বলে তা করেই ছাড়ে। যেখানে নিজের বাবা মাকে ছাড় দেয় না সেখানে ইশিতার বাবাই বা আর কি! 

ইনশিতাকে দেখেই ইনশিতার বাবা এগিয়ে আসলো। ইনশিতার বাবার চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। মেয়েকে দেখা মাত্রই সেই ক্লান্তি কর্পূরের মতো উবে গেছে। তিনি গিয়ে ইনশিতাকে বুকে টেনে নিলেন। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে জেহের ইনশিতার হাত ছেড়ে সিঁড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখের ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক। তারপর হুট করে নিজে গিয়ে ইনশিতার বাবাকে জড়িয়ে ধরল। সালাম দিয়ে বলল, 

-“আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো শশুরমশাই?” 

জেহেরের এমন স্বাভাবিক আচরণে সকলে অবাক হলো বেশ। ইনশিতার বাবাও বাদ যায়নি। তিনি জেহেরের ব্যাপারে যেমনটা শুনেছিলেন, জেহেরের এমন ব্যবহারের পর সবটাকেই মিথ্যে মনে হতে লাগল। কে বলবে জেহের উগ্র মেজাজী? তবুও নিজের মেয়েকে তুলে আনায় প্রচুর রেগে গিয়েছিলেন তিনি। 

-“তুমি আমার মেয়েকে কেন তুলে এনেছ?”

-আমি আপনার মেয়েকে ভালোবাসি, বিয়েও করতে চলেছি। এতে আপনার মেয়ের সম্পূর্ণ মত আছে। জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। 

ইনশিতার বাবা ইনশিতার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন, 
-“কী বলছে এসব? তুই রাজি হয়েছিস বিয়ে করতে?” 

ইনশিতা কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সে প্রথমে ভেবেছিল বাবাকে বলে দিবে যে বিয়েতে রাজি হওয়াটা ভণিতা ছিল মাত্র। কিন্তু জেহের যখন ওকে হুমকি দিলো তখন আর সত্যিটা বলার উপায় নেই। 

-“কী হলো বল?”

ইতস্তত করে বলেই ফেলল ইনশিতা, 
-“হুম। আমি রাজি হয়েছি।” 

ইনশিতার বাবা ইনশিতাকে নিয়ে একপাশে গেলেন। ইনশিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, 
-“দেখ ইতু, তুই ভয় পাস না। তুই কী সত্যিই বিয়েতে রাজি হয়েছিস নাকি তোকে ছেলেটা জোর করছে?”

-“না বাবা। কেউ আমাকে কোনোরকম জোর করেনি।”

-“তাহলে কালকে ফোন দিয়ে কেন বললি ছেলেটা তোকে আটকে রেখেছে।”

ইনশিতা আমতা আমতা করে বলল, 
-“বাবা, ও-ওই, আ-আসলে, উনি যখন আমাকে নিয়ে এসেছিল আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আর কি। তাই মানে...”

-“ছেলেটা তোকে জোর করে কেনই বা এনেছিল?” 

-“উনি আমাকে ব-বিয়ে করতে চাইছেন। তাই...”

-“সত্যি তুই রাজি তো এই বিয়েতে?” 

ইনশিতা খুব সাবধানে একবার তাকাল জেহেরের দিকে। একদৃষ্টে ইনশিতার দিকেই তাকিয়ে আছে জেহের। চোখের ভাষায় স্পষ্ট দেখছে, কোনো উল্টোপাল্টা কিছু করলে ছেড়ে দেবে না সে। 

-“আমি সত্যি বিয়ে করবো ওনাকে।”

-“সত্যি তো ইতু?” 

ইনশিতা ঠোঁট বিস্তৃত করে হাসল। 
-“একদম।”

ইনশিতার বাবা কিছুটা হলেও চিন্তামুক্ত হলেন। পুলিশদের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাদের বিদায় দিলেন। তার নিজেরও এই বিয়েতে কোনো আপত্তি নেই। তিনি সবসময় চেয়েছেন তার মেয়েটা যাতে একটু সুখে থাকে। কেউ যাতে তাকে ভালোবেসে কাছে রাখে। আর জেহেরকে দেখার পর তারও এটাই মনে হয়েছে, তার মেয়েটা সুখে থাকবে এ বাড়িতে। তবে তিনি যে শুনলেন জেহের অস্বাভাবিক? সে নাকি মানুষ খুন করতেও দ্বিধাবোধ করে না? তাহলে কী সব মিথ্যা ছিল? প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালেন জেহেরের মতো অবিকল ছেলেটির দিকে। ছেলেটি কি তবে তাকে মিথ্যা বলেছিল? আর বললেই বা কেন? এখন সেই ছেলেটির দৃষ্টিতে তিনি দেখলেন রাগ, প্রতিহিংসা। এত রেগে আছে কেন ছেলেটি? মনে হচ্ছে যেন তার থেকে তার প্রিয় জিনিসটি ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। 

জেহের এগিয়ে আসল ইনশিতার বাবার দিকে। 
-“আপনার এই বিয়েতে কোনো আপত্তি নেই তো শশুরমশাই?”

ইনশিতার বাবার বুক আনন্দে ভরে উঠল। ছেলেটা কী অমায়িক ব্যবহার করছে তার সাথে! এমন ছেলের হাতে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি না হয়ে কি পারা যায়? 

-“না বাবা, আমার কোনো আপত্তি নেই।”

হাসল জেহের। ইনশিতার দিকে এক পলক তাকাল সে। সেই মুহুর্তে ইনশিতাও তাকাল। অগোচরে জেহের ঠোঁটটাকে চুমুর মতো করে ইশারায় কিস ছুঁড়ে দিলো। জেহেরের এহেন কান্ডে ইনশিতার মুখ হা হয়ে গেল। কী অসভ্য ছেলে! সকলের সামনে অসভ্যতামি করছে। জেসমিন চৌধুরী সবচেয়ে বেশি খুশি হন বিয়েতে। জেবাও খুশি হলো, তবে মনের মধ্যে খচখচটা রয়েই যায়। তবে একজন কিছুতেই শান্ত হতে পারল না। মনের মধ্যে, হিংসা, রাগ, অস্থিরতা সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। সে কতই না বোঝাল ইনশিতার বাবাকে। তাও রাজি হলো? অসহ্য! 

জেহের বলল, 
-“আমি কাজীকে ডেকে পাঠাচ্ছি, আজই আমার আর রোজের বিয়ে হবে।” 

-“এখন?”

-“হ্যাঁ, এখনই।”

-“আমার একমাত্র মেয়ে। আমি চাই আমার মেয়ের খুব ধুমধাম করে বিয়ে দিতে।” 

-“রোজকে আমি এক মুহুর্তের জন্যও দূরে রাখতে চাই না।”

-“কিন্তু...”

-“আর যদি অনুষ্ঠান করে বিয়ে হয়ও, রোজকে এই বাড়িতে রেখেই হবে।”

ইনশিতার বাবা যরপরনাই অবাক। তবুও কিছু বললেন না। মেয়ে সুখে থাকবে, এর চেয়ে বড় চাওয়া আর কিইবা হতে পারে! 

-“ঠিকাছে। তোমার কথা মতোই হোক তাহলে।”

জিহাদ রেগেমেগে বের হয়ে গেল। কেউ ভ্রুক্ষেপ করল না তার দিকে। 

জেহের গার্ডদের কাজীর ব্যবস্থা করতে বলল। বাঁধ সাধল ইনশিতা। 
-“কাজীকে ডাকবেন না।”

ইনশিতার কথায় জেহেরের রাগ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে হাসি দিয়ে বলল, 

-“কেন রোজ? তুমি কী বিয়ে করতে চাচ্ছ না?”

জেহেরের রাগের তেজ অনুভব করল ইনশিতা। 
-“করবো। তবে...”

-“তবে?” 

-“আমার কিছু শর্ত আছে।”

-“সব মানতে রাজি। সব শর্ত কবুল।” 

-“আগে শুনে নিন তো শর্তগুলো।”

-“বলো তাহলে।”
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন