ভালোবাসবো যে তোকে - পর্ব ০৬ - সারা মেহেক - ধারাবাহিক গল্প


আয়ান যেন একটা স্ট্যাচু। যেমনভাবে দাঁড়ীয়ে ছিলো অমনই দাঁড়ীয়ে আছে।
মৌ হালকা স্বরে বলছে,
"সেই কখন থেকে বকা দিয়েই যাচ্ছো দিয়েই যাচ্ছো। থামার নাম গন্ধই নেই। জানো না এতো হ্যান্ডসাম ছেলেদের রাগ করা সাজে না?এই হোয়াইট শার্টে তোমাকে যা লাগছে না.... মনে হচ্ছে চিবিয়ে খাই।"

এ কথা শুনে আয়ানের চোখ দুটো আরো বড় হয়ে গেলো।সে মনে মনে বলছে,"এটা মেয়ে নাকি অন্যকিছু!!একটুও ভয় লাগে না আমার কাছে আসলে!!উল্টা আমার ই ভয় লাগে।"

"আর হ্যা কি যেনো বলছিলে,আমি তুহিন এর থেকে কেনো ভয় পাচ্ছিলাম।তোমার কাছে আসলে কেনো ভয় পাইনা।
এটার উত্তর আমি নিজেই জানি না। আমি স্বেচ্ছায় তোমার কাছে আসলে আমার একটু ও ভয় করে না।একটুও না।
যাই হোক। এতো রাগ করতে হয় না বুঝেছো?? একটু রাগটা কমাও।"

এর মধ্যে আয়ানের ফোনটা বেজে উঠলো।মৌ আয়ানের মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলো।আয়ান যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো।এরপর সে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে মনা ফোন দিয়েছে।সে একবারেই মনার কথা ভুলে গিয়েছিলো।
মৌ উকিঁ দিয়ে দেখলো কে ফোন দিয়েছে।মনার নাম চোখে পরতেই সে রেগে গেলো।
"উফ এই মেয়েটা অসময়ে ফোন কেনো করলো!!হাসবেন্ড ওয়াইফ এর রোম্যান্স টাইমে ডিস্টার্ব করা একদমই উচিত না।"
এ বলেই মৌ মিটমিট করে হাসছে।আর আয়ানের গো সেই রাগ হচ্ছে।সে ফোন রিসিভ করে কথা বলতে বলতে বারান্দায় চলে গেলো।

মনাঃআয়ান বেবি,আমি সেই কখন থেকে ওয়েট করছি তোমার জন্য তুমি কোথায়??

আয়ানঃমানে আসলে বাসায় একটু জরুরী কাজ পরে গিয়েছিলো তো তাই তাড়াতাড়ি চলে আসতে হয়েছে।

এদিকে মৌ পিছন থেকে সব শুনছে।সে তো বেশ মজা পাচ্ছে।

মনাঃতো একবার বলবে না আমাকে?? আমি কতক্ষণ ধরে বসে আছি।

আয়ানঃআচ্ছা সরি।কাজটা খুব জরুরী ছিলো বিধায় চলে এসেছি।আর ফোন দেওয়ার কথাও মনে ছিলো না।

মৌ আবার বলে উঠলো,
"আরে আমার আয়ান বেবি বলে না কেনো কি জরুরী কাজ।হুম?? লজ্জা পাচ্ছো? বলে দাও যে আমরা....... "
আর কিছু বলতে যাওয়ার আগেই আয়ান মৌ এর মুখ চেপে ধরে।ঐদিকে মনা লাইনে আছে।সে একটা মেয়ের কথা শুনতে পেয়ে বললো,
"এটা কার কন্ঠ আয়ান??কি বলছে সে?"

আয়ান আমতা আমতা করে বললো,
"আরে ও কিছু না।তুমি বাসায় চলে যাও।আমি পরে ফোন দিবোনে।"

"আচ্ছা রাখি। বাই।"

"হুম বাই।"

আয়ান ফোন রেখে মৌ কে বললো,
"এই তোর কি কোনে কাজ নেই হুম?? কি সব উল্টা পাল্টা বলছিলি??"

