অন্তর্দ্বন্দ্ব - পর্ব ৫২ - সাবরিনা ইমরান - ধারাবাহিক গল্প


-- এই ফালতু ব্যাটার সাথে আমি তোর বিয়ে হতে দিবো না।আমার সাথে আয়,বাসে করে চলে যাবো,কয়দিন আমার বাসায় থাকবি এরপর তোর প্রিতি আপুর বাসায় চলে যাইস।
-- ধৈর্য্য রাখ।বাবার অসুস্থতার জন্য বিয়েতে রাজি হয়েছি।এখন পালিয়ে গিয়ে মারবো নাকি তাকে?
-- হায়রে বাপ!আমি জানি না ভিনা,দুনিয়ার তাবৎ বাপদের কী সমস্যা।কেউ সামনা সামনি ছুড়ে ফেলে,কেউ মিষ্টি কথায় মেয়ে বলি দেয়।

শেষের কথায় ভিনা চোখ গরম করে তাকালো।নওমি কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে গয়নার বাক্স নাড়াচাড়া করতে থাকলো হাতে নিয়ে।কথা ছিলো রিসেপশন করে ভিনাকে উঠিয়ে নেয়া হবে।কিন্তু ছেলে পক্ষ তাড়াহুড়া করলো শেষ মুহূর্তে। নাদিমের বাবার মৃত্যবার্ষিকী এবং বিয়ের মাস এক হওয়ায় নাকি অনুষ্ঠান করলে খারাপ দেখা যায়।ভিনা ভেবে পায় না গত দুই মাস এরা কী করেছে।তখন এদের সেন্স কোথায় ছিলো।এখন হাতে গোণা কয়জন নিয়ে আকদ হবে।নওমিকে ভিনা নিজে গিয়ে নিয়ে এসেছে দুই সপ্তাহ আগে।নওমির নাদিম এবং নাদিমের পরিবার কোনোটাই পছন্দ হয়নি।দুই সপ্তাহ ধরে সে চেষ্টা করছে ভিনাকে বুঝাতে যেন এই বিয়ে ভেঙে দেয়।ভিনা কম কথায় সাফ জানিয়ে দিয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠান হবেই,ফিরে আসার উপায় নেই।

-- এই গয়না কেউ বিয়েতে দেয়?আমার তো মনে হচ্ছে গাউসিয়া থেকে কিনে এনেছে এগুলা।আসল সোনা এমন হয় না।আর ডিজাইন দেখ,বিচ্ছিরি।এই যুগে কেউ এত কমন লাল সবুজ পাথরের গয়না৷ দেয়?শাড়িটাও রংচটা মনে হচ্ছে।এই বিয়ে করিস না, আমি বলছি পালায় যা।আমার সাথে পালা।
-- তুই আমাকে কোনো জাতেই রাখবি না। নরমালি কোনো মেয়ে পালালে পাড়া মহল্লা রটে।আমারটা ন্যাশনাল নিউজ হয়ে যাবে।লেসবিয়ান ট্যাগ নিয়ে চলতে হবে সারাজীবন।
-- এখনো ফাযলামি করছিস?ভিনা তুই কি ভেবে দেখেছিস কী করছিস তুই?বিয়ে কি হাতের মোয়া?
-- এত ভেবে কী হবে? যখন ভেবেছি তখনও ভুল করেছি।এখন না ভেবে করি।ভালো হবে না?
-- এত রিয়েলিস্টিক হয়ে গেলি?অবশ্য আগে থেকেই ছিলি।
-- জীবন এমনই।এখানে কোনো মিরাকেল হয় না,নাটকীয়তা থাকে না।মানুষ যাকে মিরাকেল বলে,সেটা হলো মানুষের সাবকনশাস মাইন্ডে করা ভালো কাজের ফলাফল।দেখবি যারা উদাস হয়ে ঘুরে বেড়ায়,ইমোশনাল বেশি,ওদের সাথে মিরাকেল হয়।আসলে ওরা গভীরভাবে কোনো কাজ করে না,তাই আচমকা ভালো ফলাফলে খুশি হয়ে যায়।আমার সাথেও একবার হয়েছে।কিন্তু এখন আমার মতো হিসাব করে চলা মানুষের জীবনে এসব হবে না।
-- এইযে উপরে একজন আছে,সে চাইলেই তোর লাইফ মিরাকেল এ ভরিয়ে দিতে পারে।
-- যেমন?
-- যেমন হুট করে তোর সিক্রেট এ্যডমায়ারার এসে লিমুজিনে করে সবাইকে বুড়া আঙ্গুল দেখিয়ে তোকে নিয়ে যেতে পারে।
-- এই গলিতে লিমুজিন?জ্যাম বাধানোর কারণে রাস্তায় সবার গালি খেতে খেতে ওখানেই মরে যাবে।
-- তোর জন্য মরতেও পারবে!
-- আমার কপালে পুরুষ আছে,ভালোবাসা নাই।
-- এহ!বললো একটা কথা। 
-- হ্যাঁ, নাহলে আমার মতো মানুষের জীবনে তিনজন পুরু...
-- কী?!যাবির আর এই নাদিম....তিন নম্বরটা কে?

