ঘুম থেকে উঠে আমি বাড়ি তন্নতন্ন করে মা'কে খুঁজছি। মনের ভেতরে কু ডাকছে। সৃষ্টিকর্তার কাছে অপরিসীম অনুরোধ করে যাচ্ছি, সবকিছু স্বপ্নের পাতায় লুকিয়ে থাকুক। এই জঘন্যরকম
শাস্তি সৃষ্টিকর্তা আমাকে না দেন যেন। আমার পাগলামো দেখে, আবারও ডাক্তার ডাকা হলো। সকলে আমাকে বোঝাতে অক্ষম, যে আমার মা আর বেঁচে নেই। তিনি কখনও ফিরবেন না। তাকে আমি কখনও ছুঁতে পারবো না, দেখতে পারবো না।
শরীরের ক্লান্তি'কে রেহাই দিল, ঘুমের ইঞ্জেকশন। এই অসীম পাগলামি'র খেলায় আমি আমার তন্ময় ভাইয়ের শুকনো চেহারা দেখতে পেলাম। তাকে বলতে চাইলাম, মা'কে এনে দিন।
কিন্তু বলতে পারলাম না। শুধু তার চেহারা দেখেই চোখ বুঝে ফেললাম। চোখের জল, ঘুমের ইঞ্জেকশনও থামাতে পারলো না।
ঘুমে তলিয়ে গেলেও, চোখের জল ফুরোয় নি।
স্পষ্ট অনুভব করছি কারও ভালবাসার স্পর্শ। তার ঠোঁটের ছোঁয়া আমার কপালে। হাতে হাত চেপে রয়েছে। পরপর শুধু মাথায় হাত বোলাচ্ছে। দ্রুততম নেওয়া তার নিশ্বাস গুলো শুনতে পাচ্ছি। তার অতি ধীর আওয়াজ। যেই আওয়াজে বিরাজমান অপরিসীম অনুভূতি।
- অরু?
পাপড়ি কাঁপছে। ঘুমের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। ঘুম ভেঙে আসছে। অনেক সময় অতিবাহিত হয়েছে হয়তো। মাথা শক্ত হয়ে আছে। নড়ানো যাচ্ছে না। তন্ময় ভাইয়ের শুকনো চেহারা। তার এমতাবস্থা দেখতে অভ্যস্ত নই আমি। তিনি দ্রুত স্যালাইন খুলে দিলেন। গালে স্পর্শ করলেন,
- অরু?
তার কন্ঠ। তার আবেদনময়ী কন্ঠে আজ বিচলিত অনুভূতি। একধ্যানে তার চোখে তাকিয়ে। কেমন শুকিয়ে তার চেহারা। প্রতিদিনের মতো জ্বলজ্বল করছেনা। ক্লান্ত হয়ে আছেন। নিশ্চয়ই ঘুমাননি। অথচ, আমি ঘুমিয়ে নিলাম পরপর। কোনো শব্দ করতে পারছিনা। না পারছি তাকে ছুঁয়ে দিতে। কষ্ট হচ্ছে তীব্র। বুকের সেই আর্তনাদ আবারও ভেসে আসছে। চোখের জল আবারও ভিড় করছে।
তন্ময় ভাই আমাকে উঠিয়ে বসালেন। তাকে সামনে পেয়ে বাঁধ ভাঙতে ইচ্ছে হচ্ছে। কান্নার বাঁধ। তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। কেঁদে ফেললাম। ঘেষে পড়লাম তার বুকে। তিনি আমাকে শক্ত করে ধরলেন। অভিযোগ গুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে। বারবার আমার বলাতে ' মা এনে দিন, আমার মা এনে দিন। ' তিনি নেতিয়ে উঠলেন। তার লালচে চোখ গুলো দেখে মনে হচ্ছে, এই কেঁদে দিবেন। আমার অস্থির কান্নার আওয়াজে তিনি আরও কিছুটা শক্ত করে ধরলেন। মুখের সামনে থেকে চুল সরিয়ে দিলেন।
ভাঙা কন্ঠে বলতে লাগলেন,
- এভাবে করলে হবে? আমরা সবাই কী সারাজীবন থাকব? হু? যেতে তো হবে। একদিন আগে বা পরে। আর চাচী ছিলেন সৎ মনের। ভালো মানুষদের সৃষ্টিকর্তা দ্রুত নিয়ে যান। তারা সৃষ্টিকর্তার প্রিয়। তুই এভাবে কাঁদলে, চাচী কতটা কষ্ট পাবেন। কাঁদে না।
- হতে হবেনা তাকে সৎ। সৎের পরিনাম এই হলে , লাগবে না। এনে দিন মা'কে। আমি মা'র কাছে যাব।
- লক্ষি না তুই আমার? হু? কথা শোন, এখন খেতে হবে।
খাবার খাওয়া আমার দ্বারা সম্ভব না। একদম না। গলা দিয়ে যাবে না। বাবা কোথায়? তার কী অবস্থা? তন্ময় ভাইয়াকে প্রশ্ন করলাম আকুলতা নিয়ে,
- বাবা?
- প্রেসার বেড়েছে প্রচন্ড। বাবা নিজে গিয়ে খাইয়েছে। ঘুমের টেবলেট দিয়েছে। আপাতত ঘুমাচ্ছে। এখন তুই খাবি।
বড় মা এসেছে খাবার নিয়ে। আমাকে দেখতেই কিছুক্ষণের মাঝে তার শুকনো চেহারা আবারও ভিজে আসছে চোখের জলে। কোনভাবে চোখের জল মুছে তন্ময় ভাইকে বললেন,
- আব্বা, এখন গোসল নে। যা। কিচ্ছু খাস নাই। যা, আমি আসতেছি।
তিনি আবারও আমার দিক তাকালেন। শক্ত হাতে চোখের পানি মুছিয়ে দিলেন,
- খেয়ে নে। আমি আসছি।
খাবনা, খাবনা করেও জোরপূর্বক খাওয়ালেন বড় মা। খেতে গিয়েও পারছিনা। চোখের জল বেয়েই যাচ্ছে। খাওয়াতে খাওয়াতে বড় মা'ও কেমন কাঁদছে। এক হাতে আমাকে জড়িয়ে রেখেছেন। মা'য়ের চেহেরা ভাসতেই খাবার আর গিলতে পারছিনা।
এইযে বড় কষ্ট। তীব্র কষ্ট।
এহসান আর মারজি এসেছে। সাথে ওদের মা-বাবা। ওরা কাল ও এসেছিল। অজ্ঞান ছিলাম বিদায় চলে যেতে হয়েছিল। মারজির আম্মু আমার পাশে বসলেন। আমাকে বোঝালেন। মাথায় হাত রাখলেন। বললেন,
- সব ঠিক হয়ে যাবে মা। ভেঙে পড়িও না। এখন তোমার বাবাকে তোমার সামলাতে হবে। তার তো আর সন্তান নেই। তুমি তার একমাত্র রাজকন্যা। তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে, তাকে কে দেখবে?
শক্ত হতে হবে, এখন যে আছে তাকে আগলে রাখতে হবে।
সত্যি তো। আমিই তো তার সম্বল। কে আছে আর বাবার? আমাকেই তো তাকে দেখতে হবে।
বড়দের সাথে কথা বলার জন্য তারা চলে যাচ্ছেন।
মারজি দ্রুত এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আদুরে কন্ঠে বলল,
- কাঁদলে হবে? এখন অনেক অনেক দোয়া করতে হবে আন্টির জন্য। তুই কাঁদলে আন্টি আরও কষ্ট পাবেন। কাঁদে না।
বাচ্চাদের মতো আমাকে বোঝাচ্ছে। অথচ আমি বুঝতে নারাজ। একদম নারাজ।
রাতের দিক বাবা আসলো। উঠে বসলাম। একধ্যানে তার দিক তাকিয়ে রইলাম। শুকনো চেহারা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি ভালো নেই। বড্ড কষ্টে। হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে হয়তো। পাশে বসলেন। বাবাকে জড়িয়ে ধরতেই, বাবা কেমন ভেঙে পড়লেন। বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিলেন। মাথার ক্রমাগত হাত বোলাতে বললেন,
- আমি আছি তো। আমার জন্য তুমি আর তোমাত জন্য আমি। থাকবে না বাবার সাথে?
- হু।
- এইতো। আর কাঁদে না।
বাবা বসেই রইলেন। তার পায়ে মাথা রাখলাম। মাথাটা ভাড় হয়ে আছে। মাথা তুলতে কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ সব পরিবর্তন হয়ে গেলো।
বাড়িটা নিস্তব্ধতায় ঘিরে। এইযে আমাদের বাড়ি না। ভিন্ন বাড়িতে রুপান্তরিত হয়ে আছে।
পরপর দিনগুলো নিস্তব্ধতায় গেল। কয়েকদিনের মাঝে তন্ময় ভাই অনেকবার চেষ্টা করলেন, বাহিরে নেওয়ার। তিনি আমাকে নিতে অক্ষম। আজ ঢাকা থেকে এলেন মাত্র। এসেই শক্ত গলায় বললেন,
- তৈরি হ।
বসেই রইলাম। তিনি হাতে টান মেরে ওঠালেন। গাল টেনে ধরলেন,
- এক্ষুনি যা।
ধীরে বললাম,
- যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
- হবে। যা তৈরি হ। নাকি,
তিনি আমাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে নিলেন,
- আমি যাব সাথে?
চোরা চোখে তাকালাম। গাল গরম হয়ে উঠছে। উনার সাথে পেরে উঠব না। তাই আপোষে চলে গেলাম। তৈরি হওয়ার মতো ইচ্ছে নেই।
ড্রয়িংরুমে সেই আগের মতো সকলে। বড় মা রান্নাঘরে। ছোট চাচী ডাইনিং গোছাচ্ছে। শুধু মা আর নেই। এখন থাকলে, হয়তো সোফা, টিভি পরিষ্কার করা শুরু করতেন। সিঁড়ি ঝাড়ু দিতেন, মুছতেন।
আমাকে ধমক দিতেন। এটা করবি না, ওটা করবি না। চোখ বুঝে ফেললাম। বড় চাচ্চু নিউজ পেপার পড়ছেন। আমাকে দেখে ইশারা করলেন যেতে। আমি তার পাশের সোফায় বসলাম। নিউজপেপার পাশে রেখে, মাথায় হাত রাখলেন। শান্ত কন্ঠে বললেন,
- তন্ময়ের সাথে ঘুরে আস। ভালো লাগবে। মাইন্ড ফ্রেস হবে।
মাথা দোলালাম। তন্ময় ভাই হাজির। বাইকের চাবি সাথে বাইক নিয়ে বেরোবে বুঝি? আমাকে পিছু আসতে বললেন। বড় মা হাত ধরে, সাবধানে যাবার পরামর্শ দিলেন। জবাবে ' হ্যাঁ ' বললাম।
দারোয়ান নানা, কেমন আমাকে দেখে চুপসে গেলেন। কিছু বলতে চাচ্ছেন। তন্ময় ভাইয়ের দিক তাকিয়ে আর ভাবা কথাটা বললেন না। বরং চমৎকার হেসে ঘুরিয়ে বললেন,
- মহামুনি, ঘুরে দ্রুত আসবা। নতুন রুপে ফিরবা। সকলে মিলে একত্রে খেলব।
হাসলাম। আসলেই কিছু মানুষের মন খুবই সরল হয়। একদম পানির মতো। তন্ময় ভাই বাইক বের করেছেন। ধীর কন্ঠে আওয়াজ দিলেন,
- উঠ।
আমি উঠলাম। বললেন,
- ভালভাবে বস। ওড়না গলায় পেঁচা।
- পারব না। এভাবেই থাকুক। কিছু হবেনা।
পেছনে ঘুরে চোখ রাঙালেন।
- দ্রুত, কর।
উপায় না পেয়ে ঠিকঠাক হলাম। বাইকে উঠলে কত কিছু সামলাতে হয়।
.
.
.
চলবে...................................