-“কী হলো? বলো কী শর্ত তোমার?”
-“আমি আরো কিছুদিন সময় চাই, আর পড়াশোনাটা কমপ্লিট করতে চাই। তাই এখন বিয়ে করতে পারবো না।”
জেহের দাঁত কটমট করে বলে,
-“কী বললে?”
ইনশিতা মনে মনে বলল,‘তুই বয়রা নাকি রে শালা? জোরেই তো বললাম, শুনতে পাস না?’কিন্তু মুখে বলল,
-“বলেছি, আমি এখন বিয়ে করতে পারবো না। আরে! রেগে যাচ্ছেন কেন? আমি বিয়ে করবো আপনাকে, তবে এখন না। একটু সময় চাই আমার।”
-“বিয়ের পর অনেক সময় আছে। তখন পড়াশোনা করো।”
-“কথাটা বোঝার চেষ্টা করুন আপনি।”
ইনশিতার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে আলতো চেপে বলল,
-“শসসহ, কিচ্ছু বোঝার লাগবে না। আমি যা বলেছি, তাইই হবে।”
জেসমিন চৌধুরী বললেন,
-“জেহের, আমার মনে হয় তোমায় ইনশিতার কথাটা শোনা উচিত। তুমি ওকে রুমে নিয়ে যাও।”
জেহের কোনো কথা না বলে রুমে নিয়ে গেল ইনশিতাকে। জেসমিন চৌধুরী ইনশিতার বাবাকে আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জেসমিন চৌধুরী আশেপাশে তাকিয়ে আফজালকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“জিহাদ কোথায়? তখন তো এখানেই দেখেছিলাম। এখন কোথায় গেল ছেলেটা?”
আফজাল চৌধুরী মাথা নাড়লেন। মানে তিনি জানেন না। জেসমিন চৌধুরী প্রস্থান নিলেন। জিহাদকে রেগে যেতে এই প্রথম দেখলেন আফজাল। সকলের আড়ালে তিনি দেখেছেন তার ছোট ছেলেটাকে রেগে চলে যেতে।
জেহের রুমে নিয়ে গিয়ে ইনশিতার কোমড় চেপে কাছে টেনে নিলো। তর্জনী দিয়ে ইনশিতার চিবুক তুলে মুখের কাছাকাছি টেনে নিলো। ইনশিতা চোখ বন্ধ করে আছে। জেহের কোমড়ে জোরে চাপ দিয়ে বলল,
-“এখন বলো কেন বিয়ে করতে চাচ্ছ না?”
-“আ-আসলে...”
-“বলো বলো, আসলে কী হ্যাঁ?”
ইনশিতা এবার বড় একটা দম ছেড়ে বলল,
-“আমি চাইছি আমাদের বিয়েটা ধুমধাম করেই হোক। জীবনে একবার বিয়ে করবো; সেই বিয়েটাকে স্মরণীয় করে রাখতে চাই। আর সামনের মাসে আমার এক্সাম আছে। তাই এক্সামের পরেই আয়োজন বিয়ে করতে চাই।”
চোখ খুলল ইনশিতা। জেহের তার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকাতে তাকাতেই কখন যে ইনশিতার ঠোঁটের সামনে নিজের ঠোঁট এনে ফেলল জেহের নিজেই জানেনা। কোনো অঘটন ঘটার আগেই ইনশিতা জেহেরকে আলতো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। কঠোর কন্ঠে বলল,
-“বিয়ের আগে এসব ভালো লাগে না আমার।”
জেহের ঠোঁট কামড়ে হাসল। জেহের কিছু বলার আগেই ইনশিতা বলল,
-“আমি কী বলেছি বুঝতে পেরেছেন? বিয়েটা দু’মাস পরেই করবো।”
-“ওকে, তোমার যখন আয়োজন করে বিয়ে করার ইচ্ছে সেটা আমি পূরণ করবো। ততদিন তুমি আমার পাশের রুমটাতে থাকবে। চাইলে আমার রুমেও থাকতে পারো। কিছু বলবো না আমি। এতে উল্টো আমারই লাভ।”
আবারও দুষ্টু হাসলো জেহের। ইনশিতার কোমড়ে চিমটি কাটল। লজ্জায় ইনশিতার ইচ্ছে হলো মাটির সাথে মিশে যেতে। কান ঝাঁ ঝাঁ হয়ে গেল তার। পর মুহুর্তে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
-“বিয়ের আগ পর্যন্ত আমি এখানে থাকবো না। আমি নিজ বাড়িতেই থাকতে চাই।”