ভিনা কোনো উত্তর দিলো না।চেয়ার ঘুরিয়ে আয়নায় মনোযোগ দিলো।নওমি ভিনাকে নিজের মুখোমুখি বসালো।ভিনা নিশ্চুপ হয়ে তাকালো।
-- বল ভিনা।
-- কেউ না।
-- রুশান...?

ভিনা মলিনভাবে হাসলো।নওমি ভিনার হাসি দেখে চমকে গেলো।আন্দাজেই রুশানের নাম নিয়েছিলো এখন দেখছে সেটাই সত্যি।

-- রুশান তোকে পছন্দ করলে তুই ওকে ফিরিয়ে দিলি কেন?ভালো ছিলো তো।
-- আমি ফিরাই নি। ও নিজেই সরে গেছে।
-- মানে!কেন?
-- যাবিরের সাথে আমার পাস্টের ব্যাপারে জেনে।

নওমি আর কিছু বললো না।হাঁটু গেড়ে বসে ছিলো।ধীর পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিছানায় রাখা বিয়ের এত এত সামগ্রীর তাকিয়ে থাকলো,কিন্তু দেখলো না।ভিনা আনমনে নিজের সাজে মনোযোগ দিলো।পার্লার থেকে বিউটিশিয়ান আসার কথা ছিলো।ভিনা মানা করে দিয়েছে।রিয়েলিটি শোর সস্তা মেলোড্রামার জন্য হাজার হাজার টাকার মেকাপ মুখে মাখতে ইচ্ছে হয়নি।
নিজেকে সাজিয়ে নিয়ে ভিনা ফোনের দিকে তাকালো।রুদমিলার কোনো মেসেজ এখনো আসেনি।তার মানে সব ঠিকঠাক।নওমিকে জড়িয়ে ধরে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে।বেচারি ভিনার ভুল বিয়ের চিন্তায় কাহিল হয়ে ঘুমিয়ে পরেছে বেকায়দায়।কিন্তু ভিনা নওমিকে ডেকে তুলে রেডি হতে বললো উলটা।আরো কিছুক্ষণ অস্থিরতায় থাকতে হবে ওকে। নওমি শেষবারের মতো অনুরোধ করলো বিয়ে ভাঙার জন্য,কিন্তু বুঝে গেলো কোনো লাভ নেই।ভিনা নওমির দিকে তাকিয়ে নিজেকে শক্ত করলো।দেয়া কথা রাখতেই হবে।

________________________

নাইদার হাজবেন্ড রাজ বারবার বড় বড় হাই তুলছে।স্পাইক করা চুল,কড়া লাল শেড়ওয়ানি,সোনার ঘড়ি এবং গলার চেইনে মেহমান হিসেবে বেমানান লাগছে।শ্যালকের বিয়েতে নিজেই জামাই সেজে এসেছে।নাইদার দিকে তো তাকানোই যাচ্ছে না।দুই হাত ভর্তি সোনার চুড়ি,এরপর আবার এক হাতে মানতাসা।টিকলি,ঝুমকা,কানের দুল কোনোকিছুই বাদ নেই।জলজ্যান্ত গয়নার দোকান মনে হচ্ছে।সেই তুলনায় বউ হিসেবে ভিনা ফিকে হয়ে গেছে।নাইদার অর্ধেক পরিমাণ গয়নাও পরেনি। নয়নিকা গতানুগতিক মধ্যবয়স্ক ভদ্রমহিলার সাজে এসেছেন।আর নাদিমকে কোনোভাবেই জামাই মনে হচ্ছে না।সুতির পাঞ্জাবি পরে এসেছে সাদা পায়জামা দিয়ে।দেখেই মনে হচ্ছে একদম দায়সারা ভাবেই আসা হয়েছে। ভিনার এসবে কিছুই যায় আসছে না।চুপচাপ বসে রয়েছে সোফায়,বারবার ঘড়ি দেখছে।কিছুক্ষণ পরই কাজী অফিস থেকে লোকেরা আসবে। বাসায় ভিনার নানাবাড়ির দিক থেকে ছোট মামাই এসেছে,তার নাম টগর।টগর শিউলির ছোট ভাই ছিলো,মানে ভিনার ছোট মামা।এই একজনই আছে যে ভিনার মা শিউলির বিয়ে নিয়ে কোনো আপত্তি করেনি। কারণ সে তখন সবে এইচএসসি পাশ করেছে।কথা বলার মুখ ছিলো না।তাই দ্বন্দ্ব তৈরি হয়নি।দাদাবাড়ী থেকে এক ফুপু এবং চাচা এসেছে সপরিবারে। প্রিতি এখনো আসেনি।প্রিতির আসার ব্যাপারে ভিনা সন্দিহান।এই বিয়েকে কোনোভাবেই প্রিতি ভালো চোখে দেখেনি।তাই দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে বিশাল। এমনকি প্রিতি কথাও বন্ধ করে দিয়েছে।এত এত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার পর ও ভিনা বিয়ে করছে।কারণ নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে এটা ভীষণ জরুরি।সব ঠিকঠাক হওয়ার জন্যই ভীষণ জরুরি।ভিনা বিশ্বাস করে নিজের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আসলে নিজের মায়ের সাথে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কিত। শিউলি নিজের মেয়েকে এভাবেই আগলে রাখে,ভিনা তীব্রভাবে বিশ্বাস করে এটা।তাই এই বিয়েতে আপত্তি করেনি।

ভিনার ধ্যানভঙ্গ হলো কাজী অফিস থেকে লোকজন আসাতে।আবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কিছুটা চিন্তায় পরে গেলো।প্রফেসর রুদমিলা বলেছিলেন সময়ের খানিক আগেই এসে যাবেন।তিনি না আসা পর্যন্ত যেন বিয়ে না হয়।কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে বলার জন্য।রুদমিলা সাথে এও বলে দিয়েছেন যে,বড় ধরণের নাটক ও হতে পারে,যেন প্রস্তুত থাকে এবং কাউকে এই কথার ব্যাপারে কিছুই না জানায়।যেহেতু কাজী এসে পরেছে আর সময়েও হয়ে গেছে,ভিনা তাই বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে।

-- সবর হচ্ছে না নাকি?

নাইদা খোঁচা মেরে কথাটা বললো।ভিনা নিরুত্তর থেকে মাথা নিচু করে লজ্জা পাওয়ার মিথ্যে অভিনয় করলো।নাইদা ঠোঁট বাকিয়ে কোলে থাকা বাচ্চা সাথে করে নিয়ে আসা কাজের লোকের কাছে গছিয়ে দিলো।শান্তশিষ্ট বাচ্চা হওয়া সত্ত্বেও নাইদা বিরক্তির সাথে কাজের মেয়েকে ধমক দিলো বাচ্চার দিকে খেয়াল না রাখার জন্য। এরপর একদম গা ঘেষে ভিনার সাথে বসলো।ভিনা একটু সড়ে বসলে নাইদা ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট করে তাকালো-

-- কী হলো?গরম লাগে নাকি?
-- হ্যাঁ,একটু আরকি।
-- এই শীতের দিনে কিসের গরম?নাকি বিয়ের কারণে শরীর গরম হয়ে যাচ্ছে?
-- এক্সকিউজ মি?
-- কী আবার?বাদ দাও,একেবারে না সেজেই এসে পরলা বিয়ে করতে। তোমার বাবা কি একটা বিউটিশিয়ানের ও ব্যবস্থা করতে পারে নাই?
-- এখানে আমার বাবাকে টেনে আনার মানে কী?উনি এসব ব্যাপার বুঝেন নাকি?আমি নিজেই সাজিনি।
-- বুঝছি,সৎ মায়ের সমস্যা। সৎ মায়ের জাতই খারাপ বুঝছো। নিশ্চয়ই তোমার বাপ তার কথায়ই নাচে?
-- আপু আপনি একটু চুপ থাকবেন দয়া করে?আপনি এসব উদ্ভট ঘটনা কোথা থেকে সাজাচ্ছেন বুঝতে পারছিনা আমি।বেয়াদবিও করতে চাচ্ছিনা।

নাইদা ফোঁস করে উঠলো। তেড়ে গিয়ে ডাক দিলো নাদিম কে।বোনের অস্থিরতা দেখে নাদিম ছুটে এলো। এরপর নাইদা কী কথা বলেছে জানা নেই,কিন্তু নাদিম ভিনা এবং সোহেলকে একসাথে ডাকলো।সোহেল অবাক হলেন এভাবে ডাকায়,ভিনার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালেন কিন্তু কোনো উত্তর পেলেন না।নাদিম নীরবতা ভেঙে বললো-

-- ভিনা,তুমি এখনো আমার ওয়াইফ হওনি,কিন্তু আমার বোন কে ডিসরেস্পেক্ট করছো।এত সাহস কী করে আসছে?
-- আমি আপনার বোন কে ডিসরেস্পেক্ট করেছি নাকি উনি আমাকে প্রভোক করেছেন?পুরো ঘটনা জেনে এসেছেন নাকি এক তরফাই শুনে গেছেন?

নাদিম চোয়াল শক্ত করে সোহেলের দিকে তাকালো।

-- দেখুন,আমি বিয়ের আগেই এর সমাধান চাই। আমি চাইলেই ভিনাকে একা ডেকে শাসন করতে পারতাম।কিন্তু আপনাকে ডেকেছি কারণ আপনি এখনো ওর গার্জিয়ান। ভিনা যে এত এগ্রেসিভ আচরণ করেছে তাও বিয়ের দিনে,এটা কি ঠিক হলো?আপনি এর বিচার করবেন না?

সোহেল ঘটনা না জানায় কিছু বলতে পারলেন না।একবার ভিনার দিকে আরেকবার নাদিমের দিকে তাকালেন।ভিনা এবার রাগ দমিয়ে রাখতে পারলো না।নাদিমের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললো-

-- আপনার নিষ্পাপ বোনকে ডাকুন।বিচার যখন হচ্ছে,ভিক্টিমকে কেন সামনে রাখা হবে না?
-- ডোন্ট ক্রস ইওর লিমিট ভিনা।
-- সমস্যা হলে আমি ডেকে আনছি।লিমিট ভালোমতো ক্রস হোক।

ভিনা ভারী শাড়ি পরেও দ্রুত গতিতে মেহমান ভরা ঘর থেকে নাইদাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে আসলো।নাইদা মিনমিন করতে থাকলো পুরো সময়।নাইদার পেছনে নয়নিকা এবং তার পেছনে নওমি দৌড়ে আসলো। ভিনা নাইদাকে সামনে দাঁড় করালো।

-- আপনার ভাইকে কী বলেছেন যে আমার বিচার বসানো হলো?একদম সত্যি করে বলবেন।

নাইদা বিস্ফোরিত চোখে ভিনার দিকে তাকালো।ভাবতেও পারেনি পানি এতদূর গড়াবে।নাইদা ভিনার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নাদিমের হাত ধরে ন্যাকা সুরে বললো-

-- দেখলি ভাই?মেয়ের তেজ দেখলি?তোদের সামনেই এমন করে আর তখন কী কড়া কথা শুনিয়েছে বুঝলি এখন?এখনো ঘরেও ঢুকে নাই কিন্তু ঘর ভাঙানি দিচ্ছে।
-- নিজের সস্তা রসিকতা এবং মায়াকান্না বন্ধ করুন।এসব ফাযলামি এখানে চলবে না।

নাদিম ভিনার দিকে আঙুল তুলে চুপ থাকতে বললো।ভিনার আত্মসম্মানে গিয়ে লাগলো সেটা।

-- আমার বাবাকে যে অপমান করবে,তাকে আমি ক্ষমা করবো না কখনো। 

নাইদার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললো ভিনা।নাইদা ভ্রু নাচিয়ে সামনে আসলো।

-- তোর ক্ষমা কে চায় রে?এই বিয়েই আমি হতে দিবো না।তোর মতো এই চ্যাত দেখানো মেয়েকে আমার ভাইয়ের বউ করবো না।কোন এমন বড়লোক হয়ে গেলো তোর বাবা যে কথা বলা যাবে না।
-- মুখ সামলে কথা বলবি....

ভিনার কথায় পুরো ঘর যেন ঠান্ডা হয়ে গেলো।নাইদা ভাবতেও পারেনি ভিনা তুই তোকারি করবে। নাইদার এরপর কী হলো কেউ জানে না,সে নওমির পাশে যেয়ে ওর হাত ধরলো-

-- এই মেয়েটা অনেক লক্ষ্মী। তিনদিন দেখেই বুঝে গেছি শিক্ষা আছে পরিবার এ।আমি এরেই আমার ভাইয়ের বউ বানাবো।

সোহেল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন।এত অপমান এবং বিচ্ছিরি সিচুয়েশনে কখনো পরেননি আগে।ভিনা সোহেলের দিকে তাকাতে পারছে না।যেই কারণে বিয়েতে রাজি হলো,তার চেয়েও বেশি মানসিক চাপে সোহেল পরলেন।

নওমি হাত ছাড়িয়ে নিলো।কোন জাতের পাগলের পাল্লায় পরেছে বুঝতে পারছেনা।নাইদা আবার যেয়ে হাত ধরলো নওমির।এরপর গলা জড়িয়ে ধরে বললো-

-- নামও কত সুন্দর!নওমি।ন দিয়ে নাম।আমাদের সাথে কত মিলবে। দেখ ভাই,এই মেয়েকে বিয়ে কর। এই মেয়ে দেখতেও কত মিষ্টি!
-- আরে আন্টি,কীসব করছেন! 
নওমি চেচিয়ে উঠলো।
-- আন্টি কাকে বলো।আপু হবো তোমার।আর ভাই,আমি ড্রয়িং রুমে সবাইকে এই বিয়ে বাতিলের খবর জানায় আসছি দাঁড়া।

ভিনা এবার নিশ্চিত হলো নাইদা মানসিক রুগী।নাহলে কেউ সাবলীলভাবে এত অদ্ভুত বিরক্তিকর আচরণ করতে পারেনা।নাইদার পিছে বাকী সবাই ও গেলো।নয়নিকা চেষ্টা করতে লাগলেন মেয়ের পাগলামি থামানোর।সোহেল অনুরোধ করছেন সিন ক্রিয়েট না করতে। ভিনা কিছুই না বলে হেঁটে হেঁটে ড্রয়িং রুমে আসলো।এসেই প্রশান্তির হাসি দিলো।রুদমিলা এসেছেন।সাথে আরেকজন মেয়েও আছে যাকে ভিনা চিনে না।নাইদা সবার অনুরোধ শুনে আরো যেন দ্রুত গতিতে উৎসাহের সাথে ছুটে আসলো খবর দিতে।চিৎকার করে বললো,

আমরা ছেলেপক্ষরা বিয়ে ভেঙে দিয়েছি।মেয়ের সমস্যা আছে।

কথাটা শেষ করেই নাইদার চোখ পরলো রুদমিলার সাথে বসা মেয়েটার দিকে।সাথে সাথেই যেন নাইদা জমে গেলো।রুদমিলা নাইদাকে বললেন-

-- তোমরা বিয়ে ভাঙবে?কেন?নিজেদের কুকর্ম ফাঁস হয়ে গেছে?

রুদমিলা দেরি না করে সাথে আনা মেয়েকে ইশারা করলেন।মেয়েটা উঠে এসে দাঁড়ালো রুদমিলার পাশে। 

-- কী নাইদা?চিনো নাকি এই মেয়েকে?

নাইদার মুখ থেকে কোনো কথা বের হলো না।

-- ওর মুখ থেকে কথা বের হবে না তো।ফাহিমা তুমি বলো। 

ফাহিমা নামের ছোটখাটো চোখে কালি পরা ফ্যাকাশে রঙের সেই মেয়ে ভেজা চোখে কথা শুরু করলো।

-- নাইদা আমার ননদ ছিলো।আর নাদিম আমার এক্স হাজবেন্ড।

রুদমিলাই কথা চালিয়ে গেলেন।
-- এত অল্প অল্প কথা বলো কেন?পুরো ঘটনা বলো।ডিভোর্স কেন হয়েছে?
-- নাদিম প্রবাসী ছিলো।ওর সাথে আমি মাত্র দেড় মাসের সংসার।পরে দুই বছর আমি শ্বাশুড়ি আর ননদের সাথে সংসার করেছি।নাইদা আমাকে অনেক টর্চার করতো।নিজে বেশিরভাগ সময় মায়ের বাসায় থাকতো।পুরো সংসারই ওর হাতে জিম্মি।এমনকি সামান্য কথাতেই গায়ে হাত তুলতো।ওর মারধরের কারণে আমার পেটের তিন মাসের বাচ্চা মিসক্যারেজ হয়ে গেছে।মিসক্যারেজের পর আমি নাদিমকে অনেক বার বলেছি আমাকে নিয়ে যেতে,বিয়ের সময়েও কথা দিয়েছিলো অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাবে।কিন্তু কোনো পাত্তা দেয়নি।কাগজপত্র ও রেডি করেনি।বিয়ের সময় পনের লাখ টাকার জিনিস,গয়না,ফার্নিচার নিয়েছে।অথচ দুই বছরই আমাকে খাওয়ার খোঁটা শুনতে হয়েছে।দেড় বছর পর নাদিম দেশে ফিরলে নাইদা আমি থাকতেও নাদিমের আবার বিয়ে ঠিক করে। কিন্তু শেষে ঐ পরিবার আগায়নি।আমার ফ্যামিলিকে কতবার ডেকেছি,সালিশ ও বসেছে।কোনো সমাধান হয়নি।শেষে আম্মা আমাকে ফিরায়ে নিয়ে আসছে।

ফাহিমা ভেঙে পরলো কান্নায়।রুদমিলা তাকে ধরে সান্ত্বনা দিলো।

-- এন্ড শি ইজ স্টিল ট্রমাটাইজড।

রুদমিলা এবার কাশি দিয়ে নিজে শুরু করলেন কথা বলা।
-- নাইদা ইজ এ টোটালি সিক পার্সন।ওর মা ভাই ওর কাছেই জিম্মি কারণ এই মেয়ে পারেনা এমন কিছুই নেই। এইযে ওর বিয়ে,নামে মাত্র বিয়ে।টাকা পয়সা দিয়ে বিয়ে টিকিয়ে রেখেছে।নিজে তো চৌদ্দ জায়গায় রিলেশন করে বসে আছে।লাত্থি দিয়ে ঘর থেকে না বের করে ওর মা আর ভাই মাথায় তুলে রেখেছে।আবার এর ইশারায় হুট হাট বিয়েও করতে চলে যায়।জেলে ঢুকিয়ে এদের পিটানো দরকার। সিক ফ্যামিলি!

এরপরের ঘটনা যা হওয়ার তাই।রুদমিলা পুলিশে খবর দিলেন,ফাহিমা কেস করলো,আত্মীয়রা সবাই ভিনা এবং সোহেলকে সান্ত্বনা দিলো এবং ঘর বন্ধ করে নওমি ভিনাকে নিয়ে নাচা শুরু করে দিলো।ভিনা নওমিকে শান্ত করে রুদমিলার কাছে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো।এরপর ফিসফিস করে বললো-

-- ধন্যবাদ আপনাকে এবং আপনার দেবরকে। 

রুদমিলা হেসে দিলেন।এরপর দুই হাতে ভিনার চেহারা পরম স্নেহে ধরে বললেন-
-- আর যেন একি ভুল বারবার না হয় মা।সব ভুল ঠিক করার উপায় থাকে না।

_______________________

নওমি ভিনার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে।গরম তেল দিয়ে নওমির মাথায় মালিশ করে দিচ্ছে।নওমির আরামে ঘুম এসে পরেছে,চোখ ঢুলুঢুলু। 

-- ভিনা,আমি তানভিরের সাথে কথা বলবো।
-- দরকার নেই।যা হওয়ার হয়েছে।
-- অভিনয়ই তো। কিন্তু যদি সত্যিটা জানতে পারিস যাবিরের ব্যাপারে,ক্ষতি কী?
-- ক্ষতি আছে।তানভির কোন লেভেলের খারাপ ছেলে তুই ভাবতেও পারবি না।আমি চাইনা তোর ক্ষতি হোক।শুধু মন হালকা করার জন্য বলেছি তোকে। 
-- আচ্ছা যাবির কেন চলে গেলো?হুট করে কেউ এভাবে প্রতারণা করে?

ভিনা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।নওমি মাঝখানের তিন বছরের ঘটনা জানেই না।না জানাই ভালো একদিক দিয়ে।এত কুৎসিত অতীতের ব্যাপারে ভাগাভাগি করলেও কষ্ট না কমে বেড়ে যায়।

-- এর জন্যই যাবিরকে খুঁজছি রে।
-- পরে কোনো খবর কি পেয়েছিস?
-- হ্যাঁ। যাবির জেলে নেই। ও ঢাকায়ই আছে।কোথায় আছে সেটা জানি না।
-- এসব জানলি কীভাবে?
-- এক বড় ভাইকে দিয়ে খোঁজ নিয়েছি।যা বুঝলাম,যাবিরকে আমি পাচ্ছি না ব্যাপারটা এমন না।আসলে যাবির নিজেকে লুকিয়ে রাখছে।
-- কেন?কী মনে হয়?
-- জানি না।কিন্তু হাল ছাড়বো না।আপাতত কয়দিন এসব নিয়ে ভাববো না রে।একটু টেনশন ফ্রি থাকা দরকার। 
-- তুই বললে...
-- তানভির অনেক বাজে ছেলে নওমি।ঐ সিনিয়র মালিহার সাথে চিট করেছে।শুধু তাইনা,মালিহার স্ক্যান্ডাল বের করেছিলো।ইন্সটিটিউশন থেকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করেছে লম্পট টাকে।আমি জেনে শুনে তোকে কীভাবে এসবে ঠেলে দেই।আমি তোকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,তুই রাজি হয়েছিলি কথা বলার জন্য।কিন্তু আমি সময় চেয়েছিলাম এটাই জানার জন্য যে তানভির কতটুকু সেফ তোর জন্য।এরপর যা জেনেছি,সেটা তো বললামই।
-- তুই জানলি কীভাবে?
-- পৃথিবীটা অনেক ছোট।
-- এমন লম্পটই আমার কপালে জুটলো কীভাবে?মায়ের রূপের সাথে কপালটাও পেয়ে গেলাম। শালা!
-- বাদ দে।
-- খোঁজ নেয় নাই আমার ঐ লোক।এদিকে আম্মু এখন ধরতে গেলে পাগলই হয়ে গেছে।নানির বাড়ির ওদিকে আমাকে পাগলের মেয়ে ডাকে জানিস?
-- ডাকলে ডাক।ওদের ডাকে কী আসে যায়। 
-- কয়দিন পর এতিম মেয়েও ডাকবে।
-- মানে?
-- আম্মু বেশিদিন বাঁঁচবে না।
-- কীসব ফালতু কথা বলছিস নওমি!
-- কেউ বাঁচতে দেয় না।নানাবাড়িতে আগাছার মতো পরে আছি।বাড়ির চাবি মামির হাতে,নানা নানির নামেমাত্র সব।আমি তো বলি মরে গেলেই বেঁচে যাবে।
-- ছি নওমি!এরপর তোর কী হবে?
-- আমার কোনো ক্ষমতা নাই যে আম্মুকে আগলায়ে রাখবো।আম্মুর জন্য যেটা ভালো সেটাই বলছি।এরপর আমাকে ঐ বাড়িতে কেউ থাকতে বলবে না এমনিও।বের হয়ে যাবো,তোর কাছে থাকবো কিছুদিন।এরপর পড়াশোনা শুরু করবো।এই কয়দিন শুধু আম্মুর কাছেই থাকবো।
-- দেখ তুই...

ভিনা কথা শেষ করতে পারলো না।মুনার চিৎকারে বাড়ি কেঁপে উঠলো।ভিনা কয়েক সেকেন্ড বসে থাকলো নিজের ভয়ের সাথে যুদ্ধ করার জন্য।
.
.
.
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp