আমি কি আমার জীবনের স্বাধীনতা পাবো? সেই ভাগ্য কি হবে। কি পাপ করেছিলাম। এতো শাসন আমাকেই কেনো পেতে হবে। আর সকলের মতো, আমি কেন ঘুরতে যেতে পারিনা। কেন পারিনা? অভাগীর মতো দেখে যাচ্ছি, বান্ধবীরা রেস্টুরেন্ট যাচ্ছে। অথচ আমি যেতে পারছিনা। অসহায় চোখে তাদের চলে যাওয়া দেখে, আমিও বাড়ির উদ্দেশ্যে চললাম। এই অভাগী জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে আর কি লাভ। জীবন উপভোগ করতে না পারলে, এই জীবন রেখে আর কি হবে। একদিন এই শাসনের জীবন ভাঙবে, আমি মরলে।
ছোট থেকে ঘুরাঘুরি কাকে বলে জানিইনা। নানু বাড়ি ছাড়া আর কোথাও ঘুরা হয়নি। স্কুল জীবনে একবারও পিকনিক অ্যাটেন্ড করতে পারিনি। স্কুলের হেডমাস্টার দ্বারা ও বাড়িতে রিকোয়েস্ট করিয়েছি, আমাকে যেতে দেওয়ার জন্য। আফসোস কাজ হয়নি। হবে কিভাবে? বাড়িতে আছে তো এক জঙ্গল। যার নিজের জঙ্গল ছেড়ে, আমারটা পছন্দের। আররে, তোর কপালে সুখ নেই শাহজাহান তন্ময়। তুই আমার অভিশাপে ভস্ম হয়ে যাবি। টুকরো টুকরো করে ভস্ম হবি।
ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম পিকনিক আগামী শনিবার। এবার যেতে না দিলে, শাহজাহান পরিবারের একদিন নাহয় আমার একদিন। দেখে নিবো।
দরজা বরাবর আসতেই শুনছি, বড় মা ফোনে বলছেন,
--' অরু এসেছে। এইতো এখানেই। হ্যাঁ, আব্বা কখন আসবি? দুপুরে ঘরে খাবিতো? আচ্ছা, আয় তাহলে। '
আমি ক্লান্ত চোখে তাকালাম। এতো অস্বস্তি জঙলটার কি নিয়ে? আমি বাড়িতে না আসলে তুর কি? আসবো না বাড়ি। কলেজ থেকে ঘুরতে যাবো, ডেটিং করবো, যা ইচ্ছে করবো। বাটপার। নিজের বেলায় ষোলো আনা। দিন-রাত আলপনা করে, বাড়িতে এসে হুজুর। এহ। জানি না মনে হয় উনার ব্যাপারে। কয়েকদিন পরপর হেডলাইন বেরিয়ে আসে,
--' তন্ময় ভাই এর সাথে প্রেম করছে। তন্ময় ভাইকে ওই মেয়ের সাথে দেখেছি। '
নিজের হেডলাইনের চিন্তা না করে, আমাকে নিয়ে পরে থাকে। থাক থাক। আমিও দেখি কতদিন জ্বালাতে পারিস।
দরজায় জুতো খুলে জুতো র্যাগে রেখে, স্লিপার পরে ভেতরে প্রবেশ করলাম। মা,চাচীরা ছাড়া আর কেউ নেই বাড়ি। সবাই হাজির হবে আর মাত্র ঘন্টার মাঝে। দুটো বিশ এ দুপুরের খাবার। এই সময়ের মাঝে সবাইকে উপস্তিত হতে হবে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই দেখলাম, ছোট চাচী রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। নিশ্চয়ই আবারও লেগেছে চাচার সাথে। ছোট চাচী বেশ ইমোশনাল। একটুতেই কেঁদে দেন। ঠিক আমার মতো। কষ্ট নিতে পারেন না।
আমাকে খেয়াল করতেই, সে চোখ মুছে ফেললেন। হাসার চেষ্টা করে বললেন,
--' কিরে, কখন এলি। '
আমি ব্যাগটা সিঁড়ি তে ফেলে, তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
--' থাক, হাসার অভিনয় করতে হচ্ছেনা। এবার বলে ফেলো, হয়েছে কি? '
চাচী'র চোখ আবারও ভিজে উঠছে। আমি হালকা হেসে চোখের পানি মুছে দিলাম। সে হালকা আওয়াজে বলল,
--' তুর চাচা, আজও বলল সে নাকি আরেকটা বিয়ে করে ফেলবে। '
