হাসপাতালের করিডোরে ইনশিতা পায়চারি করছে। ইতিমধ্যে ভোর হয়ে গেছে। পুরো রাতটা সে নির্ঘুম কাটিয়েছে। জেহেরের চিন্তায় তার মস্তিষ্ক যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। বাহিরে বৃষ্টি থেমে গেছে। বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় বোধহয় শীতটা আরো ভালো করে জেঁকে বসেছে। তার মা কেবিনের ভেতরে বাবার পাশে বসে আছে। বাবার অবস্থা এখন মোটামোটি। বুকের মধ্যে জোরে চাপ পড়ায় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে শুধু। একটু বাদেই ইনশিতার পেছনে এসে দাঁড়াল রাফিদ। গলা খাঁকারি দিলে ইনশিতা পেছনে তাকায়। তার চোখে টলমল করছে পানি। রাফিদ এই মুহুর্তে কী বলবে বুঝতে পারল না। তবুও কিছু তো একটা বলতে হবে।
-“তুমি বাসায় চলো ইতু। এসেই তো এখানে এসে পড়লে। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। আর চেঞ্জ করেও আসো।”
ইনশিতা বলতে চাইল সে কোথাও যাবে না। কিন্তু এই পোশাকেও থাকতে পারছে না। তাই মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। ইনশিতা চলে যেতে চাইলে রাফিদ আটকায়। ইনশিতা জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে রাফিদ আমতা আমতা করে বলে,
-“আ-আব, তুমি কিছু মনে না করলে আমিও চলি তোমার সাথে?”
ইনশিতা তাও কিছু বলল না। নিরবে সম্মতি দিলো। সম্মতি পেয়ে রাফিদ খুশিমনে ইনশিতাকে নিয়ে বাড়ির পথে চলল।
ঘরে ঢুকে ইনশিতা ড্রয়িংরুমের আলো না জ্বালিয়েই তার রুমে ফ্রেশ হতে চলে গেল। একটা অফ হোয়াইট কালারের থ্রি পিস নিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকল। চোখে মুখে পানি দিয়ে ছোট আয়নাটার দিকে তাকাল। তার চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। মুখটা দেখতেও কেমন বিদঘুটে লাগছে। চোখ বন্ধ করে লম্বা কয়েকটা শ্বাস নিলো সে। জেহেরকে তারা ধরে নিয়ে কি করেছে? মারেনি তো? পুলিশের মাইর তো সেই লেভেলের। নাহ, সে এখন জেহেরের চিন্তা করে নিজের শরীর খারাপ করবে না। একজন খুনির চিন্তা করবে কেন সে?
ফ্রেশ হয়ে গিয়ে সোজা রান্নাঘরে চলে গেল ইনশিতা। মায়ের জন্য খাবার বানিয়ে নিতে হবে। বাবার চিন্তায় মা পানি ছাড়া কিছুই মুখে দেয়নি। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দেখল রাফিদ হাতে কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত মুখে তা মনোযোগ সহকারে দেখছে। টিফিন বাক্স হাতে নিয়েই সে রাফিদের পাশে দাঁড়াল। কপাল কুঁচকে বলল,
-“কী হয়েছে ভাইয়া? কী এমন দেখছো?”
রাফিদ চমকে উঠল ইনশিতার হঠাৎ বলা কথায়। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
-“এই দেখো না ইতু, সোফার কাছে এই ঘড়িটা পেলাম। বেশ দামী ঘড়িই মনে হচ্ছে। এমন ঘড়ি তো তোমার বাবা পরে না।”
রাফিদ হাত মেলে ঘড়িটা দেখাল। ইনশিতা নিজের হাতে নিয়ে নিলো ঘড়িটা। ঘড়িটা দেখেই তার ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে এলো। এমন ঘড়ি সে কোথাও দেখেছে। কিন্তু মনে করতে পারছে না। তার মাঝেই রাফিদ বলে উঠল,
-“জেহেরের হবে হয়তো। জেহের যখন তোমার বাবাকে মেরেছিল তখন বোধহয় খুলে পড়ে গেছে।”
রাফিদের কথায় ইনশিতা না সূচক মাথা নাড়াল।
-“জেহেরের ঘড়ি এমন না। তার ঘড়ি সবসময় কালো কালারের হয়...”
ইনশিতার যেন মুহূর্তেই কিছু মনে পড়ল। সে চোখ বড় বড় করে তাকাল রাফিদের দিকে।
-“কী হলো? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
ইনশিতা থেমে থেমে বলল,
-“এই ঘড়িটা তো...”
-“হ্যাঁ, ঘড়িটা তো কী?”
ইনশিতা হার্টবিট ক্রমশ বাড়তে লাগল। সে জানতোই বড় একটা ভুল হচ্ছে। আর সেই ভুলটা এখন তার চোখের সামনে। এই ঘড়িটা সেদিন জিহাদের হাতে দেখছিল। তার মানে জিহাদ তার বাবাকে মেরে জেহেরকে ফাঁসিয়ে গিয়েছে? রাফিদ ইনশিতার কাঁধে ধাক্কা দিলো।
-“এমন থম মেরে আছো কেন?”
-“ভাইয়া, এটা জিহাদের ঘড়ি।”
-“কীহ!”
