ইনশিতা ভ্রু কুঁচকে পিছন ফিরে তাকালো। সিঁড়ির গোড়ায় ব্ল্যাক শার্ট আর ব্ল্যাক ডেনিম জিন্স পরিহিত একটি স্মার্ট ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আকর্ষণীয় ফিগার যাকে বলে। সুদর্শন ছেলেটির ফর্সা মতন শরীরে কালো রঙের শার্টটি ফুটে উঠেছে। আয়ত আকৃতির চোখে এক ধ্যানে চেয়ে আছে তার দিকে। মসৃণ চুলগুলো কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ফর্সা গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। গোলাপী রঙা ঠোঁটে কিছু একটা বিড়বিড় করছে সে।
জেহের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই চোখ গেল কালোগোলাপ রাখা চেয়ারটির দিকে। যেখানে একটি মেয়ে ফুলগুলো নিয়ে কিছু একটা করছে। পিছন ফিরে ছিলো বিধায় মেয়েটির সামনের অংশ দেখতে পায়নি সে। পরনে কালো শাড়ি। মেয়েটি একটু এদিক ফিরতেই চোখ আটকে গেল তার। হৃৎপিন্ডের স্পন্দন দ্রুত গতিতে চলতে লাগলো। শ্যামলা রঙের মেয়েটির মায়াবী চোখে কাজল লেপ্টানো, কানে কালোগোলাপ গুঁজে রাখা। ঠোঁটে এক চিলতে হাসি। হাতের কাঁচের চুড়িগুলো ঝনঝন করছে। ধারালো তার গায়ের গড়ন। কালোগোলাপ মাথায় দেওয়ায় মেয়েটিকে আরো বেশি মায়াবী লাগছিলো। অনেক মেয়েকেই সে দেখেছে, তবে কখনো এমন লাগেনি তার। তাহলে এই মেয়েটিকে এত ভালো লাগছে কেন তার কাছে? তার মাথায় হঠাৎ আসলো এই মেয়েটি কুইন, তার ব্ল্যাক কুইন। কথাটি মাথায় আসতেই জেহেরের ঠোঁটে ফুটে উঠলো মৃদু হাসি। বিড়বিড় করে কথাটি বলল সে। তখনই মেয়েটা পিছনে ফিরলো আর জেহের হাসি থামিয়ে দেখতে লাগলো তার ব্ল্যাক কুইনকে।
তার মধ্যেই জেবা আসলো হাতে চায়ের কাপ নিয়ে। জেহেরকে লক্ষ্য করলো না সে। ইনশিতাকে দেখে চোখ বড় বড় করে বলতে লাগে,
-“ওয়াও! ইউ লুক সো বিউটিফুল ইনশিতা! আমি তো চোখ সরাতেই পারছি না তোমার দিক থেকে।”
বেশ লজ্জা পেল ইনশিতা। লজ্জায় তার গাল রাঙা হয়ে গেল। জেবা বুঝতে পেরে হেসে বলল,
-“থাক থাক, লজ্জা পেতে হবে না। এখন এখানে বসো। আমার সাথে একটু গল্প করো।”
সোফায় এসে বসলো তারা।
-“সিরিয়াসলি বলছি ইনশিতা, আমি যদি ছেলে হতাম না তাহলে তোমাকে এক্ষুনি তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করতাম।”
এই একটি কথায় ইনশিতা লজ্জায় রাঙাবতী হলেও ওপাশে কেউ রাগে দপ করে জ্বলে উঠলো। জেহের ঘাড় কাত করে একহাতে নিজের চুলগুলো টেনে ধরলো। চোয়াল শক্ত হয়ে গেল ক্রমশই। রাগে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। সে ছাড়া অন্যকেউ তার ব্ল্যাক কুইনকে বিয়ের কথা কেন বলবে? হোক সে ছেলে বা মেয়ে। কেন অন্য কেউ তাকে সুন্দর বলবে? একমাত্র জেহের ছাড়া অন্য কেউ তাকে কিচ্ছু বলবে না, তার এই সুন্দর সাজ অন্য কেউই দেখবে না। না না, কেউ না, কেউই না...
ইনশিতার হঠাৎ মনে হলো কেউ তাকে হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। হাত ধরা ব্যক্তির দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো সে। ঘাড় কাত করে লাল চোখ নিয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জেহের। চোখ দিয়ে মনে হচ্ছে আগুনের লাভা বের হচ্ছে। এই ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে ইনশিতার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। জেহের তার হাত ধরে টান দিয়ে নিয়ে যেতেই থেমে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে দেখলো জেবা ইনশিতার অপর হাত ধরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। জেবা জেহেরের এই রূপ দেখে ভয় পেলেও সাহস নিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
-“কি করছো জেহের ভাইয়া? তুমি ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? ছেড়ে দাও ওকে, ও এখন বাসায় যাবে।”
রাগ আরো বেড়ে গেল জেহেরের। একে তো তার ব্ল্যাক কুইনের হাত ধরে রেখেছে তার উপর তাকে ছেড়ে দিতে বলছে। সে ছাড়া তার ব্ল্যাক রোজকে কেন অন্য কেউ টাচ করবে? সে কেন ছাড়বে তার রোজকে? ও কোথাও যাবে না, শুধুই তার কাছে থাকবে। জেবা ইনশিতার হাত না ছাড়ায় জেহের আচমকা গরম চায়ের কাপ নিয়ে জেবার হাতে ঢেলে দিলো। গরম চা হাতে পড়ায় মুহুর্তেই ইনশিতার হাত ছেড়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো জেবা। ইনশিতাও এমন ঘটনায় হতবাক। ইনশিতা জেহেরের হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে জেবার জন্য দৌড়ে পানি আনার জন্য যেতেই আবারো নিজের হাতকে শক্ত হাতের মুঠোয় আবিষ্কার করলো। ইতোমধ্যে জেবার চিৎকারে মিসেস জেসমিন, জিহাদ আর শিফা উপস্থিত হলো। জেবার এই অবস্থা দেখে জেসমিন তাড়াতাড়ি গিয়ে বরফ পানি নিয়ে আসলো। জিহাদও দৌড়ে ঔষধের বক্স নিয়ে আসতে গেল। ইনশিতা জিহাদ আর শিফাকে খেয়াল করলো না। জেহের ইনশিতার হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। ইনশিতা ভয়ে কান্না করে দিয়েছে।
-“ক..কি করছেন আপনি? হাত ছাড়ুন। ছ..ছাড়ুন বলছি।”
ইনশিতার কোনো কথাই জেহেরের কানে পৌঁছায়নি। মিসেস জেসমিন তা খেয়াল করলেন।
-“জেহের, কি করছিস কি তুই? মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?”
তার কথাতেও কর্ণপাত করলো না জেহের। ইনশিতা হাত ছাড়াতে চাইলে জেহের আরো শক্ত করে হাত চেপে ধরলো। এতে করে ইনশিতার কমদামি কাঁচের চুড়িগুলো ভেঙ্গে গেল। ব্যাথা আর ভয়ে কান্না করতে গিয়ে কথাও মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। জেহের সিঁড়ি দিয়ে একপ্রকার টেনে হিঁচড়ে তার নিজের রুমে গিয়ে ইনশিতাকে নিয়ে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। ইনশিতা আরও বেশি ভয় পেয়ে গেল। না জানি জেহের এখন তার সাথে কি করে? সর্বদা ছেলেদের থেকে দশহাত দুরে থাকতো সে। আর আজ একটা বিশাল রুমে বন্দি তাও একটা অচেনা অজানা ছেলের সাথে। ভয়ে হাত পা থরথর করে কাঁপা শুরু করলো। যে কেউ দেখলে তাকে মৃগী রোগী ভেবে ভুল করবে না।
জেহের এগিয়ে এসে ইনশিতার দু'বাহু ধরে ঝাঁকালো। এতক্ষণে ইনশিতা খেয়াল করলো জেহেরের চোখের মণি কালচে নীল। এই প্রথম সে কারো নীল চোখের মনি দেখলো। জেহের হঠাৎ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। হঠাৎ জড়িয়ে ধরায় ইনশিতা ভয়ে শক্ত হয়ে জমে গেল যেন। এই ছেলে পাগল নাকি? এমন আচরণ করছে কেন? একে তো জীবনেও দেখেনি সে। এই প্রথম দেখেছে। তার মধ্যে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছে যাতে ইনশিতার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তার মনে হচ্ছে তার শরীরের সকল হাড্ডিগুড্ডি ইতোমধ্যে ভর্তা হয়ে গিয়েছে।
ইনশিতা কম্পিত কন্ঠে কোনোরকমে বলল,
-“আমায় ছেড়ে দেন প্লিজ। আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি যে এভাবে যাতাকলের মতো পিষে মেরে ফেলছেন? ব্যথা লাগছে ছাড়েন প্লিজ।”
এতুটুকু বলতেই যেন দম ফুরিয়ে গেল ইনশিতার। ব্যথার কথা শুনে জেহের আলগা করে ধরলো ইনশিতাকে। আলগা হতেই ইনশিতা জেহেরকে ধাক্কা মেরে দুরে সরিয়ে দিয়ে রেগে বলল,
-“আপনি কি পাগল? এভাবে আমাকে হুট করে এখানে আনার মানে কি? আর জেবাকেই বা চা ছুঁড়ে মারলেন কেন?”
-“ও তোমাকে টাচ করেছিলো। আর আমার কাছে তোমাকে আনার সময় আটকেছিলো। আমাকে তোমার কাছ থেকে কেউ দুর করার চেষ্টা করলে তাকে আমি এমনি এমনি ছেড়ে দেবো নাকি?”
দাঁত কিড়মিড় করে বলল জেহের।
-“আপনাকে আমি চিনিনা জানিনা, আর না আপনি আমাকে চিনেন। অচেনা একটা মেয়ের হাত ধারা, তাকে জড়িয়ে ধরা এগুলো কি ধরনের অসভ্যতামো? ম্যানারলেস কোথাকার।”
জেহের দাঁতে দাঁত চেপে রাগ আটকালো। এই প্রথম সে কারো উপর রাগ দেখালো না। বাকি সময় রাগ উঠলে কাউকেই ছাড়ে না সে, এমনকি নিজের পিতা মাতাকেও না। সে তার রোজের উপর রাগ দেখাবে না। একদমই না। তাকে ভালোবাসবে সে, খুব খুব ভালোবাসবে।
-“দেখুন। আমাকে যেতে হবে। বাবা মা অপেক্ষা করছে আমার জন্য। প্লিজ যেতে দিন আমায়।”
যাওয়ার কথা শুনেই আবারও রাগ চাপলো জেহেরের মাথায়। তার রোজ তার কাছ থেকে চলে যাওয়ার কথা বলছে? না না সে কিছুতেই যেতে দেবে না। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,
-“তুমি কোথাও যাবেনা রোজ, আ..আমার কাছে থাকবে সবসময়। আমার চোখের সামনে।”
এই কথাটাকেই বারবার করে বলতে লাগলো সে। আর নিজের চুলের পিছনের দিক টেনে ধরে বিড়বিড় করতে লাগল। এদিকে ইনশিতা হা হয়ে গেছে। এই ছেলে কিভাবে জানলো তার নাম রোজ? এই নামে কেউ তাকে ডাকেই না। আর না এখানকার কেউ জানে।
-“কি বললেন আপনি? কি নামে ডাকলেন?” অবাক স্বরে জানতে চাইলো ইনশিতা।
-“র..রোজ। আমার ব্ল্যাক রোজ। ত..তুমি শুধু আমার রোজ। আমার।”
-“কি যা তা বলছেন? আমি আপনার হতে যাবো কেন? আর আমার নাম কি করে জানলেন?”
-“তোমার নাম মানে?”
-“রোজ আমার নাম।”
ইনশিতার কথা শুনে আবারও রাগ লাগলো জেহেরের। রোজ যদি ওর নাম হয় তার মানে আরও অনেকে তাকে এই নামে ডাকে? আর এই নাম শুধুমাত্র জেহেরের দেওয়া। এই নামে অন্য কেউ কেন ডাকবে? কেন?
আবারও গিয়ে ইনশিতার বাহু শক্ত করে ধরলো। ইনশিতা চোখ বন্ধ করে ব্যথা সহ্য করলো। এই ছেলের হাতে এত শক্তি কোথা থেকে আসে? কি খায় এ?
ইনশিতার কানে দাঁত কটমট করে হিসহিসিয়ে বলল,
-“তোমার নাম রোজ হলে এই নামে আরও অনেকে ডাকে;তাই না? এই নামে কেউ ডাকতে পারবে না তোমায়। কেউ না। একমাত্র জেহের চৌধুরী ছাড়া।”
জেহের কথায় পুরো শরীর কেঁপে উঠলো ইনশিতার। এমন ভয়ঙ্কর ভাবে কেউ কথা বলে? আর তার নাম যার ইচ্ছা ডাকবে। একমাত্র এই ছেলেই ডাকবে কেন তার নাম? আশ্চর্য! আর সে ভালোভাবেই বুঝে গিয়েছে এই জেহের ছেলেটা মানসিক ভাবে অসুস্থ। সাইকো একটা। নাহলে এমন আচরণ কোনো স্বাভাবিক মানুষ করতে পারে না।
জেহের আবারও বলতে লাগলো,
-“এখান থেকে যাওয়ার কথা চিরতরে ভুলে যাও রোজ। কোত্থাও যেতে পারবে না তুমি উইদাউট মাই পারমিশন।”
রোজ নামে ডাকায় ইনশিতার প্রথমে ভালো লাগলো। তার ইচ্ছা ছিলো কেউ না কেউ তাকে যাতে রোজ বলে ডাকে। পরমুহুর্তে আগের আর পরের কথা শুনে রাগের সাথে ভয় ঝেঁকে ধরলো তাকে। সে কোথায় যাবে না যাবে সেটা এই বেয়াদব ছেলেটাকে কেন বলবে?
-“কেন? আপনার পারমিশন নেব কেন? আর এখানেই বা আজীবন কেন থাকবো? আপনার কোনো কথা শুনতে বাধ্য নই আমি। ছাড়ুন আমায়। ছাড়ুন বলছি।”
-“তুমি বাধ্য রোজ। কারণ আমি তোমায় ভালোবাসি। আই লাভ ইউ মাই ব্ল্যাক কুইন।”ইনশিতার কানে ফিসফিস করে বলল জেহের।
ইনশিতার শরীরে ভয়ের এক ঠান্ডা শিহরণ বয়ে গেল।
-“আমি যেহেতু তোমাকে ভালোবাসি সেহেতু তুমি আমায় ছেড়ে কোত্থাও যেতে পারবে না। যা কিছুই করো না কেন সবকিছুতেই আমার পারমিশন নেবে। আমার কথা মতো চলবে তুমি। কারো সাথে দেখা করতে হলেও আমার পারমিশন নেবে। ইভেন তোমার বাবা মায়ের সাথে দেখা করার জন্যও।”
ইনশিতা যা ভেবেছিল তা আসলেই ঠিক। এই ছেলেটা একশ পার্সেন্ট সাইকো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর কেউ যদি কাউকে ভালোবাসে তাহলে সে সবসময় তার ভালোবাসার মানুষের স্বাধীনতায় কোনো বাঁধা দেয় না। উল্টো প্রায়োরিটি বেশি দেয়। অথচ এই ছেলে তো সম্পূর্ণ বিপরীত। এটা কোনোমতেই ভালোবাসা না। কিন্তু এখন এর থেকে কোনোমতেই জোর করে ছাড়া পাওয়া যাবে না। তাই বুদ্ধি দিয়েই সরতে হবে। কিছুটা দম ছেড়ে বলল,
-“আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি। এখন আমার খুব খিদে পেয়েছে। আপনি কি একটু খাবার ব্যবস্থা করতে পারবেন?”
জেহের অস্থির হয়ে বলল,
-“তোমার খুব খিদে পেয়েছে তাই না, আ..আমি এক্ষুনি খবার পাঠতে বলছি। না না, তোমার জন্য আমি নিজ হাতে খাবার বানিয়ে আনবো। তুমি এইখানটায় বসো রোজ। আমি না আসা পর্যন্ত এক পাও নড়বে না, একদমই না।”
বলেই রুমের বাহিরে যেতে লাগলো। যেতে গিয়ে হঠাৎ পিছন ফিরলো। পিছন ফিরতে দেখে ইনশিতার মুখ চুপসে গেল। হঠাৎ কি মনে করে পিছন ফিরলো আবার? জেহের এসে দু’হাতে ইনশিতার এইটুকুনি মুখটি ধরে কপালে চুমু খেয়ে চলে গেল। চলে যেতেই ইনশিতা রেগে শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালটা ঘষে ঘষে মুছে নিলো। যেন কপালে কালি দিয়ে কেউ মেখে দিয়েছে আর সে সেটা ঘষে উঠাচ্ছে।
ইনশিতা দ্রুত করে দরজা খুলে পালিয়ে যেতে ধরলো তখনই তার মনে হলো দরজাটা আটকানো। শিট, তার প্ল্যানে পানি ঢেলে দিলো সাইকোটা। বারান্দা দিয়েও নামার কোনো উপায় নেই। নিচে কতগুলো গন্ডারের মতো গার্ড পাহারা দিচ্ছে। এখন কি করে পালাবে সে? ধুর!
এসব ভাবছিলো আর তখন দরজা খোলার ক্ষীণ শব্দ কানে এলো তার। দেখলো সেই জেহের ছেলেটি আর সাথে একটি মেয়ে। জেহেরকে দেখেই ভয় ঝেঁকে ধরলো আবার তাকে। তবে ইনশিতা চরম অবাক হলো যখন দেখলো জেহের ছেলেটির চোখে চশমা আর পরনে অন্য কাপড়। আর চোখ মুখ একদম শান্ত।
মেয়েটি ইনশিতার কাছে এসে তাকে এক সেট জামা দিয়ে বলল পাল্টে নিতে। ইনশিতাও তাই করলো। ওয়াশরুমে গিয়ে কয়েক সেকেন্ডই চেঞ্জ করে আসলো। আর দেখলো মেয়েটি জেহেরকে জিহাদ নাম ধরে কথা বলছে। আশ্চর্য! এটা কি জেহের নয়? জেহের তো ইনশিতা কে দেখে এত শান্ত থাকে না।
সে জেহেরের মতো দেখতে ছেলেটিকে কিছু বলতে নিলো,
-“আপনি..”
তখন জিহাদ তাকে থামিয়ে বলল,
-“আমি জানি এখন তোমার মনে প্রশ্ন চলছে; কিন্তু এখন কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় নেই। তুমি এই মুহুর্তে চলে যাও, ভাই যেকোনো মুহুর্তে চলে আসবে। গো।”
এই ছেলেটির কন্ঠ জেহের থেকে কিছুটা মাত্র ভিন্ন। জেহেরের কন্ঠে গম্ভীরতা মেশানো আর এই ছেলেটির কন্ঠে রয়েছে চঞ্চলতা। চেহারা শান্ত হলেও কন্ঠে প্রচুর চঞ্চলতা প্রকাশ পায়, আর জেহেরের চেহারাও যেমন গম্ভীর তেমন তার কথাবার্তাও। তবে জেহেরকে গাম্ভীর্যপুর্ণ চেহারাটাই বেশ মানিয়েছে। ইনশিতা কিছু না ভেবেই দরজা ডিঙিয়ে চলে যায়। সিঁড়ির কাছে যেতেই দেখলো জেহের রান্নাঘরে অ্যাপ্রোন পরে কিছু একটা করছে। ইনশিতার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। উপরেও জেহের আবার নিচেও জেহের। কি হচ্ছে এসব? আপাততঃ এসব চিন্তা বাদ দিয়ে তাকে আগে এখান বের হতে হবে। তবে রান্নাঘর থেকে পুরো ড্রয়িং রুম দেখা যায়, আর সেখান দিয়েই তাকে যেতে হবে। পরক্ষণেই মনে হলো সে তো অন্য একটা জামা পরে আছে, ওড়নাটা দিয়ে মুখটা ভালোভাবে ঢেকে নিলো। ব্যস এখন আর জেহের চিনবে না। ইনশিতা চুপিসারে জেহেরের সামনে দিয়ে বেরিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো। বাড়ি থেকে বের হতেই রাস্তার ধারে সাইকেল নজরে আসলো। সেটা নিয়েই সে চলে আসে।
.
.
বর্তমানে..
—————
-“এবার বুঝেছি কাহিনীটা। আমি জেবাকে কিছুটা হলেও চিনতাম, কিন্তু ওর যে ভাই আছে সেটা জানতাম না। আর আমার কিন্তু তোর মতোই মনে হচ্ছে, এই জেহের ছেলেটা আসলেই সাইকো। অস্বাভাবিক একটা ছেলে। এর নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা আছে। পাগল হবে, আর পাগলের সাথে সংসার করলে লাইফ পুরা হেল হয়ে যাবে। আর কি মনে হয় জানিস, জেহেরের মতো দেখতে ছেলেটা বোধহয় তার ভাই-টাই হবে।”
হড়বড় করে বলল নয়নিকা। ইনশিতা অন্ধকার আকাশে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বলল,
-“হয়তো।”
-“একটা জিনিস বুঝলাম না আমি। জেহের ছেলেটা তোকে দেখেই হঠাৎ এমন করলো কেন? তোকে তো আগে কখনো দেখেনি তাই না?”
-“আমি তো তাকে কখনোই দেখিনি। আর তিনি এমনটা কেন করলো সেটা আমি কি করে বলবো?”
ছোট্ট একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নয়নিকা বললো,
-“আসলেই তো। তুই-ই বা কীভাবে বলবি! সাইকো তো, তাই মনে হয় তোর সৌন্দর্য দেখে মাথা আউলিয়া গেছে।”
ইনশিতা নয়নকে আলতো ধাক্কা দিয়ে হেসে বলল,
-“ধুর।”
-“আচ্ছা বাদ দে, এটা ক্ষণিকের দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যা।”
-“হু।”
সেই রাতে আর এই বিষয় নিয়ে কোনো কথা হলো না তাদের মধ্যে। দুজনেই বারান্দায় বসে এটা সেটা বলে, হাসাহাসি করে রাত পার করলো।
.
.
.
চলবে............................