গুঞ্জন আসতে আস্তে স্পন্দনের এক্কেবারে কাছে চলে এলো। স্পন্দন বেচারা এবার না পেছাতে পারছে না এগোতে। ও টেবিলে রাখা পেপার ওয়েট দিয়ে নিজেই মাথাটাই ফাটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে, ও কিছুক্ষণের জন্যে ভুলেই গেছিলো যে এটা অন্য কোনো মেয়ে নয় এটা গুঞ্জন। অনেক মেয়েরা যেটা কল্পণাও করতে পারেনা গুঞ্জন সেটা করে দেখাতে পারে। স্পন্দন গুঞ্জন দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো ঢোক গিললো। গুঞ্জন আঙ্গুল দিয়ে স্পন্দনের কপাল থেকে ডান ভ্রুর পাশ দিয়ে স্লাইড করে গালে নামিয়ে আনলো। স্পন্দন এবার তুতলিয়ে বলল,
--- " গু্ গুঞ্জন কী ক্ করছো এসব ?"
গুঞ্জন একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
--- " তুমিই তো বললে যে বন্ধ কোনো রুমে হাজবেন্ড এন্ড ওয়াইফ থাকলে কী করে জানি কী না? সেটাই করে দেখাচ্ছিলাম যে আমি জানি কী করে। কিন্তু তুমি তো মাঝপথেই থামিয়ে দিলে। চলো কম্প্লিট করি।"
এটুকু বলে আরেকটু এগোতে নিলেই স্পন্দন ওর হাত দিয়ে গুঞ্জনের কাধ ধরে আটকে দিয়ে বলল,
--- " নাহ থাক। আমি দেখে নিয়েছি। আর বুঝেও নিয়েছি যে তুমি কী কী পারো।"
গুঞ্জন একটা টেডি স্মাইল দিয়ে সরে এলো। স্পন্দনও একটু ঠিকঠাক হয়ে বসে গলা ঝেড়ে বসল। গুঞ্জন মূখে হাসি রেখেই বলল,
--- " নেক্সট ফ্রাইডে ভাইয়ার বিয়ে। মেঘুদি ইনভাইট করেছে নিশ্চয়ই। আসবেন তো?"
স্পন্দন ভ্রু কুচকেই বলল,
--- " চেষ্টা করবো।"
গুঞ্জন একটু বিরক্ত হয়ে বলল,
--- '' আজব। একই বাড়ির দুজন আপনাকে ইনভাইট করছে তবুও আপনি দেখছি বলছেন? আপনি না সবাইকে ম্যানার্স শেখান?"
--- " সকাল থেকে এসে এখানে পরে আছো। কলেজ পড়াশোনা তো সব আজকের মতো গেছে। এখন কী বাড়িও ফিরবেনা নাকি?"
গুঞ্জন একটু বিরক্ত হয়ে মুখ ফুলিয়ে বলল,
--- '' কেনো? আমি থাকায় আপনার প্রবলেম হচ্ছে নাকি?"
স্পন্দন একটু চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে বলল,
--- '' অবশ্যই লাগছে। কেউ আমার কাজের জায়গায় এসে ডিসটার্ব করুক সেটা আমার ভালোলাগেনা।"
গুঞ্জন এবার একটু রেগে গেলো। হাত দিয়ে নাকে একটা ঘসা মেরে বলল,
--- " হ্যাঁ হ্যাঁ তাতো লাগবেই। খবিশ ডেবিল একটা।"
বলে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেলো। স্পন্দন সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।
____________________
চারদিন কেটে গেছে। এই চারদিনের দুদিন গুঞ্জন স্পন্দনকে নানা ভাবে জ্বালিয়ে মেরেছে। হুটহাট অফিসে গিয়ে ওকে ডিসটার্ব করেছে। কখনো ওকে লিফট দিতে বাধ্য করেছে। মানে পুরো লেপটে ছিলো স্পন্দনের সাথে । বাকি দুদিন আবিরের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত ছিলো তাই ততোটা জ্বালাতে পারেনি। আজ আবিরের রিসিপশন। স্পন্দন রেহান আর সারাও এসছে। মেঘলা, রেহান, সারা, গুঞ্জন মিলে আড্ডা দিচ্ছে। এতোক্ষণ গুঞ্জন স্পন্দনের পেছনেই পরে ছিলো। বিভিন্নভাবে ইরিটেড করে গেছে ওকে। এইমাত্র ওদের সাথে গল্প করতে এলো। রেহান বলল,
--- " সিরিয়াসলি গুটি তুই পারিসও। এ কয়দিনে স্পন্দনের অবস্হা পুরো নাজেহাল করে দিয়েছিস!"
গুঞ্জন ভাবতে ভাবতে বলল,
--- " কী মনে হয়? বরফ গলছে?"
সারা হাতে একটা ক্লাব মেরে বলল,
--- " গলছে মানে। আমিতো সিউর এব্যাপারে। লেগে থাকো হয়ে যাবে!"
মেঘলাও সায় দিয়ে বলল,
--- " শুধু গলবে না। তরতর করে গলবে।"
হঠাৎ কেউ বলে উঠলো,
--- " আমি কী বরফ যে হিট দিলেই গলে যাবো?"
সবাই চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখে যে স্পন্দন পকেটে হাত দিয়ে কুচকে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। সারা ওর ডান দিকে আঙ্গুলের ইশারা করে বলল,
--- "আমি কিছু বলিনি যা বলার গুঞ্জন বলেছে।"
স্পন্দন ভ্রু কুচকে গুঞ্জনের দিকে তাকাতেই গুঞ্জন আঙ্গুল দিয়ে ডান দিকে মেঘলার দিকে ইশারা করে বলল,
--- " আমি কিছু বলিনি সব মেঘুদি বলেছে।"
স্পন্দন একি ভঙ্গিতে মেঘলার দিকে তাকাতেই মেঘলা একটু চমকে গিয়ে তাড়াতাড়ি ওর ডান দিকে রেহানের দিকে ইশারা করে বলল,
--- " আমিও কিচ্ছু বলিনি। যা বলার সব রেহান বলেছে।"
স্পন্দন এবার রেহানে দিকে তাকাতেই রেহান ওর ডান দিকে ইশারা করে বলল,
--- " আমি কিছু বলিনি সব ও.."
এটুকু বলে ডানে তাকিয়ে দেখে ওর ডানে আর কেউ নেই। একবার ডানদিকে একবার আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে, অসহায়ভাবে আঙ্গুলটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে করুণ কন্ঠে বলল,
--- " হ্যাঁ। যা বলার আমিই বলেছি।"
স্পন্দন বিরক্ত হয়ে কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
--- " ইউ গাইস আর জাস্ট ইমপসিবল।"
বলে ওখান থেকে চলে গেলো আর ওরা সবাই একে ওপরের দিকে গম্ভীর হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একসাথে হেসে দিলো।
_____________________
আরো কয়েকটা দিন কেটে গেলো। এরমধ্যে আবিরের বিয়ের ঝামেলা শেষ হয়ে গেছে। আর রেহান, রেহানের বাবা মা স্পন্দন ওরা এসে মেঘলাকে দেখে গেছে আর সামনের মাসে ওদের বিয়ের দিনটাও ঠিক হয়ে গেছে। গুঞ্জনের বাবা-মা এখন আর গুঞ্জনের সাথে কোনো মিস বিহেভ করেনা কিন্তু সম্পর্কটাও ঠিক হয় নি আগের মতো। এদিকে স্পন্দনকে সারাক্ষণ ইরাটেড করে করে অস্হির করে দেয় গুঞ্জন। মাঝরাতে ফোন দিয়ে পকরপকর করাটা অন্যতম হয়ে গেছে। কিন্তু স্পন্দনের একটাই কথা ও গুঞ্জনকে বিয়ে করবেনা। কিন্তু গুঞ্জনও নাছোড়বান্দা নিজেকে একপ্রকার স্পন্দনের বৌ বলেই দাবী করে বেড়ায় ও।
গুঞ্জন, তিতির, আবির বেডে বসে আছে। গুঞ্জন কোলে বালিশ নিয়ে আসাম করে দাঁত দিয়ে নখ কাটছে, তিতলি গালে হাত দিয়ে বসে আছে আর আবির বেডে হেলান দিয়ে ফোন দেখছে। মেঘলা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রেহানের সাথে কথা বলছে ভিডিও কলে। একটু পর মেঘলা রেহানকে লাইনে রেখেই ভেতরে চলে এলো।সবাই রেহানের সাথে কথা বলল। কিন্তু গুঞ্জন এখনো দাঁত দিয়ে নখ কাঁটতে কাঁটতে কিছু ভাবছে। মেঘলা বিরক্ত হয়ে বলল,
--- " কী হয়েছে বলবি?"
গুঞ্জন গালে হাত দিয়ে ভাবনায় মসগুল থেকেই উদাসীন কন্ঠে বলল,
--- " জীবণটা বোধ হয় আমার সিঙ্গেলই কেটে যাবে গো.."
আবির সাইড থেকে গ্লাস নিয়ে পানি খাচ্ছিলো। গুঞ্জনের কথা শুনে বিষম খেয়ে গেলো। তিতলি গুঞ্জনের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
--- " আহারে কেনো কী হলো ননদিনী? স্পন্দন ভাইয়া বিয়ে করে নিয়েছে বুঝি? দেখো তোমার ভাই কিন্তু বিষম খেয়ে গেছে।"
বলেই ঠোঁট চেপে হাসলো। মেঘলা আর ওপাশ থেকে রেহানও হেসে দিলো। গুঞ্জন চমকে তিতলির দিকে তাকিয়ে বলল,
--- " ভাবী প্লিজ এসব কুলক্ষণে বলোনা। এমনিতেই টেনশনে আছি। "
ওপাশ থেকে রেহান বলে উঠলো,
--- " অলুক্ষণে শুনেছি। বাট হোয়াট ইজ কুলক্ষণে?"
গুঞ্জন আবারও দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে বলল,
--- " অলুক্ষণের সুপারলেটিভ ভার্সেন এটা।"
রেহান মাথা ঝাকিয়ে বলল,
--- '' ওহহহ।"
হঠাৎ গঞ্জনের কথাটা ভালোকরেই ভাবতেই অবাক হয়ে বলল,
--- " কীহ?"
আবির কেশে গলাটা ঠিক করে বলল,
--- " আরেহ অলুক্ষণের ওপর দিয়েও অলুক্ষণে কিছু হলে তাকে কুলক্ষণে বলে তাইনা গুটি?"
গুঞ্জনও মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল,
--- " হ্যাঁ এক্সাক্টলি।"
মেঘলা একটু হাসলো কারণ আবির আর গুঞ্জনের এসব কথা শুনে ও অভ্যস্ত। কিন্তু রেহান অার তিতলি হা করে তাকিয়ে আছে দুই ভাইবোনের দিকে, বাংলা ব্যাকরণের এমন অসাধারন ব্যাখ্যা এর আগে শোনেনি এরা। তবে কী এটা বাংলা নিয়ে অনার্স মাস্টার্ট না করারই ফল? ওরা দুজন এসব চিন্তা করতে করতেই গুঞ্জন বলে উঠলো,
--- " তোমাদের বিয়ে হয়ে গেলো, মেঘুদি আর জিজুরও সব সেট হয়ে গেলো, শুধু আমার ঐ খবিশ রামটাই এক গান লাগিয়ে রেখেছে। আরে ভাই কেউ তো ওকে বোঝাও যে আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি?"
মেঘলা একটু বিরক্ত হয়ে বলল,
--- " ওয়ে ড্রামাকুইন সবে বিশ হয়েছে তোর।"
গুঞ্জন বিরক্ত হয়ে বলল,
--- " ঐ বাংলা প্রবাদ আজে না? বুড়িতে কুড়ি না কুড়িতে বুড়ি। সেটাই বলছিলাম। বাট আমার অবস্থাটা ভাবো।"
তিতলি গুঞ্জনের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
--- " ইয়াহ ইয়াহ। আই আন্ডারস্টান্ড।"
গুঞ্জন এবার বালিশটা কোল থেকে ছুড়ে ফেলে বলল,
--- " অনেক হয়েছে ঐ ডেভিল চৌধুরীর ভাব নেওয়া। এবার হয় এসপার নয় ওসপার।"
বলে গুঞ্জন ফোনটা এমন ভাবে বেড় করলো যেপো যুদ্ধের জন্যে তলোয়ার বের করছে। সবাই একটু পিছিয়ে গেলো। গুঞ্জন স্পন্দনের নাম্বারে কর দিলো। ওরা সবাই আবার এগিয়ে এসে কান পাতল, রেহান ওপাশ থেকেও কান পাতার ট্রাই করছে। স্পন্দন বেডে হেলান দিয়ে অফিসিয়াল কাজ করছিলো। গুঞ্জনের ফোন দেখে একটু বিরক্ত হয়ে রিসিভ করে করল। না করেও উপায় নেই কারণ কল ততক্ষণ দেবে যতক্ষণ না ধরবে। স্পন্দন ফোন কানে নিয়ে বলল,
--- " গুঞ্জন ব্যাস্ত আছি আমি এখন জ্বালিয়োনা।"
গুঞ্জন একটু ধমকের সুরে বলল,
--- " রাখো তোমার ব্যাস্ততা। আগে বলো ভালোবাসো আমায়?"
গুঞ্জনের ধমকে ওরা একটু পিছিতে গেছিলো পরে আবারও এসে কান পাতল। স্পন্দনও একটু চমকে গেছিলো পরে নিজেকে সামলে বলল,
--- " এর উত্তর আগেও দিয়েছি তোমায়। হ্যাঁ ভালোবাসি। আর উত্তরটা আজীবন একই থাকবে।"
গুঞ্জন বিরক্তিমিশ্রিত কন্ঠে কন্ঠে বলল,
--- " হ্যাঁ হ্যাঁ শুনতে শুনতে কান পঁচে গেছে। এবার বলো বিয়ে করবে কী না?"
স্পন্দন স্পষ্ট ভাবে বলল,
--- " নাহ।"
গুঞ্জন দাঁত করমর করে বলল,
--- " আবার বলো?"
স্পন্দন এবারেও বলল,
--- " নাহ মানে না। নো এন্ড নেভার।"
গুঞ্জন বিরক্তি নিয়ে বলল,
--- " ফোনটা লাউডে দাও তো?"
স্পন্দন জানে না দিলে কথা পেঁচাতেই থাকবে তাই লাউডেই দিয়ে বলল দিয়েছে। গুঞ্জন এবার চেঁচিয়ে বলল,
--- " খবিশ, ডেভিল, হনুমান বিয়ে করবেননা তাইনা। করতে হবেনা বিয়ে। যান ভার মে গিয়ে মরেন। স্টুপিড। দেখুন এবার আমি কী করি। হুহ। এবার যা হবে সেটার জন্যে আপনি দ্বায়ী।"
বলে ফোনটা কেটে দিলো। স্পন্দন বেকুবের মতো কিছুক্ষণ বসে থেকে মুখ দিয়ে শ্বাস ছেড়ে বলল,
--- " ডেঞ্জারাস।"
বলে ল্যাপটপ বন্ধ করে শুয়ে পরলো। এদিকে গুঞ্জনের দিকে সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। গুঞ্জন রাগে ফুসছে। মেঘলা বলল,
--- " কী করতে চাইছিস বলতো?"
গুঞ্জন হাতের ফোনটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,
--- " মহাভারতে ব্রহ্মাস্ত্রর কথা শুনেছো? এমন অস্ত্র যা কখনো বিফলে যায় না? সেটাই চালাবো এবার। কালকে সকালে বলে দেবো কী করতে হবে এখন গেলাম।"
বলে গুঞ্জন চলে গেলো আর ওরা সবাই ভাবছে যে এই মেয়ে কী করতে চাইছে?
____________________
স্পন্দন সন্ধ্যাবেলা অফিস সেড়ে বাড়িতে এসে দেখে কলিংবেল অনেক্ষণ বাজানোর পর সারা এসে খুলে দিলো। স্পন্দন ভ্রু কুচকে বলল,
--- " এতো লেইট হলো কেনো?"
সারা মূখটা গম্ভীর সাজার চেষ্টা করে বলল,
--- '' এমনিতেতো এতো সাধু হয়ে ঘুরে বেড়াস। তলে তলে এতো?"
স্পন্দন অবাক হয়ে বলল,
--- " মানে?"
-- "ভেতরে গেলেই বুঝতে পারবি।"
বলে ভেতরে চলে গেলো সারা। স্পন্দন ভেতরে ওদের ড্রয়িং রুমে ঢুকে অবাক। মিস্টার আর মিসেস চৌধুরীর সোফায় বসে আছেন আর ওনাদের মাঝখানে বসে গুঞ্জন হাতে পায়েসের বাটি নিয়ে পায়েশ খাচ্ছে। স্পন্দনকে দেখেই গুঞ্জন মূখে পায়েস নিয়েই মুচকি একটা হাসি দিলো। স্পন্দন ও আহম্মক হয়ে গেছে। এই মেয়ে এই বাড়িতে কী করছে? এতদিন যা যা করেছে সেটা কী কম ছিলো? যে এখানেও চলে এসছে? এবার কী করবে একমাত্র এই মেয়ে আর আল্লাহ ই জানেন।
.
.
.
চলবে......................................