-“নো, নেভার। এই বাড়ি থেকে এক পা বের করে দেখার সাহস করো আগে। পা ভেঙে রেখে দেবো।”
ইনশিতা রাগ হওয়া থেকে সামলালো নিজেকে। ভিতরে ভিতরে কথা গুছিয়ে নিলো। জেহেরের হাত নিজের হাতের মুঠোয় রাখলো। কোমল কন্ঠে বলল,
-“দেখুন জেহের। আমি সব নিয়ম নীতি মেনেই এই বিয়েটা করতে চাই। বিয়ে নিয়ে প্রত্যেকটা মেয়ের আছে হাজারো স্বপ্ন। তেমনি আমারও আছে। আমিও চাই বাকি পাঁচটা বিয়ের মতো আমাদের বিয়েটাও ধুমধাম করে হোক। তার জন্য আমাকে নিজের বাড়িতে যেতে হবে। মাঝে মাঝে ভালোবাসা বাড়ানোর জন্য হলেও দূরত্ব প্রয়োজন। সেই দূরত্ব ভালোবাসার ভীত আরও মজবুত করে। প্লিজ, আপনি আমার এই কথাটা রাখুন।”
জেহেরের চোখে মুখে খুশির ঝিলিক দিয়ে উঠলো। এই প্রথম রোজ তাকে তার নাম ধরে ডেকেছে। তার রোজের মুখেই তার নামটা বড্ড মিষ্টি শোনায়।
-“ঠিকাছে। তোমার কথা রাখলাম, শুধুমাত্র আমার নামটা নিজের মুখে নেওয়ার জন্য। কী মিষ্টি শোনায় তোমার মুখে আমার নামটা! খুব মিষ্টি করে ডাকো তুমি। তবে আমি প্রতিদিন তোমার খোঁজ নিবো। ফোন করবো। ফোন তুলতে এক সেকেন্ড দেরি করলে তোমার খবর আছে। বাথরুমে গেলেও ফোন সাথে করে নিয়ে যাবে। কলেজে যাওয়ার সময় কারো দিকে তাকাবে না। কোনো ফ্রেন্ড ডাকলেও সাড়া দেবে না। সবাইকে বয়কট করবে। নিজের মতো ক্লাস করে চলে আসবে। সব জায়গায় আমার নজর থাকবে তোমার উপর। একটু এদিক সেদিক হলে তোমায় তুলে নিয়ে আসবো। এনে রুমে বন্দী করে রাখবো। আর একটা ইম্পর্টেন্ট কথা হলো, তুমি তোমার ওই ফ্রেন্ডের সাথে কোনো কথা বলতে পারবে না। এতে তোমার ফ্রেন্ডেরই ক্ষতি।”
ইনশিতা এতক্ষণ ধরে ভ্রু কুঁচকে জেহেরের কথা শুনছিল। বাবারে বাবা! কত নিয়ম! শেষ কথাটা শুনে ভ্রুযুগল আরো কুঁচকে গেল।
-“ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ওর সাথেই আমি সব শেয়ার করি।”
-“তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমি। এখন থেকে যা শেয়ার করার আমার সাথেই করবে।”
-“দেখুন, সবসময় সব কথা আপনার সাথে শেয়ার করা যাবে না। মেয়েদের নিজস্ব একটা পার্সোনাল ব্যাপার আছে।”
-“কেন? কী এমন ব্যাপার আছে যেটা আমাকে বলা যায় না?”
ইনশিতা হতাশ দৃষ্টিতে তাকাল জেহেরের দিকে। এই পাগলকে কে বোঝাবে মেয়েদের কত শত ব্যক্তিগত ব্যাপার থাকে?
-“এখন আপনাকে বলতে পারবো না। শুধু বলে রাখি, নয়নিকার সাথে কথা বললে আপনি ওর কিছু করতে পারবেন না। বুঝেছেন?”
-“বলেছি না, ওই মেয়েটার সাথে কোনো কথা বলবে না। তুমি ওই মেয়েটাকে আমার থেকে বেশি প্রায়োরিটি দাও, যেটা আমার ভালো লাগে না। ওই মেয়ে তোমার হাত ধরে, তোমার সাথে থাকে, তোমার সাথে অনেক কথা বলে, আমার এসব একদমই ভালো লাগে না। তোমার সাথে অন্য কেউ মিশলে আমার রাগ হয়। তখন উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেলতে পারি।”
ইনশিতা ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
-“ও তো একটা মেয়ে। একটা মেয়েকেও এত হিংসা করেন? বাব্বাহ!”
