প্রহেলিকা - পর্ব ১৩ - আশফি শেহরীন চিত্রা - ধারাবাহিক গল্প


জেহেরের সামনে চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় বসে আছে তিনজন মহিলা। যারা মেকআপ রুমে ইনশিতাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। জেহের ইনশিতাকে খোঁজখুঁজি করার পরও যখন পায়নি তখন তার মনে পড়ল সিসি ক্যামেরার কথা। সিসি ক্যামেরা মেইন গেটের সামনে রয়েছিল। সেখানে তার লোকেরা দেখতে পেল তিনজন বোরকা পড়া মহিলা যারা ইনশিতাকে তুলে নিয়েছিল। আর দুর্ভাগ্যবশত ইনশিতাকে গাড়ি উঠিয়ে দেয়ার পর সেই মহিলারা নিকাব খুলে ফেলেছিল যার কারণে জেহেরের লোকদের সেই মহিলাদের খুঁজতে বেশি সময় লাগেনি। 

মহিলারা ভয়ে কাঁপছে। না জানি এখন তাদের কি শাস্তি পেতে হয়! জেহেরের হাতে স্ট্রেইটনার। জেহের শান্ত গলায় বলল, 

-“রোজকে কেন উঠিয়ে নিয়েছিস তোরা?”

মহিলারা খুব ভালো করেই জানে মিথ্যে বলে কোনো কাজ হবে না। তাই সত্যি বলল সবাই। 

-“স্যার আমাদের টাকা দিয়েছিল। মেয়েটাকে উঠিয়ে গাড়িতে উঠালে আমাদের হিউজ অ্যামাউন্টের টাকা দিবে বলেছিল।”

জেহের ঘাড় কাত করে তাকাল। উঠে এসে যেই মহিলা কথা বলল তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর গরম স্ট্রেইটনারটা কানের মধ্যে লাগিয়ে দিলো। গগন বিদারী চিৎকার করে উঠল মহিলাটি। জেহেরের ইশারায় একজন লোক এসে মুখ চেপে ধরল। জেহের মহিলাটির উদ্দ্যেশ্যে হিসহিস করে বলল, 

-“মেয়েটি কী হ্যাঁ? ম্যাম বল ম্যাম। আমার রোজকে মেয়েটি বলার সাহস কি করে পাস? কল হার ম্যাম।”

জেহের স্ট্রেইটনার সরিয়ে নিলো। মহিলার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে আর কাঁটা মুরগীর মতো ছটফট করছে। তা দেখে পাশে বসে থাকা দুজন মহিলার পা কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেল। জেহের এবার দুজনের উদ্দ্যেশ্যেই বলল, 

-“তোদের স্যার কে? কার আদেশে এমনটা করেছিস?” 

-“আ-আমরা জানি না। স্যারকে আমরা দেখিওনি। স্যার শুধু মোবাইলে আমাদের কাজ বুঝিয়ে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিল।”

-“গিভ মি দ্যা নাম্বার।”

মহিলাটি মোবাইল বের করে নাম্বার দিলো জেহেরকে। জেহের কল করে দেখে নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছে। শিট বলে ছুঁড়ে ফেলল মহিলাটির মোবাইল। সিসি ক্যামেরায় গাড়ির এরিয়াটা কভার করেনি বিধায় গাড়িটাকে দেখতে পেল না সে। উঠে দাঁড়িয়ে গার্ডদের ইশারা করে চলে গেল। সে চলে যেতেই ভেতর থেকে মহিলাদের আকাশ কাঁপানো চিৎকার ভেসে আসে। 

জেহের ইনশিতার বাবার কাছে এসে বলে, 
-“আপনার ভাগ্য ভালো শশুরমশাই যে এ কাজে আপনার কোনো হাত নেই। তবে যে এই কাজ করেছে তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ একটাও থাকবে কি না সন্দেহ।”

বলেই হনহন করে চলে গেল। ইনশিতার মা আর বাবাও দুশ্চিন্তা নিয়ে কমিউনিটি সেন্টার থেকে বাড়ি চলে এলো। জেসমিন আর আফজাল নিজেদের গাড়ি করে রওয়ানা দিলো নিজ বাড়িতে। 

ইনশিতাকে খোঁজার চেষ্টা কোনো চেষ্টাই বাদ রাখছে না জেহের। এয়ার লাইন, রেল স্টেশন সব জায়গায় লোক লাগিয়েছে। কিন্তু কোনো খবর পায় নি। তবুও জেহের হাল ছাড়েনি। তাকে যে করেই হোক তার রোজকে পেতেই হবে। 

জেহের গাড়ি চালাচ্ছে আর ভাবছে রোজের কথা। পরনের শেরওয়ানীর উপরের দিকে পুরোটাই খোলা যার কারণে লোমহীন ফর্সা উদোম বুক দেখা যাচ্ছে। মসৃণ চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হাতের রগগুলো ভেসে যেন দৃষ্টিগোচর হয়েছে। জেহের একহাতে কপালে থাকা চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে কটমট করে বলল, 

-“আমার রোজকে আমার থেকে দুরে সরানোর সাহস কার হয়েছে? কার এমন বুকের পাটা আছে? একবার জাস্ট সামনে পাই তোকে। কেটে কুকুরকে খাওয়াবো।”

বলেই ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিতে লাগল। রাগে তার শরীর রি রি করছে। তার রোজ এখন কী করছে? কোথায় আছে? কিছু খেয়েছে কি না? এসব ভেবে ভেবে মাথাটা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে জেহেরের। বাড়িতে না গিয়ে সোজা ফার্মহাউজে চলে গেল সে। যেখানে মাঝে মধ্যে গিয়ে নিজেকে রিল্যাক্স করে আসে সে, তবে আজ কিছুতেই রিল্যাক্স হতে পারছে না জেহের। ঘরে ঢুকে সবকিছু এদিক ওদিক ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। সোফা টেবিল উল্টিয়ে পাল্টিয়ে ভাঙতে লাগল। যখন সব ভাঙা শেষ হলো তখন ভেতরের রুমে চলে গিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিলো। মোবাইল বের করে রোজের ছবিতে হাত বুলাতে লাগল আর বিড়বিড় করতে করতে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ল। 

.

.

বড্ড পিপাসায় ইনশিতার গলা কাঠ হয়ে এলো যেন। চোখ দুটো মেলে রাখতেও কষ্ট হচ্ছে। তবুও তৃষ্ণা মেটাতে খুব কষ্টে উঠে বসল। পাশের টেবিলে রাখা পানির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করে নিলো। এবার কিছুটা শান্তি লাগছে। যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে সে। খাট থেকে নামলে আচমকা তার মাথায় আসে গতকালকের কথা। চোখ দুটো ভালোভাবে কচলে চারিদিকটা ভালো করে দেখে নিলো। মাঝারি আকারের একটি রুম। রুমে আসবাবপত্র খুবই কম। গোল সাইজের একটি খাটে বসে আছে সে। তার পাশেই ছোট্ট একটি টেবিল। আর দরজার পাশে লাগোয়া আলমারি আর একটি ড্রেসিং টেবিল। দেখে মনে হচ্ছে কোনো হোটেলের রুম। ইনশিতা নিজের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। কালকের সেই বিয়ের সাজেই রয়েছে সে। হাত পা বাঁধামুক্ত। ইনশিতা উঠে দাঁড়িয়ে রুমের বারান্দায় চলে গেল। শীত শীত লাগছে। চারপাশে কেমন উঁচু উঁচু বিল্ডিং। একেকটা বিল্ডিংয়ের সাজ বাহির থেকেই চোখ ধাঁধানোর মতো। নিচের রাস্তা একদম পরিষ্কার। মানুষগুলোকেও বাঙালি বাঙালি মনে হচ্ছে না। অদূরে একটি নদীর অংশবিশেষ চোখে পড়ছে। তাই তো এত বাতাস আসছে। এটা তো বাংলাদেশ না। তাহলে কি বিদেশে নিয়ে এসেছে জিহাদ তাকে? ভাবনার জগৎ ভঙ্গ হলো কোনো মেয়েলী কন্ঠের আওয়াজে। পেছন ফিরে দেখল ফ্যাকাশে রঙের একজন বিদেশী মেয়ে। হাতে খাবারের ট্রে। ইনশিতা ভ্রু কুঁচকালো। মেয়েটি শুদ্ধ ইংরেজিতে বলল, 

-“হেয়ার ইজ ইওর ব্রেকফাস্ট ম্যাম। প্লিজ, হেভ ইট।”

ইনশিতা মেয়েটিকে বলল, 
-“আচ্ছা, এটা কোন দেশ?” 

মেয়েটি বুঝতে পারল না। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে ইনশিতার দিকে। ইনশিতা বুঝতে পেরে নিজের কপাল নিজেই চাপড়াল। সেও তো ভুলে গিয়েছে এই ধলা মেয়েটি ইংলিশ ছাড়া বাংলা বুঝে না। সে বলল, 
-“হুইচ কান্ট্রি ইজ ইট?”

-“ইটস থাইল্যান্ড ম্যাম।”

বলেই খাবার টেবিলে রেখে চলে গেল। ইনশিতা মাথায় হাত দিয়ে বেডে বসে পড়ল। 
-“আল্লাহ! গতকালই না আমি বাড়িতে ছিলাম আর আজ থাইল্যান্ড?”

ইনশিতা দরজা খুলতে গিয়ে দেখল দরজা বাহির থেকে আটকানো। বিরক্তি নিয়ে আবার বসে পড়ে খাটে। খাবারগুলো দেখে নিয়ে খেতে শুরু করে। প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছে তার। খাবার প্রায় শেষ তখন দরজা খোলার ক্ষীণ আওয়াজ আসে। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে একটু আগের সেই মেয়েটি। 

-“স্যার ইজ কলিং ইউ। কাম উইথ মি ম্যাম।” 

ইনশিতা খাবার রেখে দ্রুত উঠে পড়ল। জিহাদের সাথে একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে সে। সাহস কত ছেলেটার! আজকে ছেলেটাকে নিজ হাতে কিছু শাস্তি দিবে। তাই লুকিয়ে ফলের ছুঁড়িটা নিয়ে নিল আঁচলে। মেয়েটির পেছন পেছন গিয়ে লিফটে উঠল ইনশিতা। মেয়েটি তার থেকেও অনেক লম্বা। ফিগারটাও দেখার মতো। ইনশিতা বলল, 

-“হোয়াট'স ইওর নেম?” 

-“জুন।”

.

.

জেহেরের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে ফোনের তীব্র আওয়াজে। ফোনটা তার বুকেই ছিল। উঠিয়ে দেখে আননোন নাম্বার। জেহের বিরক্তি নিয়ে বলল, 

-“হু দ্যা হেল আর ইউ?” 

ওপাশ থেকে একটি মেয়ের কন্ঠ ভেসে আসে, 
-“মি. জেহের! আপনি আপনার রোজের খবর পেয়েছেন তো?” 

জেহের এবার উঠে বসে, 
-“হু আর ইউ?” 

-“আমি কে সেটা জেনে আপনার লাভ নেই। তবে আপনার রোজের খবর আমি দিতে পারি মিষ্টার।” 

জেহের শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
-“কোথায় আছে আমার রোজ? কার কাছে?”

-“আমি আপনাকে বলব, তবে আমার একটা শর্ত আছে।”

-“যত টাকা লাগবে সব দেব। ব্ল্যাংক চেকও দিয়ে দেব, তাও বলো আমার রোজ কোথায়?”

ওপাশ থেকে মেয়েটির অট্টহাসির শব্দ শোনা গেল। বিরক্ত হলো জেহের। মোবাইলটা আছড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। তবুও নিজেকে শান্ত রাখল। মেয়েটি হাসি থামিয়ে বলল, 

-“এসব টাকা ফাকা আমার কিছুই লাগবে না মিষ্টার। আমার অন্য কিছু চাই। অন্য একটা শর্ত আছে।” 

জেহেরের কপালের মধ্যভাগ কুঞ্চিত হলো। 
-“কী শর্ত?” 

.
ইনশিতাকে নিয়ে মেয়েটি অর্থাৎ জুন ছাদে চলে আসলো। হোটেলের ছাদটা বিশাল। একপাশে ছোট ছোট চেয়ার টেবিল বসানো। আরেকপাশে ফুলের বাগান। সব নাম না জানা ফুল। জুন ছাদের বিপরীত প্রান্তে নিয়ে চলল ইনশিতাকে। ইনশিতা আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে গেল। এবার হয়ত জিহাদকে খুনই করে দিতে পারে। বড্ড বাড় বেড়েছে জিহাদ। তারা কাছে যেতেই দেখল শেষ মাথার চেয়ারে একটা লোক বেশ আরাম করে বসে আছে। জুন ইনশিতাকে পেছনের একটি চেয়ারে বসতে দিয়ে চলে গেল। ইনশিতাও একটু আরাম করে বসল। একটু ঊনিশ বিশ হলে জিহাদকে মেরে দিতেও তার হাত কাঁপবে না। ইনশিতা নিজেই কথা বলা আরম্ভ করল, 

-“মি. জিহাদ! নিজেকে কী ভাবেন আপনি? কিং?আপনি যা চাইবেন সব পেয়ে যাবেন? সব পেলেও পেতে পারেন বাট আমাকে না। জানেন তো! আপনারা দুই ভাই-ই এক। কোনোটাই কোনোটার চেয়ে কম না। কি হলো? চুপ করে আছেন যে? মুখে কি কুলুপ এঁটেছেন না কি?” 

এই কথার শেষেই লোকটি দাঁড়িয়ে ইনশিতার দিকে ফিরল। সামনের লোকটিকে দেখে ইনশিতা সবিস্ময়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। লুকিয়ে রাখা ছুঁড়ি হাত থেকে পড়ে গেল। মুখ আপনাআপনি হা হয়ে গেল তার। তার সাথে এসব কী হচ্ছে? সবকিছু এমন ধাঁধা ধাঁধা লাগছে কেন? প্রহেলিকায় পড়ল না কি সে? সবকিছুতেই এত প্রহেলিকা কেন? মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে একটা নামই বেরিয়ে আসলো তার,

-“রাফিদ ভাইয়া!” 
.
.
.
চলবে..............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন