জেহের নিজের পার্সোনাল হেলিকপ্টারে উঠে বসল। ব্ল্যাক স্যুটের সাথে হোয়াইট শার্ট। শার্টের ওপরের বোতাম দুটো খোলা। সানগ্লাস আটকে রাখা আছে শার্টে। চুলগুলো সেই আগের অবস্থানের মতোই কপালে ঠাঁই নিয়েছে। হাতে রিস্ট ওয়াচ। চোখে মুখে গম্ভীর ভাব তবে চোখ দুটো অসম্ভব লাল, যেন কাউকে সামনে পেলে লাল চোখ দ্বারাই উড়িয়ে দেবে। উড়ে চলল হেলিকপ্টার তার গন্তব্যের দিকে।
.
ইনশিতা এখনো হা করেই আছে। রাফিদ হেসে ইনশিতার সামনে দুই আঙুল দিয়ে তুড়ি বাজাল। ধ্যান ভেঙে গেল ইনশিতার। সে বিস্মিত গলায় বলল,
-“রাফিদ ভাইয়া! তুমি?”
রাফিদ ভ্রু কুঁচকালো,
-“তো কার আশা করছিলে তুমি? জেহের নাকি জিহাদ?”
ইনশিতা উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
-“তুমি এখানে কেন নিয়ে এসেছ আমায়? আর এভাবে নিয়ে আসার মানেটা কী?”
-“সবুর করো ইতু। সব জানতে পারবে। আগে ফ্রেশ হয়ে আসো তো। রুমের আলমারিতে ড্রেস রাখা আছে, চেঞ্জ করে আসো। এত ভারি সাজে থাকতে কষ্ট হবে।”
-“এতক্ষণ যেভাবে ছিলাম সেভাবেই থাকব। আগে তুমি বলো।”
-“বললাম না চেঞ্জ করে আসো।”
-“তুমি না বলা পর্যন্ত আমি এক পাও নড়ব না।”
রাফিদ হাল ছেড়ে দিলো। সে জানে ইনশিতা এখন না জেনে কোত্থাও যাবে না। তাই নিজে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে সামনের চেয়ারে ইনশিতাকে বসতে ইশারা করল।
-“তুমি নিশ্চয়ই জানো যে তোমার সাথে একজনের বিয়ে ঠিক হওয়া ছিল আগের থেকেই?”
-“হ্যাঁ। কিছুদিন আগে বাবার কাছ থেকে জানলাম। কিন্তু এই প্রশ্ন কেন?”
-“যার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল সেই ছেলেটা আমি।”
ইনশিতা দ্বিতীয়বারের মতো বিস্ময়ে আবারও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। রাফিদ বিরক্তি নিয়ে বলল,
-“বারবার দাঁড়াচ্ছ কেন? স্থির হয়ে বসে থাকতে পারো না?”
ইনশিতা স্ট্যাচুর মতোই দাঁড়িয়ে আছে।
-“কিন্তু তুমি তো আমার ভাই হও।”
রাফিদের বিরক্তির সাথে সাথে রাগও উঠে গেল। নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে ইনশিতার বাহু ধরে ঝাঁকাল। রাগী গলায় বলল,
-“আমি তোমার কোন কালের ভাই হু? তুমি আমার মায়ের পেটের বোন না কি আমি তোমার মায়ের পেটের ভাই? সবসময় খালি ভাইয়া ভাইয়া করতেই থাকো। একদিনও আমি তোমার সাথে ভাইয়ের মতো আচরণ করেছি?”
-“তুমি তো আমার সাথে প্রেমিকের মতও আচরণ করো নাই।”
রাফিদের বিরক্ত নিয়ে আশেপাশে চোখ বুলাল। মেজাজ ঠান্ডা করতে হবে। বড় একটা শ্বাস নিয়ে বলল,
-“আমি তোমাকে সবসময় তুমি করে বলি সেটা কী প্রেমিকের মতো আচরণ না?”
-“আশ্চর্য! আমিও তো তোমাকে তুমি করে বলি। আর ভাইরাও তো বোনকে তুমি করে বলে।”
রাফিদ শক্ত করে ইনশিতার বাহু ধরে বলল,
-“যাই হোক, ভাই বোন চুলোয় যাক। শুধু এটা জেনে রেখো আমি তোমাকে কখনো বোনের চোখে দেখিনি। যখন থেকে শুনেছি তোমাকে আমার বউ করা হবে তখন থেকেই তোমার প্রতি অন্যরকম অনুভূতি অনুভব করেছি। ভালোবাসতে শুরু করেছি।”
ইনশিতা চোখ দুটো বড় করে গোলগোল করে তাকিয়ে আছে। রাফিদ বলা থামালো না।
-“ঐ সাইকো জেহের আমাকে মারার পর অনেকদিন বেড রেস্টে ছিলাম। যখন সুস্থ হই তখন জানতে পারি তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ঐ শালা জেহেরের সাথেই। তারপর থেকে প্ল্যান শুরু করি আমি। তুমি যখন কলেজ যাও তখনো একা পাইনি তোমায়। চারপাশে লেডি গার্ডসরা তোমার উপর নজর রাখতো। তবুও প্রতিদিন লুকিয়ে দেখতাম তোমায়। তোমার বাসায়ও নজর রাখতাম। একদিন দেখি জিহাদ তোমার বারান্দায় গিয়ে তোমার সাথে মিসবিহেভ করছিল। আমি যখন আটকাতে যাব তখনই তুমি জিহাদকে ছাড়িয়ে ভেতরে চলে গিয়েছিলে। জিহাদ চলে যাওয়ার পর তুমি ঐ বারান্দাতেই বসে কাটিয়েছিলে। সারারাত দাঁড়িয়ে থেকে পাহারা দিয়েছিলাম যাতে ঐ জিহাদের বাচ্চা আর না আসে। হলুদের রাতে বারান্দায় তোমায় আর জেহেরকে একসাথে দেখে খুব রেগে গিয়েছিলাম। তাই ঢিল ছুঁড়ে মারি। আমার প্ল্যান ছিল বিয়ের দিনই তোমাকে উঠিয়ে থাইল্যান্ড নিয়ে আসব। সব বন্দোবস্ত আগে থেকেই করে রেখেছিলাম। আমি কিছু করার আগেই দেখি কিছু মহিলা তোমাকে জোর করে তুলে দিয়েছে একটা মাইক্রোতে। আমি গাড়িটি ধরার আগেই গাড়ি ছেড়ে দেয়। সেই গাড়ির পেছন পেছন বাইক নিয়ে আসি। কিছুক্ষণ বাদেই গাড়িটি থেমে ড্রাইভার নেমে গিয়ে জিহাদ উঠে যায়। বুঝতে পারি যে এসব জিহাদেরই প্ল্যান। আমি বাইক নিয়েই গাড়িটির সামনে দাঁড়ালে জিহাদ গাড়ি থামিয়ে বেরিয়ে আসে। আমার মাথায় হেলমেট ছিল তাই জিহাদ আমাকে চিনতে পারেনি। আমিও এগিয়ে গিয়ে ক্লোরোফর্ম মাখানো রুমাল জিহাদের মুখে চেপে ধরি। জিহাদ অজ্ঞান হয়ে গেলে আমি আমার বাইক রেখে গাড়িতে এসে বসে পড়ি। কাঙ্খিত জায়গায় পৌঁছে তোমায় কাঁধে তুলে হেলিকপ্টারে নিয়ে রাখি অ্যান্ড অ্যাট লাস্ট আমার প্ল্যান সাক্সেসফুল। থ্যাংকস টু জিহাদ অর্ধেক কাজ করে আমারই হেল্প করেছে।”
এতক্ষণ ইনশিতা অবাক হয়ে শুনছিল রাফিদের কথা। এত এত প্ল্যান শুধুমাত্র তাকে পাওয়ার জন্য! ইনশিতা ঝটকানি দিয়ে রাফিদের হাত বাহু থেকে ছাড়িয়ে নিল। ঝাঁঝাল গলায় বলল,
-“তাহলে আপনাদের তিনজনের মধ্যে তো কোনো পার্থক্যই দেখছি না। সবগুলাই একই জলের মাছ।”
রাফিদ ইনশিতার দুটো হাত একসাথে ধরে সামনে আনল,
-“দেখো ইতু। তোমার সাথে আমার বিয়ে হলে কিন্তু কোনো ঝামেলাই হতো না। আর আমি ঐ দুই ভাইয়ের মতো না। আমাকে একদম ওদের সাথে মেলাবে না। একজন তো তোমাকে নিজের কাছে বন্দী রাখতে চায়, আরেকজন সেই বন্দী থেকে মুক্ত করে নিজের কাছে এনে আবার বন্দী রাখতে চায়। কিন্তু আমি এসব কিছুই চাই না। আমি চাই তুমি তোমার মতো থাকো। আমার কাছে থেকেই তুমি তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করো। আমার আর তোমার একটা ছোট্ট সংসার হবে। আমার মা-বাবা, আমি আর তুমি মিলে একটা সংসার। তোমার ইচ্ছা হলে তুমি চাকরি করবে। আমাদের পুচকু হলে আমি চাকরি ছেড়ে পুচকুদের দেখাশোনা করবো যাতে তোমার প্রফেশনাল লাইফে কোনো ক্ষতি না হয়। একটা টোনাটুনির সংসার করার বড্ড ইচ্ছা আছে তোমার সাথে।”
ইনশিতা মুখ ফিরিয়ে নিলো। তার অনেক কষ্ট হচ্ছে। তারও তো এমন একটা সংসার করার ইচ্ছা আছে। জেহেরের সাথে যদি জীবনেও দেখা না হতো তাহলে সে নিশ্চয় রাফিদের সাথে নিজের স্বপ্নের সংসার গড়তে পারতো। কিন্তু এসব যে আর কখনো সম্ভব হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত জেহের আছে।
রাফিদ ইনশিতার মুখ নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো। দুহাতে ইনশিতার চোখ মুছে গালে হাত রাখল। বলল,
-“ইতু, তুমি কী চাও না এমন একটা সংসার করতে যেখানে শুধুই ভালোবাসা আর স্বাধীনতা রয়েছে?”
ইনশিতা অস্ফুট স্বরে সম্মতি দিলো।
-“তাহলে আমার সাথে এরকম একটা সংসার গড়তে সমস্যা কোথায়?”
-“সেটা কখনোই সম্ভব না।”
-“তুমি কি জেহেরের ভয় পাচ্ছ?”
ইনশিতা মাথা নিচু করে ফেলল।
-“সব ভুলে যাও ইতু। ভয় পেলে তো চলবে না। জেহের কিইবা করবে আর। ও তো জানেই না আমরা এখানে রয়েছি। দরকার হলে এখানেই আমরা বিয়েশাদী করে কয়েকবছর পর দেশে যাবো। তখন দেখবে, জেহের কেন, জেহেরের চৌদ্দগোষ্ঠীও কিছু করতে পারবে না।”
ইনশিতা চমকে তাকাল,
-“বিয়ে!!”
-“হ্যাঁ, তোমার আর আমার বিয়ে। সমস্যা না হলে আমরা আরও কিছুদিন পর বিয়ে করবো। চিন্তা করবে না, জেহের কখনোই জানতে পারবে না যে আমরা এখানে আছি। আর তোমার বাবার সাথেও কথা হয়েছে আমার।”
-“কী! বাবা জানে?”
-“তুমি যখন ঘুমে ছিলে তখনই সব জানিয়েছি। আর এটাও বলেছি তোমার সাথে আমার বিয়ে হবে, এখানে কিংবা দেশে। তোমার বাবাও এটা চেয়েছিল। ওয়ান সেকেন্ড, কথা বলে নাও তুমি।”
রাফিদ ইনশিতার বাবাকে ফোন করে ইনশিতার কানে দিলো।
-“হ্যালো বাবা।”
-“কেমন আছিস ইতু?”
-“ভালো আছি বাবা, তুমি কেমন আছো? মা কেমন আছে? খাবার খেয়েছ তো?”
-“গতকাল পর্যন্তও খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। এখন ঠিক আছি।”
-“তার মানে তুমি সত্যি রাজি।”
-“কিসের ব্যাপারে?”
-“আমার আর রাফিদ ভাইয়ের বিয়ের ব্যাপারে।”
-“হ্যাঁ ইতু। আমি অনেক ভেবে দেখেছি। আর রাফিদের সাথেই তোর বিয়ে ঠিক করেছিলাম প্রথমে। এখন যখন রাফিদের সাথেই বিয়ে হচ্ছে তাতে না করার কোনো কারণ নেই।”
-“হু।”
ইনশিতা একটু একপাশে গিয়ে বলল,
-“বাবা, জিহাদের কি অবস্থা?”
-“শুনেছি গতকাল ও কে নাকি মাঝ রাস্তায় পাওয়া গেছে। আফজাল সাহেব খবর পাওয়ার পর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছেন।”
বাবা-মেয়ের কথোপকথন শেষ হলে রাফিদ বলে,
-“কী? এবার রাজি আছো তো?”
ইনশিতা একবার মুখ উঠিয়ে তাকাল। চোখেমুখে এখনো রাজ্যের ভয়। রাফিদ বুঝতে পারল। আশ্বস্ত করে বলল,
-“সহজ হও ইতু।”
ইনশিতা জোর করে হাসল। রাফিদ ও কে ফ্রেশ হওয়ার জন্য নিচে নিয়ে গেল। ফ্রেশ হয়ে ইনশিতা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। রাফিদ নিজেও পাশে এসে দাঁড়াল। ইনশিতা বলল,
-“রাফিদ ভাইয়া! সত্যি কী এবার আমার স্বপ্নের মতো সংসার হতে যাচ্ছে?”
-“এখনো বিশ্বাস করতে পারছ না?”
-“না মানে...”
-“বুঝেছি, চিন্তা করো না। তোমার ইচ্ছেতেই সব হবে। আর হ্যাঁ, দয়া করে এবার আর ভাইয়া ডেকো না। রাফিদ বলেই ডেকো।”
-“ক-কীভাবে? মানে...”
-“ধীরে ধীরে অভ্যেস করে ফেলো। অভ্যেসে সব হয়।”
-“হু।”
-“জেহেরের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও। ভাবো যে ওটা একটা দুঃস্বপ্ন অতীত ছিলো। অতীত মাথায় রেখে বর্তমান আর ভবিষ্যত নষ্ট করতে নেই। আর এখন জেহের কিচ্ছু করতে পারবে না।”
রাফিদ ইনশিতার হাত ধরে এনে চেয়ারটিতে বসে নিজেও পাশের চেয়ারে বসল। ইনশিতার চুলগুলো বাতাসে উড়োউড়ি করছিল। রাফিদ নিজ হাতে ইনশিতার চুলগুলো বেঁধে দিলো। ইনশিতার খুব ভালো লাগলো এই ভেবে যে, রাফিদ কোনো সুযোগ নিচ্ছে না। আর জেহের হলে তো জড়িয়ে ধরা শুরু করে আর কি কি যে করতো! বাপরে বাপ!
.
.
জেহের থাইল্যান্ডের মাটিতে পা রাখল। বডি গার্ডরা তার লাগেজ হাতে পেছন পেছন আসতে লাগল। হেলিকপ্টারের বাতাসে জেহেরের চুল কপালের একসাইডে গিয়ে উড়োউড়ি করছে। জেহের শার্টের বুক থেকে সানগ্লাস নিয়ে চোখে পড়ল। ঠোঁটে বাঁকা হাসি। হাতঘড়িতে একবার সময় দেখে নিলো। বাঁকা হাসি মুখে রেখে নিজেই নিজেকে বলল,
-“জেহের চাইলেই সবকিছু করতে পারে। আর নিজের ভালোবাসার জন্য তো কোনো কিছুরই পরোয়া করবে না জেহের। নেভার অ্যান্ড এভার। আমার কাছ থেকে আমার রোজকে নিয়ে লুকিয়ে যাবি ভেবেছিস? যদি ভেবে থাকিস তাহলে এটাও ভেবে রাখ যে তোর মৃত্যু আসন্ন। বনের রাজা সিংহের সাথে বনের ক্ষুদ্র প্রাণী যেমন পেরে উঠে না, তেমনই তুইও আমার সাথে পেরে উঠবি না। তোর হাতে সময় খুব কম। সো, কাউন্ট ডাউন স্টার্ট মি. রাফিদ হাসান।”
.
.
.
চলবে..............................