অতঃপর তুমি - পর্ব ২১ - ইশরাত জাহান সুপ্তি - ধারাবাহিক গল্প


#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-২১
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি 



অভ্র'র দুলাভাইয়ের বাসায় যেতে যেতে আমাদের অনেকটা দেরি হয়ে গেলো।বাসায় পৌঁছাতেই দুলাভাই এই অভিযোগ নিয়ে আমাদের দিকে তেড়ে এলেন।অনেক সাফাই গেয়ে অতঃপর অভ্র ছাড়া পেলো দুলাভাইয়ের হাত থেকে।
তুতুলদের বাড়িটি খুব সুন্দর।ঢাকা শহরের মাঝখানে সাদা রঙের ডুপ্লেক্স বাড়িটি।বাইরে থেকে পুরো সাদা রঙের হলেও ভেতরে সাদার সাথে কিছু দেয়ালে আবার হলুদ রঙ মেশানো।মাঝখানের দেয়ালটি গাঢ় নীল রঙে সাদার মাঝখানে ফুটে আছে।হল রুমটি নানা শোপিজ আর শৌখিন আসবাবপত্রে ঠাসা।
দুলাভাইয়ের বাবা নেই।মা আছে সে থাকে স্পেনে দুলাভাইয়ের বড় ভাইয়ের সাথে।এই বাড়িতে আরিশা আপু আর দুলাভাই একাই থাকেন।আরিশা আপুর বিয়ে হয়েছে অভ্র'র বিয়ের আরো আট বছর আগে।

দেরি করে আসায় বাসায় গিয়েই সোজা খাবার টেবিলে বসে পড়তে হলো।পুরো টেবিল ভরে আছে বিভিন্ন পদের খাবারে।খাবারের সুস্বাদু ঘ্রাণ পুরো ঘর ময় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আমরা টেবিলে বসে পড়ার পর আরিশা আপু চিংড়ি মাছের একটা আইটেম নিয়ে এলেন।দেখে মনে হচ্ছে মাত্রই চুলা থেকে নামানো হয়েছে।দুলাভাই বলে উঠলেন,
'এটা তোমার আপুর স্পেশাল আইটেম।একদম গরম গরম খেতে হয়।'
আমি বললাম,
'আপু আমাকেও শিখিয়ে দিবেন।'
'অবশ্যই অরু।দেখেছো তুতুলের বাবা,একেই বলে ভালো মেয়ে।শেখার আগ্রহ আছে।'
'তাতো আমরা জানিই আরিশা।আমার একমাত্র শালা সাহেবের বউ কি কখনো খারাপ হতে পারে।তোমার এই রান্নাটারও কোনো তুলনা হয় না।এর জন্যও হলেও তোমার জ্বালাতন গুলা সহ্য করে থাকা যায়।'
আমি মুখে হাত দিয়ে মুচকি হাসলাম।আরিশা আপু দুলাভাইয়ের দিকে চোখ গরম করে তাকালেন।দুলাভাই একটা ঢোক গিলে খাবার বাড়ার দিকে নজর দিলেন।
আমি বললাম,
'আপু আপনিও বসুন।'
'না অরু।তোমরা খাও আমি পরে খাবো।'
'কেনো আপু আপনি বসুন না।সবাই একসাথে খাই।'
'থাক আমি পরেই বসবো।তোমরা এখন খাও।আমি বসলে তোমাদের বেড়ে খাওয়াবে কে?'
'আপু আমরা কি পর যে আমাদের বেড়ে খাওয়াতে হবে!আমরা নিজেরা বেড়ে খেতে পারবো না?আপু আপনি খেতে বসুন না হলে আমিও পরে খাবো।'

অভ্রও বললো,'আপু তুমি বসো তো।সবাই একসাথে খেয়ে ফেলি।'
আপু একটু মৃদু হেঁসে দুলাভাইয়ের পাশে খেতে বসে পড়লেন।আমরা চার জন খেতে বসে পড়লাম।তুতুল টেবিলের পাশেই ফ্লোরে বসে চারপাশে খেলনা দুলনা ছড়িয়ে রেখে দুলাভাইয়ের ফোনে গেমস খেলছে।
এতো এতো খাবারের আইটেম রাখা যে কোনটা ছেড়ে কোনটা খাবো কিছুই বুঝতে পারছি না।একটা দুটো পদ খেতেই তো আমার পেট ভরে গেলো।আরিশা আপু বললেন,
'এ কি অরু!তুমি ইলিশ মাছ ভাজা খাচ্ছো না কেনো?'
'থাক আপু খাবো না।'
'কেনো?ভালো লাগে না ইলিশ মাছ?'
'ভালো লাগে কিন্তু ইলিশ মাছে প্রচুর কাটা থাকে তো আমি বেঁছে খেতে পারি না।'

অভ্র আমার কথায় খাওয়া বন্ধ করে বললেন,
'এটা কোনো কথা কাটা বাছার জন্য ইলিশ মাছ খাবে না!কত সুস্বাদু একটা মাছ!দাও আমি কাটা বেঁছে দিচ্ছি।'

অভ্র তার পাতে একটি ইলিশ মাছ ভাজার টুকরো নিয়ে খুব ভালো মতো কাটা বেঁছে বেঁছে আমার পাতে দিতে লাগলো।আর আমি তা খেতে লাগলাম।দুলাভাই একবার চোখ ইশারা করে আরিশা আপুকে দেখালো।অভ্র নিজের খাওয়া বাদ দিয়ে পুরো দমে আমার খাওয়ার পেছনে লেগে গেছে।বারবার এটা ওটা পাতে বেড়ে দিয়েই যাচ্ছেন।আমার কোনো বারণই শুনছেন না।আমি কি এতো খেতে পারি নাকি!

আমাদের খাবারের মাঝপথে দুলাভাই হঠাৎ অভ্রকে বললেন,
'অভ্র,তোর বিয়েতে তো আমার কোনো গিফট দেওয়া হয় নি।পরে সু্যোগ পেলে তো আর এ নিয়ে ক্ষ্যাপাতে ছাড়বি না।'

আরিশা আপু বললেন,
'ক্ষ্যাপাবেই তো।একটা মাত্র শালা দাও নি কেনো।এখন শুনবে সারাজীবন ভর খোঁটা।'

'জ্বি না শালার বোন।সেই সুযোগ আর আমি আপনার ভাইকে দিচ্ছি না।'

দুলাভাই পকেট থেকে আমাদের দুজনের মাঝখানে একটি কাগজ রেখে একগাল হেঁসে বললেন,
'এই নে অভ্র আমার পক্ষ থেকে তোর বিয়ের উপহার।দশ দিনের হানিমুন প্যাকেজ।'

দুলাভাইয়ের মুখে হানিমুনের কথা শুনে অভ্র'র বিষম উঠে গেলো।আর আমি চোখ বড় বড় করে মুখের খাবার যেনো আর গিলতেই পারছি না।
আরিশা আপু অভ্র'র দিকে পানির গ্লাস বাড়িয়ে বললেন,
'সাবধানে দেখে খা।'

উনি এক চুমুকে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে ফেললেন।দুলাভাই বললেন,
'বান্দরবানে দশদিনের জন্য হানিমুনে যাবি নেক্সট মান্থেই।এখন বল কিভাবে যাবি?বাই ট্রেন নাকি বাই প্লেন?'

অভ্র কিছুক্ষণ ইতস্তত বোধ করতে করতে বললেন,
'দুলাভাই,এখন তো সম্ভব না।এখন একটু ব্যস্ত আছি কাজে।'
'এমন একটা মাইর দেবো অভ্র যে দুলাভাইয়ের নাম ভুলে যাবি।ঐ কাজ কি তুই শুধু একা করিস আমরা করি না?নাকি আমরা বিয়ে,বাচ্চা কাচ্চা হওয়ার পর কাজে ঢুকেছি?আমি আর কোনো কথা শুনছি না নেক্সট মান্থ কয় তারিখে যেতে পারবি বল।আমাকে তো আবার কনফার্ম করতে হবে রে বাবা!'

'দুলাভাই সমানে তাগড়া দিয়েই যাচ্ছেন।আমার আর অভ্র'র মুখের অবস্থা হয়েছে দেখার মতো।দুজনেই পুরো জবুথবু হয়ে আছি।মাঝে মাঝে মনে হয় দুলাভাইয়ের জীবনের উদ্দেশ্যই হলো আমাকে আর অভ্রকে শুধু অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেওয়া।
আমাদের এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিলো তুতুলের হাতের ফোনটি।হঠাৎ বাজখাঁই গলায় বেঁজে উঠা শুরু করলো।দুলাভাই বললেন,
'তুতুল ফোনটা দিয়ে যাও।'

তুতুল দৌঁড়ে এসে বাবার হাতে ফোনটা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।দুলাভাই কিছুক্ষণ ফোনে কথা বলে হাসি মুখে আরিশা আপুকে বললেন সৌরভের ছোট বোন মানে তার এক বন্ধুর এক ছেলে সৌরভের পর এখন আবার আজ একটা মেয়ে হয়েছে।দুলাভাইয়ের কথা শেষ হতেই তুতুল তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো,
'বাবা, বোন হলে কি হয়?'

দুলাভাই একগাল হেঁসে বললেন,
'বোন হলে অনেক আনন্দ হয়।একটি খেলার সাথী হয়।তাকে খুব আদর যত্ন করতে হয়।এই যে সৌরভের ছোটো বোন হলো তাই এখন সৌরভ বড় ভাই হয়ে গেছে।'
তুতুল খুব মনোযোগ সহকারে কিছুক্ষণ তার বাবার কথা শুনে বলল,
'বাবা,আমারও একটা বোন লাগবে।আমাকে একটা বোন এনে দাও না।'

তুতুলের কথা শুনে দুলাভাই আর আরিশা আপু দুজনেই থতমত খেয়ে গেলেন।আমি খাওয়ার ফাঁকে ঠোঁট চেঁপে একটু হেঁসে নিলাম।

'বাবা,বোন এনে দাও না।'

দুলাভাই বললেন,
'তুতুল দেখছো না এখানে বড়রা খেতে বসেছে।যাও বাবা তুমি ফোন নিয়ে সোফায় বসে গেম খেলো।'

তুতুল খুব জোর দিয়ে না বলে তার বাবার হাত ধরে জোরে জোরে নাড়িয়ে বলল,
'না আমি যাবো না।আমার ছোট বোন লাগবে।আমাকে একটা ছোটো বোন এনে দাও।'

চার বছরের বাচ্চার জেদ ভয়ংকর হয়।তুতুল সেই ভয়ংকর জেদ নিয়ে দুলাভাইকে বারবার বলতেই লাগলো।দুলাভাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আবারো একগাল হেঁসে বললেন,
'বাবা,এখন তো আমরা না তোর মামা মামী তোকে বোন এনে দিবো।তোর মামাকে বল তোকে একটা ছোট্ট বোন এনে দিতে।'

দুলাভাইয়ের কথায় তুতুল তার বাবার হাত ছেড়ে তার মামার হাত ধরে বলতে লাগলো,
'ও মামা মামা,আমাকে একটা বোন এনে দাও না।আমিও সৌরভের মতো বড় ভাই হতে চাই।দাও না মামা।'

অভ্র পড়ে গেলো বিপাকে।কি বলবে না বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।একটা জোরপূর্বক হাসি টেনে বলল,
'তুতুল সোনা,এসব কথা বলে না বাবা।যাও খেলতে যাও।'

'না আমার একটা বোন লাগবে,লাগবেই।মামা আমাকে একটা বোন এনে দাও না।'

তুতুল 'বোন এনে দাও',বোন এনে দাও' করে করে অভ্রকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছে আর এদিকে দুলাভাই হানিমুন হানিমুন করে।বেচারার অবস্থা শোচনীয়।দুদিকে সামাল দিতে দিতে তিনি অস্থির হয়ে পড়ছেন।আর আমার কথা আর নাই বা বললাম।সেই যে মাথা নিচু করেছি আর উঠায় নি।দুলাভাই থামার নামই নিচ্ছেন না।তার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যে তিনি এখনই আমাদের দুজনকে ধরে বেঁধে হানিমুনে পাঠিয়ে দিবেন।



চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন