প্রহেলিকা - পর্ব ২৬ - আশফি শেহরীন চিত্রা - ধারাবাহিক গল্প


ইনশিতার বাবা কাঁদছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে ইনশিতার মা'ও আঁচলে মুখ গুঁজে আছে। ইনশিতা নিজের কান্না সংবরণ করে হাসি মুখে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-“আমি কী একেবারের জন্য চলে গেছি না কি যে এভাবে মরা কান্না কাঁদছো? মা, প্লিজ, কান্না থামাও। অনেকদিন হয়েছে তোমার হাতের খাবার খাই না। যাও তো, তাড়াতাড়ি কিছু বানিয়ে নিয়ে এসো।”

ইনশিতার মা তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরে ছুটল। ইনশিতার বাবা বলল, 

-“জেহেরকে আনলি না কেন?”

ইনশিতা মিথ্যে বলল, 

-“জেহের অফিসে। আমাকে কলেজের সামনেই দিয়ে গেছে। ওনার অনেক কাজ তো তাই চাইলেও আসতে পারেননি।”

বাবা মায়ের সাথে দুপুরে খাবার খেয়ে বিদায় নিয়ে কলেজ গেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো ইনশিতা। নয়নিকা বলেছে গেটের সামনে দাঁড়াতে। আসার সময় ইনশিতা তার আগের ভাঙা মোবাইলটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। এটা লুকিয়ে রাখবে যাতে জেহের না দেখে। আর মাকেও বলেছে কোনো সমস্যা হলে এই নাম্বারেই যাতে কল করে। 

মাঝ রাস্তায় হঠাৎ করে দেখা হলো জেসমিন চৌধুরীর সাথে। উনি গাড়িতে ওঠার সাথে সাথেই ইনশিতাকে দেখেন আর দৌড়ে আসেন। ইনশিতা হকচকিয়ে গেলেও পরমুহুর্তে নিজেকে সামলে নেয়। সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করতে চাইল ইনশিতা। তবে তিনি দেখার সাথে সাথেই অস্থির হয়ে জেহেরের খোঁজ নেন। 

-“আমার জেহের কোথায়? এতদিন তোমরা কোথায় ছিলে?”

-“আসলে জেহেরের একটা বাগানবাড়ি আছে না? ওটাতেই এখন আমাকে নিয়ে থাকে।”

জেসমিন চৌধুরী মনে করতে লাগলেন জেহেরের কোনো বাগানবাড়ি আছে কি না! জেহের কোনোকিছুর তথ্য কখনোই কাউকে দিতে চায় না। তিনি প্রশ্ন ছুঁড়লেন ইনশিতাকে। 

-“কোন বাগানবাড়ি?”

-“ওনার নিজস্ব একটা বাগানবাড়ি আছে যেটা না কি সবার অজান্তে কিনেছিল।”

-“ওও... ইনশিতা!”

-“জি।”

-“তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার আছে। এতদিন তোমায় খুঁজেছিলাম অনেক, পাইনি। আজ সেই সুযোগ পেয়েছি।”

ইনশিতা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। জেসমিন চৌধুরী ইনশিতার হাত চেপে কাছে আনলেন। আকুল আবেদনের সুরে বললেন, 

-“মা, আমার ছেলেটাকে কখনো ছেড়ে যেও না। ওর তোমাকে বড্ড প্রয়োজন। ওর মনের সব কষ্ট দূর করতে একমাত্র তুমিই পারবে। আমি দেখেছি, তোমার মাঝেই আমার জেহেরের সুখ। তুমি ও'কে কখনোই দূরে ঠেলে দিও না।”

ইনশিতা কিছু না বলে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। থেমে থেমে বলল, 

-“আপনার ছেলে যে আমাকে আটকে রাখে সেটা কী কম কষ্টের? খাঁচায় বন্দী পাখির মতো অবস্থা আমার। আমার কষ্টটা কী জেহেরের কষ্ট থেকে খুবই কম?”

জেসমিন চৌধুরী কিছুক্ষণ ইনশিতার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ থাকলেন। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, 

-“আমি জানি তুমিও কষ্টে আছো। কিন্তু ইনশিতা, তুমি যদি একবার জেহেরের কষ্ট দূর করতে পারো, তাহলে তোমার আর এমন জীবনযাপন করতে হবে না, তুমি নিশ্চিত থাকো। ওর অস্বাভাবিকতাটাই সবচেয়ে বড় কষ্ট। ও'কে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনে তুমি নিজেও কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে আর আমার জেহেরও মুক্ত হতে পারবে। সেই ছোটবেলা থেকেই জেহেরের কষ্টের শুরু। সেই কষ্ট কেউ না দেখলেও আমি দেখি। আমি তোমাকে একটা সত্যি কথা বলতে চাই জেহের সম্পর্কে, যা শুনলে তুমি হয়তো চাইলেও আমার জেহেরকে দূরে রাখতে পারবে না।”

ইনশিতা উৎসুক হয়ে চেয়ে রইল। কী এমন সত্যি? জেসমিন চৌধুরী কথা শুরু করার আগে একবার আশপাশটা ভালো করে দেখে নিলেন। চাপা সুরে বললেন,

-“জেহের কোথায়? জেহের তো মনে হয় আশেপাশে কোথাও আছে। ও তো তোমাকে একা ছেড়ে দেবে না। কোথায় ও?”

ইনশিতা মাথা নিচু করে ফেলল। সে কী বলবে এখন? বলবে যে আপনার ছেলেকে আমি বেঁধে রেখে এসেছি? জেসমিন চৌধুরী কাঁধ ধরে ঝাঁকালেন ইনশিতার। 

-“বলো জেহের কোথায়?”

ইনশিতা অপরাধীর মতো মুখ করে মাথাটা একটু তুলে তাকাল জেসমিন চৌধুরীর দিকে। সেই মুখ দেখেই বোধহয় জেসমিন চৌধুরী বুঝে গেছেন ইনশিতা কিছু একটা করেছে। সন্দেহের দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, 

-“কী হলো? তুমি কিছু করোনি তো আমার জেহেরের সাথে?”

ইনশিতা দ্বিতীয়বারের মতো মাথা নিচু করে ফেলল। জেসমিন চৌধুরী শক্ত গলায় বললেন, 

-“কী করেছো তুমি জেহেরের সাথে।”

ইনশিতা মিনমিন করে বলে ফেলল। সব শুনে জেসমিন চৌধুরী বিস্ফোরিত নয়নে চোখ বড় বড় করে তাকায় ইনশিতার দিকে। 

-“কি! তুমি এটা করতে পারলে কীভাবে ইনশিতা? একবারও বুক কাঁপল না?”

ইনশিতা মিনমিনে গলায় বলল, 

-“আমার আর কিছু করার ছিল না মা। ওনার কাছে শত অনুরোধ করার পরও তিনি আসতে দিতে চায়নি। এদিকে আমার বাবার শরীরটাও ভালো না আমার খোঁজ না পেয়ে। তাই...”

-“তুমি তোমার পরিবারের সাথে দেখা করেছো?”

-“জি।”

-“কেমন আছেন তোমার বাবা?”

-“আপাতত সুস্থ।”

-“আচ্ছা। আর এক্ষুনি চলে যাও জেহেরের কাছে। আমি পারলে যেতাম জেহেরের কাছে, কিন্তু জেহের আমাকে কখনো সহ্য করতে পারবে না। তুমি যাও মা, এক্ষুনি ফিরে যাও জেহেরের কাছে।”

বলে জেসমিন চৌধুরী ঘুরে চোখ মুছলেন। ইনশিতার দৃষ্টি এড়ালো না সেই দৃশ্য। সে জেসমিন চৌধুরীর বাম হাত নিজের দু’হাতে চেপে ধরে বলল, 

-“আমাকে একটা কথা বলবেন মা?”

জেসমিন চৌধুরী ভ্রু জোড়া হালকা কুঁচকে তাকালেন। ইনশিতা বলল, 

-“জেহের কেন আপনাকে চোখের সামনে দেখতে পারে না? কেন আপনার আর বাবার সাথে এমনকি নিজের পুরো পরিবারের সাথে তিনি মিশেন না? কী এমন হয়েছে যার কারণে তিনি এমন ব্যবহার করছেন আপনাদের সাথে?”

জেসমিন চৌধুরী হাত ছাড়িয়ে ইনশিতার গালে রাখলেন। কান্না আটকিয়ে বললেন, 

-“সেই কথাটাই তো তোমাকে বলার প্রয়োজন মা। আর সেটা এখনি বলবো ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন আর সেই সময় নেই, তুমি চলে যাও জেহেরের কাছে। আমি আসছি।”

ইনশিতা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। জেসমিন চৌধুরী চলে যেতে গিয়েও ফিরে এলেন। শেষবারের মতো মিনতি করে বললেন, 

-“আমার ছেলেটার সুখের চাবি কিন্তু একমাত্র তুমি মা। কখনো আমার জেহেরকে কষ্ট দিও না। ও'কে খুব ভালোবেসো।”

জেসমিন চৌধুরী গাড়িতে উঠে গেলেন। ইনশিতা নির্বিকার ভঙ্গিতে চেয়ে দেখল জেসমিন চৌধুরীর চলে যাওয়া। তবে সে স্পষ্ট দেখতে পেল জেসমিন চৌধুরীর চোখে তার ছেলেকে ভালো রাখার আকুলতা। 

.

.

কলেজ গেটের সামনে আসতেই নয়নিকাকে দেখা গেল। একটা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ভেতরের মানুষকে দেখা গেল না। ইনশিতাকে দেখতে পেয়ে নয়নিকা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। ইনশিতা জেসমিন চৌধুরীর সাথে দেখা হওয়াটা চেপে গেল নয়নিকার কাছে। দুজন দুজনের খবরাখবর নিয়ে হাঁটতে লাগল ফুটপাথে। 

-“ইতু।”

-“হু!”

-“তোর কি মনে হয় না জেহের তোর পুরো অস্তিত্বে নিজের মালিকানা খাটাতে চাইছে?”

ইনশিতা উদাসী গলায় জবাব দিলো,
-“সে তো আমাকে দেখার পর থেকেই খাটাচ্ছে।”

নয়নিকা দাঁড়িয়ে পড়ল। ইনশিতার কনুই ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল, 

-“জেহের তোকে সত্যিকারের ভালোবাসে না ইতু।”

-“আমারও প্রথমে তাই মনে হয়েছিল নয়ন। কিন্তু ওনার সাথে থাকতে থাকতে বুঝে গিয়েছি উনি সত্যি আমাকে ভালোবাসে। ওনার মায়াতে আমি জড়িয়ে গেছি।”

-“ওটা ভালোবাসা না। ওটা পাগলামি, অসুস্থ ভালোবাসা। তুই কেন বুঝতে চাইছিস না? জেহের চায় তোকে নিজের হাতের পুতুল বানিয়ে নাচাতে। উঠতে বললে উঠবি, বসতে বললে বসবি। তোর সত্তার উপর নিজে রাজ করতে চায়। জেহের যদি এক'কে দুই বলে তাহলে তোকেও সেটা বলতে হবে। ও যদি তোকে সত্যি ভালোবাসতো তাহলে তো তোর ইচ্ছা অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দিতো, তাই না? তা না করে তোকে নিজের মন মতো চালাচ্ছে। এই যে তুই কলেজ আসতে চাইলি, বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে চাইলি, তোকে কি জেহের আসতে দিয়েছিল? দেয়নি তো? তাহলে কোন হিসেবে ও তোকে সত্যিকারের ভালোবাসে? আর জেহের তোকে কারো সাথে মিশতে দিতে চায় না, কারো সাথে হাসতে খেলতে দিতে চায় না, তুই কারো সাথে কথা বলিস, হাসিস, এসব জেহের কোনোভাবেই চায় না। এটা কীভাবে ভালোবাসার লক্ষণ হয়? ও চায় তুই পুরো দুনিয়া ভুলে গিয়ে ওর সাথে থাক। দেখ ইতু, তুই একটা ভুলের মাঝে আছিস। সময় আছে, বের হয়ে আয়।”

ইনশিতা অসহায় চোখে তাকাল নয়নিকার দিকে। মিনমিনে আওয়াজে বলল, 

-“উনি যে অনেক বড় কষ্টে আছেন নয়ন। আমাকেই সেই কষ্ট হতে ওনাকে বের করতে হবে। আমি কখনোই পারবো না ওনাকে ছেড়ে যেতে।”

-“কিরে! কী বলছিস? বুঝতে পারছি না।”

-“কিছু না।”

-“আচ্ছা, চল তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাই।”

-“আমি যেতে পারব না নয়ন। জেহেরকে একা রেখে এসেছি।”

-“তো উনি কি বাবু না কি যে একা থাকতে পারবে না?

-“সেটা না, আমি ওনাকে ঘুমের মাঝেই বেঁধে রেখে এসেছি।”

নয়নিকা কয়েক মুহুর্ত অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল ইনশিতার দিকে। পরমুহুর্তেই ইনশিতার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল,

-“ব্র্যাভো! এই না হলে ইতু! ভালোই করেছিস। এখন চল।”

ইনশিতা দাঁড়িয়ে পড়ল। কাট কাট গলায় বলল, 

-“আমি ভুল করেছি ওনাকে বেঁধে। অনেক বড় ভুল। এটা করা উচিৎ হয়নি আমার। আমি যাচ্ছি জেহেরের কাছে।”

ইনশিতা উল্টো পথে হাঁটা ধরলে নয়নিকা সামনে এসে দাঁড়ায়। কঠিন গলায় বলে, 

-“তুই কোথাও যাবি না ইতু। আর জেহেরের কাছে তো কোনোদিনও নয়। পাগলের কাছে গিয়ে নিজে সেধে পাগল হওয়ার দরকার কী? চল...”

নয়নিকা একপ্রকার জোর করে টেনে নিতে থাকল। ইন‌শিতা মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। সেই সিদ্ধান্ত নয়নিকাকে জানানোর সময় এসেছে। সে নয়নিকার হাত ধরে থামিয়ে দিলো। নয়নিকা বিরক্ত নিয়ে তাকাল। ইনশিতা তোয়াক্কা না করে বলতে আরম্ভ করল, 

-“আমি জেহেরকে ভালোবাসি নয়ন। উনি যেমনই হোক না কেন, আমি ভালোবেসে ফেলেছি। এতদিন বুঝতে না পারলেও কিছুক্ষণ আগে টের পেয়েছি সেটা।”

নয়নিকা চোখ গোল গোল করে বলল, 

-“ইতু, তুই নিজেও পাগল হয়ে গিয়েছিস। তুই না বলেছিলি তুই মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিস? এটা সেই মায়া। মায়া আর ভালোবাসা এক না। কয়েকদিন যাক। মায়া কেটে যাবে।”

ইনশিতা দৃঢ় গলায় বলল, 

-“আমার কাছেও মায়া মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না, এটা মায়া না, এটা ভালোবাসা। আমি জেহেরকে ছেড়ে থাকতে পারব না কোনোদিন। আমি জানি না কখন কীভাবে ভালোবেসে ফেললাম। শুধু এটুকুই জানি জেহেরকে আমি ভালোবাসি।”

-“জেহের যে মানসিকভাবে অসুস্থ সেটা নিশ্চয় ভুলে যাসনি?”

-“কেউ অসুস্থ হলে তাকে আগে সুস্থ করা প্রয়োজন। তাই জেহেরকে মানসিকভাবে সুস্থ করা দরকার। আর সেই সুস্থতার দায়িত্ব আমার কাঁধে কারণ আমি তার স্ত্রী। একবার অসুস্থতার উৎসটা জানতে দে আমায়, ইন শা আল্লাহ আমি ওনাকে সুস্থ করার চেষ্টা করব।”

ওদের দুজনের কথোপকথনের মাঝেই একটা গাড়ি চলে আসলো। এটা সেই গাড়িই যেটার সামনে নয়নিকাকে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখেছিল ইনশিতা। দুজনে গাড়িটার দিকে তাকালে দরজা খুলে বের হয়ে আসলো জেবা।

-“কেমন আছো ইতু?”

-“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি?”

জেবা মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বলল, 

-“আমিও।”

কথা সেরেই জেবা ইনশিতাকে গাড়ির মধ্যে আসতে বলল। ইনশিতা না জানালে জেবা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো নয়নিকার দিকে। নয়নিকা তৎক্ষণাৎ বলল, 

-“ইতু না কি তোমার ভাই জেহেরকে ভালোবেসে ফেলেছে। আর সে না কি কোনোদিন জেহেরকে ছাড়তে পারবে না।”

এটা শুনে জেবা শান্ত দৃষ্টিতে একবার তাকায় ইনশিতার দিকে। তারপরই গাড়িতে ঢুকে যায়। নয়নিকাকে ইশারা করে ইনশিতাকে ভেতরে ঢোকাতে। নয়নিকাও ইনশিতাকে জোর করতে লাগল। 

-“চল না একটু।”

ইনশিতা বারবার করে বলতে লাগল, 

-“তুই বুঝতে পারছিস না নয়ন। আমার এখন যেতে হবে। জেহের অনেক রেগে আছে বোধহয়। ছাড় তুই আমায়।”

এক পর্যায়ে নয়নিকা ইনশিতাকে বলল, 

-“আচ্ছা, ঠিকাছে। তুই যাস। গাড়িতে ওঠ। গাড়ি করেই না হয় তোকে দিয়ে আসা হবে। এতে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারবি। ওঠ যা।”

ইনশিতা কয়েক মুহুর্ত ভেবে গাড়ির ব্যাক সিটে উঠে বসল। পাশে নয়নিকাও বসল। গাড়ি চলতে আরম্ভ করলে ইনশিতা ড্রাইভারের সিটে জিহাদকে দেখে চমকে গেল। জিহাদ তার দিকেই তাকিয়ে আছে মুখভর্তি হাসি নিয়ে। ইনশিতা পাশে বসা নয়নিকাকে জিজ্ঞেস করলে প্রত্যুত্তরে চুপ থাকে নয়নিকা। ইনশিতার ভালো লাগছে না কিছু। তার মন বলছে তাদের সকলের মধ্যে ঘাপলা আছে। জিহাদের হাসিটাও তার গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। ইনশিতা জেবাকে বলল,

-“জেবা, গাড়ি থামাতে বলো। আমি একা যেতে পারব।”

জেবা মাথা হালকা ঘুরিয়ে বলল, 
-“একা একা যাওয়ার দরকার নেই, আমরা আছি তো। পৌঁছে দিয়ে আসবো।”

নয়নিকা ইনশিতার হাত চেপে ধরে চাপা কন্ঠে ধমকে বলল, 
-“নাটক করিস না তো। যখন বলেছে পৌঁছে দিবে তার মানে দিবে। চুপ থাক।”

ইনশিতার হাত পা অকারণেই কাঁপতে লাগল। বারবার চাইছে যাতে তাকে নামিয়ে দেওয়া হোক এখানে। জানালা খুলে খানিকটা দম ছাড়লো ইনশিতা। ইনশিতা মোবাইলে দেখে নিলো এখন সাড়ে চারটা বাজে। যেতে যেতে তো এক দেড় ঘন্টা লেগে যাবে। আর জেহের তো এখনও দুপুরের খাবার খায়নি। আর খাবেই বা কীভাবে, ও তো বেঁধে দিয়ে এসেছে। ভাবতেই ইনশিতার মনে কষ্টরা ভীড় জমাতে লাগল।

অনেকক্ষণ গাড়ি ছুটছে। অথচ রাস্তাটা ভিন্ন। ইনশিতা জিজ্ঞেস করলে জেবা বলে যে এটা শর্টকাট রাস্তা। এখান দিয়ে তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে। ইনশিতার এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো, সে তো ঠিকানা বলেনি। আর ওরাও তো জানতে চায়নি। পরেই আবার মনে হলো, ওরা হয়তো জানে জেহেরের বাগানবাড়ির ঠিকানা। 

.
সন্ধ্যা নেমে এসেছে প্রায়। আর কিছুক্ষণ পরই মাগরিবের আজান পড়বে। তখনই গাড়িটা থামে রাস্তার সাইডে। ইনশিতা ভ্রূ কুঁচকে তাকাল সবার দিকে। এই জায়গাটা অচেনা তার কাছে। আর মানুষজন বলতে গেলে খুবই কম। চারপাশে কয়েকটা বড় বড় বিল্ডিং। সকলেই নেমে গেল গাড়ি থেকেই। জিহাদ গিয়ে ইনশিতার পাশের দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দিলো। ইনশিতা দেখল জিহাদের মুখটা হাসি হাসি। একবার হাতের দিকে তাকিয়ে ইনশিতা পাশ কাটিয়ে নেমে গেল। জিহাদ কিছুটা অপমানিত হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে ইনশিতার হাত ধরল। রাগে ইনশিতা জিহাদকে ধাক্কা মেরে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, 

-“সমস্যাটা কী আপনার? হাত ধরছেন কেন? অনুমতি ছাড়া নিজের ভাইয়ের বউয়ের হাত ধরতে লজ্জা করে না? নির্লজ্জ বেহায়া কোথাকার।”

জিহাদ রেগে গিয়ে ইনশিতার দিকে এগিয়ে যেতে নিলে জেবা ইশারায় থামতে বলে। নয়নিকা ইনশিতাকে চোখ রাঙিয়ে বলে,

-“বেশি বেশি করছিস তুই। সামান্য হাত-ই তো ধরেছে। এতে এত রেগে যাওয়ার কী আছে?”

ইনশিতা চেঁচিয়েই বলতে থাকল, 

-“রেগে যাব না তো কী পা ধরে সালাম করবো? এনাকে আমার যাস্ট সহ্য হয় না। উনি অনুমতি ছাড়া আমার হাত ধরার সাহস পায় কীভাবে?”

জেবা দেখল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাচ্ছে। রাস্তার কিছু মানুষ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। ইনশিতাকে আরও বেশি রাগালে তাদের কাজের কাজ কিছুই হবে না। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল, 

-“আচ্ছা, জিহাদ ভুল করেছে, ক্ষমা করে দেও। ও ভুলে এমন করেছে। এখন চলো আমাদের সাথে।”

ইনশিতার রাগ কমছে না। একে তো সে জেহেরকে বাঁধায় মনের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছে, তার উপর জিহাদের হাত ধরা আর অচেনা জায়গায় নিয়ে আসা। বেঁধে রাখা রাগের লাগাম ছুটে গেল তার। তর্জনী উঁচিয়ে চিল্লিয়ে উঠল সে, 

-“কোথায় নিয়ে এসেছ তোমরা আমায়? কোত্থাও যাবো না তোমাদের সাথে। তোমরা নিশ্চয়ই কোনো প্ল্যান করে এনেছ আমায়, তাই না? এতক্ষণে বুঝেছি আমি। আমি-আমি চলে যাব জেহেরের কাছে, এক্ষুনি।”

ইনশিতা চলে যেতে নিলে জিহাদ সামনে এসে দাঁড়ায়। ইনশিতার দু’হাত নিজের একহাতে, আরেকহাতে ইনশিতার গাল চেপে ধরে বলে, 

-“এই মুখটায় সারাদিন জেহের নাম লেগে থাকে কেন? যে এত কষ্ট দেয় তার কাছে আবার ফিরে যেতে লজ্জা করে না তোর? কী এমন করল জেহের যে তার কাছেই বারবার ছুটে যাস তুই? খুব আদর করে জেহের? এমন আদর যে অন্য কারো দিকে ফিরে তাকাতেও মন চায় না? আমিও আদর করবো তোমায়। জেহেরের থেকেও শতগুণ বেশি আদর করবো। তখন তোমার সারা শরীরে...”

জিহাদের মুখের ভাষা ক্রমশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যা শুনে ইনশিতার গা গুলানো শুরু করল। সে চিৎকার করে বলল, 

-“চুপ করুন আপনি। অসভ্য কোথাকার। ভাইয়ের বউকে এসব বলতে লজ্জা করে না?”

জিহাদ অট্টহাসি হেসে বলল, 

-“ভাইয়ের বউ? সিরিয়াসলি? তুমি নিজেকে জেহেরের বউ দাবি করলেও কেউই মানে না তোমাদের।”

-“কারো মানা না মানায় আমার কিছু যায় আসে না। জেহের আর আমি মানলেই চলবে। ছাড়ুন আমায় বেয়াদব কোথাকার। ছাড়ুন বলছি।”

-“একবার যখন পেয়েছি তখন আর ছাড়ি কীভাবে? আগে তো নিজের করে নিই। তারপর ছাড়াছাড়ির কথা উঠবে।”

কথাটা বলে জিহাদ খুব বিশ্রী হাসি হাসল। ইনশিতা নিজেকে ছাড়াতে চাইলে জিহাদ আরও শক্ত করে ধরে। ইনশিতা কয়েকবার চেষ্টা করল জিহাদের মেইন পয়েন্টে হাঁটু দিয়ে লাথি মারার। তবে ব্যর্থ হলো। জিহাদ পা দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে ইনশিতার পা। তিন চারজন মানুষ এগিয়ে আসতে লাগলে ইনশিতা সাহস পায়। সকলের কাছে সাহায্যের জন্য বলে। দুয়েকজন জিহাদকে ধরতে এলে জেবা গিয়ে পুলিশের ভয় দেখায়। সকলকেই পুলিশের ভয় দেখিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। 

ইনশিতা কনুই দিয়ে কয়েকবার জিহাদের বুকে আঘাত দিয়েছে। তাতে ব্যথা পেয়ে হাত আলগা করলেও ছাড়েনি ইনশিতাকে। জিহাদ ইনশিতাকে চেপে ধরে সামনের সুউচ্চ বিল্ডিংয়ের দিকে এগোতে লাগে। তবে ইনশিতার এত লাফঝাপে এগিয়ে নিতে পারছে না। ইনশিতা এবার কামড়ে দিলো জিহাদের হাতে। জিহাদ আর ধরে রাখতে পারছে না ইনশিতাকে। ইশারায় ওদেরকে ডাকে। নয়নিকা আর জেবাও এগিয়ে এসে শক্ত করে ইনশিতাকে চেপে ধরে। ইনশিতার খুব কান্না পাচ্ছে। এতটা অসহায় তার কোনোদিন লাগেনি। নয়নিকার দিকে করুণ চোখে তাকালেও নয়নিকা অগ্রাহ্য করে সে দৃষ্টি। 

ইনশিতার এবার সকলকেই নিজের শত্রু মনে হতে লাগে। জেবার গলার কাছে আর নয়নিকার হাতে কনুই দিয়ে আঘাত করেও ছাড়া পায় না সে। কান্না করে দিলো ইনশিতা। তবে কেউ পরোয়া করলো না। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে তার। সবকিছু ঝাপসা ঝাপসা লাগছে। তিনজনের সাথে না পেরে শরীরের শক্তিও ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। নিজের কাছের মানুষকে শত্রু রূপে দেখতে পেয়ে মনের জোরটাও চলে গেছে। হাত পা অবশ হয়ে আসে ইনশিতার। তবুও বৃথা চেষ্টা করতে থাকে ছাড়া পাওয়ার। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে নিজেও জানে না। সকলে মিলে জোরাজুরি করে ইনশিতাকে নিয়ে লিফটের মধ্যে ঢুকে গেল। ইনশিতার চোখের অশ্রু আর আর্তনাদ কারো মন গলাতে পারল না।
.
.
.
চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন