ভিনার চোখেমুখে ক্লান্তি। গতরাতে এক ফোঁটা ঘুম হয়নি।সোহেল বমি করেছিলেন দুই তিনবার,মাথা ঘুরাচ্ছিলো নাকি।ভিনা অনেক জোর করেও হস্পিটালে নিতে পারেনি।তাই টেলিমেডিসিন এ ডাক্তারের সাথে কথা বলে ঔষধ দিয়েছে,সারারাত পাশে বসেছিলো।মাহভিন এমনিতে সব কথা শুনলেও ঘুমের বেলায় অনেক বিরক্ত করে।মুনা চাইলেও রাতে সোহেলের পাশে থাকতে পারেননি,মাহভিনকে নিয়ে অন্য রুমে থাকতে হয়েছে।বিপদের ঘরে বাচ্চারাও কেন যেন আরো বিরক্ত করতে থাকে,অস্থির হয়ে থাকে।ঘুম পারিয়ে যে এই ঘরে আসবেন মুনা,সেই সুযোগ ও পাননি।
সোহেলকে গভীর ঘুমে দেখে ভিনা তার গায়ে পাতলা কাথা টেনে দিলো,মাথায় ও হাত বুলিয়ে দিলো।ভোর হচ্ছে,এই সময়ে হালকা ঠান্ডা লাগে।ডিম লাইট বন্ধ করে দরজা চাপিয়ে ভিনা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।দুইদিন হলো এ বাসায় এসেছে,একদিন রাতে প্রচন্ড ভয়ের স্বপ্ন দেখে মনে অস্থিরতা কাজ করছিলো।বারবার মন ছুটে যাচ্ছিলো সোহেলের কাছে থাকার জন্য।বাসায় এসে দেখলো,সোহেলের শরীর অনেক খারাপ,শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।অথচ ভিনা এসবের কিছুই জানে না।তাকে জানানোই হয়নি এই ব্যাপারে।পৃথিবীতে হাতে গোণা অল্প কয়জন মানুষ নিয়ে ভিনার জীবন,তারাও যখন কথা লুকানো শুরু করে,তখন সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা থাকে না।সবচেয়ে অবাক হয়েছিলো যখন ভিনাকে দেখে সোহেল খুশি হওয়ার পরিবর্তে চিন্তায় পরে গিয়েছিলেন।
-- তুই এখানে কী করছিস?হটাৎ এলি যে?
ভিনা কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো।নিজের বাসায় এসে এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হবে,জানতো না।কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো-
-- তোমার জন্য খারাপ লাগছিলো বাবা।
সোহেল চুপ হয়ে গেলেন,অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেন।মেয়েকে কিছু বলতে পারছেন না।ভিনার চলে যাওয়া উচিৎ,আবার বহুদিন মেয়ের দেখা পাননি,তাই থাকতে বলতে ইচ্ছা করছে।সবমিলিয়ে মাথায় জট লেগে গেছে।
-- তুমি চিন্তা করোনা বাবা।আমি একদিন থাকবো তোমার কাছে,এরপর চলে যাবো।
সোহেল নিরুত্তর রয়ে গেলেন।চোখ পানিতে টলটল করছিলো।বিদেশে বিয়ে করে মেয়েকে পাঠাতে চাচ্ছেন,থাকবেন কী করে এতদিন?
সেদিন বিকেলে এসেছিলো বাসায়।দুপুরে খাওয়া হয়নি।সন্ধ্যার দিকে চুমকিকে বলে নাস্তা দিতে।চুমকি প্লেইন কেক,চানাচুর আর জুস নিয়ে আসে।চুমকি খাবার দিয়ে চলে যায় না,টেবিলের কোণায় দাঁড়ায় থাকে।ভিনা খেয়াল করে তাকালো-
-- কিছু বলবি চুমকি?
-- আপনে এইখানে থাকেন না ক্যান?খালুজানের শরীরডা দ্যাখসেন?
-- আমি থাকলে বাবার শরীর আরো খারাপ করবে।
-- ধুরো,কী কন এডি?মাইয়া কাছে থাকলে বাপে অসুস্থ হয় নাকি?
-- হয় চুমকি।তুই বুঝবি না।
-- আপনের বিয়ে নিয়া অনেক চিন্তা করে খালু।
ভিনা খাওয়া থামিয়ে দিলো।সরু চোখে তাকিয়ে বললো-
-- খুলে বল তো।
-- মুনা খালারে কথা কইতে শুনসিলাম।আপনের বিয়া নিয়া চিন্তা করতে মানা করসিলো।তখন খালু কইসিলো,আপনেরে বিদেশে বিয়া দিতে চায়।
-- বিদেশে?তুই সত্যি বলছিস?
-- কান পাতি নাই আপা,এমনে যা শুনতে পাইসি,ঐডাই কইলাম।তয় এটা সত্যি,খালু আপনের বিয়া নিয়া অনেক চিন্তায় থাকে।
ভিনা এতক্ষণে সোহেলের শরীর খারাপের কারণ ধরতে পারলো।ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।ভিনার কারণে ওর বাবার শরীর খারাপ,ভেবেই অনুতাপে মন বিষিয়ে যাচ্ছে।আজকে একটা ভুল সম্পর্কের মাশুল তার বাবা দিচ্ছে।
ভিনা চানাচুর হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে শেষে মুখে কিছু না দিয়েই উঠে চলে গেলো।নিজের ঘরে দরজা আটকে ঘর অন্ধকার করে বসে থাকলো কয়েক ঘন্টা,নিজের মধ্যে গভীরভাবে ডুব দিলো।জীবন কোন দিকে ওকে নিতে চাচ্ছে,এটা বোঝা অনেক জরুরি।গন্তব্যহীন ভাবে না চলে জীবনকে বুঝে সে অনুযায়ী নিজেকে তৈরি নেয়া ভালো।তৈরি হয়ে না থাকলে ভালো কিছুও জীবনে সুন্দরভাবে আসে না,প্রস্তুত হয়ে থাকলে খারাপ পরিস্থিতিও মেনে নেয়া যায় সহজে।ভিনা সেই অন্ধকার কয়েক ঘন্টায় নিজেকে বুঝিয়ে নিলো,নিজের বাবার শরীর,মাহভিনের সুন্দর ভবিষ্যৎ এবং পরিশেষে অনুতাপহীন জীবনের জন্য এখন বিয়ে হওয়া জরুরি।সেটা প্রবাসী কারো সাথেই হবে।এটাই নিয়তি,মেনে নিতে হবে।
পরের দিন সকালে একদম স্বাভাবিকভাবে সবার সাথে কথা বললো।সোহেলের ঘরে গেলো সকালের খাবার নিয়ে। এরপর নিজ হাতেই খাইয়ে দিলো।
সোহেল খাবার খেলেন মায়ের বাধ্যগত সন্তানের মতো ।ভিনা পরে ঔষধ দিয়ে এরপর নিরবতা ভেঙে বললো-
-- আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা কেন করো বাবা?
-- দুশ্চিন্তা না মা,এটা বয়সের দোষ। প্রতিটা বয়সে কিছু দোষ থাকে।মধ্যবয়স হয়ে গেলে,বয়সের দোষ হয় দুশ্চিন্তা করা।
-- তুমি কি আমার বিয়ে নিয়ে ভাবো?
-- কে বললো তোকে?
-- আমি পড়াশোনা করছি,মাহভিনের থেকে আলাদা থাকছি।তাহলে বাকী থাকে শুধু সেটেলমেন্ট। নিজের সেন্স থেকে বললাম।
-- ভাবতে তো হবেই রে মা।
-- চিন্তা করো না।যা সিদ্ধান্ত নিবে,আমি পাশে থাকবো তোমার।
-- আচ্ছা শোন,রুশান কেমন আছে?কতদিন হয়ে গেলো আসেনা।
-- ভালো আছে বাবা।ব্যস্ত হয়ে গেছে,তাই আসে না।
-- আগেও তো ব্যস্ত থাকতো।কোনো সমস্যা হয়েছে তোদের মধ্যে?
-- না বাবা।আগেই তো বলেছি ও অনেক ইম্যাচিওর ছেলে।দীর্ঘদিন বন্ধুত্ব রাখা ওর পক্ষে সম্ভব না।
-- ইম্যাচিওর হতে পারে....কিন্তু...হটাৎ?
-- ওর চোখ খুলে গেছে।
ভিনা ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে ঘর থেকে চলে গেলো।সেদিন বিকেল থেকেই সোহেলের শরীর বেশিই খারাপ লাগছিলো।মাঝরাতে বমি করে পরে যাওয়ার পর ভিনা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে হস্পিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য।এমনকি সোহেল বমি করে ভাসিয়ে দিয়ে ঘর নোংরা করে ফেলায়,ভিনাকে কাছেও ভীড়তে দেননি,নিজেই চুমকিকে দিয়ে কাপড় আনিয়ে পরিষ্কার করেছেন।এমন আচরণ দেখে ভিনার ইচ্ছা করছিলো চিৎকার করে কান্না করতে।নিজেকে সামলে নিয়ে তখন যা দরকার,তাই করেছে। ড্রাইভারকে ফোন করে এনেছিলো এত রাতে,তবুও সোহেল হাসপাতালে যাননি।অগত্যা ড্রাইভারকে দিয়ে ডাক্তারের কথামতো ঔষধ আনিয়ে খাইয়ে দিয়েছে।ডাক্তার ফোনেই বলে দিয়েছে,মাইল্ড স্ট্রোকের সম্ভাবনা প্রবল।যত জলদি সম্ভব চেক আপের জন্য যেন নিয়ে যাওয়া হয়।সারারাতের ধকল শেষে যখন বারান্দায় দাঁড়ালো,তখন জীবনে আশার আলো দেখতে পেলো না।
••••••••••••••
রুশান সিগারেটের প্যাকেট কিনে এনেছে।এ বাড়িতে কারো সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস নেই।জেবার কঠোরতার এই এক ভালো দিক ছিলো,উনি নিজের স্বামী এবং ছেলেদের বাজে কিছু অভ্যাস থেকে দূরে সড়িয়ে রাখতে পেরেছিলেন।কিন্তু রুশান পারছে না নিজের মানসিক পীড়ার সাথে যুদ্ধ করতে।ক্লাস শুরু হয়েছে,আশেপাশে পরিচিত কেউই নেই।সমসাময়িক সবাই এখন দুই-তিন সেমিস্টার করে আগানো।জুনিয়রদের সাথে ক্লাস করতে ভীষণ অস্বস্তি কাজ করে।ফ্যাকাল্টি যখন রোল জিজ্ঞেস করে কেন এত সেমিস্টার পেছনে,জুতসই কোনো উত্তর দিতে পারে না।হটাৎ করেই রেললাইনের মতো নিরন্তর এবং সোজা ট্র্যাক থেকে ছিটকে পরে গেছে।ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড হাজার রঙের স্বপ্ন নিয়ে চলা এক্সট্রোভার্ট ছেলে ছিলো,এখন মানুষের মুখোমুখি ও হতে ইচ্ছা করে না।বন্ধুদের এড়িয়ে চলতে হয়।ক্লাবের মেম্বারদের থেকে দূরত্ব রাখতে হয়।এত এত প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে ভালো লাগে না।স্বেচ্ছায় এই অমানসিক চাপ নিজের উপর টেনে নিয়ে এসেছে রুশান।নিজেই দাওয়াত দিয়ে,এখন নিজেই নিতে পারছে না এই যন্ত্রণা।তাই আজকে ফেরার পথে সিগারেট নিয়ে এসেছে।একটা জ্বালিয়ে টান দিতে দিতেই কাশি উঠে নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার যোগাড় হয়েছে।তাই পুরো প্যাকেট ফেলে দিয়ে চুপ চাপ বসে আছে বিছানার উপর।যার জন্য যেটা নয় আরকি,সিগারেট নেশা ফেশা রুশানের জন্য না।জোর করে এসব চাইলেও করতে পারবে না।একিভাবে,ভিনাকে ঘৃণা করাও ওর পক্ষে সম্ভব না।দিন যত যাচ্ছে,বুঝতে পারছে,নিজের সামনে যে মুখোশ পরে আছে,সেটা অমূলক। ভিনাকে এখনো আগের মতোই ভালোবাসে।পার্থক্য এখন ভালোবাসায় বাস্তবতা এসে পরেছে।রুশান ফোন হাতে নিলো ভিনাকে কল দেয়ার জন্য,পারলো না।নিজের আচরণ দিয়েই ভিনাকে অনেক দূরে সড়িয়ে দিয়েছে।এমন সব প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে,যেটা ভিনার জন্য ছিলো মৃত্যুসম।আজকে নিজে প্রায় একি রকম পরিস্থিতিতে পরে টের পাচ্ছে,অযাচিত প্রশ্ন ভেতরকে কীভাবে ভেঙ্গে দেয়।কী হবে এত দেরিতে উপলব্ধি এসে,বিশেষ করে এখন,যখন ভিনা অন্য একজনের হতে চলেছে।
.
.
.
চলবে.........................................................................