হা হা হা। এই কথাটা ঝগড়া লাগলেই চাচা বলেন। সেটা প্রতিবার বিশ্বাস করা আমার নিরীহ চাচী। সে একদম অবুঝ। চাচা যে তাকে কতটা ভালবাসেন তা সে কখনোই বুঝতে পারেননি। আসলে চাচা শক্ত মনের। মনের কথা মনে রাখতে পছন্দ করেন। কিন্তু বাড়ির আমরা জানি, সে চাচী 'কে কতটা ভালবাসেন, স্নেহ করেন।
--' সে বললেন আর তুমি সত্যি ভেবে নিলে? সে বলে রাগে। রাগ কমে আসলে দেখবে, তোমার পছন্দের রসমালাই এনে ফ্রিজ জ্যাম করে রেখেছেন। '
সে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর চোখ মুছে ফেললেন।
--' কথা তো সত্য। আমি যাই মেলা কাজ। '
আমি হাসলাম। ব্যস। রাগ, অভিমান, কান্না শেষ তার। একদম নিস্পাপ বাচ্চাদের মতো। উনার যে তিন ছেলেমেয়ে আছে, তা তার ব্যাবহারে একদম বুঝা অসম্ভব।
রুমে প্রবেশ করতেই মনে পড়লো, মোবাইল নেই আমার। মোবাইলহীন এতিম আমি। মনে হচ্ছে জীবনে বড় কিছু নেই। ফাঁকা ফাঁকা লাগছে সব৷ ব্যাগ গুঁছিয়ে রেখে আমি বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে পরলাম। বড় এক মিশন রয়েছে আমার। পিকনিক যাবার মিশন। পিকনিক যেতে হলে আগে কাকে ধরবো? আব্বা? না। সে উজবুকের কথায় ডিসিশন নেন। উজবুক না বললে সেও না বলে দিবেন। বড় মা? না। সেও তার ছেলের কথায় গলে যান। আর মা তো আরও আগে না। তাহলে? অপশন আছে, বড় আব্বু আর রবিন ভাই। ইয়েস।
একটা উনত্রিশ। আমার গোসল শেষ। একটু ছাঁদ ভ্রমণ করা যাক। ছাঁদে উঠেই আমার চোখে চড়কগাছ। তন্ময় ভাই দাঁড়িয়ে শর্টস পরে। মনে হচ্ছে গোসল সেরে এসেছে। ফোনে কথা বলছে। আমি উল্টো পথে আসার আগেই সে দেখে ফেলেছে। আমার মনে পরে গেলো তার নিষ্ঠুরতম আচরণ। এর সাথে একা থাকা যাবেনা। আমি দ্রুত ফিরতে গিয়ে, খেলাম দরজার সাথে টাক। তন্ময় ভাই আগেই হালকা স্বরে চেঁচালেন,
--' ওয়াচআউট ইডিয়ট। '
আমিতো ততক্ষণে চিতকার এক দিয়ে, কপাল ধরে বসে পড়েছি।
পা দুটো আর কপাল কিছুক্ষণের জন্য একদম অবসে পরিনত হলো। চোখ ধাঁ ধা করছে। কি মারাত্মক ব্যাথা'টাই না পেলাম। সে এসে আমার কপাল থেকে হাত সরালেন,
--' দেখি। '
একপ্রকার মাথা উঁচু করে, কপাল ঘষে দিলেন৷
--' এতটা গাঁধি একজন কিভাবে হয়? '
আমি গাঁধি? আবার উহ, দরদও দেখাচ্ছে। উজবুক একটা। নিজে চুল টেনে, হাঁটু আমার ছুঁলে দিয়ে, এখন মায়া দেখাচ্ছে। আমি তার হাত সরালাম। নিজে'ই উঠে দাঁড়ালাম। সে বলল,
--' একটা আইস কিউব ঘষে দে কপালে। যা। '
না চাইতেও নিচুস্বরে বললাম,
--' জ্বি। '
আমি অনেকগুলো সিঁড়ি গিয়ে, আবারও পিঁছু ফিরলাম। তন্ময় ভাই তাকিয়ে। এবার ভ্রু উঁচু করলেন? আমি দ্রুত নেমে গেলাম। শেষ কপালটা আমার।
নিচে নামতেই দেখলাম রুবি আপু টিভি দেখছেন। চাচীরা ডাইনিং সাজাচ্ছেন। চাচ্চুরা আলাপে বিভোর। দীপ্ত হাতে ড্রয়িং বুক নিয়ে বসে। আমিও সোফায় বসলাম। শক্ত চোখে আশেপাশে নজর বোলাচ্ছি। এখন তন্ময় ভাই নেই। এখনই সবাইকে রাজি করানোর, সুহানা পাল। আমি উঠে চাচ্চুদের পাশে বসলাম। ব্যস তাদের নজর আমার দিক।
--' কলেজ থেকে আগামী শনিবার পিকনিক। আমি যেতে চাচ্ছি। ' কেউ কিছু বলার আগেই, আমি প্রায় রিকোয়েস্ট করতে লাগলাম,
--' প্লিজ। আমি যাবো। আমি একবারও যেতে পারিনি। আমি এবার যাবো। প্লিজ, যেতে দাও। প্লিজ। '
বড় চাচ্চু অবাক কন্ঠে বললেন,
--' এভাবে বলছো কেন অরু? অবশ্যই যাবে। '
--' বলছ তো? পরে কথা খিলাফ করবে না তো? '
--' আররে অমান্য কেন করবো? '
--' ছুঁয়ে প্রমিজ করো। '
বড় চাচ্চু প্রমিজ করার আগেই, উজবুক হাজির। এসেই প্রশ্ন করছে,
--' কিসের প্রমিজ? '
চাচ্চু হাসতে হাসতে বলছেন,
--' অরুর কলেজ পিকনিক আগামী শনিবার। ও যেতে চাচ্ছে। কিন্তু দেখ, কিভাবে রিকোয়েস্ট... '
চাচ্চু আর বলতে পারলেন না। উজবুক ঘ্যানঘ্যান শুরু করলো,
--' এবার উত্তরের পাহাড়ি এলাকায় নিচ্ছে। সাথে বি সেকশনের ছেলেরা সহ যাচ্ছে। প্রাইভেসি নেই। যাবার প্রয়োজন নেই। '
আমি দ্রুত বললাম,
--' গার্ড নিচ্ছে কলেজ থেকে। '
চাচ্চুও সহমত হলেন,
--' হ্যাঁ, ওরা গার্ড রাখে। আর কলেজের প্রিন্সিপাল আমার পরিচিত। আমি পারসোনালি দেখে রাখতে বলবো। '
তন্ময় ভাইয়ের শক্ত কন্ঠ,
--' কিসের গার্ড। এতগুলো স্টুডেন্টদের কি সেফটি দিবে? আর ও যেই গাঁধি। এক পা আগাতে দশবার হোঁচট খায়, ওরে কিভাবে পাঠাতে চাচ্ছো? সাথে উটকো ছেলেরা যাচ্ছে, এখানে কিসের গ্যারান্টি? যাবার প্রয়োজন নেই। '
আমার চোখ ভিজে আসছে। আমি টলমল চোখ নিয়ে চাচ্চু - আব্বুর দিক তাকালাম। বড় চাচ্চু স্বর তুললেন,
--' মেয়েটা যেতে চাচ্ছে। তো যাবে। একা না ছাড়তে চাইলে, আমি রবিনকে পাঠাবো সাথে। দুদিন এর ট্রিপ। ঘুরে আসুক। '
আমি সহমত হলাম,
--' হ্যাঁ, হ্যাঁ। রবিন ভাই গেলে...
উজবুকের থমথমে কন্ঠ,
--' ও যাবেনা। '
ব্যস। আব্বু নিজেও উজবুকের সাথে সহমত,
--' আমি ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো। তন্ময় যেহেতু চাচ্ছে না, তাহলে অবশ্যই কারণ আছে। আমি নিয়ে যাবো, হু? '
আমার কান্না পাচ্ছে। সবাই যাচ্ছে৷ স্যমনাও যাচ্ছে। ও তো প্রতিবার গিতেছে। আমিই একমাত্র অভাগী। কথা না বাড়িয়ে আমি সিঁড়ির দিক চললাম। পেছন থেকে বড় চাচ্চুর আওয়াজ,
--' কি হচ্ছে তন্ময়? ও যেতে চাচ্ছে, যাবে। '
তন্ময় ভাই জবাব দিচ্ছেন না। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। কি শয়তান এটা। তুই পস্তাবি দেখিস। উজবুক।
দুপুরে খেলাম না। রাতেও না খেয়ে। এবার সত্যিই খিদে পাচ্ছে। তাতে কি? খাবো না। উজবুক খাক সব। আমি স্বাস নিচ্ছি এতেও ওর সমস্যা। আমি মরলে ওর সমস্যা সমাধান হবে। এর মাঝে বড় মা আসলেন। আমি আঁড়চোখে তাকিয়ে, বিছানায় বসেই রইলাম। সে প্লেট আমার পাশে রাখলেন,
--' বাবাহ। মেয়ের দেখি রাগ। '
বলতে বলতে গাল টেনে দিলেন। আমি দ্রুত তাকে জড়িয়ে ধরলাম।
--' বড় মা। আমি যাবো। প্লিজ। '
--' আচ্ছা। যাবি। '
--' তুমি পরে কথা ঘোরাবে। '
বড় মা আত্নবিশ্বাস নিয়ে বললেন,
--' যাবি। আমি বলছি৷ '
--' ছুঁয়ে প্রমিজ করো। '
বড় মা করলেন প্রমিজ।
--' অরুকে ছুঁয়ে বলছি। অরু এবার পিকনিক যাবে। '
ওরে, আমার খুশি কে দেখে। বড় মা নিজেই খাইয়ে দিলেন।
কিন্তু, খুশি বেশিক্ষণ টিকলো না। কারণ উজবুক গাড়ি করে দিয়ে আসবে, আবার নিয়ে আসবে। তো এখানে পিকনিনে যাওয়াটা কিভাবে হলো? যাবারই কি দরকার?
.
.
.
চলবে.................................