মৌ কিছু বলতে যাবে কিন্তু বলতে পারছে না। কারন আয়ান তার মুখ চেপে ধরেছে।সে আয়ানকে ইশারা করলো হাত সরাতে।আয়ান বুঝতে পেরে হাত সরিয়ে নিলো।

"আমি ভুল কি বললাম বলো।আমরা একসাথে সময় কাটাচ্ছিলামই তো।"

"ধুর...তোর সাথে কথা বলা মানে নিজের সময় নষ্ট করা।"

বলেই আয়ান ওয়াশরুমে গেলো ফ্রেশ হতে।
আর মৌ অহনার রুমে এসে বসলো।

"মৌ জানিস আজকে না দাদি আসবে।"

মৌ এ কথা শুনে খুব খুশি হলো।কারন তার সাথে দাদির খুব মিল।

"কি বলিস!!!কখন আসবে দাদি?"

"রওনা দিয়েছে। বিকালের মধ্যেই চলে আসবে।রওনক ভাইয়ের সাথে আসছে।"

রওনক হলো অহনা আর আয়ানের চাচাতো ভাই।সে বয়সে আয়ানের থেকে ছোটো আবার অহনার থেকে বড়।

"ওহ।এবার দাদি আসছে সময়টা বেশ ভালো কাটবে।"

"হুম।"

বিকালের দিকে দাদি চলে আসলো।সবাই তো তাকে দেখে অনেক খুশি। সবচেয়ে বেশি খুশি অহনা আর মৌ।মৌ কে দেখে দাদি বললো,
"আমি খুব খুব খুশি হয়েছি রে মৌ।তোকে আর আয়ানকে একসাথে দেখতে আমার খুবই ভালো লাগে।"

এরই মধ্যে আয়ান নিচে নেমে আসলো।সে দাদিকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।

দাদিঃহয়েছে হয়েছে শুধু উপর উপরে ভালোবাসা দেখাতে হবে না।একবারও তো ফোন দিস না।

আয়ানঃআরে দাদি এতো মাইন্ড করতে হয়না।

আয়ানের আম্মুঃসবার কথাবার্তা কি হলো??মা কে রেস্ট নিতে দে। এতো দূর থেকে এসেছেন উনি।মা চলো তোমার রুমে নিয়ে যাই।

তারপর সবাই যে যার রুমে চলে গেলো।

বিকালে সবাই ড্রইং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে।হঠাৎ রওনক মৌ আর অহনাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
"তোমাদের দুজনের পড়া কেমন চলছে?"

মৌ হালকা হেসে জবাব দিলো,"এই তো আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো চলছে। আপনার বিজনেস কেমন চলছে?"

"বেশ ভালো চলছে।"

এভাবে মৌ আর রওনক কিছু সময় কথা বললো।আর এদিকে আয়ান তো রেগে বোম হয়ে আছে। যেকোনো সময় ফাটতে পারে এ বোমটা। আর এসবের মজা নিচ্ছে দাদি আর অহনা।

দাদি ফিসফিস করে অহনার কানের কাছে বললো,
"আরে অহনা আমাদের আয়ান বোম যেকোনো সময়েই ফাটতে পারে রে।যেমন জ্বলছে ও।"

"ঠিক বলেছে দাদি।"

অহনা বলে উঠলো,"জানো গো দাদি,আমি না খুব জ্বলার গন্ধ পাচ্ছি।সেই কখন থেকে কিছু একটা জ্বলেই যাচ্ছে।"

"হুম ঠিক ধরেছিস তুই।আমি একই জিনিস খেয়াল করছি।"

আয়ান নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে দাঁতে দাঁত চেপে মৌ কে বললো,
"মৌ এখুনি একটু রুমে আসতো।একটা জরুরী কথা আছে।"

মৌ জবাব দিলো,"তুমি যাও আমি একটু পরে আসছি।"

""কি বললাম আমি কথা কি কানে যায়নি?আমি বলেছি এখনই আসতে।"

অহনা মৌ এর কানে কানে বললো,"যা রে মৌ। ভাইয়া যেহুতু এভাবে বলছে কাজ আছে নিশ্চয়ই।"

"হুম যাচ্ছি রে।"
 
তারপর মৌ আয়ানের পিছু পিছু রুমে গেলো। রুমে ঢুকার সাথে সাথে আয়ান দরজা বন্ধ করে দিলো।

"কি হলো এতো জোরে দরজা বন্ধ করলে কেনো?আর কি কাজ?"

আয়ান কিছু না বলে মৌ আর হাত দুটো দেয়ালের সাথে তার দু হাত দিয়ে জোরে চেপে ধরে। এতে মৌ খুব ব্যাথা পায়।
আয়ান রেগে বলে,
"এই তোর সাহস তো কম না। এভাবে পরপুরুষের সাথে কথা বলছিস লজ্জা করে না??"

"আয়ান আমার হাত ছাড়ো প্লিজ।খুব ব্যাথা লাগছে।"

"লাগুক ব্যাথা। এতো কথা বলার আগে তোর ভেবে নেয়া উচিত ছিলে।"

"কেনো ভাববো শুনি??আমি সবার সামনেই কথা বলছিলাম।কারোর অগোচরে কথা বলি নি।"

"যাই হোক।তোর এতো কথা বলতে হবে কেনো?? তারপর আবার আমি ডাকলে বলিস একটু পর আসছি।"

মৌ আয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,"তোমার এতে জ্বলছে কেনো??"

আয়ান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
"আআমার জ্বলবে কেনো??"

"তাই তো। তাহলে কোনো সমস্যা নেই তো।আমি কথা বললে তোমার কোনে সমস্যা নেই তাহলে আমি কথা বলবো।"

আয়ান রেগে মৌ এর হাত আরো জোরে চেপে ধরে বললো, "তুই কথা বলবি না মানে বলবি না।অন্য পুরুষের সাথে এতো কিসের কথা হ্যা?

ব্যাথায় মৌ এর চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা পানি পরে গেলো।
সে বললো, "তাহলে একই নিষেধাজ্ঞা তোমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।তুমি কেনো মনার সাথে কথা বলবে?? স্ত্রী ঘরে থাকা সত্ত্বেও কেনো তুমি পরনারীর সাথে দেখা করতে যাবে? তুমি যখন এমন করো তখন কি আমার গায়ে লাগে না??
আমি করলেই দোষ আর নিজে সেই একই কাজ করবা কিন্তু আমি কিছু বলবো না!! আমাকে বলার আগে নিজে শুধরে নাও।"

এসব শুনে আয়ানের নিজেকে বড়ই অপরাধী মনে হলো। সে মৌ এর চোখে পানি দেখে তার হাত দুটো ছেড়ে দিলো।আর সাথে সাথে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।আর মৌ সেখানেই বসে কান্না করতে লাগলো।নিজের সাথে নিজেই কথা বলছে সে,

"এভাবে কষ্ট কেনো দাও আমাকে আয়ান?জানো খুব কষ্ট হয় যখন ভাবি যে তোমার মনে আমি না অন্য কোনো মেয়ে আছে।আমাকে কি কখনো ভালোবাসতে পারবেনা?
জানো আমি কখনো রিলেশন করি নি। এসবের চিন্তা ভাবনাও করেনি।আমি ভেবে রেখেছিলাম আমার বর কে আমি আমার চাইতেও বেশি ভালোবাসব।আর আমার বর ও আমাকে খুব ভালোবাসবে। কিন্তু আমার কপালে এমন কিছুই নেই।"

মৌ অঝোর ধারায় কাঁদতেই থাকে।
আর এদিকে আয়ান ছাদে এসে একা একা দাঁড়ীয়ে আছে।বিকালের অস্ত যাওয়া সূর্য দেখছে।

"আচ্ছা আমি তো মনাকে ভালোবাসি তাহলে মৌ কে অন্য ছেলের সাথে দেখলে এতো খারাপ লাগে কেনো? মৌ কাছে আসলে এক অন্যরকম অনুভূতি কেনো হয়?"

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আয়ান আবার বলছে,
"নাহ মৌ এর সাথে এমন করা একদমই উচিত হয়নি।কি জোরেই না আমি হাত দুটো চেপে ধরেছিলাম ওর যে ব্যাথায় কান্না করে দিয়েছিলো।আমি সবসময়ই মেয়েটাকে কষ্ট দেই। আমার উচিত তাকে সরি বলা।

কিছুক্ষণ পর গিয়ে সরি বলে আসবনে।

এদিকে মৌ কাঁদতে কাঁদতে দেয়ালের সাথে হেলান দিয় ঘুমিয়ে পরেছে। মাগরিবের আজান হয়ে গিয়েছে তাও সে শুনতে পারেনি।

আয়ান ছাদের থেকে নামার সময় অহনার সাথে দেখা হয়।

"কি ব্যাপার ভাইয়া মৌ কে সেই কখন রুমে নিয়ে গিয়েছিস। আর তো বের ই হয়নি সে?? কি এতো রোম্যান্স করছিলি হুমমমমম????"

"কি বলিস এখনো বের হয়নি ও রুম থেকে!!"

"নাহ তো।কেনো কিছু হয়েছে নাকি ভাইয়া?"

"আরে না। কিছুই হয়নি। মনে হয় কোনো কাজ করছে ও।"

"হুম তা হতে পারে।আচ্ছা তুই গিয়ে দেখ।"

এরপর আয়ান রুমে এসে দেখে মৌ দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পরেছে।

"দেখো দেখি মেয়ের কান্ড। এভাবে কেউ ঘুমিয়ে পরে!!"

আয়ান গিয়ে মৌ কে ডাকলো।কিন্তু তার কোনো সাড়াশব্দ নেই।আয়ান আর কিছু না ভেবে মৌ কে কোলে তুলে নিয়ে বেডে শুইয়ে দেয়।আর মৌ এমন ঘুমানো ঘুমাচ্ছিল যে কিছুই টের পায়নি।

রাতে খাবার খাওয়ার জন্য মৌ কে বেশ কিছুবার ডাকে আয়ান। কিন্তু তার কোনো হেলদোল নেই।

খেয়েদেয়ে এসে আয়ান ঘুমাতে যাবে কিন্তু সে লক্ষ্য করলো মৌ এর হাত দুটো লাল হয়ে গিয়েছে। তার আঙ্গুলের ছাপ বুঝা যাচ্ছে।আয়ানের এটা দেখে নিজের উপর ই নিজের রাগ লাগছে।

"তুই সত্যিই খুব খারাপ একটা মানুষ। এ মেয়েটাকে কি পেয়েছিস কি হুম? অযথা শুধু কষ্ট দিস ওকে।এতো জোরে হাত চেপে ধরার কি দরকার ছিল?নিজের রাগটাও কন্ট্রোল করতে পারিস না।"এ বলে আয়ান ফাস্ট এইড এর বক্স থেকে মলম এনে অতিযত্নে মৌ এর হাতে লাগিয়ে দিলো।

আয়ান উঠতে যাবে কিন্তু কেনো যেন তার হঠাৎ মৌ এর ঘুমন্ত মুখখানি দেখতে খুব ইচ্ছা করছে।
সে একভাবে মৌ এর দিকে তাকিয়ে আছে। খুবই মায়াবি লাগছে মৌ কে দেখতে।আয়ানের মনে হচ্ছে হয়তো মৌ কে এভাবে দেখে সারারাত পার করে দিতে পারবে।কোনো ক্লান্তি আসবে না।

 ফ্যানের বাতাসে মৌ এর মাথার অবাধ্য চুলগুলো তার চোখের উপর এসে পরছে।আয়ানের হাত যেন একা একাই চলে যাচ্ছে মৌ এর মুখের উপর আসা চুলগুলো ঠিক করার জন্য। সে আলতো হাতে মৌ এট চুলগুলো নিয়ে কানের পিছনে গুঁজে দিলো। মৌ এতে হালকা নড়ে উঠলো। এদেখে মনে হয় আয়ানের হুশ আসলো।সে তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে শুয়ে পরলো।
.
.
.
চলবে......................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন