জিহাদ আর জেবা বসে আছে রাফিদের সামনের সোফায়। রাফিদের ডান হাতে, পায়ে আর মাথায় ব্যান্ডেজ। এই দু'সপ্তাহে সে ঠিক হলেও পুরোপুরি ঠিক হতে পারেনি। হাঁটতে চলতে কারো না কারো সাহায্য লাগেই। গতকালই হসপিটাল থেকে রিলিজ পেয়েছে।
প্রথমে জিহাদই কথা শুরু করল,
-“পুলিশকে মিথ্যা বলেছিলে কেন?”
রাফিদ কপাল কুঁচকায়।
-“আমি কাউকে মিথ্যা বলিনি। যা হয়েছিল তাই বলেছি।”
-“তোমার কী মনে হয়, আমরা সত্যিটা জানি না? তোমার চেয়ে আমরা বেশি ভালো করে জানি আমাদের ভাইকে। সে কেমন, কার কী করতে পারে এই ব্যাপারে তোমার ধারণা আমাদের চেয়ে কম। পুলিশকে সত্যিটা বললে আজ ভাই হয়তো জেলে থাকতো আর ইনশিতাও রেহাই পেত।”
-“আপনার ভাই কোনো প্রকার এভিডেন্স রাখেনি। তাহলে পুলিশ কীভাবে তাকে ধরত?”
-“তোমার জবানটাই আসল প্রমাণ ছিল। কিন্তু সেটা তুমি করোনি। হোয়াই?”
-“তবুও কোনো না কোনো প্রমাণ দরকার ছিল। সেটা যাই হোক, আমি যখন এখানেই কেস ক্লোজ করে দিয়েছি সেখানে আপনারা এত আগাচ্ছেন কেন?”
জিহাদ বিরক্তিতে কপালে হাত ঠেকায়। সে ভালোই বুঝতে পারছে রাফিদ ইচ্ছে করেই পুলিশকে মিথ্যা বলেছে। রাফিদ কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তার এই অবস্থা কে করেছে? উত্তরে রাফিদ বলেছিল, থাইল্যান্ড থেকে দেশে আসার পর সে রাস্তায় একটা ঝামেলায় জড়ায় আর মারামারি লেগে যায়। এই মিথ্যে শুনে জিহাদ আর জেবার, উভয়েরই চোখ কপালে উঠে যায়। অহেতুক মিথ্যা বলার কোনো কারণ পায় না তারা। যদি সত্যি বলত যে জেহেরই এসব করেছে তাহলে অন্তত কিছুটা হলেও পুলিশি ব্যবস্থা নেয়া যেত। আর সেই কারণে জেবা আর জিহাদ রাফিদের কাছে এসেছিল কেন সে মিথ্যা বলেছিল জানতে। তবে এখানেও রাফিদ কথা ঘোরানোর চেষ্টা করছে। যেন সে ইচ্ছে করেই পুলিশকে সত্যিটা জানাতে চায় না।
রাফিদের পায়ে যন্ত্রণা চিলিক দিয়ে উঠছে। এখানে বসে থাকতে ভালো লাগছে না তার। তবুও বসে আছে বিরক্তি নিয়ে। এই জিহাদ ছেলেটাকে দেখলেই তার জেহেরের কথা মনে পড়ে যায়, মনে হয় জেহের নিজেই তার সামনে বসে আছে। তবে জেহের আর জিহাদের মধ্যের পার্থক্যও ভালোভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। জেহেরের বসার ধরণটা বেশ রাজকীয় স্টাইলে, হাঁটা চলা, বসা সবকিছুতেই আলাদা একধরনের অ্যাটিটিউড আছে যেটা সহজেই জেহেরকে জিহাদের থেকে আলাদা করে। আর জিহাদ ছটফটে স্বভাবের, একটু পরপরই অস্থির হয়ে ছটফটানি শুরু করে দেয় এমন। এমনিতেও সে জিহাদকে দেখতে পারে না কারণ জিহাদ ইনশিতাকে ভালোবাসে আর একবার মিসবিহেভও করেছিল। তাই যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে সে।
জিহাদ উঠে দাঁড়ায়। তার দেখাদেখি জেবাও দাঁড়ায়। জিহাদ রাফিদের সোফার দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে রাফিদকে উদ্দেশ্যে করে কটাক্ষ করে বলে,
-“ইউ নো হোয়াট? তোমার বুদ্ধিটা এখনো হাঁটুর নিচে। নাহলে ইনশিতাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মতো ফালতু ভাবনা মাথায়ও আনতে না। কমপ্লেন খাও। বুদ্ধি বাড়বে।”
বলেই দরজার দিকে এগোতে লাগল। এই কথাটি যেন রাফিদের আগুনে ছাই ঢালতে সক্ষম। রাফিদ নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে বাম হাতে সোফার পাশে থাকা ফুলদানি নিয়ে একদম জিহাদের পা বরাবর ছুঁড়ে মারল। পড়তে পড়তে দরজা ধরে বেঁচে গেল জিহাদ। আগুন গরম চোখে রাফিদের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গিয়ে কলার ধরল। অবস্থা বেগতিক দেখে জেবা জিহাদকে ছাড়াতে লাগল।
-“ওর অবস্থা এমনিতে ভালো না। তার উপর তুই আর ঝামেলা পাকাস না ভাই, প্লিজ।”
জিহাদ শুনলো না তার কথা। সে নিজেও রাফিদকে দু'চোখে দেখতে পারে না। জেহেরকে কিছু করতে না পারলেও রাফিদকে সে এক ঘুষিতেই কপাত করতে পারত। সেদিন যদি রাফিদ মাঝ রাস্তায় তাকে অজ্ঞান করে ইনশিতাকে নিয়ে চলে না যেত তাহলে হয়ত অন্য রকম জীবন গড়তে পারত। এই রাফিদই যত নষ্টের মূল। রাফিদকে শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছা মনের মধ্যে পুষলেও জেবার কারণে কিছু করতে পারেনি সে। একমাত্র জেবার জন্যই রাফিদ এখনো বেঁচে আছে, নইলে এতদিনে রাফিদের টিকিটারও কেউ খোঁজ পেত না।
জেবা বহুকষ্টে রাফিদকে জিহাদের থেকে ছাঁড়াল। জিহাদকে টেনে বের করিয়ে আনলো ঘর থেকে। তবে যাওয়ার আগে জোরে শব্দ করে দরজায় ধাক্কা মেরে গেল জিহাদ। রাফিদ তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে বলে,
-“আমার বুদ্ধি হাঁটুর নিচে? আর তোরা তো সব গোবর মাথায় নিয়ে চলিস। শালারা!”
একটুবাদে রাফিদের সামনে হঠাৎ জেবা এসে দাঁড়াল। রাফিদ ডান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল জেবার দিকে। জেবা আস্তে করে‘ভালো থাকবেন। টেক কেয়ার।’বলে চলে গেল।
রাফিদ ঠাঁয় বসে রইল। জেবাকে সে এই দু'সপ্তাহ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেছে। সে জানে না কেন এই মেয়েটি তার এতটা খেয়াল রাখছে। বেশিরভাগ সময়টাতেই জেবা রাফিদের কাছে থেকে তার খেয়াল রাখত। মাঝে মধ্যে রাতের বেলায় সে অনুভব করতো জেবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তাহলে কী জেবা তার প্রেমে পড়ল? কিন্তু সে তো ভালোবাসতে পারবে না কাউকে। একমাত্র ইনশিতাকেই ভালোবেসেছিল। আর এখনো বাসে। হোক সে এখন অন্য কারো। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো রাফিদের ভেতর থেকে।
.
.
ড্রয়িংরুমের সামনে বড় খোলা বারান্দায় পাতানো চেয়ারের এক হাতলে পা ছড়িয়ে আরেক হাতলে পিঠ হেলান দিয়ে বসে আছে ইনশিতা। হাতে মৃদু গরম কফির মগ। হালকা শীতের সন্ধ্যায় কফি খাওয়ার মজাটাই আলাদা। গায়ে পাতলা একটা শাল জড়ানো। কফিটির স্বাদ অন্যরকম। কারণ আজকের কফি অন্য একজন বানিয়েছে। এই দুই সপ্তাহ লাগিয়ে জেহেরকে সে কফি বানানো শিখিয়েছে কিনা।
জেহের খুব মনোযোগ দিয়ে রোজের কফি খাওয়াটাকে লক্ষ্য করছে। কফিটি কেমন হয়েছে সেটা এখনো পর্যন্ত বলেনি রোজ। উৎসুক মনটা রোজের মন্তব্যের জন্য চাতক পাখির মতো চেয়ে আছে।
জেহের ঢোক গিলছে বারবার। গলা শুকিয়ে আসছে। হাত পা ঝিমঝিম করে কাঁপছে। নাহ, কফির ভালো খারাপ মন্তব্যের জন্য নয়। রোজ ছোট্ট ছোট্ট চুমুক দিয়ে ঠোঁটটাকে কফির মগে ডুবাচ্ছে। আবার কখনো ঠোঁটটাকে চুমুর মতো ভঙ্গিমা করে কফিতে ফু দিচ্ছে। যেন কফিটাকে খুব যত্ন করে খেতে চাইছে সে। তা দেখে জেহের এখন মনে মনে চাইছে, সে কেন কফির মগটা হলো না? তাহলে রোজ তাকে কফির মগ ভেবে এভাবে ঠোঁট ছোঁয়াতো। এত সুন্দর করেও বুঝি কেউ কফি খায়? কফিটাও কী তার রোজের প্রেমে পড়ে গেল না কি? নাহলে এতক্ষণেও ঠান্ডা হচ্ছে না কেন? রোজের ঠোঁটের উষ্ণ বাতাস পেতে কফিটাও কী ইচ্ছে করে গরম হয়ে আছে? এক মুহুর্তের জন্য নির্জীব কফিটার উপর খুব রাগ হলো জেহেরের।
জেহের টান মেরে কফির মগটা রোজের মুখ থেকে সরিয়ে নিলো। রোজ চকিতে তাকাল জেহেরের দিকে। অবাক দৃষ্টি যেন জীবন্ত হয়ে বলছে,‘কফিটা কেন নিয়েছেন?’
জেহের কফির মগটা ছোট টেবিলের উপর রেখে বলে,
-“কেমন হয়েছে সেটা তো বললে না?”
ইনশিতা চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। এভাবে হুট করে মুখের সামনে থেকে কফি নিয়ে নেওয়াটাকে ভালো চোখে দেখছে না সে। ভালোই তো লাগছিল গরম গরম কফিটা। রাগমিশ্রিত গলায় চাপা স্বরে বলল,
-“সেটা বললেই পারতেন। কফির মগটা নিয়ে নিলেন কেন?”
জেহের থতমত খেয়ে বলল,
-“তুমি কফি খাওয়াতে এতটাই ব্যস্ত ছিলে যে কেমন হয়েছে সেটা বলতেই ভুলে গিয়েছ। তাই তোমার ধ্যান ভাঙালাম।”
-“ভালো হয়েছে কফিটা। এবার দিন তো, ঠান্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগবে না খেতে।”
ইনশিতা কফিটা নিতে গেল। তা দেখে জেহের এক চুমুকে কফিটা নিয়ে সাবাড় করে দিলো। ইনশিতা চরম রকমের বিরক্ত হলো। বলল,
-“এটা কী করলেন?”
জেহের মগটা টেবিলে রাখতে রাখতে গম্ভীর গলায় বলে,
-“দেখলে না? কফি খেলাম। শুনেছি, স্বামী স্ত্রী এক কাপে ভাগাভাগি করে খেলে নাকি ভালোবাসা বাড়ে। তাই ভালোবাসা বাড়াতে তোমার অর্ধেক খাওয়া কফিটা আমি খেয়ে নিলাম।”
বলে উঠে ভেতরে চলে গেল। তার কফিটা ভালো লাগছে না একটুও। দুনিয়ার চিনি দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে সে। তাও রোজের কথায়। রোজ চিনি ছাড়া কফি খাবে না। আর জেহের চিনি দেওয়া কফি দু'চোখেও দেখতে পারে না।
রাতের খাবার খাওয়ার সময় ইনশিতা কিছু একটা বলতে চাইছিল জেহেরকে। বেশ কয়েকবার ইতস্তত করে বলতে চেষ্টাও করেছিল। তবে জেহেরের গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারা দেখে কথাগুলো জড়িয়ে আসছে।
এই দুই সপ্তাহ এখানে রয়েছে। সময়টা ইনশিতার খারাপও কাটেনি, আবার ভালোও কাটেনি। দুটোর মাঝামাঝিতে লটকে আছে। প্রতিদিন সকালে জেহেরের সাথে উঠে জগিং করায় আলাদা এক আনন্দ রয়েছে। এই জঙ্গলের ছোট একটা পথেই তারা জগিংয়ে বের হয়। বেরোলে কারো দেখাও পায় না সে। কোনো মানুষের চিহ্ন নেই এলাকায়। তবুও দুজনে একসাথে পাশপাশি দৌড়াতে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে। হাঁপিয়ে গেলে যখন জেহের ইনশিতাকে কোলে করে নিয়ে আসে কিংবা যত্ন করে জুতোর ফিতে লাগিয়ে দেয় তখন নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে বেশি ভাগ্যবতী বলে মনে হয় ইনশিতার। তবুও মনের মধ্যে যেন কিছু একটা নেই, কিছু একটা নেই ভাব লেগে থাকে।
এই ঘরের চিলেকোঠার একটা বড় রুম আছে। ওখানে শত শত ইংরেজী বই। জেহের আগে এগুলো পড়ত। রোজের জন্য সে আলাদা করে রোজের পছন্দের বই এনে রেখেছে। সেখানে বেশিরভাগ গিয়ে বই পড়ে কাটায় ইনশিতা। তবে জেহের যতক্ষণ বাসায় থাকে অর্থাৎ সন্ধ্যা থেকে সকাল অবধি, ততক্ষণ জেহেরের সামনে সামনেই থাকতে হয় ইনশিতার। বারান্দায় গেলেও জেহেরকে নিয়ে যেতে হয়।
ইনশিতা জেহেরের কোলেই বসে। কারণ এটা জেহেরের আদেশ, খাওয়ার সময় তাকে জেহেরের কোলে বসতেই হবে, আর জেহের খাইয়ে দেয় তাকে। ইনশিতা শেষ পর্যন্ত বলেই দিলো,
-“জেহের, আসলে আমি একটু...”
-“হুম। তুমি একটু?”
-“আমি একটু কথা বলতে চাই সবার সাথে। মানে মা বাবার সাথে... ফোনে... কথা বলবো।”
জেহের কর্ণপাত করলো না ইনশিতার কথায়। খাবার ঢুকিয়ে দিলো ইনশিতার মুখে। ইনশিতা আবারও বলল,
-“প্লিজ, একটু তো কথা বলতে দিন।”
-“কী বলবে? কেমন আছে, কী করছে, খেয়েছে কিনা? এসবই তো? এসব বলে কোনো লাভ নেই। তাই কথা বলেও লাভ নেই। আর তোমার বাবা মা ভালোই আছে, আমি তাদের কোনো দিক দিয়ে কমতি রাখিনি।”
ভারী অবাক হয়ে ইনশিতা বলল,
-“আশ্চর্য! এই সামান্য কথাটুকুতেও অনেক ভালোবাসা আছে। এইটুকু তো বলতে দিন।”
জেহের শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। কন্ঠ শীতল করে বলল,
-“তোমার ভালোবাসা শুধুমাত্র আমার জন্যই। বিয়ের আগে তাদের ভালোবেসেছ, এখন সমস্তটা দিয়ে আমাকে ভালোবাসবে। তাদের কথা ভাবার দরকার নেই।”
-“ওনারা আমার মা বাবা। ওনাদের জন্য ভালোবাসা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থাকবে আমার। আপনার সামান্য ভালোবাসার জন্য আমার মা বাবার ভালোবাসাকে তো আমি হেলাফেলা করতে পারি না তাই না?”
জেহের খাওয়ার প্লেটটাকে উল্টে ফেলে দিলো। ইনশিতা চমকে গিয়ে উঠতে চাইলে জেহের টেনে ধরে বসিয়ে দেয়। আগুন ঝরানো চোখ নিয়ে বলে,
-“আমার ভালোবাসা সামান্য? কোনদিক দিয়ে সামান্য লেগেছে বলো? তোমার যা পছন্দ হয় সব করেছি, তাও সামান্য বলছো?”
ইনশিতা বোঝাতে চাইল জেহেরকে,
-“আমি সেটা বলিনি।”
-“সেটাই বলেছো তুমি।”
-“না, আমি শুধু বলেছি, সবকিছুর উর্ধ্বে বাবা মায়ের ভালোবাসা। শুধু সেটাই বুঝিয়েছি। ...”
-“আমার ভালোবাসাকে তার মানে নিচে দেখিয়েছো? আমি তোমার সবকিছুতে উপরে থাকতে চাই, ভালোবাসাতেও উপরে থাকব আমি। সব...”
ইনশিতা থেমে গেল। তারই ভুল হয়েছে ভালোবাসার কথাটা উঠানো। জেহের যে ছোট একটা বিষয় নিয়ে সীনক্রিয়েট করে ফেলতে পারে সেটা তার কল্পনার বাইরে ছিল। ভেবেছিল জেহের বুঝবে তার মনের অবস্থা। অথচ এই ভাবনাটাও তার বৃথা। এখন জেহেরকে শান্ত করবে কীভাবে? তবুও চেষ্টা চালালো,
-“আচ্ছা, আচ্ছা। এখন রাগ করিয়েন না। শুনুন, বাবা-মা...”
জেহের ইনশিতার গাল চেপে ধরে বলল,
-“বাবা মা, বাবা মা করবে না। আই হেট বাবা মা। কোনো বাবা মায়ের ভালোবাসাই ভালো না। সবাই স্বার্থপর, সবাই। সব সময় নিজের দিকটাই বুঝে সবাই। এইসব যা যা ভালোবাসা দেখায় সবটাই তাদের ছলনা। তাদের ভালোবাসা সবটা মিথ্যে।”
বলতে বলতে জেহেরের চোখ লাল হয়ে গেছে। ইনশিতা গালের ব্যথার দিকে নজর না দিয়ে অবাক চোখে দেখে জেহেরকে। জেহেরের লাল চোখে জমা হয়ে আছে বিন্দু বিন্দু জল। চোখে একরাশ ঘৃণা বাবা মায়ের জন্য। জেহেরের কথায় অভিমান আর ঘৃণা স্পষ্ট টের পেল ইনশিতা। বাবা মায়ের প্রতি জেহেরের এত ঘৃণার কারণ খুঁজে পেল না ইনশিতা। যেন জেহের কথাগুলো নিজ বাবা মা'কে উদ্দেশ্য করে বলছে।
জেহের ইনশিতাকে ছেড়ে উঠে চলে গেল। ইনশিতা ভাবতে লাগল, সামান্য একটা কথাকে কেন্দ্র করে জেহের কি না কি বলে ফেলল। ইনশিতার সিক্সথ সেন্স বলছে, জেহের কোনো না কোনো কারণে তার বাবা মায়ের উপর রেগে আছে। আর সেই কারণে পৃথিবীর কোনো বাবা মায়ের ভালোবাসাটাকেও মেনে নিতে পারছে না।
ইনশিতা রুমে জেহেরকে খুঁজে পেল না। অন্য রুমেও না পেয়ে সোজা ছাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। গিয়ে দেখল জেহের ছাদের রেলিংয়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। একটু অসাবধানতা হলেই জেহের সোজা নিচে পড়ে যাবে। ভয়ে ইনশিতার বুক কেঁপে উঠল। এখন জেহেরকে জোরে ডাকাও যাবে না, কিংবা কোনো কথাও বলা যাবে না। যদি হঠাৎ ডাকে চমকে গিয়ে পড়ে যায়! তবুও উপায় না পেয়ে মৃদুস্বরে জেহেরকে ডাকে। জেহের পেছন ফিরে দেখে রোজ হেঁটে আসছে তার দিকে। রোজকে দেখেও সে রেলিং থেকে নামে না।
ইনশিতা ছাদের লাইটের আলোয় খেয়াল করল জেহেরের চোখে এবার টলমল করছে পানি। চোখমুখ লাল হয়ে আছে। জেহের কী কান্না করেছে? জেহের হঠাৎ ইনশিতাকে কাছে টেনে বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে। জেহেরের শরীর কাঁপছে। ইনশিতা এক হাতে জেহেরের পিঠে দিয়ে আরেকহাতে জেহেরের মসৃণ চুলে হাত বুলায়। জেহের ধরা গলায় বলে,
-“কোনো মা বাবাই ভালো না রোজ। কেউ না। আমাকেও কেউ ভালোবাসে না।”
জেহেরের কথায় প্রচন্ড অভিমানের আভাস পাওয়া গেল। ইনশিতা আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল জেহেরকে।
-“কে বলেছে আপনাকে ভালোবাসে না? সবাই আপনাকে ভালোবাসে। আপনার ভাই, বোন, মা বাবা...”
জেহের বাচ্চাদের মতো রাগ ধরে বলে,
-“উহুম। বলেছি না, কেউ না। আমার কোনো মা নেই। কোনো বাবা নেই। সবাই পর। আমাকে যদি ভালোবাসতো তাহলে...”
এটুকু বলার পর থেমে যায় জেহের। ইনশিতা কৌতুহলী গলায় বলে,
-“তাহলে কী।”
জেহের নিরুত্তর। ইনশিতাকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আজ এমন ছোঁয়ায় ইনশিতা কোনো কামনার ইঙ্গিত পাচ্ছে না। বরং এমন ছোঁয়ায় তাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার ইচ্ছা পোষণ করছে। যেন ইনশিতাকে বলতে চাইছে কোথাও না যেতে। জেহেরের কাছে থেকে তাকে সবসময় সাপোর্ট করতে।
জেহের মাথা একটু তুলে মায়া ভরা কন্ঠে বলে,
-“তুমি আমাকে সবসময় ভালোবেসো। আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না। বাবা মা কাউকেই না তোমার লাগবে আর না আমার। আমরা দুজন দুজনের থাকবো আজীবন। তুমি আমাকে ভালোবাসো তো রোজ?”
জেহেরের প্রশ্নে চুপ হয়ে যায় ইনশিতা। জেহেরকে সে ভালোবাসে কী বাসে না সেটা নিজেই বুঝতে পারছে না। তবে এতদিনে জেহেরের মায়ায় পরে গেছে। মায়া আসলেই খারাপ জিনিস, একবার কারো মায়ায় পড়লে সেখান থেকে উঠে পড়া দায় হয়ে যায়। তবে এটুকু বুঝতে পারছে যে জেহেরকে ছেড়ে থাকতে পারবে না সে। মায়া ছাড়া আরেকটা কারণও আছে। তার মনে হচ্ছে জেহের কোনো একটা কারণে মনে মনে খুব কষ্টে আছে। তবে কাউকে বোঝাতে দিতে চায় না। নিজেকে বাহিরে স্ট্রং দেখালেও কষ্টটা ভেতর থেকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আর এই কষ্টটা ইনশিতার কাছে আসলেই হাওয়া হয়ে যায়। যেন ইনশিতাকে নিয়েই সব কষ্টের জয় করতে পারবে জেহের।
জেহের সবসময় নিজেকে সবার থেকে আলাদা রাখতে চায়, একা বাঁচতে চায়, আড়ালে রাখতে চায় নিজেকে। কারো সাহায্য চায় না পাশে। তবে রোজের কাছে আসলেই জেহেরের সবকিছু জুড়ে তার রোজ থাকে। তখন জেহেরের মনে হয়, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য তার রোজ পাশে থাকলেই যথেষ্ট। কোনো কষ্ট নেই দুনিয়াতে। কাউকে লাগবে না শুধুমাত্র রোজ ছাড়া। সকল আবদার, ভালোবাসা, অভিমান রোজেতে ঘিরে থাকবে।
-“কী হলো? বললে না, আমাকে ভালোবাসো কি না?”
ইনশিতা মুচকি হেসে বলে,
-“সেটা কোনো একদিন বলবো। তবে এটা জেনে রাখুন যে আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।”
-“তুমি না চাইলেও থাকতে হবে আমার সাথে।”
-“আচ্ছা, এখন নামুন এখান থেকে। ভয় করে না এখানে বসার? যদি পড়ে যেতেন?”
-“অভ্যেস আছে।”
-“অভ্যেস থাকলেও চলবে না। আর যেন কোনোদিন না দেখি। বুঝেছেন?”
ইনশিতা শাসনের সুরে কথাটা বলল। জেহের মিষ্টি করে হাসলো। কারো এমন শাসনের খুব প্রয়োজন ছিলো তার জীবনে। তার জীবনটা অগোছালো। সবাই হয়তো জেহেরকে দেখে বলবে পারফেক্ট জীবন কাটাচ্ছে। অথচ ভেতরে ভেতরে সে অগছালো। বড্ড অগোছালো। এই অগোছালো জীবনকে সাজিয়ে গুছিয়ে দেবার জন্য একজন এসেছে। তার রোজ।
.
.
.
চলবে.............................