স্পন্দন রাতে রুমে বসে বেডে হেলান দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করতে করতে গুঞ্জনের কথা ভেবে চলেছে। ভুলটা ও নিজে করেছে অথচ একটা সামান্য সরিও বলে উঠতে পাললোনা মেয়েটাকে এটা ভেবে নিজের ওপরে রাগ হচ্ছে। অন্যদিকে গুঞ্জনের আজকে বলা কথাগুলো মনে পড়তে একদিকে যেমন হাসি পাচ্ছেন অন্যদিকে তেমন খারাপও লাগছে। মেয়েটা হয়তো অনেক কষ্ট পেয়েছে ওর ব্যবহারে। সরিটাও বলা হলো না। আর চেয়েও মাথা থেকে এসব বের করতে পারছেনা। তবুও বহু কষ্টে মাথা থেকে এসব চিন্তা বাদ দিয়ে কাজে মন দেবে ঠিক তখনি দরজার টোকা দিয়ে সারা বলে উঠল,
--- " ভাইয়া আসবো?"
স্পন্দন ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে সারাকে দেখে আবারও ল্যাপটপে চোখ দিয়ে বলল,
--- " আয়।"
সারা মুচকি হেসে হেলতে দুলতে এসে স্পন্দনের সামনে বসল। কিন্তু স্পন্দন নিজের কাজে ব্যাস্ত। বেশ কিছুক্ষণ সারা বসে রইলো কিন্তু কিছু বলল না। আর স্পন্দনও কিছু না বলে কাজ করে যাচ্ছে। স্পন্দনকে চুপ থাকতে দেখে সারা নিজেই হালকা একটু কাশি দিলো। সারার কাশি শুনে স্পন্দন সারার দিকে তাকালো। স্পন্দন তাকাতেই সারা দাত বের করে একটা হাসি দিলো। স্পন্দন ভ্রু কুচকে বলল,
--- " এভাবে দাঁত কেলাচ্ছিস কেনো? কিছু বলবি?"
সারা মুখে সেই হাসি রেখেই বলল,
--- " আমি আর কী বলবো? তুই কী কিছু বলেছিস?"
স্পন্দন বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
--- " কী বলবো? কাকে বলব?"
সারা একটু ঠেস মেরে বলল,
--- " যাহ বাবা। কালকে না বললি গুঞ্জনকে সরি বলবি? বলেছিস আজ?"
স্পন্দন এবার বুঝলো ব্যাপারটা। অনেকটা ইতস্তত করে তারপর বলল,
--- " আবব্ না বলিনি।"
সারা এবার অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
--- " যাহ। তুইনা বললি সরি বলবি? এখনো বলতে পারিসনি।"
স্পন্দন হালকা গলা ঝেড়ে আবারও ইতস্তত করে বলল,
--- " আরে আজ গিয়েছিলাম কিন্তু ও তো আজ উল্টে নিজের মতো করে আমাকে কথা শুনিয়ে দিলো। আর তাছাড়া ওর সামনে গিয়ে সরি শব্দটা বের হচ্ছিলো না। এতো চেষ্টা করেও মুখ দিয়ে বের করতে পারছিলাম না।"
সারা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে শব্দ করে হেসে দিলো। সারার হাসি শুনে স্পন্দন বিরক্ত হয়ে বলল,
--- " কী হয়েছে কী হ্যাঁ? এভাবে বোকার মতো হাসছিস কেনো?"
স্পন্দনের ধমকে সারা হাসি থামিয়ে দিলো তারপর স্পন্দনকে পিঞ্চ করে বলল,
--- " দা গ্রেট স্পন্দন চৌধুরী? দেশে বিদেশে এত্তো এত্তো বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টদের সামনে যে গড়গড় করে কথা বলে যায় সে একটা মেয়ের সামনে গিয়ে সরি শব্দটা বলতে পারছেনা? হাউ সেইমফুল?"
কথাটা বলে সারা নিচের ঠোঁটটা বাকা করে একটা আফসোসের শ্বাস নিলো। স্পন্দন এতোক্ষণ ভ্রু কুচকে সারার কথা শুনছিলো। স্পন্দন এবার চোখ ছোট ছোট করে বলল,
--- " আমায় টিজ করছিস?"
সারা সাথে সাথেই মুখটা ইনোসেন্ট করে ফেলল। তারপল গলা ঝেড়ে বলল,
--- " আমার ঘাড়ে কটা মাথা বল? দেখ তুই মেয়েটাকে অকারণে বোকেছিস তো বোকেছিস তারওপর গায়ে হাত তুলিছিস। সো যেকরেই হোক তোর তো সরি বলা উচিত তাইনা। তাই বলছি কী যতো কিছুই হোক সরি বলে দিস হুম? ওল দা বেস্ট।"
বলে ওখান থেকে উঠে একপ্রকার পালিয়ে গেলো সারা। সারা এমনিতে স্পন্দনকে ভয় পায়, কিন্তু স্পন্দন যখন নরমাল মুডে থাকে তখন এদের দুষ্টুমি খুনশুটি লেগেই থাকে। স্পন্দনও হালকা হেসে দিলো সারার কান্ডে। তারপর ভাবলো নাহ যেকরেই হোক সরি বলতেই হবে। এরপর ঐ মেয়ের সাথে দেখা হোক বা না হোক তাতে ওর কিছু যায় এসে না।
_______________________
মেঘলা, আবির, বাড়ির সবাই ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে। মেঘলা আবির দুজনেই অফিস যাবে তাই ওদের আগে খেতে দেওয়া হয়েছে। দুজনের কেউই এখনো শুরু করেনি, খাবার সামনে করে বসে আছে। গুঞ্জন ভার্সিটির জন্যে রেডি হয়ে বেড়োতে নেবে তখনি মেঘলা বলে উঠলো,
--- " কীরে? ব্রেকফাস্ট না করে কোথায় যাচ্ছিস?"
গুঞ্জন পেছন ঘুরে বলল,
--- " ক্যানটিনে করে নেবো দি।"
এটুকু বলে যেতে নিলেই আবির বলে উঠলো,
--- " ক্যানটিনে খেতে টাকা লাগে। কতো টাকা ইনকাম করিস মাসে?''
গুঞ্জন থেমে পেছনে না তাকিয়েই বলল,
--- "ঠিকাছে খাবোনা ক্যানটিনে।"
আবির বিরক্ত হয়ে বলল,
--- " না খেয়ে থেকে অসুখ বাধালে তোকে হসপিটালে ভর্তি করবে কে শুনি? আর খরচ কে দেবে?"
গুঞ্জন এবার রাগে গজগজ করতে করতে এসে ডাইনিং টেবিলে বসল। আবির আর মেঘলা মিটমিটিয়ে হাসছে। গুঞ্জনের বাবা মাও মনে মনে একটু শান্তি পেলো, তবে ওর কাকা কাকী একটুও খুশি হয়নি সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। গুঞ্জন খাওয়া শুরু করার পর আবির শুরু করল। যার কারণ কেউ না বুঝলেও মেঘলা বুঝতে পারলো।
_____________________
স্পন্দন আজকেও এসছে গুঞ্জনের সাথে কথা বলতে। ক্যামপাসে দাঁড়িয়ে আছে হঠাৎ গুঞ্জনকে চোখে পড়তেই স্পন্দন ডাকলো ওকে। কারো ডাক শুনে তাকিয়ে স্পন্দনকে দেখে বরাবরের মত আজকেও বিরক্ত হলো গুঞ্জন। বিড়বিড় করে বলল,
--- " সমস্যা কী এই লোকটার। অসহ্য।"
বলে অন্যসাইড দিয়ে চলে গেলো। স্পন্দন চেয়েও আটকাতে পারেলোনা ওকে। ওর বন্ধুরাও অবাক হলো কিন্তু স্পন্দনকে দেখে ব্যাপারটা বুঝতে পারলো।
