রুবি আপু আমাকে সাজাচ্ছেন। চমৎকার একটি তাঁতের শাড়ি পরিয়েছেন। সিম্পল সাজে, চুলগুলো খোঁপা করেছেন। সামনের দুপাশে কিছু চুল ছেড়েছেন। নিজেকে যখন আয়নায় দেখলাম প্রচন্ড অবাক হলাম। আয়নার সামনে এক নতুন আমি। একদম ভিন্ন। টানা কাজলে চোখ গুলো নিস্পাপ। খোঁপায় রয়েছে ফুলের মালা। স্বচ্ছল সেই মালায় কালো ঘন চুল ৷ রুবি আপুর ধাক্কায়,
রুম থেকে বেরিয়ে নিচের দিকে যাচ্ছি। অনুভূতির পাহাড় বুকে চেপে আছি। প্রত্যেকটি পদক্ষেপ জানান দিচ্ছে, কতটা ব্যকুলতা আমার বুকে। তাকে দেখার জন্য। তাকে অনুভব করার জন্য।
এইতো, সে দাঁড়িয়ে। সিঁড়ির শেষের দিক সে দাঁড়িয়ে। পড়নে অপরিসীম সুন্দর এক পার্পল পাঞ্জাবি। ভয়ানক সুন্দরে রুপান্তরিত আজ সে। চোখ ফেরানো দায়। তাও আমি চোখ ফোরালাম। তার সেই শান্ত চাহনি কেমন অদ্ভুত নেশাময়। কখনও সক্ষম হবোনা সেখানে তাকানোর। ধীরে নামছি। শেষের দিক আসতেই, সে তার ডান হাত আমার দিক এগিয়ে দিলেন। অস্থিরতা রেখে ধীরে তার হাতে নিজের হাত রাখলাম। সে আমার হাতে তার ঠোঁট ছোঁয়ালেন।
ধীর কন্ঠে জানালেন,
' আমার স্বপ্নের প্রেয়সী আজ বাস্তবে । '
চোখ শক্ত করে বন্ধ করে নিলাম। এই অনুভূতি খুব যন্ত্রণাদায়ক। শ্বাস আটকে আসছে। তীব্র হার্টবিট নিয়ে আবেগী চোখে তার পানে চেয়ে। মধুময় এই সময় যেন থমকে যায়। সারাজীবনের জন্য থমকে যায়। সে শক্ত করে হাত ধরলেন। পাশাপাশি হেঁটে বেরোচ্ছি দু'জন। বাইকে উঠার সময়, সে কোমরে স্পর্শ করে উঠতে সাহায্য করলেন৷ আদুরে ভাবে চোখ বন্ধ করে ফেললাম । তারপর ধীরে পেছন হতে দু'হাত তার দু'পাশে ছোঁয়ালাম। সে বাইক স্টার্ট দিলেন। বাইক চলছে। দুজন বেরিয়ে পড়লাম অজানা উদ্দেশ্যে।
নির্জন এক স্থানে পৌঁছেছি। প্রকৃতির অপরিসীম ছোঁয়া চারপাশে। সে ঘুরে আমাকে ছুঁয়ে দিলেন। অনুভূতির জ্বালে, চোখ বন্ধ করে ফেললাম। অনুভব করলাম তার ঠোঁট ক্রমশ আমার ঠোঁট বরাবর আসছে। এইতো ছুঁই ছুঁই। শাড়ি শক্ত করে চেপে ধরলাম।
তার হুসকি ভয়েস,
' ভালবাসি। '
চোখ বন্ধ করে আমি তার স্পর্শের অপেক্ষায়। হঠাৎ,
' অরু? দ্রুত উঠ। কাজ আছে। '
লাফ মেরে উঠে বসলাম। বুকের তীব্র ধুকপুক চলছে। পেটে অদ্ভুত যন্ত্রণা হচ্ছে। এখনও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় আমি। চারপাশ ঘোলাটে লাগছে। আবারও চোখে ভাসছে তন্ময় ভাইয়ের পাঞ্জাবি পড়া মুখ। ইশ। স্বপ্ন দেখছিলাম? সব স্বপ্ন ছিলো? তাহলে তার স্পর্শের সেই অনুভূতি, এখনও এমন তাজা কেন? মনে হচ্ছে সে আমাকে ছুঁয়েছে। অদ্ভুত ভাবে।
রুবি আপু অবাক কন্ঠে বললেন,
' কী'রে? হয়েছে কী? '
লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম। রুবি আপু না ডাকলে, চুমুটা। উঁহু। বালিশে মুখ চেপে নিলাম। ভাবতেই শরীর শিউরে উঠছে। এমন অদ্ভুত স্বপ্ন আমি দেখছিলাম। মুখ দেখানোর ও যায়গা নেই এখন। এ কী হচ্ছে আমার। কী হচ্ছে আমার সাথে। মাথা উঁচু করে,
ছলছল নয়নে আপুর দিক তাকালাম। রুবি আপু কপালে হাত ছোঁয়ালেন,
' জ্বর এসেছে নাকি? নাতো নেই। অসুস্থ লাগছে নাকি? পিরিয়ড হয়েছে? '
বিরক্তিকর স্বরে বললাম,
' ধুর, না। '
' তাহলে এমন সাইকো-সাইকো বিহেভিয়ার কেন? '
তাজ্জব বনে গেলাম।
' সাইকো বিহেভিয়ার? আমার এগুলো সাইকো বিহেভিয়ার
লাগছে? '
' তো? পাগলের মতো গুনগুন করছিস। বালিশ চেপে আছিস।
একটু একটু হাসছিস। আবার লজ্জায় লাল ও হচ্ছিস।
সাইকো'ই তো লাগছে। '
হঠাৎ আমার কাছাকাছি আসলেন। অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
' কী'রে তন্ময়'কে নিয়ে আবার খারাপ স্বপ্ন দেখিস নি তো? '
' ছিইইইইইইইইইইই। গেইট আউট। '
আপু হাসছেন। দ্রুত ওয়াশরুমে দৌঁড়ালাম। কি একটা অবস্থা।
ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে দেখলাম, দীপ্ত বিছানায় বসে। হাতে চকলেট কোণ।
' কে এনেছে? '
চাপা স্বরে বলল,
' তন্ময় ভাই। '
জোরে চেঁচালাম,
' কে? '
কান দু'হাতে চেপে জবাব দিলো,
' বাড়িতে কয়টা তন্ময় ভাই? '
আমার দৌঁড় আর কে দেখে। দৌঁড়ে তার রুমে উঁকি দিলাম। নেই সে। আবারও ঘুরে নিচে নামলাম। সেখানেও নেই। আশপাশে খুঁজলাম, নেই তো। রেগে রুমে গেলাম। দিলাম দীপ্তর মাথায়
থাপ্পড়। রাগী কন্ঠে বললাম,
' একদম এই বিষয় নিয়ে ফাজলামো করবি'না। কখনও না। '
এতো প্রত্যাশা নিমিষেই ভেঙে গেল। এ যে কতটা কষ্ট, তা যদি দীপ্ত বুঝতে পারতো।
দীপ্ত চোখ কুঁচকে ফেলল,
' ইনফরমেশনও দেব না তোমায় আর। গেলাম। '
ওর গেঞ্জি টেনে ধরলাম। আবারও প্রত্যাশাময় চোখ দুটো দেখিয়ে প্রশ্ন করলাম,
' মিথ্যে কেন বললি? '
বিরক্তি নিয়ে জবাব দিল,
' উফ। তুমি পুরো কথা শুনলে কই? '
অস্থির গলায় বললাম,
' আচ্ছা। শুনছি, বল। '
' ভাই মেইনগেইটের সামনে। দারোয়ান নানা'র সঙ্গে কথা বলছেন।'
আবারও দৌঁড় লাগালাম। পেছন থেকে দীপ্ত চেঁচাচ্ছে,
' এভাবে যেও না, তার বন্ধুরা এসেছে সাথে। তোমাকে ভাই আস্ত গিলে ফেলবে। '
না থেমে আমি রাস্তা বদলালাম। ছাঁদে চললাম। ওখান থেকে তো আর দেখবে না। গিয়ে দেখলাম রুবি আপুও দাঁড়িয়ে। মিষ্টি হেসে তাকিয়ে। ওহ। তারমানে ইব্রাহিম ভাইও এসেছেন?বাব্বাহ। আমিও পাশে দাঁড়ালাম। ওইতো সে দাঁড়িয়ে। সকালের স্বপ্নের লোক। স্বপ্নে আমাকে হেনস্তা করে, কত সুন্দর করে দাঁড়িয়ে। সে এতো সুন্দর কেন? রুবি আপু চমকে উঠলেন,
' কখন এলি? '
' মাত্র। তুমি জানতে ইব্রাহিম ভাই আসবে?'
' না৷ দীপ্ত জানালো। '
তারপর আমার দিক ফিরলেন। সামনে গিয়ে দোলনায় বসলেন। আমি তখনও তন্ময় ভাইয়ের দিক তাকিয়ে।
' তন্ময় জানলে খুবই রাগবে। '
জিজ্ঞেস করলাম,
' কোন বিষয়ে? '
' এইযে সুমনা ব্যাপার। '
আমিও সহমত। সে পূর্ব হতেই সুমনা'কে তেমন পছন্দ করেন না।
এখন যদি, এগুলো শুনেন। এবার রাগবে না। বোমা ফাটাবে বাড়িতে।
তার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। তন্ময় ভাই আগে তার রুমে আসবেন। এসে ফ্রেস হবেন৷ কাজ শেষ করে, নিচে নামবেন। তার আরেকটি ভালদিক হচ্ছে, সে রুমে মানুষ আনেন না। মানুষ বলতে, তার বন্ধু বা ভাই-ব্রাদার। তারা আসলে ড্রয়িংরুমে বা ছাঁদ। ছাঁদে তাদের নিলে সে আগেই বলে যাবে, কেউ যেন ছাঁদে না উঠে। এইদিক গুলো বড্ড কিউট। দেখলাম সে আসছে। দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। ওড়না ঠিক ভাবে ছড়িয়ে নিলাম। সে আমাকে লক্ষ্য করে, ভ্রু উঁচু
করলেন। আমতাআমতা করে বললাম,
' নিচে নামছিলাম। '
' দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, নিচে নামছিলি? '
' হ্যাঁ। মানে, আপনাকে দেখে দাঁড়ালাম। কিছু লাগবে আপনার? '
সে আমাকে টপকে ভেতরে ঢুকলেন। সাহস জুগিয়ে পেছন-পেছন আমিও ঢুকলাম। কি সুন্দর গোছানো রুমটি। এখানে যে একজন ব্যক্তি বসবাস করেন, তা অবিশ্বাস্য মনে হবে। একটু ময়লা নেই। ক্লিন একদম। এতো সুন্দর ভাবে ক্লিন তো আমার রুমও নেই। এদিকসেদিক কাপড় পরে আছে হয়তো। ঘুম থেকে উঠে বিছানাও গুঁছিয়ে আসিনি। হাহ। সে তার হাতের ব্যাগ ড্রেসিংএ রাখলেন। একেএকে হাত ঘড়িও খুলছেন। বললেন,
' আপাতত কফি খাওয়াতে পারিস। '
একটুও রোমান্টিক না। ধুর। কোথায় একটু মিষ্টি কথা বলবে।
' কফি? '
' হু। '
আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। কফি কেন? মধু আনি।
তন্ময় ভাই আমার দিক ফিরলেন।
' কি হয়েছে? '
' না, যাচ্ছি। '
সে পিছু ডাকলেন,
' ওড়না ঠিক ভাবে নে। চুল বেঁধে যা। নিচে মেহমান আছেন। '
হু। এগুলো মনে থাকে?
ইব্রাহিম ভাইকে সেই খাতির করা হচ্ছে। বড় মা পরপর যা আছে বাড়িতে সব সার্ভ করছেন। আমাকে দেখতেই পাশে বসতে ইশারা করলেন। আমি বসলাম। ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
' আমার উনি কই? '
দুষ্টু স্বরে বললাম,
' আপু আপনাকে অলরেডি দেখেছে। '
' সত্যি? কীভাবে? '
' ছাঁদে দাঁড়িয়ে একধ্যানে শুধু আপনাকেই দেখেছে। '
বড় হাসি তার ঠোঁটে ঝুলে।
' ওয়াও। ডেকে আনো না। প্লিজ। '
' কী পাব আনলে? '
' যা চাইবে। '
' ইশ। মিথ্যুক। '
' সত্যি। '
' ঘুরতে নিতে হবে আমাদের। '
' ওয়াও। এটা তো আরও উত্তম। অবশ্যই। '
দীপ্ত'কে ইব্রাহিম ভাই নিজের কাছে বসালেন। বাড়ির সম্পর্কে ওর পড়ালেখা নিয়ে সকল প্রশ্ন করছেন। তেমনি দীপ্ত উত্তর দিচ্ছে। বাহ। দীপ্ত জিজু পেয়ে গেল।
রান্নাঘরে হাজির হলাম। কাউকে না পেয়ে নিজের মাতব্বরি শুরু করলাম। গরম পানি মগে ঢালতে গিয়ে, হাতে ফেলেছি। সাথে সাথে জ্বলে উঠলো। আরেকটু হলেই হাত পুড়ে যাচ্ছিলো প্রায়। কোথা থেকে মা দ্রুত আসলেন। হাত ধরে পানিতে চুবিয়ে দিলেন। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি এনে, হাতে ঢালছেন। সে অতপর আমাকে বকছেন,
' এতো বড় হয়েছে, এখনও ঠিক ভাবে একটা কাজ করতে পারেনা।
পাতিল হতে পানি হাতে কেমনে পড়ে? হ্যাঁ? '
আমি আদুরে চোখে তার দিক তাকিয়ে। মা তো মা'ই হোন।
ছোট চাচী মলম আনলেন পোড়ার। হাতে লাগিয়ে দিলেন।
' হায়রে অরু। তোর কপাল ভালো। নাহলে অন্য বাড়ি বিয়ে হলে,
শ্বাশুড়ি দ্বিতীয় দিন ফেরত পাঠাতো। ভাগ্যিস বেঁচে গেলি।'
আমি লজ্জা পেলাম। আবারও পানি ধরতে যেতেই, মা ধমকে দিলেন,
' কী করবি? '
' কফি। তন্ময় ভাইয়ার জন্য। '
মা হাসছেন। আঁড়চোখে তাকিয়ে বললেন,
' আমি বানিয়ে দিচ্ছি। '
পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা আমার একটু রাগী।
ভাইদের অনেকটা ভালবাসেন। তাতে কী? মা তো আমার? দিন শেষে সেই ভালো তো আমাকেই বাসেন।
.
.
.
চলবে....................................