-“হ্যাঁ ভাইয়া, জিহাদের হাতে সেদিন দেখেছিলাম এটা। আমার স্পষ্ট মনে আছে। তার মানে এসব জিহাদের প্ল্যান ছিল ভাইয়া। ও জেহেরকে ফাঁসানোর জন্য এ-এমন করেছে।”
ইনশিতার চোখে কান্নারা জমে এলো। কান্নার বাঁধ ভেঙে গেল তার। রাফিদ বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল।
-“তাহলে তোমার মা যে বলেছিল জেহের ছিল। আর চোখ তো নীল ছিল। এমনকি পোশাকটাও নাকি তোমার বলা কথা মতো ছিল।”
-“লেন্স বলেও একটা জিনিস আছে ভাইয়া। আর জিহাদ হয়তো জেহেরের ড্রেসকোড ফলো করে একই ড্রেস পরেছে যাতে সবাই মনে করে ওটা জেহের।”
একটু থেমে ইনশিতা বলল,
-“আমি এক্ষুনি জেহেরের কাছে যাবো ভাইয়া। আমাকে নিয়ে চলো জেহেরের কাছে।”
রাফিদের বিস্ময় যেন কাটছেই না। জিহাদ যে এতবড় খেলোয়ার হবে সেটা তার ভাবনার বাইরে ছিল।
-“কী হলো ভাইয়া? চলো না।”
বিস্ময় কাটিয়ে প্রশ্ন করল সে,
-“জেহের কোথায় আছে সেটা এখন জানবে কীভাবে? পুলিশ স্টেশনটা চিনো?”
-“না, আমি তো কিছুই জানি না।”
-“তাহলে?”
ইনশিতা মাথায় হাত দিলো। এই মুহূর্তটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য মুহূর্ত বলে মনে হলো তার কাছে। টেনশনে তার মাথা ধরে গেছে। পরক্ষণেই বলল,
-“জেহেরকে ফোন দেই?”
-“পুলিশ যদি ফোন নিয়ে নেয়?”
-“যদি না নিয়ে থাকে? একবার তো ফোন দিয়েই দেখি।”
-“আচ্ছা।”
-“তোমার ফোনটা দাও। আমারটা জঙ্গলে হারিয়ে গেছে।”
রাফিদ ফোন বের করতে দেরি ইনশিতার টান দিতে দেরি নেই। তিনবার ফোন করার পরেও নো রেসপন্স। রাগে মোবাইলটা আছড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করল। ডুকরে কেঁদে উঠল ইনশিতা। একটু বাদেই জেহেরের নাম্বার থেকে কল আসলো। চোখ মুছে ফোনটা রিসিভ করে কিছু বলবে তার আগেই ওপাশ থেকে জেহেরের জড়ানো কন্ঠ শুনতে পেল,
-“ডোন্ট ক্রাই রোজ।”
ইনশিতা অবাক হলো। জেহের কীভাবে জানলো যে সে কাঁদছে? আর ফোনটা যে সে-ই তুলবে সেটাই বা কীভাবে জানলো? বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করল। ভেজা গলায় বলল,
-“আপনি...”
-“কী করে জানলাম তাই তো? ওহ রোজ, তোমার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস আমার জানা। চাইল্ডিশ কথা বলো না তো।”
-“আপনি কোথায় এখন?”
-“কোথায় আবার! বাসায়। কেন? জেলে থাকার কথা ছিল নাকি? যদি সেটা মনে করে থাকো তাহলে শুনে রাখো, এসব পুলিশ-জেল আমার কিছুই করতে পারবে না। টাকার কাছে সবই তুচ্ছ। তুমি তাড়াতাড়ি এসো তো।”
-“আপনি সত্যি এখন বাসায়?”
জেহের সেই কথার জবাব না দিয়ে কেমন অন্যরকম গলায় বলল,
-“আই ওয়ানা সি ইউ রাইট নাও। চলে এসো প্লিজ। আ-আমার ভালো লাগছে না তোমাকে ছাড়া।”
জেহেরের কন্ঠটা কেমন জড়িয়ে আসছে। যেন যুদ্ধ করে সে এখন ক্লান্ত। ইনশিতা আর কিছু বলবে সেই মুহূর্তে ওপাশ থেকে কিছু একটার বিকট আওয়াজ শোনা গেল।
-“হ্যালো, জেহের। হ্যালো!”
বেশ কিছুক্ষণ হ্যালো বলার পরে হুট করেই ফোন কেটে গেল। ইনশিতা ফোন সরিয়ে দ্রুত বেরিয়ে আসতে নিলো। রাফিদ পেছন থেকে আসতে আসতে বলল,
-“কোথায় যাচ্ছ এখন?”
ইনশিতা পেছন না ফিরেই উত্তর দিলো,
-“হাসপাতালে, আগে এগুলো হাসপাতালে দিয়ে আসি। মা এখনো কিচ্ছু খায়নি। তারপর জেহেরের কাছে যেতে হবে।”
রাফিদ ইনশিতার হাত থেকে টিফিন বাক্স নিলো। চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলে।
-“তুমি এত প্যানিক হচ্ছো কেন? শান্ত হও। তুমি যাও জেহেরের কাছে, আমি খাবার দিয়েই আসছি। মা আছে ওখানে।”
ইনশিতা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকাল রাফিদের দিকে। রাফিদ মুচকি হাসল শুধু। দেরি না করে ইনশিতা চলল বাগানবাড়ির উদ্দেশ্যে।
আকাশ মেঘলা। পুঞ্জ পুঞ্জ কালো মেঘ ছড়িয়ে আছে আকাশের মধ্যিখানে। তবুও চারপাশটায় কেমন গুমোট ভাব। ইনশিতার বুকের ভেতরটায় দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে। অপরাধবোধে ভেতরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে তার। এসব কিছুই জেহের করেনি। তাহলে সে কেন জেহেরকে দোষী করেছিল? সব ছিল জিহাদের প্ল্যান। ছিঃ! গতকাল জেহেরকে সে কতই না খারাপ খারাপ কথা বলেছে। অথচ জেহের তার বিপরীতে কিছু না বলে শুধু তাকে বোঝাতে চেয়েছিল। সে যদি একবার জেহেরের কথা মন দিয়ে শুনতো!