-“মেয়ে হোক বা ছেলে, তোমার সাথে কেউ কথা বললেই আমার রাগ হয়।”
-“প্লিজ। ওকে কিচ্ছু করবেন না আপনি। তাহলে আমি আপনার সাথে কথা বলবো না।”
-“না না না। কিচ্ছু করবো না আমি। তুমি তবুও আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করো না। তবে বেশি বেশি মিশবে না।”
ইনশিতা মনে মনে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জেহেরের গালে হাত দিলো। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলাতে বেশ লাগে। দু’হাত দিয়ে জেহেরের দু'গালে হাত বুলালো। জেহের আবেশে চোখ বুজে ফেলল। কম্পিত কন্ঠে বলল,
-“এমন করলে তোমাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করে রোজ।”
জেহেরের এমন কথায় ইনশিতা দ্রুত হাত সরাতে চাইলো। তার আগেই জেহের হাত চেপে ধরল গালে।
-“প্লিজ, হাত সরিও না।”
জেহের চোখ বন্ধ করে নিজেই ইনশিতার হাত ধরে পুরো গালে হাত বুলাচ্ছে। ইনশিতা ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে আছে।
-“যেতে হবে আমায়। হাত ছাড়ুন।”
অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল জেহের। সেই চোখে চোখ রাখতেই ইনশিতার হৃদয় কেঁপে উঠল।
-“এখন না। আরেকটু পর।”
-“না, এখনি যেতে হবে।”
-“প্লিজ।”
-“না।”
ইনশিতা নিজেই জোর করে হাত সরিয়ে নিলো। চলে যেতে নিলে জেহের হাত ধরল।
-“চলো না, আজকেই বিয়ে করে ফেলি?”
বাচ্চাদের মতো আবদার। যেন বলছে, আমাকে ওটা কিনে দাও না প্লিজ। বাচ্চাদের মতো আদুরে কন্ঠের কথাটা ইনশিতার সর্বাঙ্গে শিহরণ জাগিয়ে দিলো। চোখের দৃষ্টি এদিক সেদিক ঘোরালো। জিভ দিয়ে নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
-“সময় হোক, তারপর।”
বলে নিজেই হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেল নিচে। জেহের এক সেকেন্ড স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে নিজেও দ্রুত পা চালালো নিচের দিকে।
ইনশিতার বাবা ইনশিতাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন। জেহের নিজ থেকেই তাদেরকে দিয়ে আসার জন্য বলল। ইনশিতার বাবা মিজান হোসেন বাঁধা দিলেন না।
গাড়িতে জেহের ড্রাইভিং সীটে, তার পাশে মিজান হোসেন আর পেছনে ইনশিতা। ইনশিতার বাবা গল্প জুড়ে দিলেন। সেই গল্পে অবশ্য জেহেরও শামিল ছিলেন। এই প্রথম জেহেরকে এত হাসিখুশি দেখল ইনশিতা। জেহেরের হাসি আসলেই খুব সুন্দর। ঠোঁটটাকে একটু বাঁকা করে হাসে। ইনশিতা ভেবে পায় না, এত মিষ্টি হাসির ছেলেটা এত রাগী কেন! লুকিং গ্লাসে ইনশিতা আড়চোখে বেশ কয়েকবার জেহেরকে দেখেছিল। যখনই জেহেরকে দেখত সে আশ্চর্যজনক ভাবে তখনই জেহের তার দিকে তাকিয়ে ছিল। বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ইনশিতা। কখনো কখনো তাকালে তো জেহের চোখ টিপ দেয়, আবার চুমু দেবার ভঙ্গিমা করে। ইনশিতা এটা ভেবে বাঁচলো যে তার বাবা সাথে আছে, এখন যদি বাবা না থাকতো জেহের হয়তো তাকে কোলে করে নিয়েই গাড়ি চালাতো।
ইনশিতার বাড়ির কাছে আসতে মিজান হোসেন নেমে গেলেন। জেহেরকে অনেকবার বলার পরেও সে আসলো না। ইনশিতা চলে যেতে নিলে জেহের হাত টেনে ধরে। মিজান হোসেন আগেই চলে গেছেন। ইনশিতা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে? জেহের ইনশিতার মাথা টেনে ধরে সামনে আনলো।
-“উফ! মাথা টানছেন কেন?”
-“আমার সাথে কথা না বলেই চলে যাচ্ছ কেন?”
-“তো কী কথা বলবো? ছাতার মাথা বলবো?”
-“তোমাকে এই ধরনের ভাষা কে শিখায় হ্যাঁ?”
-“ওইগুলা আমিই শিখি।”
-“আর যাতে এসব কথা না শুনি।”
ইনশিতা জিভ দেখিয়ে ভেংচি কাটল। জেহের ইনশিতার নাক টেনে কপালে ছোট্ট চুমু খেলো।
-“মিস ইউ রোজ।”
ইনশিতা কিছু বলতে গিয়ে অনুভব করলো তার গলা কাঁপছে। মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ করতে পারছে না। কেউ তাকে এত ভালোবাসবে সেটা তার কল্পনার বাহিরে ছিল। সে নিজেও চাইতো কেউ তাকে খুব করে ভালোবাসুক। সেটা কী সত্যি জেহের? তবে জেহেরের ভালোবাসা তার কাছে অসুস্থ ভালোবাসা মনে হয়। এমন ভালোবাসা সে চায়নি কোনোদিন। বিধাতা এই ভালোবাসাই কি তার কপালে লিখে রেখেছে? নাকি অন্য কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য?
.
.
.
চলবে.............................