ক্যাফেতে বেশি মানুষ নেই,যারা আছে তারাও বেশ দূরে দূরে বসেছে।এই ক্যাফেতে যারা আসে,তারা নিঃসন্দেহে কোয়ালিটি টাইম কাটানোর জন্যই আসে।ছবি তোলার মতো পর্যাপ্ত আলো এখানে নেই।মাঝখানে লার্জ কার্পেট সিলিং ল্যাম্প পুরো পরিবেশে প্রশান্তির ছায়া তৈরি করেছে।এমবিয়েন্ট ইন্ডোর লাইটিং এর আবছা আলো,সফট মিউজিক এবং গরম কফির সাথে মানুষ কোলাহলবিহীন শান্ত সময় কাটায় প্রিয়জন নিয়ে।ক্যাফেতে বসে থাকা বেশিরভাগ মানুষের চাইতে ভিনার বয়স কম।এখানে অধিকাংশ মানুষ কর্মজীবী এবং বাকীরা বয়স্ক দম্পত্তি।আজকে যার সাথে দেখা হওয়ার কথা,তার রুচি নিয়ে ভিনার কোনো সন্দেহ থাকলো না।
-- হ্যাভ আই মেড ইউ ওয়েট টু লং?
-- নো,হ্যাভ এ সিট প্লিজ।
কারো ভারী গলার ডাকে ভিনার ধ্যান ভাঙলো।টিল কালারের টি শার্ট এবং ওয়ার্ম ট্যান শেডের প্যান্ট পরা দীর্ঘদেহী এই ব্যাক্তিটির নাদিম মোস্তাক।পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার,বাবা মায়ের বড় ছেলে। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে বিয়ে করার জন্য।ভিনা বায়োডাটায় দেখেছিলো,নাদিমের বয়স বত্রিশ বছর,সে হিসেবে ভিনা থেকে প্রায় বছর দশেক বড়। প্রথম দর্শনে কিছুটা বুঝাও গিয়েছে বয়স,কিন্তু বাহ্য রূপ আকর্ষণীয়। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রং,চোখে ভারী চশমার ফ্রেম দেয়া,ঠোঁটের কোণে হাসি।ভিনা যা আশা করেছিলো,তার চেয়ে অনেক ভালোই পছন্দ করেছে তার বাবা সোহেল।ভিনার দিক সোহেল,মুনা এবং নাদিমের দিক থেকে তার বোন নাইদা এবং মা সবাই এই শপিং মলেই ঘোরা ফেরা করছে।তারা ভিনা এবং নাদিমকে আলাদা কথা বলার জন্য পাঠিয়েছে।আধুনিক পরিবার,আধুনিক আচার আচরণ।অন্য সময় হলে ভিনা কখনোই রাজি হতো না এভাবে দেখা করতে,কিন্তু সোহেলের কথা ভেবে সবকিছুতে সম্মতি দিয়ে রেখেছে।ডাক্তারের চেক আপে মাইল্ড স্ট্রোক ধরা পরেছে।ডাক্তার সাবধান করে দিয়েছে স্ট্রেসের ব্যাপারে।জীবন নিয়ে আশাহীন ভিনার কাছে,তাই এই বিয়ে সংক্রান্ত ব্যাপারে রাজি হওয়া কঠিন কিছু মনে হয়নি।নাদিমের খালুই এই প্রস্তাব এনেছিলো যখন সোহেলের কাছ থেকে ভিনার কথা শুনেছে।সবকিছু মিলিয়ে সোহেলের নাদিমকে পছন্দ হয়েছে। যদিও বয়সের পার্থক্য একটু বেশি,কিন্তু ভিনাও তো আর ছোট রয়নি।জীবনের কড়াঘাতে বয়সের আগেই বয়সী লেবাস ধরে গেছে মানসিকতায়।
ভিনা দৃষ্টি নামিয়ে চুপ করে থাকলো।অচেনা মানুষের সাথে কথা বলতে পারে না তা না।কিন্তু বর্তমানের পরিস্থিতি ভিন্ন।সামনে বসা মানুষটার সাথে ওর বিয়ের ভালো তোড়জোড় চলছে।চাইলেও আড়ষ্টতা ভাঙা সহজ না।
-- তুমি করেই বলি,অসুবিধা হবে?
-- না,কোনো সমস্যা নেই।
-- কফি খাও?
-- হ্যাঁ
নাদিম হালকা হাসি দিয়ে মেনু ভিনার দিকে বাড়িয়ে দিলো।আরেকটা মেনু ওয়েটার কে বলে চেয়ে নিলো।
-- যখন বাংলাদেশে ছিলাম,তখন একবার এসেছিলাম এখানে।এখানে কফির ভ্যারাইটি ইম্প্রেস হওয়ার মতো।তোমার খারাপ লাগবে না।
-- জায়গাটাই পছন্দ হওয়ার মতো।এত সুন্দর ইন্টারফেসে যেকোনো কফিই ভালো লাগবে।
-- তারপর বলো,পড়াশোনা কেমন চলছে?
-- ভালো
-- আমি শুনেছি তুমি অনেক ভালো ছাত্রী,ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড আই ওয়ান্ট টু আস্ক,তাড়াতাড়ি বিয়ে করার কোনো কারণ আছে?
-- বাবা চাচ্ছে,আর আমারো কোনো সমস্যা নেই।
-- বাবার প্রতি ভালোবাসা নাকি চাপ?
-- ভালোবাসা। একসময় তো আমাকে বিয়ে করতেই হতো,পার্থক্য শুধু আগে পরের।
-- কেন?এম্বিশন নেই কোনো?
-- আছে।তবে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছি। সুযোগ থাকলে অবশ্যই এম্বিশনের জন্য ছুটবো।
-- হাজবেন্ড পার্মিশন না দিলে?
-- কেন দিবে না সেটা জানার চেষ্টা করবো আগে।
-- এরপর?
-- এরপর বাবা মার দিকে তাকাবো।
-- তুমি নিজে?
-- আমার পরিবারই আমার সব।
দুইজনের কফিই এসে পরলো,সাথে ওয়াফেলস।নাদিম কফিতে চুমুক দিয়ে আবার ফিরলো ভিনার দিকে।
-- আমাকে কোনো প্রশ্ন করবে না?
-- না
-- কেন?
-- আপনার করা প্রশ্ন থেকেই আমার যা জানার জেনে নিয়েছি।
-- কথা কম বলো,তাইনা?
-- হ্যাঁ
নাদিম মাথা নাড়িয়ে হেসে ভিনার দিকে তাকালো।ভিনা এর অর্থ বুঝতে পারলো না ঠিক।এরপর পুরো সময় সেসব কথাই হলো,যা সাধারণত সব নতুন পরিচিত মানুষের মাঝে হয়।পছন্দের রং,খাবার বই,শিল্পী এবং অন্যান্য।
কথা শেষ হওয়ার পর নাদিম বিল দেয়ার সময় ভিনাও কন্ট্রিবিউট করতে চাইলো,নাদিম ভদ্রতার সামলে নিলো পরিস্থিতি।
-- আমার পছন্দের জায়গায়,আমার পছন্দের মেহমান।আজকে এটা করতে দিতে পারছিনা।
ভিনা জোরাজুরি করলো না।এরপর দুইজন মিলে বের হয়ে পরিবারের বাকীদের খুঁজতে গেলো।শপিং মলের একটি জুয়েলারি দোকানে সবাইকে খোশগল্প করতে দেখা গেলো।বিশেষ করে সোহেলের মুখের উজ্জ্বলতা সবারটা ছাপিয়ে যাচ্ছে।তাদের সবার সামনে আংটির বক্সের বাহার।ভিনা মুহূর্তেই বুঝে গেলো এখানে কিসের কেনাকাটা চলছে।পরক্ষণেই নাদিম আর ওর চোখাচোখি হলো।দুইজনই অস্বস্তিতে পরে গেলো,যদিও নাদিম হেসে 'কোনো ব্যাপার না' বলে পরিস্থিতি হালকা করতে চাইলো।
-- বাবা?এসব....
-- দেখ তো কোন আংটি পছন্দ হয়েছে?
-- এখনই আংটি কেন বাবা?
পেছন থেকে নাদিমের ছোট বোন নাইদা এসে হাত ধরে বললো--
-- এখনই আংটি পরাবে না,সুন্দর অনুষ্ঠান করে এনগেজমেন্ট হবে।
ভিনা কষ্ট করে হাসি ধরে রেখে বললো-
-- না মানে সব এত তাড়াতাড়ি....
-- কেন কেন?আমার ভাইকে পছন্দ হয়নি?একটু কালো কিন্তু ব্ল্যাক ডায়মন্ড বিশ্বাস করো।
ভিনা কোনো উত্তর দিতে পারলো না।প্রথম দেখায় এত বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবও অনেকসময় মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।দেখে মনে হচ্ছে নাদিম এবং তার মায়ের চেয়ে নাইদারই ভাইয়ের বউ আনার আগ্রহ বেশি।নাইদা নিজে বিবাহিত,যময পুত্রের জননী।বয়স ছাব্বিশ-সাতাশ হবে। ভিনার চেয়ে বড়,তবে আচরণে বোঝার উপায় নেই।নাইদার এই বাচ্চাসুলভ আচরণ দেখে তার মা নয়নিকা এগিয়ে এসে মেয়ের হাত চেপে ধরলেন।এরপর ভিনার কাঁধে হাত রাখলেন-
-- কিছু মনে করো না মা।আমার মেয়ে এখনো বাচ্চা রয়ে গেছে।আমরা এমনিই আংটি দেখছিলাম।
মুনা পাশে দাঁড়িয়ে ভিনাকে লক্ষ্য করছিলো।ভিনার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য শুরু থেকেই ছটফট করছেন।এমন না যে পরিবার পছন্দ হয়নি।নাদিমের পরিবার অনেক ভালো,মিশুক।তবু ভিনার এখন বিয়ে করার ইচ্ছা ছিলো না,নিজের বাবার জন্যই যে এমন করছে তা মুনা ভালোমতো বুঝতে পারছেন।বহুবছর আগের নিজের প্রতিচ্ছবি আজকে ভিনার মাঝে খুঁজে পাচ্ছেন তিনি।অনেক্ষণ চুপচাপ এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকার পর মুনা সামনে এগিয়ে এসে ভিনার দিকে তাকিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন-
-- জুয়েলারির দোকানে পর কত আসা যাবে!আজকে আমরা এমনি পুরো শপিং মল ঘুরে দেখি।কী বলো সবাই।
সবাই সায় দিলো নাইদা ছাড়া।এক নাইদাই জিদ করলো আংটি কিনে নেয়ার জন্য।নাদিম সবার সামনে যতটুকু সম্ভব বোনকে বুঝিয়ে বাইরে নিয়ে এলো। এরপর কিছুক্ষণ ঘুরে যে যার বাসায় চলে গেলো।রাস্তায় সোহেল মেয়েকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না,কিন্তু এক অদ্ভুত প্রশান্তি তার চোখেমুখে বিরাজ করছে।ভিনা বাসায় পৌঁছেই ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে বারান্দার টুলে বসলো।প্রিতি মেসেঞ্জারে অসংখ্য মেসেজ পাঠিয়ে রেখেছে।সব মেসেজেই অভিমান ভরা।আজকে এক মাসের উপর হয়ে গেছে ভিনা নিজের বাসায়ই,সবার সাথে থাকছে।প্রিতি জিজ্ঞেস করেও এর সদুত্তর পায়নি ভিনার কাছ থেকে।তাই ভেবেছে যে রেহান আর নিজের টোনাটুনির সংসারে ভিনা আনইজি ফিল করছে।কিন্তু ভিনা যে নিজের বিয়ের জন্য এ বাড়িতে এসে থাকছে,এটা জানে না।কারণ প্রিতি কোনোভাবেই এই বিয়ে হতে দিবে না।হাজারটা যুক্তি দাঁড় করাবে,সোহেলকে অনুরোধ করতে থাকবে।এর আগে প্রিতি ইন্ডিরেক্টলি বেশ কবার বুঝিয়েছে যে,রুশানের সাথে সব ঠিক করে ফেলতে,ভিনার জন্যই ভালো হবে।কিন্তু প্রিতি জানে না,রুশানের সাথে আর কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ভিনা নিজেই উপলব্ধি করে,রুশানের সাথে ওর কোনোভাবেই যায় না।সেজন্যই ভিনা প্রিতিকে বিয়ের সব ঠিক হওয়ার পর জানাবে।এতে প্রিতির সাথে সম্পর্কের অবনতি হবে নিশ্চিত। কিন্তু বিদেশে চলে কার মায়ায় দেশে আসবে?মায়া কমিয়ে ফেলাই কি ভালো না?
••••••••••••••
-- নাদিম এমন করে কিছু বলো না কেন তুমি?
-- দেখ নাদি,ঘরে যা করিস,করিস।বাইরে নিজের ভাইকে নাম ধরে ডাকবি না।আর ঐ মেয়ের সাথে এত গায়ে পরে যাচ্ছিলি কেন তুই?
-- মা দেখো,নাদিমকে বিয়ে করতে বলো তো!কত বয়স হয়ে যাচ্ছে ওর। কতদিন এভাবে করবে?
-- কিন্তু মেয়েটা তো ছোট অনেক।
-- কিসের ছোট,ভার্সিটিতে পড়ে!
নয়নিকা মোস্তাক মেয়ের সাথে না পেরে বিরক্ত হয়ে উঠে চলে গেলেন।স্বামী গত হওয়ার পর থেকেই নাদিম সংসারের দায়িত্ব নিজের উপর নিয়েছে।পালিয়ে বিয়ে করা বোনের সম্মান রক্ষা করার জন্য কত কাঠখোর পুড়িয়ে বড় অনুষ্ঠান করে বিয়ে দিতে হয়েছিলো সেই স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায়ই।এখনো শ্বশুরবাড়ি থেকে এই ফরমাস,ঐ ফরমাস আসতেই থাকে।মা বোনের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে শখ আহ্লাদ বেমালুম ভুলে গেছে।এই বছর অতি আদরের বোনের জেদের জন্যই দেশে এসেছে বিয়ে করার জন্য। যদিও মেয়েদের মন বোঝা অনেক কঠিন।আর বাস্তবতার জন্য বিয়ের মন ও উঠে গেছে।বাইরের দেশের যৌন আবেদনময়ীর অভাব নেই,আর দায়িত্ব আগে থেকে জীবনে অনেক আছে।তাহলে বিয়েটা করবে কেন?শুধু বোনের জন্য?
.
.
.
চলবে........................................................................