দশটা বাজে সে বাগানবাড়িতে পৌঁছাল। মনে তার প্রচন্ড ঝড়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এমনিতে জঙ্গলের মধ্যে তার উপর কুয়াশার আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত পুরো পরিবেশ। ঘরটা দেখতে যেন আগের দিনকার চেয়েও ভয়ানক লাগছে। যেন পুরো ঘরটার দেয়ালে আতঙ্কের ছাপ। মেইন দরজা খোলা। ভেতরটা প্রচুর অন্ধকার। ঢোক গিলে ক্ষীণ কন্ঠে সে জেহেরকে ডাকল। কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। আবার ডাকল। নাহ! কোনো সাড়া নেই। রুমের কোথাও নেই, ড্রয়িংরুম, ব্যালকনিতেও নেই। তার মানে কী জেহের এখনো জেলেই? খট করে কিছু একটার শব্দ এলো। থমকে দাঁড়ায় ইনশিতা। আওয়াজটা চিলেকোঠা থেকে আসছে। ঐ তো আবারও আসছে আওয়াজটা।
ইনশিতা পা টিপে টিপে সেদিকে গেল। রুমের দরজা ভেজানো। একটু ফাঁক করে যা দেখল তাতে তার পুরো শরীর কেঁপে উঠল ভয়ে। অবাক বিস্ময়ে তার মস্তিষ্ক চলাচল বন্ধ করে দিলো। ধাম করে সে দরজাটা খুলে দৌড়ে ভেতরে গেল। জেহের পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্থায়। মুখ থেকে গড়গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। জেহেরের মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে ডাকতে লাগল।
-“জেহের! এই জেহের? কী হলো আপনার? জেহের?”
জেহের চেতনাহীন। চোখ দুটোও খুলছে না। মৃদু শ্বাস উঠানামা করছে। ইনশিতার আত্মা শুকিয়ে আসলো। কীভাবে কী করবে সে এখন? পানি খুঁজতে আশেপাশে তাকাতেই তার চোখ কপালে। ডেস্কের উপর বসে পা দোলাতে দোলাতে সিগারেট ফুঁকছে জিহাদ। চোখদুটো টকটকে লাল। পরিহিত টিশার্ট বুকের দিক দিয়ে ছেঁড়া। একহাতে চেয়ারের ভাঙা শক্ত হাতল। অস্ফুটে ইনশিতার মুখ থেকে জিহাদের নাম বেরিয়ে আসলো। জিহাদ তাকাল ইনশিতার দিকে। সেই তাকানো দেখে ইনশিতার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। তোতলিয়ে কিছু একটা বলল। স্পষ্ট শোনা গেল না। জিহাদ হাতলটা ফেলে ইনশিতার দিকে এগিয়ে আসলো। ইনশিতার বাহু শক্ত করে ধরে উঠিয়ে দিলো। ব্যথায় ইনশিতা চেঁচিয়ে উঠল। জিহাদ কর্ণপাত করল না। সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে সব ধোঁয়া ইনশিতার মুখে ছুঁড়ে দিলো। কেশে উঠল ইনশিতা। হাত ছাড়াতে চাইল। পারল না।
আচমকা ইনশিতাকে চেপে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল সে। ইনশিতা তখন জেহেরকে ডাকতে ব্যস্ত। জিহাদ নিজের সিগারেটের দিকে তাকিয়ে ইনশিতার গলার দিকে তাকাল। ধীরে ধীরে জ্বলন্ত সিগারেট এগিয়ে নিতে লাগল ইনশিতার গলার তিল বরাবর। সিগারেটটা ইনশিতার গলা ছুঁই ছুঁই সেই ক্ষণেই জিহাদ আর্তনাদ করে মাথায় হাত চেপে বসে পড়ল। ইনশিতা বড় বড় চোখ নিয়ে দেখল রাফিদ সেই শক্ত হাতল ধরে আছে পেছনে।
জিহাদের মাথায় আরেকটা বারি দিবে তার আগেই জিহাদ রাফিদের পা উল্টে ধরলে সে পড়ে যায়। সেই সুযোগেই জিহাদ মাথায় হাত চেপে টলতে টলতে দৌড়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। ইনশিতা দৌড়ে যায় জেহেরের কাছে। বারবার ডাকতে থাকে। রাফিদ উঠে দাঁড়াল। ইনশিতাকে বলল,
-“এভাবে ডাকলে হবে না। জেহেরকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।”
ইনশিতা কাঁদছে।
.
.
মিসেস জেসমিন চৌধুরী উদভ্রান্তের মতো দৌড়ে আসলো। এসে দেখল ইনশিতা চেয়ারে বসে কাঁদছে আর পাশে রাফিদ দাঁড়ানো। তিনি এসেই ইনশিতাকে বলল,
-“জেহের আমার জ-জেহের কোথায়?”
কান্নার দমকে ইনশিতার কথা দলা পাকিয়ে আসলো। সে কিছুই বলতে পারল না। তার হয়ে রাফিদ বলল,
-“ওটিতে নেওয়া হয়েছে।”
জেসমিন চৌধুরী ধপ করে বসে পড়ল ইনশিতার পাশের চেয়ারে। আফজাল চৌধুরী পাশে দাঁড়িয়ে তাকে শান্তনা দিতে লাগলেন।
-“মানিক আসছে। ওকে খবর দিয়ে দিয়েছি। চিন্তা করো না তুমি। কালই মানিক আসবে।”
মানিক রহমান আফজাল চৌধুরীর বেস্ট ফ্রেন্ড। পেশায় ডক্টর। আর তাকে আফজালের পারিবারিক ডক্টরও বলা যেতে পারে। আপাতত তিনি দেশের বাহিরে আছেন। জেহের হসপিটালে আসছে শুনে তিনি আগেই মানিককে বলে দিয়েছেন। আর মানিক কালকেই আসছে বলে জানালো।
জেসমিন চৌধুরী বিমুঢ় চোখে তাকিয়ে থাকল ওটির দরজায়। কয়েক ঘন্টা পর ডক্টর বেরিয়ে আসলে ইনশিতা তড়িঘড়ি করে জানতে চায় জেহের কেমন আছে। ডক্টর জানায় জেহের বিপদমুক্ত। তবে মাথার এক সাইড জখম হয়েছে খুব মারাত্মকভাবে। তাকে দেখতে চাইলে ডক্টর মানা করে। কারণ তার জ্ঞান এখনো ফিরেনি।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মাগরিবের আজান পড়েছে। হসপিটালের ভ্যাপসা গন্ধে ইনশিতার দম বন্ধ হয়ে যেতে লাগল। মাথা ঘুরছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। একটু খোলা বাতাস দরকার তার। চেয়ার ধরে কোনরকমে উঠে ধীরে ধীরে হসপিটালের বড় ব্যালকনিটায় এসে দাঁড়াল। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে চাইল। অথচ পারল না। বুকটা ভার লাগল। যেন শতমণ পাথর চাপা দিয়ে আছে। হুট করে ইনশিতা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মুখে হাত গুজে কাঁদতে লাগল। হাত কামড়ালো কিছুক্ষণ। তাও যেন কান্না থামছে না।
কাঁধে কারো হাত পড়তেই সে পেছন ফিরে তাকায়। দেখে জেসমিন চৌধুরী বিষন্ন মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। জেসমিন চৌধুরী এখনো জানেন না তার ছোট ছেলে আর মেয়ের কর্মকাণ্ড। না জানানোই ভালো। একটা ধাক্কাই সামলে উঠতে পারছে না, বাকি গুলোতে না জানি কী অবস্থাই হয়! ইনশিতা চোখের পানি মুছে হাসি হাসি মুখে তাকাল। কিন্তু বেশিক্ষণ আর হাসিমুখ ধরে রাখতে পারল না। চোখ ভর্তি হয়ে আসলো নোনাজলে।
জেসমিন চৌধুরী ইনশিতার হাত ধরে চেয়ারে বসালো। তিনি তাকিয়ে আছেন ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত রাস্তার পানে। তারপর ধীর কন্ঠে বলে উঠল,
-“তোমাকে একবার বলেছিলাম না তোমাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার আছে?”
ইনশিতা কিছু বলল না। শুধু মাথা নাড়াল।
-“আজ বলছি সেটা। জানি না ঘটনাটা শোনার পর জেহেরের প্রতি তোমার মনোভাব কিরূপ হবে! তবে তোমাকে এটা বলা অনেক প্রয়োজন।”
ইনশিতা শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল জেসমিন চৌধুরীর দিকে। পরক্ষণেই চোখে মুখে অজস্র কৌতুহল জেগে উঠল। ঘটনাটা জানতে উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইলো জেসমিন চৌধুরীর অভিমুখে।
.
.
****
.
.
-“জেহের আমার নিজের সন্তান নয়।”
জেসমিন চৌধুরীর কথাটা শুনে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো চমকে উঠল ইনশিতা। মুখ হা হয়ে গেল বিস্ময়ে। কথাটা বারবার তার মস্তিষ্কে বাজতে লাগল। পিনপতন নীরবতা পুরো চারপাশ জুড়ে। ততক্ষণে আফজাল এবং রাফিদও পাশে এসে বসেছে। রাফিদ নিজেও নির্বাক এই কথাটি শুনে। জেসমিন চৌধুরী বলেন,
-“শুধু জেহের না, জিহাদও আমার সন্তান নয়। আমি তাদের সৎ মা। তাদের মধ্যে জেহের মানসিক রোগে আক্রান্ত। ছোট থেকেই মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল ওর। তবে কারণটাও ছিল বেশ বড়সড়।”
কথাটি বলতে গিয়ে জেসমিন চৌধুরীর কন্ঠস্বর কেঁপে উঠল। আফজাল কথার মাঝে থামালেন জেসমিন চৌধুরীকে।
-“আমি বলছি। পুরো ঘটনাটাই প্রথম থেকে শুরু করছি।”
একটু থেমে আফজাল বলতে লাগেন,
-“জেহের আর জিহাদের মা, মানে মিতালি আমার প্রথম স্ত্রী ছিল। আমাদের দুজনেরই লাভ ম্যারেজ হয়েছিল। তখন মিতালির বয়স নিতান্তই কম ছিল। বিয়ের দুই বছর পর জেহের আর জিহাদ দুজনেই একসাথে পৃথিবীতে আসে। আমার জীবনে বোধহয় এরচেয়ে বেশি খুশির দিন আর কোনোটাই ছিল না। দুজনেই ছিল আমার চোখের মণি। মিতালি একজন লেকচারার ছিল। জেহের ছিল বেশ মা ভক্ত। আমার থেকেও সে মিতালিকে বেশি ভালোবাসতো। এমনকি খেলাধুলার সাথীও ছিল মিতালি। মিতালি যখন কলেজ যেত তখন বেশিরভাগ জেহেরকেই নিয়ে যেত। জিহাদ যেতে চাইত না। সে বাহিরে সকলের সাথেই খেলত। জেহের আর জিহাদের যখন নয় বছর তখনই মিতালি পাল্টে যেতে শুরু করল। পরিবর্তন আসতে লাগল মিতালির মধ্যে। সে বাচ্চাদেরকে সময় দিলেও আমার সাথে তার সম্পর্কের অবনতি হচ্ছিল। ঝগড়া হতো প্রতিনিয়ত। বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে আমি মিতালির সাথে ঝগড়া খুব কমই করতাম। কিন্তু মিতালি যেন সবসময় সুযোগ খুঁজত আমার সাথে ঝগড়া করার। জেসমিন ছিল মিতালির বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি তাকে ব্যাপারটা জানাই। জেসমিন আমাকে সাহায্য করবে বলে আশ্বস্ত করে। আর আমাদের বাড়ি প্রতিদিন আসতো বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য। কারণ এই বয়সে বাচ্চাদের দেখার জন্য কাউকে না কাউকে লাগতোই। আমি ব্যবসার জন্য সময় দিতে পারতাম না।
জেহের যখন মিতালির সাথে কলেজ যেতে চাইত তখন মিতালি সাথে নিতে চাইত না। কিন্তু জেহের এক প্রকার জোর করেই যেত। কারণ সে জেসমিনকে অকারণেই অপছন্দ করত। জেসমিনের ধারে কাছে ঘেঁষতে চায় না। আর জিহাদ মিতালিকে কাছে না পেয়ে জেসমিনের সাথেই থাকত। ছোট বাচ্চাদের মন তো! যার কাছে ভালো লাগবে তার কাছেই চলে যাবে। জিহাদও তাই। জেসমিনের আমাদের বাসায় নিয়মিত আসা যাওয়াটা মিতালি মেনে নিতে পারেনি। তার সন্তান অন্যের অধীনে বড় হবে এটা সে কোনোভাবেই মানতে পারত না। একদিন ঝগড়া করে সে এটা নিয়ে। জেসমিনের সামনেই। সে জেসমিনের নামে অনেক বাজে বাজে কথা উঠায় আর এটাও বলে দেয় যে, আমার আর জেসমিনের মাঝে সম্পর্ক আছে। সেজন্যই নাকি মিতালি আর আমার সম্পর্ক নষ্ট হয়। অথচ এমন কিছুই হয়নি, জেসমিনের সাথে ছেলেদের কথা ছাড়া বাড়তি কোনো কথাই বলতাম না আমি। জেহের আর জিহাদকেও বুঝ দিত জেসমিন খারাপ, জেসমিন আন্টি নাকি তাদেরকে তার মায়ের থেকে দূরে সরিয়ে দেবে। জিহাদ প্রথমেই জেসমিনের ভক্ত হয়ে গিয়েছিল, তাই সে প্রথমে মানলেও পরবর্তীতে ভুলে যায় মায়ের কথা। আর জেহের তো মায়ের সব কথাকেই চোখ বুজে বিশ্বাস করে নিত। আর তারপর থেকে জেহের জেসমিনকে দুচোখে দেখতেই পারত না। খুব ঘৃণা করত।
একদিন খোঁজ নেওয়ার পর জানতে পারি মিতালির সাথে ঐ কলেজের আরেকজন টিচারের সাথেই সম্পর্ক চলছে। আর গভীরেও গিয়েছে সেটা। আমি মিতালির সাথে এই ব্যাপারে ব্যক্তিগত ভাবেই বোঝাপড়া করে নিতে চেয়েছিলাম। কারণ আমি চাইছিলাম না, সন্তানদের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলুক। আমি একদিন সেটা ও'কে বলেওছিলাম। সে নিজেই সেদিন উঁচু গলায় কথা বলে। যার ফলস্বরূপ বাচ্চারাও এসে পড়ে। বাচ্চাদের সামনে সে নিজে বলে আমার নাকি সম্পর্ক চলছে জেসমিনের সাথে। তখন জেহের আর জিহাদও কিন্তু কিছুটা বুঝদার। এসব সম্পর্ক কিছুটা হলেও তারা বুঝে। আমি থামাতে চেয়েছিলাম মিতালিকে, থামেনি। আমার এত রাগ হয়েছিল যে আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাকে চড় মেরে দিই। সেদিন রাতেই মিতালি বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। জিহাদ আর জেহেরকে নিতে চাইলে জিহাদ কান্নাকাটি করে সে কখনোই যাবে না, আর এমনিতেও জিহাদ মিতালির আদর খুব কম পেয়েছে। তাই জেহেরকে সাথে নিয়েই সেদিন চলে যায় মিতালি। আমি পরে অনুতপ্ত হয়ে মাফ চেয়ে আটকাতে চেয়েছিলাম, পারিনি।”
আফজাল চৌধুরী হাঁপাতে থাকেন। রাফিদ পানির বোতল এগিয়ে দেয়। ঢকঢক করে পানি পান করেন তিনি। চোখের চশমা খুলে চোখ মুছে আবারও পরে নেন। ইনশিতার চোখে পানি। জেসমিন চৌধুরী বিমূঢ় চেয়ে থাকেন রাস্তার দিকে। যেন প্যারালাইজড রোগী তিনি। আফজাল চৌধুরী লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে আবার বলেন,
-“সেদিন সন্ধ্যায়ই আমার মোবাইলে আননোন নাম্বারে কল আসলে শুনি গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে একটা ট্রাকের সাথে। আর গাড়িতে একটা বাচ্চা আর মহিলাকে পাওয়া যায়। আমি তখনই হাসপাতালে ছুটে যাই। জেসমিন সেদিন শহরে ছিল না। মিতালি স্পট ডেড। জেহের আহত হয়েছিল। তবে ব্রেইনে মারাত্মক ইফেক্ট ফেলে এই অ্যাক্সিডেন্ট। সে মেনে নিতে পারেনি মায়ের মৃত্যু। বাসায় আনার পর সে অনেক চিৎকার করেছিল মায়ের কাছে যাবে বলে। পাগলের মতো ব্যবহার করত। জিহাদকে ব্যাট দিয়ে মেরেছিল একদিন। তারপর জিহাদকে আলাদা রুমে শিফট করলাম।
এভাবে এক বছর কেটে যায়। জেহেরের আচরণ ক্রমেই অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছিল। কোনো পরিবর্তন হচ্ছিল না, ডাক্তার দেখাতে যেয়েও পারিনি জেহেরের কারণে। পরিচারিকার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল একবার। ঘর থেকে বেরিয়ে যেত ফাঁক পেলেই। এমন আচরণের জন্য রুমে বন্দী করে রাখলাম। আমি কী করতাম? বাচ্চাদের কীভাবে সামলাতে হয় জানি না। মনে হয়েছিল রুমে বন্দী থাকলেই ও এসব বন্ধ করবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। রুমের মধ্যেই একদিন খাবার দিতে গিয়ে দেখলাম সম্পূর্ণ রুমে ভাঙচুর অবস্থা। রক্ত এদিক সেদিক। জেহেরকে দেখলাম সোফার সামনে অজ্ঞান অবস্থায়। ড্রেসিং করিয়ে রুম পরিষ্কার করিয়ে দিলাম। ডাক্তার ডাকলাম না ইচ্ছা করেই। রুমের দরজা বন্ধ করলাম না আর। তার পরদিন সকালেই জেহেরকে রুমে পাওয়া যায় না। পুরো রুম তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না। বাহিরে বেরিয়ে আসলে দেখি আমার পালিত কুকুরকে সে ইট হাতে মেরে ফেলেছে। আমার রাগ হলো খুব। এমনিতেও মিতালিকে হারানোর শোক আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। খুব ভালোবাসতাম ও'কে। তার উপর জেহেরের পাগলামো। তাই রাগ কন্ট্রোল করতে পারলাম না। জেহেরকে সেদিন খুব মারলাম। রুমে নিয়ে জানালার সাথে শিকল পরিয়ে দরজা আটকে রাখলাম। পুরো দিনে আমি ওর কথাই ভুলে গিয়েছিলাম এক প্রকার।
রাতের বেলা জেসমিন আসলো। ও এসে সবার আগে জেহেরের খোঁজ নিল। আমার তখনই মনে পড়ল জেহেরের কথা। জেসমিনকে বললে সে খুব রেগে যায়। দুজনে যখন দরজা খুলে দেখি তখন জেহের কেমন ঝিমাচ্ছিল। সকাল থেকে খায়নি, আমার মনেই ছিল না। জেসমিন গিয়ে ও'কে মুক্ত করে নিজ হাতে শরীর মুছিয়ে খাইয়ে দেয়। শরীরে ওর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল। জ্বরের ঘোরে জেহের 'মা মা' বলে খুব কেঁদেছিল। আমার মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করা শুরু করল। সেদিন পুরো রাত জেসমিন ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ঘুম পাড়িয়েছে।
জেহেরের জ্বর থাকাকালীন পুরোটা সময় জেসমিন জেহেরের খেয়াল রেখেছে। তবে জেসমিনের এখানে বারবার আসা যাওয়াটাকে প্রতিবেশীরা খুব খারাপ ভাবে নিয়েছিল। জেসমিন লজ্জায় আসা বাদ দিলো। কিন্তু না এসেও থাকতে পারত না। তখন বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য বাধ্য হয়েই জেসমিনকে বিয়ের প্রস্তাব দেই। জেসমিন রাজি হয়েছিল একমাত্র জেহের আর জিহাদের জন্যই। দুদিন পর আমাদের বিয়ে হয়। তখন জেহের সুস্থ। আমি বলেছিলাম জেসমিনকে মা বলে ডাকতে, জিহাদ ডাকলেও জেহের ডাকেনি। সে তারপর থেকে প্রচুর ঘৃনা করতো আমাদের। তার ধারণা সেদিন আমি মিতালিকে চড় মেরেছিলাম নাকি জেসমিনের কারণে। আমি নাকি জেসমিনকেই বিয়ে করার জন্য মিতালিকে মেরে ফেলি। আর মিতালি আগেও জেসমিনের ব্যাপারে বানোয়াট কথা বলেছিল বিধায় জেহের আরও বেশি ঘৃণা করত জেসমিনকে। মিতালির মৃত্যুর জন্য আমাদের দায়ী করে জেহের। জেসমিন তাকে খাওয়াতে চাইলে সে খাবার ফেলে দিত। আমার রাগ হলেও আমি কিছু করতে পারতাম না, কারণ জেসমিন রাগ করতে বারণ করেছিল আমায়। আমি যদি জেহেরকে মিতালির মৃত্যুর দিন থেকেই বাবার দায়িত্ব পালন করতাম তাহলে আর এসব দিন দেখতে হতো না, ও'র গায়ে হাত তোলা আমার ঠিক হয়নি।
যত বড় হতে লাগল ততই জেহের এগ্রেসিভ হতে লাগল। এর মধ্যে জেবা আসলো। তাও জেহের জেবাকেও দেখতে এলো না। নিজের সব কাজ নিজেই করে নিত। জেসমিন কিংবা আমার সাহায্যও নিত না। নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকত। আমাদের এড়িয়ে চলত। পড়াশোনা নিজ দায়িত্বেই করে, ঘরে টিচার রাখলে জিহাদের আর জেহেরের জন্য আলাদা রাখতে হতো। জেহেরের রাগ হলে তার মাথা ঠিক থাকত না, পছন্দ মতো কিছু না হলে খুব রেগে যেত। আর একবার যেটা তার প্রিয় হয়ে ওঠে সেটা কখনোই হাতছাড়া করতে চাইত না, কাউকে দেখাতেও পর্যন্ত চাইত না, ভাবত কাউকে দেখালেই তারা ছিনিয়ে নিবে। জেহেরের এতটাই রাগ যে আমার নিজেরই ভয় করত জেহেরের সামনে যেতে।”
এবার জেসমিন চৌধুরী মুখ খুলেন,
-“আমি জেহেরকে নিজের ছেলে হিসেবে চাইতাম খুব, আমি কখনোই সৎ মায়ের মতো আচরণ করিনি, তাদেরকে আপন মায়ের থেকেও বেশি ভালোবাসা দিয়েছি। তাও জেহের আমাকে এড়িয়ে চলত। জেবা আর জিহাদের সাথে আমার সম্পর্ক আর বাকি পাঁচটা মা-সন্তানের মতোই। কিন্তু জেহের আমাকে কখনোই মা হিসেবে দেখেনি। ওর মুখ থেকে মা ডাক শোনার জন্য আমি মরিয়া হয়ে থাকতাম। জিহাদ আর জেবার কাছে আমি আদর্শ মা হয়েও যেন আমার কমতি ছিল। জেহেরকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতে চাইতাম। জেহেরের এড়িয়ে যাওয়াটা আমার মনে খুব কষ্ট দিতো, তাও আমি ওর মুখ থেকে মা ডাক শোনার জন্য কত কিছুই না করলাম! পছন্দের খাবার রান্না করতাম, ওর পছন্দের জিনিস কিনে দিতাম, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। ও নিজের রুমেই আলাদা খেতো, এমন মনে হয় যেন সে একা একাই থাকে, তার আশেপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে সে খেয়াল রাখে না। আমাকে দেখলে ও রেগে যেত খুব। ওর অস্বাভাবিক আচরণ কমেনি। এসবের জন্য একবার সাইকোলোজিস্ট দেখাতে চেয়েছিলাম। একবার সফল হয়েছি দেখাতে, মেডিসিন সাজেস্ট করেছিলেন। সেগুলো নিয়মিত দেওয়া হয় জেহেরকে তার অজান্তে, তাও যে কেন ছেলেটা আমার সুস্থ হয়নি! সবসময় ভাবে আমরা সবাই তার ক্ষতি করে ফেলব। কাউকেই সে বিশ্বাস করেনি, তার মনে হয় দুনিয়ার সকল মানুষ মিথ্যে মুখোশ পরে ঘুরছে। সকলকেই বিশ্বাসঘাতক মনে হয় তার। এত বছর হয়ে গেল, হাল ছাড়িনি তাও। আমার বিশ্বাস একদিন জেহেরের ভুল ভাঙবে, সে একদিন আমাকে মা বলে জড়িয়ে ধরবে। তখন আমি শান্তি পাবো, আর নয়তো মরে গিয়েও শান্তি পাবো না।”
জেসমিন চৌধুরী শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। ইনশিতা বুঝল না সে কীভাবে এখন শান্তনা দিবে। তার কাছে শান্তনা দেওয়ার মতো ভাষা নেই। তার নিজের কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। জেহেরের কষ্ট সে বুঝতে পারছে না ঠিকই কিন্তু কিছুটা অনুভব করতে পারছে। জেসমিন চৌধুরী যে কীভাবে নিজেকে সামলিয়েছেন! ধৈর্য্য আছে বলতে হবে!
আর রাফিদ চেয়ারে হেলান দিয়ে বুকে হাত মুড়ে বসে আছে। তার নিজেরও খারাপ লাগছে জেহেরের কথা শুনে। ছেলেটা এত কষ্টের মধ্যে বড় হয়েছে! নিজেকে সবসময় সকলের থেকে আলাদা করে গুটিয়ে রেখেছে! এত কষ্ট বুকে চেপে বেঁচে আছে কী করে?
কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা বিরাজ করল পুরো পরিবেশ জুড়ে। মনে হয় যেন পৃথিবীর সব জায়গাতেই এমন গম্ভীর নিরবতা ছেপে আছে। নিরবতার জাল ছেদ করলেন আফজাল চৌধুরী।
আফজাল বলেন,
-“ আমাকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করে কারণ তার মনে হয় আমি যদি মিতলিকে কলেজ যেতে না দিতাম তাহলে মিতালি সম্পর্কে জড়াত না। আর না সে মারা যেত।”
ইনশিতা ভারী গলায় বলল,
-“এই জন্যই কী জেহের আমাকে কলেজ পড়তে দিত না? ওর মনে হতো আমিও এমন সম্পর্কে জড়িয়ে যাব? আর কারো সাথে মিশতে দিতো না, ভাবতো আমাকে কেউ নিয়ে যাবে?”
আফজাল চৌধুরী উপর নিচ মাথা নাড়ালেন। ইনশিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জেহের এতটা ইনসিকিউরড তাকে নিয়ে! ইনশিতা কখনোই তো এমনটা করবে না। তাও জেহের কেন এতটা ভয় পায়? পরক্ষণেই মনে হল, তার মায়ের ঘটনাটা, তার মায়ের সাথে যা ঘটেছে সেটা যে তার সাথে ঘটবে না তার তো আর নিশ্চয়তা নেই! আর ইনশিতাকে জেহেরের কারো মিশতে না দেওয়ার কী এইটাই কারণ? যাতে তাকে কেউ ছিনিয়ে নিতে না পারে? যাতে তার ভালোবাসার রোজ সবসময় তার সাথে থাকে? জেহেরের এই ভাবনাটাও স্বাভাবিক।
তখনই কারো পদশব্দ পাওয়া গেল। এবং শব্দটা খুবই দৃঢ় হতে লাগল।
-“আফজাল!”
কারো ডাকে আফজাল চৌধুরী মাথা তুলে তাকালেন। ব্যক্তিটিকে দেখে কষ্টের মাঝেও হাসি ফুটে উঠল। উঠে দাঁড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন।
-“মানিক! কেমন আছিস বন্ধু?”
-“আমি ভালো। তোর খবর কী?”
-“এত তাড়াতাড়ি? তোর না কাল আসার কথা ছিল?”
-“আজকের ডিউটি ক্যান্সেল করেছি।”
কুশল সেরে মানিক জানতে চাইলেন জেহেরের কথা। ইনশিতা তাকাল জেহেরের কেবিনের দিকে। স্বচ্ছ কাঁচ ভেদ করে নিস্তেজ দেহের অক্সিজেন মাস্ক লাগানো জেহেরের দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইল।
.
.
জেহেরের জ্ঞান ফিরল পুরো একদিন পর, সকালে। ধীরে ধীরে চোখ খুলে নিজেকে অচেনা জায়গায় আবিষ্কার করল। উঠতে চাইল। পারল না, পুরো শরীরে যেন পাথর চাপা দেওয়া হয়েছে। তবুও উঠল। তার ভালো লাগছে না এখানে, রোজকে দেখতে হবে। রোজ কোথায়? তার মনে আছে, রোজের সাথে ফোনে কথা বলার সময়ই তার মাথায় ভারী আঘাত পায়। পিছন ফিরে জিহাদকে দেখলেও পর মুহুর্তে চোখে অন্ধকার দেখে।
বহু কষ্টে উঠে বসে সে। মুখের অক্সিজেন মাস্ক টেনে খুলে ফেলে। মাথার মধ্যে প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে। কেমন খাপছাড়া লাগল নিজেকে। তাকে রোজের কাছে যেতেই হবে। এসব যন্ত্রণা তাকে রোজের কাছে যেতে আটকাতে পারবে না। ফ্লোরে পা রাখতেই মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। পড়ে যেতে নিলেই ইনশিতা দৌড়ে এসে ধরে ফেলল। সে দূরের সোফাতেই বসে ঝিমুচ্ছিল। আওয়াজ শুনে দেখে জেহের উঠে পড়েছে। উতলা হয়ে জেহেরকে ধরে বসাতে বসাতে বলল,
-“আপনি উঠেছেন কেন? বসুন।”
জেহের ইনশিতার হাত শক্ত করে ধরল। ইনশিতা হাত ছাড়াতে চাইল, কিন্তু জেহেরের শক্ত হাত থেকে কিছুতেই ছুটতে পারল না।
-“ছাড়ুন এখন, আমি মানিক আঙ্কেলকে ডেকে আনছি।”
ছাড়ল না জেহের। এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল ইনশিতার দিকে। এমন ভাবে তাকাল যেন সে কত বছর পর দেখছে রোজকে। জেহেরের শুষ্ক ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। চোখে কাতরতা। তারপর আচমকা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ইনশিতাকে। ইনশিতা হতভম্ব। তাও কিছু বলল না, আর না ছাড়াতে চাইল। জেহেরের পিঠে আলতো হাত বুলিয়ে দিলো কিছুক্ষণ। কোমল কন্ঠে বলল,
-“জেহের, কিছু লাগবে আপনার?”
-“তোমাকে।”
.
.
.
চলবে...........................