প্রহেলিকা - পর্ব ২১ - আশফি শেহরীন চিত্রা - ধারাবাহিক গল্প


সেই ঘটনার দুইদিন পর খবর আসে রাফিদ হসপিটালে। রাফিদের বাবা মা পুলিশে কেস করলেও পুলিশ কোন ক্লু খুঁজে পায় না। রাফিদের অবস্থা খারাপ। শরীরে রক্তের পরিমাণ নেই বললেই চলে। তবুও ডাক্তাররা চেষ্টা করছে। এই খবর শোনার পর অনেক কেঁদেছিল জেবা। ইনশিতাও বাদ যায়নি। তবে লুকিয়ে, জেহেরের সামনে সে মন খারাপ করে রাখার সুযোগ পায়নি। একটু মন খারাপ করলেই জেহের গাল চেপে ধরে ধমকায়। সেই ভয়ে সর্বদা হাসিমুখে থাকার চেষ্টা করেছে ইনশিতা।

এই দুইদিনে জেহের যেন আরো বেশি গম্ভীর হয়ে গেছে। আগের হাসিটুকুও মিলিয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে মাথা চেপে ধরে বিড়বিড় করে রুমের দুই একটা জিনিস আছড়ে ফেলে। তা দেখে ইনশিতা ভয় পেলে জেহের নিজেই সরি বলে নিজেই রুম ক্লিন করে। কোনো মেইডকে রুমে ঢুকতে দেয় না সে। ইনশিতাকেও নজরে নজরে রাখছে। বাথরুমে গেলে বেশিক্ষণ থাকলে জেহের দরজা ধাক্কানো শুরু করে। মনে হয় যেন, তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হারাতে চলেছে। 

ইনশিতাকে বারান্দায়ও যেতে দেয় না তেমন একটা। রাতের বেলায় নিজের সাথেই ইনশিতাকে নিয়ে যায়, তবে একা যেতে দেয় না। জেহের যখন অফিসে থাকে সেই মুহুর্তটা ইনশিতা আলিশান রুমটাতে এক প্রকার বন্দী হয়ে থাকে। বারান্দার দরজা আটকে রাখার কারণে ইনশিতা ভেতর থেকেই উদাস নয়নে বাহিরে তাকিয়ে থাকে, অথবা বই পড়ে কাটায়। নয়নিকা বা মা বাবা ফোন দিলে লাউডস্পিকারে কথা বলতে আদেশ দেয় জেহের। এটা করো না, সেটা করো না, ওদিক যেয়ো না, এদিক যেয়ো না, নিজের ইচ্ছেটাই চাপিয়ে দেয় ইনশিতার উপর। বিয়ের এক সপ্তাহ ও ভালো করে হয় নি, এর মধ্যেই জেহেরের এত নিয়ম কানুন; আর বাকি দিন তো পড়েই আছে। 

ইনশিতার যেন দমটাই বন্ধ হয়ে যায় এসব কারণে। প্রথম কিছু সময়ের জন্য ভালো লাগলেও পরে যেন গলায় ফাঁসের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাপারটা। একদিন মানা যায়, দুদিন মানা যায়, কিন্তু আর কত? নিজেকে জেলে থাকা বন্দীদের মতো মনে হয়। ইচ্ছে হয় একটু খোলা বাতাসে প্রাণ খুলে পাখির মতো উড়ে বেড়াতে। কিন্তু জেহের কিছুতেই ইনশিতাকে উড়তে দিতে চায় না। খাঁচায় বন্দী পাখির মতো সবসময় নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়।  

এই তো, একদিন আগে নয়নিকা ফোন দিয়েছিল ইনশিতাকে। জেহের তখন অফিসের ফাইল দেখছিল। ইনশিতার ফোন আসায় কাজ রেখে ইনশিতার সামনে বসে ফোন রিসিভ করে লাউডস্পিকারে দিতে বলেছিল। ইনশিতা চায়নি লাউডস্পিকারে কথা বলতে, কারণ নয়নিকা এমন সব কথা বলবে যা ইনশিতার কাছে স্বাভাবিক মনে হলেও জেহের শুনে হয়ত রেগে যেতে পারে। 

আর হলোও তাই। নয়নিকা বলেছিল, সে একটা ছেলের উপর ক্রাশ খেয়েছে, ছেলেটার সাথে নয়নিকার সেটিং করিয়ে দেওয়ার জন্য ইনশিতাকে ছেলেটার সাথে কথা বলতে। আগে ইনশিতা নয়নিকার এমন ব্যাপারে একটু আধটু হেল্প করত, তবে এখন পরিস্থিতি আলাদা। জেহের তা শুনে তখনই মোবাইলটা জোরে দেয়ালের সাথে আছাড় মেরে ভেঙেছে। আর ইনশিতাকে শাসিয়েছে নয়নিকার সাথে কথা বললে নয়নিকার শেষ দিন দেখতে হবে তাকে। পরবর্তীতে যদিও সেদিন আরেকটা মোবাইল দিয়েছিল ইনশিতাকে, তবে নজর সরেনি কথা বলার সময়। 

পরদিন সকালে ইনশিতা ডিসিশন নেয় যে সে আজ থেকে কলেজ যাবে। বই খাতা বিয়ের সময়ই নিয়ে এসেছিল। জেহের তখন ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে মাত্র। ইনশিতা জেহেরের সামনে গিয়ে বলল, 

-“একটা জরুরী কথা ছিল।”

জেহের গম্ভীর কন্ঠে বলে, 

-“বলো।”

-“আজ থেকে আমি কলেজে যাব ভেবেছি।”

তা শুনে জেহের শুধু ফিচেল হাসলো। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ইনশিতাকে পাশ কাটিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে চলে গেল। ইনশিতা জেহেরের কাছে এসে ফের বলল, 

-“কী হলো? আপনি কি শুনেছেন আমার কথা?”

জেহের উত্তর দিলো না। ইনশিতা জেহেরের মৌনতাকে সম্মতি ভেবে নিলো। ব্যাগ গুছাতে লাগল। তারপর জামা কাপড় নিয়ে গোসলে ঢুকে গেল। গোসল সেরে বের হতেই ইনশিতা বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। ব্যাগের সব বই বের করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। কয়েকটা পাতা ছিঁড়েও গিয়েছে। আর ড্রেসিং টেবিলের সামনে অফিসের ড্রেস পরিহিত জেহের আঙুল দিয়ে চুল ঠিক করছে। ইনশিতা অবাক হয়ে বলে, 

-“বইগুলোর এমন অবস্থা কেন? বই ব্যাগ থেকে বের করেছে কে?”

বলে ইনশিতা নিজেই তাড়াতাড়ি বই গুছিয়ে ব্যাগে ঢুকাতে লাগল। ব্যাগে বই ঢুকাতে নিলে জেহের এসে ইনশিতার হাত ধরে ফেলে। ইনশিতা হতবাক হয়ে তাকায় জেহেরের দিকে। জেহের ইনশিতার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। ইনশিতা রাগী গলায় বলে,

-“কী করছেনটা কী আপনি? ব্যাগ ফেললেন কেন?”

-“বুঝতে পারোনি?”

ইনশিতা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যার মানে সে বুঝতে পারেনি। জেহের ড্রেসিং টেবিলের সামনে যেতে যেতে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে, 

-“তোমার পড়াশোনা করতে হবে না। তাই এসব বই খাতারও প্রয়োজন নেই।”

ইনশিতা যেন আকাশ থেকে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে। কানে জেহেরের কথাটা ঝাঁ ঝাঁ করে বাজতে থাকে। বিস্ফোরিত কন্ঠে বলে, 

-“মানে? আপনি পাগল হয়ে গেলেন না কি? আপনি তো বলেছিলেন বিয়ের পড় যত ইচ্ছা পড়াশোনা করা যাবে। আর আমাকে কথাও দিয়েছিলেন। তাহলে এখন উল্টো পথে হাঁটছেন কেন?”

ইনশিতার কথা শুনে জেহের এক পলক তাকাল। শান্ত দৃষ্টি যেন ঝড়ের পূর্বাভাস। তবে ইনশিতা থামল না। রাগে শরীর কাঁপছে তার। পড়াশোনায় সে মোটামুটি ধরনের ছাত্রী হলেও পড়াশোনা ছাড়তে নারাজ। একমাত্র পড়াশোনা করার মাধ্যমে সে নিজের একটা পরিচয় বানাতে পারবে। যাতে সবাই জেহেরের স্ত্রী হিসেবে না চিনে নিজ পরিচয়ে তাকে চিনে। ইনশিতার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। তবে তা জেহেরের রাগের কাছে নস্যি। জেহের ডিভানে গিয়ে আরাম করে শুয়ে মোবাইল দেখতে লাগল। 

তাতে ইনশিতার রাগ যেন আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। আকস্মাৎ সে জেহেরের মোবাইলটা খুব জোড়ে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে জেহেরের কলার ধরল। তবে ডিভান থেকে জেহেরের কলার ধরে টেনে উঠাতে পারল না। কী করেই বা পরবে? কখনো কী বিড়ালের শক্তি সিংহের শক্তির সাথে পেরে উঠে? উল্টো ইনশিতা জেহেরকে ওঠাতে না পেরে জেহেরের বুকের উপর উঠে বসে কলার চেপে ধরে। রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ে চিৎকার করে বলে,

-“উত্তর দিচ্ছেন না কেন? আপনি তো নিজেই আমায় কথা দিয়েছিলেন। তাহলে সেই কথার এখন কী হলো? নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েও পড়াশোনা ছাড়ার কথা ভাবতে পারিনি, সেখানে এখন এত সুযোগ পেয়ে কেন ছাড়বো আমি? হু?”

জেহের শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রোজের দিকে। রাগলে রোজকে আরো বেশি কিউট দেখায়। চেহারাটা ফুলে উঠে আরও কিউট লাগে। চোখ দুটি বড় বড় করে তাকালে জেহেরের তখন ইচ্ছে করে, বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে আরেকবার ভালোবাসার সাগরে ডুব দিতে। আর ঠোঁট দুটো! ইশ! এমনভাবে কাপেঁ না, যে জেহেরের ইচ্ছে করে আমের মতো খেয়ে ফেলতে। শান্ত কন্ঠেই বলে, 

-“তখন টাকা পয়সার জন্যই তো পড়াশোনা করেছিলে, আর এখন যখন চারপাশে কোটি কোটি টাকা তখন পড়াশোনা করে তোমার লাভ কী? যত ইচ্ছা খরচ করো, আছে তো অনেক। কোনো দরকার নেই এই পড়াশোনার।”

ইনশিতা বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। জেহেরের কলার ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। সে এতদিন টাকার জন্য পড়াশোনা করেছে? মানে জেহের তাকে ইনডাইরেক্টলি লোভী বলছে? হ্যাঁ, মানছে সে বাবা মায়ের অবস্থা স্বচ্ছল করার জন্য একদিক দিয়ে পড়াশোনা চালাচ্ছে। কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্য তো নিজের একটা পরিচয় বানানো। সেখানে জেহের তাকে টাকার পাহাড়ে এখন ডুবে থাকতে বলছে? ইনশিতা অস্ফুট স্বরে বলল, 

-“আমি নিজের আলাদা পরিচয় বানাতে চাই জেহের। শুধুমাত্র ভালো চাকরি করে টাকা পাওয়ার লোভেই কিন্তু আমি পড়াশোনা করিনি।”

জেহের উঠে বসল। সে জানে যে রোজ টাকার লোভে পড়াশোনা করেনি। নিজের পরিচয়ের জন্যই করেছে। কিন্তু জেহের তা চায় না। রোজকে সকলে জানবে, চিনবে, এটা সে কিছুতেই চায় না। আর রোজ চাকরি করলে সবসময় তাকে জেহেরের থেকে দুরে থাকতে হবে সেটা তো আরো আগেই চায় না জেহের। আর সেই কারণে রোজকে পড়াশোনা করতে দেবে না সে। সকলের সাথে মিশবে, কথা বলবে, হাঁটবে, চলবে— এসব সহ্য করতে পারবে না জেহের। তখন রাগের মাথায় কি না কি করে বসে ঠিক থাকবে না। 

জেহের ইনশিতাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে গালে গাল ঠেকিয়ে নরম স্বরে বলে, 

-“আলাদা পরিচয় বানানোর কী দরকার রোজ? আমার পরিচয়েই তুমি পরিচিত হবে। তোমাকে আলাদা করে কেউ জানুক আমি তা চাই না।”

ইনশিতা এবার রণচণ্ডী হয়ে গেল। রাগে সে দিশেহারা হয়ে বলতে লাগল, 

-“কেন রে? আমাকে পড়াশোনা করালে কি তোর জাত যাবে? না কি তোর সম্পদের ক্ষতি হবে?”

আর এটাই বোধহয় ইনশিতার কাল হয়ে দাঁড়াল। জেহেরকে কেউ তুই সম্বোধন করে বলুক তা একদম পছন্দ না তার। হয় আপনি নয় তুমি করেই বলে সবাই। কিন্তু নিজের ভালোবাসার মানুষের মুখে তাকে ছোট করে কথা বলাটা সে মেনে নিতে পারল না। ইনশিতাকে হেঁচকা টানে ডিভানে ফেলে দিল। ক্রুদ্ধ হয়ে ইনশিতার গলা চেপে বলতে লাগল,

-”বেশি বার বেড়ে গেছ, না? আমাকে তুই করে বলার সাহস কোথায় পেলে তুমি? ছাড় দিয়েছি বলে কী নিজের অবস্থান ভুলে গেলে না কি? আমাকে তুই করে বলা তাই না? আজকে তোমায়..”

বলে জেহের আশেপাশে কিছু খুঁজতে লাগল ইনশিতাকে শায়েস্তা করার। তার মেজাজ বিগড়ে গেছে। এদিকে ইনশিতার যেন জান যায় যায় অবস্থা। জিভ বেরিয়ে গেছে। চোখ উল্টে গেছে। জেহেরের দুই হাতের লোহার শক্তিতে ইনশিতা দুনিয়া ভুলতে শুরু করেছে। তখনি জেহের ইনশিতাকে ছেড়ে ওয়ারড্রোবের সামনে চলে গেল। ইনশিতা এ যাত্রায় প্রাণে বাঁচল। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজের শক্তি ফিরিয়ে আনতে চাইল। তার আগেই জেহের আবার তাকে টান মেরে উঠিয়ে খাটে ফেলে দিল। ইনশিতা উল্টে পড়ল খাটে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জেহের ইনশিতার একহাত বেঁধে দিলো খাটের কর্ণারের সাথে, দড়ি দিয়ে। ইনশিতা কিছুই করতে কিংবা বলতে পারল না। আগে সে নিজের জান তো ফিরে পাক। গলায় এখনো অসহ্য যন্ত্রণা করছে। মনে হয় জেহেরের আঙ্গুলের ছাপ বসে গেছে। 

জেহের আবার কিছু একটা ভেবে ইনশিতার হাতের বাঁধন খুলে দিলো। তারপর আলমারির সবচেয়ে নিচে কিছু খুঁজে ইনশিতার কাছে আসল। খাটের সাথে একহাতে হ্যান্ডক্যাফ পরিয়ে দিলো। তারপর নিজে নিজেই স্বগতোক্তি করল, 

-“তোমার জন্য হ্যান্ডক্যাফ আনাটা শেষ পর্যন্ত স্বার্থক হলো। ভেবেছিলাম লাগবে না, কিন্তু তুমি যেই লেভেলের বদমাশ, তোমাকে তো বেঁধে রাখতেই হয়। আমার সাথে জোর গলায় কথা বলার শাস্তি এটা। আজ পুরোদিন তুমি এভাবেই থাকবে।”

জেহের বাহির থেকে আটকে চলে গেল অফিসে। ইনশিতা উঠে বসতে পারল না। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়েই শুয়ে রইল। না চাইতেও চোখের কার্ণিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে পড়ালেখা করতে চায়। জেহেরের পরিচয়ে না, নিজ পরিচয় বানাতে চায়। আসন্ন বিপদের আশংকায় তার মনটা কু ডেকে উঠল।
.
.
.
চলবে..............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন