বেলা বেশ অনেকটাই হয়েছে কিন্তু এখনো সম্পূর্ণ কাটেনি। প্রায় দশটার মতো বেজে যাওয়ার পরেও চারপাশটা ঝাপসা হয়ে আছে। ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে স্পন্দন। কাল রাত থেকে এক সেকেন্ডের জন্যেও চোখের পাতা এক করতে পারেনি। চোখ নাক লাল হয়ে আছে। কাল থেকে গুঞ্জনের ফোনে কল করে চলেছে কিন্তু ফোন বন্ধ বলছে। বারবার গুঞ্জনের বলা কথাগুলো মনে পরছে। কানে বাজছে কথাগুলো। গুঞ্জন কীকরে বলল কথাগুলো? একদিন আগে অবধি গুঞ্জনের আচরণে ও বুঝতে পারতো যে গুঞ্জন ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পরছে কিন্তু জাস্ট একটা দিনের মধ্যে কী এমন হয়ে গেলো যে গুঞ্জন এসব কথা বলল। এসব ভাবতে ভাবতে মাথা অলমোস্ট ধরে আসছে ওর। কী হচ্ছে কিচ্ছু বুঝতে পারছেনা। কিছুতো একটা হয়েছেই গুঞ্জনকে একদমি স্বাভাবিক লাগেনি ওর। কোনো তো কারণ আছে গুঞ্জনের এই আচরণের সেটা বেশ ভালোকরেই বুঝতে পারছে স্পন্দন। তবে যেই কারণই থাক না কেনো গুঞ্জন যেটা করেছে সেটা ঠিক করেনি। গুঞ্জনের প্রতি একটা চাপা ক্ষোভ ও জন্মাচ্ছে ওর। দীর্ঘসময় ধরে এসবই ভেবে চলেছে ও। বেশ অনেক্ষণ পর সারা এসে বলল,
--- '' ভাইয়া? তুই এখানে? তোকে সারা বাড়িতে খুজে মরছি। অনেক বেলা হয়ে গেছে ব্রেকফাস্ট করবি না?"
স্পন্দন বাইরের দিকে তাকিয়েই বলল,
--- " যা আমি আসছি।"
স্পন্দনের চোখ মুখ দেখে সারার কেমন জেনো লাগলো। তাই গিয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
--- " কী হয়েছে বলতো ভাইয়া? রাতে ঘুমাস নি মনে হয়?"
স্পন্দন এবারেও বাইরে চোখ রেখেই বলল,
--- '' কিছু হয়নি আমার। যা তুই এখান থেকে।"
সারা স্পন্দনের হাতের ওপর হাত রেখে বলল,
--- " আমাকেও বলবি না?"
স্পন্দন এবার একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
--- " গুঞ্জন আজ বলেছে ওর পক্ষে নাকি আমাকে কোনোদিন ভালোবাসা সম্ভব না। তারওপর এটাও বলেছে যে ওর সাথে আমার না মেশাটাই নাকি ভালো হবে।"
সারা অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,
--- " এগুলো গুঞ্জন নিজে বলেছে তোকে?"
স্পন্দন একটু রাগী কন্ঠে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
--- " হ্যাঁ কিন্তু এতোটা সাহস হয় কীকরে ওর? এভাবে কীভাবে বলতে পারে যে আমার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবেনা ও। হাউ?"
বলে খুব জোরে ওয়ালে একটা পাঞ্চ মারলো স্পন্দন। সারা বুঝতে পারলো যে ব্যাপারটা বেশ গুরুতর। কিন্তু স্পন্দনের মুড ঠিক নেই তাই একটু দুষ্টুমি করে বলল,
--- " কী অদ্ভুত তাইনা? যে স্পন্দন চৌধুরীর পেছনে মেয়েদের লাইন পরার সত্যেও সে পাত্তা দিতো না। সেই স্পন্দন চৌধুরী জাস্ট একটা মেয়ের জন্যে এতো দিওয়ানা হয়ে গেলো আর মেয়েটা ওকে রিজেক্ট করে দিলো? হাউ স্যাড তাইনা? ঘামান্ড চাকনাচুর কার দিয়া তেরা।"
স্পন্দন রাগে কটমট করে তাকাতেই সারা একটা ইনোসেন্ট বাচ্চেওয়ালী ফেস করে বলল,
--- " না মানে দেখ। তোর বউ হিসেবে একদম পার্ফেক্ট ই আছে। যেমন মিঞা তার তেমন বিবি ইকুয়াল ইকুয়াল। তুই ঠিকি বলিস এক্কেবারে ঝাঁসির রাণী।"
স্পন্দন নিজের হালকা হেসে দিলো সারার কথায়। সারা কিছুক্ষণ হেসে বলল,
--- " আম্মু ব্রেকফাস্ট টেবিলে ওয়েট করছে তোর জন্যে তাড়াতাড়ি চলে আয়।"
বলে সারা চলে গেলো। এরপর আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল যে ওকে গুঞ্জনে সাথে কথা বলতে হবে। আরো ক্লিয়ারলি কথা বলতে হবে। এতো সহজে সবকিছু শেষ করে দিতে পারেনা ও।
_____________________
গুঞ্জনকে আজ যেই দেখছে সেই অবাক হচ্ছে। কলেজ থাক বা অফ ডে থাক গুঞ্জন তো রোজ বের হয় আর সারাদিন বাইরেই থাকে। তবে আজ আর বাইরে যায়ই নি। সারাদিন বাড়িতেই ছিলো। বাড়িতে রোজ যতোক্ষণ থাকতো টিশার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে থাকতো। কিন্তু আজ একটা টিশার্ট আর লং স্কার্ট পরেছে। গলায় একটা স্কার্ফ ও ঝুলিয়ে রেখেছে। একদম বেশিই শান্ত লাগছে ওকে। গুঞ্জনের বাবা মা গুঞ্জনকে এভাবেই দেখতে চেয়েছিলেন কিন্তু আজ ওনাদের এটা ভালো লাগছে না। কারণ গুঞ্জনের এই হঠাৎ পরিবর্তনের কারণ যে ভয়ঙ্কর কিছু সেটা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে। আর মেঘলাও গুঞ্জনের এই হঠাৎ পরিবর্তনে বেশ চিন্তায় পরে গেছে। গুঞ্জন সোফায় বসে বসে পাশে ল্যাপটপ রেখে কানে ইয়ারফোন গুজে গান শুনছে। মেঘলা ওর পাশে এসে বসে বলল,
--- " কী হয়েছে তোর বলতো?"
গুঞ্জন কান থেকে ইয়ারফোনটা থামিয়ে একটু হেসে বলল,
--- " কী হবে আমার?"
মেঘলা এবার ভ্রু কুচকে খুব বিরক্ত হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
--- " দেখ বেশি স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করিস না। পোশাক চেঞ্জ করে ফেললি। নিজের আচার আচরণ সব চেঞ্জ হয়ে গেছে। কেনো?"
গুঞ্জন নিজের আঙ্গুলের নখ দেখতে দেখতে বলল,
--- " আমার ঐরকম লাইফস্টাইল তো অনেকেরই ভালোলাগে না তাই।"
মেঘলা এবার একটু বিরক্ত হয়ে বলল,
--- " তুই আবার কবে থেকে অন্যের মতামতের গুরত্ব দেওয়া শুরু করলি?"
গুঞ্জন একটু হেসে বলল,
--- " ধরে নাও আজ থেকে?"
মেঘলা খুব ভালোকরেই বুঝতে পারলো গুঞ্জন এখন ওকে কিছুই বলবে না তাই জিজ্ঞেস করেও লাভ নেই। তাই বেশি কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজে চলে গেলো। গুঞ্জন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবল, তুমি ভেতরের আমিটাকে ভালোবাসো স্পন্দন তাই হয়তো আমার বাইরের লুক নিয়ে তোমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এটাতো সত্যি যে তোমার মনে যেরকম মেয়ের ছবি আঁকা ছিলো তার ভেতরটা আমার সাথে মিলে গেলেও বাইরেটা আমার সাথে একদম মেলেনা। তোমার ভালোবাসতে নাইবা পারলাম, কিন্তু তোমার পছন্দগুলোকে আকড়ে ধরে বাকি জীবণটা কাটিয়ে দিতে পারবো। এসব ভেবে নিজেই নিজের ওপর হালকা হাসলো গুঞ্জন।
____________________
পরের দিন গুঞ্জন সিএনজি নিয়ে ভার্সিটি গেছে। ওকে মোটামুটি যারা চেনে সবাই বেশ অবাক। না সিএনজি করে এসছে তার জন্যেনা ওর ড্রেসাপ দেখে। সাদা লং গ্রাউন্ড, গোলাপি ওড়না। গুঞ্জনকে জেনো কেউ চিন্তেই পারছেনা। তবে ওকে এই রুপে দেখে ঘায়েল হওয়া ছেলেরও অভাব নেই। কলেজের পুরোটা সময় ওর বন্ধুরা অবাক হয়ে ছিলো। গুঞ্জন ওদের সাথে কথা বলেছে ঠিকই কিন্তু আগের সেই গুঞ্জনকে ওরা পায়নি। তবে গুঞ্জন বেশ স্বাভাবিক। ওর দেখে বোঝার উপায় নেই যে কিছু হয়েছে কী না। গুঞ্জন ক্লাস শেষে বেড়িয়ে দেখে স্পন্দন দাঁড়িয়ে আছে। গুঞ্জন পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই স্পন্দন বলে ওঠে,
--- '' গুঞ্জন দাঁড়াও।"
গুঞ্জন দাঁড়িয়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিয়ে পেছনে তাকিয়ে বলল,
--- " আমার মনে হয় আমাদের মধ্যকার সব কথা কালকেই শেষ হয়ে গেছে।"
স্পন্দন ভ্রু কুচকে গুঞ্জনের পা থেকে মাথা অবধি চেকআউট করে বলল,
--- " এসবমানে কী?"
গুঞ্জন বুঝতে পেরেও পাল্টা প্রশ্ন করে বলল,
--- " কোনসব?"
স্পন্দন ভ্রু কুচকে রেখেই বলল,
--- " হঠাৎ এরকম পোশাক কেনো?"
গুঞ্জন মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
--- " আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই।"
স্পন্দন গুঞ্জনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল,
--- " এনিওয়ে কথা আছে আমার সাথে।"
গুঞ্জন শক্ত কন্ঠে বলল,
--- " কিন্তু আপনার সাথে আমার শোনার বা বলার মতো আর কিছুই নেই।"
বলে চলে যেতে নিলেই স্পন্দন হাত ধরে আটকে দিয়ে বলল,
--- " সবকিছু তোমার ইচ্ছেতেই হবে তাইনা?"
--- " বিষয়টা যদি আমিকেন্দ্রিক হয় দেন অবশ্যই ইয়েস।"
বলে হাত ছাড়িয়ে চলে ওখান থেকে চলে গেলো গুঞ্জন কয়েকবার ডাকার পরেও সারা দিলোনা।
এভাবে আরো চারদিন কেটে গেছে। স্পন্দন অনেকবার ট্রায় করেছে গুঞ্জনের সাথে কথা বলার কিন্তু গুঞ্জন কোনো কথাই শোনেনি স্পন্দনের। এরকমভাবেই বারবার ইগনোর করেছে। গুঞ্জন এখন প্রায় অতিষ্ট হয়ে গেছে। স্পন্দনের কাছে গেলে ও দুর্বল হয়ে পরছে। কিন্তু স্পন্দনকে সেটা কীকরে বোঝাবে? আজ স্পন্দন বেশ রেগে আছে। আর এটাও ঠিক করে নিয়েছে যে গুঞ্জনের সাথে আজ একটা এসপার ওসপার করতেই হবে। খুব বেশি বাড়াবাড়ি করছে মেয়েটা। গুঞ্জন বারবারের মতো আজ ভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে সিএনজি এর জন্যে ওয়েট করছে ঠিক তখনি স্পন্দনকে দেখতে পেলো। স্পন্দনকে দেখে গুঞ্জন চলে নিলেই স্পন্দন এসে ওর হাত ধরে ফেলল। তারপর নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
--- " গুঞ্জন এভরিথিং হ্যাজ আ লিমিট। বেশি হচ্ছে কিন্তু।"
গুঞ্জন হাত ছাড়িয়ে বলল,
--- " দেখুন সিনক্রিয়েট করবেননা যেতে দিন আমাকে।"
বলে পাশ কাটাতে নিলেই স্পন্দন আবার ওর কাছে এনে কোমর চেপে ধরলো। গুঞ্জনের এবার আর সহ্য হলোনা। নিজের আর নিজের ভাগ্যের প্রতি রাগ, ক্ষোভ সব এবার গিয়ে পরলো স্পন্দনের ওপর। ও সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে জোরে একটা থাপ্পড় মেরে দিলো স্পন্দনের গালে। স্পন্দন গালে হাত দিয়ে শক্ত চোখে তাকালো গুঞ্জনের দিকে। গুঞ্জন চেঁচিয়ে বলল,
--- " কী পেয়েছেন কী আপনি হ্যাঁ? বাংলা বোঝেন না? বারবার আমার পেছন পেছন ঘুরছেন আমি পছন্দ করিনা তবুও। কী চান আপনি আমার কাছ থেকে। টাই পাসের জন্যে চান আমাকে আপনি নাকি ফিজিক্যাল ইন্টিমেন্সির জন্যে বলু.."
কথাটা শেষ করার আগেই খুব জোরে ধমক দিলো স্পন্দন গুঞ্জনকে। গুঞ্জন এইপ্রথম কারো ধমকে কেঁপে উঠলো। একদম চুপ হয়ে গেলো। এখন বুঝতে পারছে একটু আগে কী করে ফেলেছে ও। ও স্পন্দনকে চড় মেরেছ ভাবতেই এই হাতটা কেটে ফেলতে ইচ্ছে করছে এখন। কী করলো ও রাগের বসে? স্পন্দন নাক ঘষে নিজের রাগটা কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
--- " টাইম পাসের জন্যে মেয়ের অভাব স্পন্দন চৌধুরীর কোনোদিন হবেনা। আমি একটা তুরি মারলে মেয়েদর লাইন পরে যাবে। আর হ্যাঁ ফিজিক্যাল ইনটেমেন্সি চাইলে আরো আগেই সেটা পেয়ে যেতাম অনেকবার সুযোগ ছিলো আমার কাছে। এটাই চাওতো আমি তোমার থেকে দূরে সরে যাই? ফাইন! আজকের পর না তোমাকে জ্বালাতে আসবো আর না বিরক্ত করতে। ফ্রম টু ডে ইউ আর টোটালি ফ্রি। স্পন্দন চৌধুরী আর তোমার ধারেকাছেও আসবে না। প্রমিস।"
.
.
.
চলবে..........................................