ঐ দিন সহ আরো একটা দিন পার হয়ে গেলো।এই দুদিন স্পন্দন চেষ্টা করেছে গুঞ্জনকে সরি বলার কিন্তু পারেনি। গুঞ্জন পুরোপুরি ইগনোর করে গেছে ওকে। আর যেটুকুও কথা বলার সুযোগ পেয়েছে সরি আর বলতে পারেনি, ফলে গুঞ্জনকে বিরক্তি নিয়েই চলে যেতে হয়েছে।একবার কাগজে সরি লিখে গুঞ্জনের বাইকে ঝুলিয়ে রেখেছিলো উইদআউট নেম কার্টেসি। গুঞ্জন সেটা দেখে কে লিখেছে কেনো লিখেছে কিছুই বুঝতে না পেরে কাগজটা ফেলে দিয়ে চলে গেছে। কিন্তু গুঞ্জনকে সরি না বলে মনে শান্তিও পাচ্ছেনা স্পন্দন । অস্বস্তি হচ্ছে ভীষণ, সকাল সকাল নিজের রুমে বসে কী করা যায় সেটাই ভাবছে ও। এরমধ্যেই সারা এসে বলল,
--- " ভাইয়া তোর কফি।"
স্পন্দন ভাবতে ভাবতেই বলল,
--- " হ্যাঁ রেখে যা।"
সারা বুঝতে পারলো স্পন্দন কিছু একটা ভাবছে, তাইও কফি রেখে চলে যেতে নিলেই স্পন্দন বলল,
--- " এই শোন?"
সারা থেমে গিয়ে বলল,
--- " হ্যাঁ কিছু বলবি?"
স্পন্দন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
--- " আবব সরি কীভাবে বলা যায়?"
সারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে বলল,
--- " কীহ?"
স্পন্দন হকচকিয়ে গিয়ে বলল,
--- " আ.. কিছু না। আচ্ছা এটা বল গুঞ্জনের সাথে তো একটু হলেও মিশেছিস? ও কী পছন্দ করে?"
সারাতো বোকা হয়ে গেছে স্পন্দনের প্রশ্ন শুনে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে ইতস্তত কন্ঠে বলল,
--- " আমি ঠিক জানিনা রে ওরকম কিছু খেয়াল করিনি।''
স্পন্দন একটা হতাশ নিশ্বাস ত্যাগ
--- " আচ্ছা যা তুই।"
সারা হ্যাবলার মতো মাথা নেড়ে চলে গেলো আজকে স্পন্দনের বিহেভিয়ারে ও পুরো বোকা বনে গেছে। আর স্পন্দন সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের ভাবনায় ডুবে গেলো।
_____________________
অফিসের কেবিনে বসেও স্পন্দন এটাই ভাবছে যে সরিটা কীকরে বলবে? একটা সামান্য সরি বলাটা ওর কাছে ওরগানিক কেমেস্ট্রি, বিশ্বযুদ্ধ, জটিল জটিল বিজনেস ম্যানেজমেন্টের চেয়েও কঠিন মনে হচ্ছে। সরি শব্দটা কী এতোটাই জটিল? এসব ভাবতে ভাবতেই স্পন্দনের ম্যানেজার এসে বলল,
--- " মে আই কাম ইন স্যার?"
স্পন্দন ওর নিজের ধ্যানে আছে তাই শুনতে পায়নি তাই এবার ম্যানেজার একটু জোরেই বলল,
--- " স্যার? মে আই কান ইন?"
স্পন্দনের এবার ধ্যান ভাঙলো। ও একটু গলা ঝেড়ে বলল,
--- " ই্ ইয়াহ কাম ইন।"
ম্যানেজার এসে একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বলল,
--- '' আপনার এখানে আপনার সাইন লাগবে।"
স্পন্দন ফাইলটা নিয়ে কাজ করছে আর ভাবছে। ভাবতে ভাবতেই স্পন্দন বলে উঠল,
--- " ম্যানেজার সাহেব?"
--- " ইয়েস স্যার?"
স্পন্দন সেইসব ভাবতে ভাবতেই বলল,
--- " সরি কীকরে বলে?"
ম্যানেজার তো আহম্মক হয়ে গেলো এই প্রশ্নে। অবাক কন্ঠেই বলল,
--- " সরি স্যার?"
স্পন্দন এবার রাগ, বিরক্তি, হতাশার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে ম্যানেজরের দিকে তাকালো। সেটা দেখে ম্যানেজার গলা ঝেড়ে বলল,
--- " ইয়ে মানে স্যার?"
স্পন্দন ফাইলটা ম্যানেজারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
--- " আপনি আসতে পারেন। আর মিস মেঘলাকে পাঠিয়ে দেবেন।"
এটুকু বলে স্পন্দন নিজের কাজে মন দিলো। ম্যানেজার কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে থেকে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর মেঘলা এসে বলল,
--- " স্যার আসবো?"
স্পন্দন ল্যাপটপে কাজ করতে করতেই বলল,
--- " হ্যাঁ আসুন।"
মেঘলা এসে দাঁড়াতেই স্পন্দন দুটো ফাইল মেঘলার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
--- " এগুলো কমপ্লিট করে নিন। কাল মিটিংয়ে লাগবে।"
মেঘলা মুচকি হেসে বলল,
--- " ওকে স্যার।"
মেঘলা যেতে নিলেই স্পন্দন কাজ করতে করতে বলল,
--- " শুনুন?"
মেঘলা ঘুরে জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল,
--- " ইয়েস স্যার?"
স্পন্দন ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে বলল,
--- " আপনি তো একজন মেয়ে সো মেয়েদের সম্পর্কে ভালো আইডিয়া আছে?"
মেঘলা একটু অবাক হলেও মুখে হাসি রেখে বলল,
--- " হ্যাঁ। কেনো স্যার?"
স্পন্দন এবার একটু ইতস্তত কন্ঠে বলল,
--- " কোনো মেয়েকে সরি কী কী ভাবে বলা যেতে পারে?"
মেঘলা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে একটু হাসলো তারপর বলল,
--- " স্যার ডোন্ট মাইন্ড। আপনার গার্লফ্রেন্ডকে সরি বলার জন্যে টিপস চাইছেন?"
স্পন্দন একটু হেসে বলল,
--- " নাহ তেমন কিছু না। জানা থাকলে বলুন।"
মেঘলা একটু ভেবে বলল,
--- " সবারটা জানিনা। বাট আমার ছোট বোন আছে। ওর রাগ ভাঙানোর বা সরি বলার কিছু স্পেশাল উপায় আছে। আপনি চাইলে বলতে পারি।"
স্পন্দন একটু এক্সাইটেড হয়ে বলল,
--- " ইয়াহ সিউর। বসে বলুন"
মেঘলা বসে স্পন্দনকে সবটা বলতে শুরু করলো। স্পন্দনও একটু মনোযোগ দিয়ে শুনছে সব।
______________________
বিকেলে ক্লাস শেষ করে গুঞ্জন ওর বন্ধুদের সাথে বেড়োতে নিলেই স্পন্দনকে দেখেই গুঞ্জন বিরক্ত হয়ে বলল,
--- " আজ আবার কী ড্রামা করবে লোকটা?"
প্রাপ্তি বলল,
--- " আরে বাবা তুই শুনেতো নিবি যে কী বলে?"
ওরা এসব নিয়ে কথা বলতে বলতেই স্পন্দন চলে এলো ওদের কাছে। গুঞ্জন চলে যেতে নিলেই স্পন্দন ওর হাত ধরে ফেলল। গুঞ্জনতো চরম অবাক। স্পন্দন বাকি সবার দিকে তাকিয়ে বলল,
--- " তোমরা যাও ও পরে আসবে।"
গুঞ্জন রেগে বলল,
--- '' পরে যাবো মানে কী? হাত ছাড়ুন?"
স্পন্দন সেদিকে পাত্তা না দিয়ে রাগী দৃষ্টিতে ওর বন্ধুদের দিকে তাকাতেই ওরা চলে গেলো। গুঞ্জন ডেকেও থামাতে পারলোনা। স্পন্দন কিছু না বলে গুঞ্জনের হাত ধরে গাড়ির দিকে হাটা দিলো, গুঞ্জন এতো কথা বলছে কিন্তু স্পন্দন শুনেও শুনছে না সেসব।
.
.
.
চলবে..........................................