প্রহেলিকা - পর্ব ২০ - আশফি শেহরীন চিত্রা - ধারাবাহিক গল্প


পরপর দু'দিন ইনশিতার বেশ ভালোই কাটল। ইনশিতার প্রতি জেহেরের কেয়ার, ছোটখাটো জিনিস খেয়াল রাখা সবকিছু মিলিয়েই ইনশিতা জেহেরের প্রতি সন্তুষ্ট। আর সবচেয়ে বেশি যেটা ভালো লাগল তা হলো জেহের জোর করেনি কখনো তাকে। এমনকি ভুলেও বাজেভাবে ছোঁয়নি। তবে ইনশিতাকে এপর্যন্ত একবারের জন্যও নিচে যেতে দেয়া হলো না। জেহের নিজেই ইনশিতাকে নিয়ে ছাদে যায়, বাগানে হাত ধরে ঘুরে, মাঝে মাঝে পুল সাইডে বসে গল্প করে। অফিসের কাজগুলো রাতেই সেরে বাকিটা সময় ইনশিতার সাথে কাটায়। মা বাবা, নয়নিকার সাথে কথা বলার জন্য নিউ ফোন কিনে দিয়েছে জেহের। 

তবে ইনশিতা দুইদিনে যতবারই কলেজে যাওয়ার কথা বলেছে, জেহের কেমন এড়িয়ে গিয়েছে। বলেছে, কয়েকদিন কলেজ ছাড়া এনজয় করো, আমার সাথে কাটাও; তারপর যেদিন আমি অফিস ফুল্লি যাবো, সেদিন তোমাকে কলেজ দিয়ে আসব। ইনশিতাও সেটাই মাথায় রেখে দিন কাটিয়েছে। 

তার একদিন বেশ ভোরে হঠাৎ কিছু একটার শব্দে ইনশিতার ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় হাতড়ে জেহেরকে খুঁজে পায় না। শব্দের উৎস খুঁজতে আশেপাশে চোখ বুলায় তবে অন্ধকারের জন্য কিছুই দেখে না সে। বেডের পাশে ল্যাম্প জ্বালাতেই ইনশিতা চিৎকার দেয়। জেহের ওয়ারড্রোবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জেহেরের শার্ট রক্তের ছিটে। জেহের নিজেও চমকে যায় হঠাৎ বাতি জ্বালানোয়। কিছু বলার শব্দ খুঁজে পায় না সে। ইনশিতা দ্রুত নেমে আসে জেহেরের সামনে। আঁতকে বলে,

-“আ-আপনার শার্টে রক্ত কেন? কি হয়েছে আপনার? অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে?”

বলে দেরি না করে জেহেরের শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করে। তবে কোনো ক্ষত না পেয়ে ইনশিতা অবাক হয়ে তাকায় জেহেরের দিকে। 

-“আপনার কোথাও তো লাগেনি। তাহলে এত রক্ত কিসের?”

জেহের ভড়কে যাওয়া গলায় বলে, 

-“ম-মানে, আমি একটু বাহিরে গিয়েছিলাম তো। একজনকে দেখলাম অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, হসপিটালে নিয়ে গিয়েছি, তাই আমার শার্টেও রক্ত লেগেছে আর কি।”

বলে জোর করে হাসল জেহের। ইনশিতার কাছে কথাটা অযৌক্তিক মনে হলো। এত ভোরে হঠাৎ জেহেরের বাইরে যাওয়া, তার উপর অ্যাক্সিডেন্ট। ঠিক সেই সময়েই জেহেরের ফোন আসে। জেহের রোজের দিকে তাকিয়ে কেটে দেয়। এমন করে আরো দু'বার কল আসলে জেহের ফোন সুইচ অফ করতে নেয়। তখনই আরেকবার কল আসলে ইনশিতা কি মনে করে ছোঁ মেরে ফোনটা রিসিভ করে কানে দেয়। জেহের ঘাবড়ে গিয়ে মোবাইলটা নিতে গেলে ইনশিতা পিছু হটে যায়। ওপাশ থেকে যা শুনলো তাতে ইনশিতার চোখ বড় বড় হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ফোনটা কেটে কাঁপা কাঁপা গলায় ইনশিতা জেহেরকে বলে, 

-“কাকে মেরে এসেছেন আপনি? কাকে হসপিটালে ভর্তির কথা বলছে?”

-“কাউকে না রোজ। তুমি হয়ত ভুল শুনেছ। তুমি...”

-“আমি ঠিক শুনেছি জেহের। একজন আপনাকে স্যার বলে বলেছিল কাউকে হসপিটালে নিয়ে যেতে। বলেছিল লোকটার অবস্থা না কি খারাপ। হসপিটালে না নিয়ে গেলে বাঁচানো যাবে না। আ-আর এটাও বলেছিল যে আপনি বললে তারা লোকটাকে মেরে পুতে ফেলবে।”

জেহের নিজের মাথার চুল টেনে ধরে চোখ বন্ধ করে। ইনশিতা এবার রাগে জেহেরকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলে, 

-“এই, বলুন, কাউকে তো শিওর মেরে এসেছেন আপনি। কাকে মেরে এসেছেন আপনি? কি হলো? চুপ করে আছেন কেন? হু? বলুন।”

জেহের চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে ঠান্ডা রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে মনে হয় না বেশিক্ষণ থাকতে পারবে। জেহেরকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে প্রায় দেয়ালের কাছেই এনে ফেলল ইনশিতা। এক পর্যায়ে ইনশিতার ধাক্কায় জেহেরের মাথা আর পিঠ খুব জোরে বারি খেল দেয়ালের সাথে। এবার আর নিজের ক্রোধ দমন করতে পারল না জেহের। চোখ মেলে দুহাতে ইনশিতাকে সজোরে ধাক্কা দিলো। টাল সামলাতে না পেরে ইনশিতা পড়ে যায় নিচে। মাথায় কিছুটা আঘাতও পায়। আঘাত ভুলে ইনশিতা অবাক হয়ে যায় জেহেরের এরুপ আচরণের কারণে। জেহের এক হাঁটু ভাজ করে বসে ইনশিতার গাল চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

-“সত্যি আমি মেরে এসেছি রোজ। এমন অবস্থা করেছি না। জীবনেও তোমার দিকে তাকানোর সাহস অব্দি পাবে না।”

-“মানে? ক-কাকে মেরে এসেছেন?”

জবাবে জেহের অদ্ভুত হাসি দিলো। অদ্ভুত এই হাসি দেখে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ইনশিতার। জেহের ইনশিতাকে উঠিয়ে এগিয়ে চলল ঘরের বাহিরে। ভোরের আলো তখন মাত্র ফুটতে শুরু করেছে। জেহের ইনশিতাকে গাড়িতে বসিয়ে নিজে ড্রাইভিং সীটে বসল। ইনশিতা এখনো অবাকের রেশ থেকে বের হতে পারছে না। পাঁচ মিনিট ড্রাইভিংয়ের পর জেহের একটা ভাঙ্গা ছোটখাটো একটা বাংলোর সামনে নামল। ইনশিতার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে ভেতরে নিলো। জেহেরের ঠোঁটে এখনো সেই অদ্ভুত হাসি বিরাজমান। বাংলোর ভিতরে শেষ রুমে কয়েকজন গার্ডদের দেখতে পেল ইনশিতা। সেই রুমে নিয়ে ইনশিতাকে দাঁড় করিয়ে সবগুলো গার্ডদের ইশারায় বেরোতে বলল। রুমে ঢুকে ইনশিতার হাত পা বরফের ন্যায় জমে গেল। মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। পা থরথর করে কাঁপছে। জেহের ইনশিতার চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে বলল, 

-“বললে না কাকে মেরেছি? দেখো, এতক্ষণ ধরে একেই সাইজ করেছিলাম।”

ইনশিতার গা গুলিয়ে আসতে লাগল। নিজের শরীরের ভার ছেড়ে দিলো জেহেরের বুকে। জেহের শক্ত করে ধরল ইনশিতাকে। সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে রাফিদ। শরীরের একটু অংশও দেখা যাচ্ছে না রক্তের কারণে। নিস্তেজ শরীর পড়ে আছে মেঝেতে। হাত পা মুখের সব জায়গায় ক্ষত। দেখলেই ভিন্ন জগতের প্রাণী মনে হবে। এত রক্ত দেখে ইনশিতার গা গুলানো শুরু করল। একটু পাশে খুব মোটা লাঠির মতো কিছু একটা পড়ে আছে। ইনশিতা অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করল, 

-“রাফিদ।”

-“তোমাকে ছোঁয়ার, তোমাকে নিয়ে যাওয়ার সকল শাস্তি দিলাম রাফিদকে। আমার থেকে নিস্তার পাওয়া এত সোজা না কি? কী বলো রোজ?”

ইনশিতা জেহেরকে ঠেলে সরিয়ে রাফিদের দিকে অগ্রসর হতে চাইল। তবে পা যেন চলতেই চাইছিল না তার। 

-“আপনি দয়া করে রাফিদকে হসপিটালে নিয়ে যান। প্লিজ।”

-“নিয়ে যাবো বলছো? কিন্তু ও যদি আবার তোমাকে আমার হাত থেকে নিয়ে যেতে চায়? উহুম। ও কে এক্ষুনি শেষ করে দেব। অলরেডি তো মরেই গিয়েছে। বেঁচে আছে কি না সন্দেহ।”

বলেই জেহের বেশ দুঃখ পাওয়ার ভান ধরল। পরক্ষণেই হা হা করে বিকট অট্টহাসি দিতে দিতে ইনশিতাকে ছেড়ে রাফিদের দিকে চলল। ইনশিতা দেয়াল ধরে নিজেকে সামলাল। জেহের পা দিয়ে রাফিদকে সোজা করে দিল। চোখ মুখ কুঁচকে আছে জেহের। চোখে অজস্র ঘৃণা। যেন সে পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্রী জিনিস তার সামনে দেখছে। রাফিদের পেট হালকা উঠানামা করছে। ও? বেঁচে আছে তার মানে? 

-“ওয়েল। হসপিটালে নেব। তার আগে এটা বলো, ও যদি তোমার দিকে আবার হাত বাড়ায় তাহলে কী শাস্তি দেওয়া উচিত হবে?”

ইনশিতা দ্রুত বলল, 

-“রাফিদ আর কক্ষনো আমার দিকে হাত বাড়াবে না। প্রমিস করছি। অমি নিজেই ও কে দুরে ঠেলে দেব। ওর সামনে যাব না কখনো।”

জেহের তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ঘাড় কাত করে বলল, 

-“হাহ! তোমাকে যেতে দিলেই তো!”

পাশে পড়া লাঠিটা হাতে নিয়ে ক্রিকেট স্টাইলে ধরল জেহের। রাফিদের মাথা বরাবর ক্রিকেটারদের মতো ব্যাট ধরে হালকা বারি দিতে লাগলো। তারপর যখন খুব জোরে বারি দিবে তখন ইনশিতা চেঁচিয়ে উঠল। 

-“প্লিজ, ও'কে হাসপাতালে নিয়ে যান। ওর সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দেব আমি। সত্যি। তবুও প্লিজ ও'কে বাঁচিয়ে রাখুন।”

বলতে বলতে ইনশিতা দেয়াল ধরেই বসে পড়ল। জেহের চোয়াল শক্ত রেখে বলে, 

-“বাব্বাহ! এত দরদ? এত দরদ উথলে পড়ে কেন?”

বলে রাফিদের হাঁটুতে খুব জোরে বারি দিলো। রাফিদ আবারো উল্টে গে‌ল। ইনশিতা চিৎকার করতে লাগল। জেহের গার্ডদের ইশারা করলে তারা রাফিদকে নিয়ে চলে যায়। জেহের লাঠিটাকে আঁছড়ে ফেলে। যেন সব রাগ এখন লাঠির ওপর। ইনশিতার কাছে এসে ইনশিতাকে কোলে করে গাড়ির দিকে পা বাড়ায়। ইনশিতা সীটে মাথা হেলিয়ে কাঁদতে লাগল। জেহের ইনশিতার গাল চেপে ধরে নিজের কাছে আনল। চোখ লাল করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, 

-“অন্য একজনের জন্য তোমার চোখের পানি আমি একদম মেনে নিতে পারব না। রাফিদকে মেরে ফেলব নাকি?” 

ইনশিতা জোরে জোরে না সূচক মাথা নাড়াল। 

-“তাহলে নিজের মূল্যবান চোখের পানি বিসর্জন দেওয়া বন্ধ করো। আর যদি কোনোদিন দেখেছি আমি ছাড়া কারো জন্য কেঁদেছ তাহলে তাকে দুনিয়া থেকে সরাতে আমার এক মুহূর্ত লাগবে না।”

ইনশিতা চোখের পানি দ্রুত মুছে ফেলল। জেহের ইনশিতার গাল আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল, 

-“হাসো। হাসো বলছি। আমার সাথে সবসময় হাসি মুখে থাকবে। কী হলো? হাসো হাসো। হু। আরো বড় করে হাসো। আরো...আরো বড়।”

ইনশিতা নিজের সাথে যুদ্ধ করে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল। জেহের আঙুল দ্বারা ইনশিতার গাল আরো চেপে ঠোঁট বের করল। বাঁকা হেসে ইনশিতার ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলল, 

-“দ্যাটস মাই গার্ল।”
.
.
.
চলবে................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন