প্রহেলিকা - পর্ব ৩৭ - আশফি শেহরীন চিত্রা - ধারাবাহিক গল্প


কলেজ শেষে ইনশিতা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে দশ মিনিট। জেহেরের আসার খবর নেই। ইনশিতা ভাবল সে ট্যাক্সি করে চলে যাবে। ঠিক সেই মুহুর্তে জেহেরের গাড়ি এসে থামে তার সামনে। ইনশিতা উঠে পড়ে। ইনশিতা দেখে জেহের গাড়ি না চালিয়ে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে তার দিকে। জেহেরকে এবার সে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে। তাকে খুব অগোছালো লাগছে। চোখমুখ কেমন যেন দেখাচ্ছে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে বারবার। ঘোলাটে নীল চোখ। 

-“আপনার কী হয়েছে? দেখতে কেমন যেন লাগছে।”

ইনশিতার কথা শেষ হতে না হতেই জেহের তাকে জড়িয়ে ধরল। হতবাক ইনশিতা। জেহের শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ইনশিতাকে নিজের কোলে এনে ফেলল। 

-“কী করছেন? ব্যথা পাচ্ছি।”

জেহেরের হাতের বাঁধন আরো শক্ত হলো। বলতে লাগে, 

-“আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না, কোনদিন না।”

-“আরে কোথায় যাবো? কী সব যা তা বলছেন? মাথাটা পুরো গেছে নাকি?”

ইনশিতার মুখটা জেহের দুহাতে তুলে বলল, 

-“বলো, আমাকে ছেড়ে কোনোদিন যাবে না। আমাকে সবসময় ভালোবাসবে। আ-আমাকে খুব ভালোবাসবে রোজ।”

সবকিছু ইনশিতার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ইন‌শিতাকে চুপ দেখে জেহের জোরে ধমকে উঠল, 

-“কী হলো বলো?”

জেহেরের ধমকে কেঁপে ওঠে ইনশিতা। সামলে উঠে মিনমিন করে বলল, 

-“আপনাকে ছেড়ে কেন যাবো? আপনাকে আমি ভালোবাসি জেহের। আপনাকে ছাড়ার কথা এ জন্মেও ভাবতে পারি না।”

জেহের স্বস্তি পেল এই কথায়। ইনশিতার মাথা বুকে চেপে একা একা বিড়বিড় করতে লাগে সে, 

-“আমিও তোমাকে ভালোবাসি রোজ। খুব বেশি ভালোবাসি। তোমাকে আর কেউ ভালোবাসতে পারবে না, যে বাসবে তাকে শেষ করে দেবো আমি। সব শেষ করে দেবো...”

বিড়বিড় করতে করতেই সে গাড়ি স্টার্ট দিলো। 

-“ছাড়ুন। বসবো।”

জেহের ছাড়ল না। এক হাতে ইনশিতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজের কোলে বসিয়েই গাড়ি চালাল বাড়ির রাস্তায়। 

.

.

রাতে জেসমিন চৌধুরীকে দেখা গেল প্রায় উদ্ভ্রান্তের মতোই কোথাও একটা ছুটে যেতে। একটু আগেই ল্যান্ড লাইনে কল এসেছিল। সেই কল পেয়েই ঘরের পোশাকে চলে গেলেন কোথাও। ইনশিতা তখন রান্নাঘরে রাতের খাবার তৈরি করছিল। জেসমিন চৌধুরীকে এভাবে যেতে দেখে সে বিস্মিত। কিছু বলার সুযোগই পেল না। রান্না রেখে সে আফজাল চৌধুরীকে ফোন করে জানাল জেসমিন চৌধুরীর যাওয়ার ব্যাপারটা। তার এক ঘন্টা বাদে আফজাল ফোন দিয়ে জানালেন জিহাদকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে। অবস্থা খুবই শোচনীয়। পায়ের হাড় ভেঙে গেছে, ঘাড় মচকে গেছে কিছুটা। জানা যায় দুপুরেই নাকি জিহাদকে জেহের এসে হকিস্টিক দিয়ে মারা শুরু করে। পুলিশ কিছু করার আগেই সে ভেতর থেকে লোহার গেট বন্ধ করে দেয়। পরে কষ্টে দরজা খুলে জিহাদকে উদ্ধার করে হসপিটালে নেওয়া হয়। আর জেহের পুলিশকে হুমকিও দেয়। এখন জেসমিন খবর পেয়ে হসপিটালেই ছুটে গেছেন। 

সবটা শুনে ইনশিতা থ। তার মানে জেহের তখন আলুথালু বেশে জেল থেকেই এসেছিল! তখনই জেহের শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে নেমে আসে। রোজকে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে। 

-“হোয়াট হ্যাপেন? স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

ইনশিতা বিস্ময় কাটিয়ে প্রশ্ন করল, 

-“আপনি তখন জিহাদকেই মেরে এসেছিলেন তাই না?” 

জেহেরকে নির্বিকার দেখাল। ভাবলেশহীন সুরে বলল, 

-“হ্যাঁ তো?”

জেহেরকে নির্বিকার দেখে ইনশিতা আরো বিস্মিত হলো। 

-“আপনার কাছে এটা স্বাভাবিক লাগছে? মারতে গেলেন কেন?”

-“ও তোমাকে কী বলেছিল মনে নেই? তোমাকে নাকি ভালোবাসে, তোমাকে থেকে যেতে বলেছে, আপন করে নিতে বলেছে, হাউ রিডিকিওলাস! এসব আমার সহ্য হয়নি, তাই মেরেছি ব্যস!”

ইনশিতা বড় বড় চোখ করে তাকাল। 

-“আ-আপনি কী করে জানলেন এসব?”

-“তোমার কলেজে খোঁজ নিলে জানতে পারি তুমি যাওনি। পরে গার্ডসদের বললে তারা জানায় তুমি মি. অ্যান্ড মিসেস চৌধুরীর সাথে জিহাদের সাথে দেখা করতে গিয়েছ। অফিসের পথে না গিয়ে আমি ওখানে যাই আর তোমার আর জিহাদের সব কথা শুনতে পাই। দ্যান তুমি চলে আসার আগেই তোমার কলেজে এসে পড়ি।”

-“আমাকে যখন কলেজে দেখেছিলেন তখন কিছু বলেননি কেন?”

এই প্রশ্নে জেহের ইনশিতার কাছে এগিয়ে আসলো। খুব কাছে। 

-“আমি তখন খুব রেগেছিলাম। সেই রাগ চাইনি তোমার উপর দেখাতে। আমার বাজে রাগটা তোমাকে খুব কষ্ট দেয় রোজ। যার কারণে তুমি আমার থেকে দূরে সরে যাও। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি, চাইনি তুমি দূরে সরে যাও। তাই আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছি।”

ইনশিতা চোখ বন্ধ করে রইল শুধু। জেহেরের তপ্ত নিঃশ্বাসে তার সারা শরীর রোমাঞ্চিত হচ্ছে বারংবার। তার ভালো লাগলো এই ভেবে যে, জেহের তাকে কষ্ট না দিতে নিজেকে কন্ট্রোলে রাখতে চাইছে। তবে...সেই রাগের শিকার যে অন্য কাউকে হতে হয়। যেমনটা এখন জিহাদ হলো। চোখ খুলল ইনশিতা। এক কদম পিছু হটে সে। 

-“জিহাদকে মেরে মোটেও ভালো কাজ করেননি।”

জেহেরের চোখে রাগের আভাস ঝিলিক দিলো। তা বুঝতে পারল ইনশিতা। আর এটাও বুঝতে পারল যে জেহের অন্য কিছু মিন করছে এটাকে। তাই জেহের কিছু বলার পূর্বেই সে বলল, 

-“আসলে বলতে চেয়ছিলাম, ও তো ওর শাস্তি পাচ্ছেই তাই না! ওর রায় হতো তো কিছুদিন পর। বাবা সেই ব্যবস্থা করে রেখেছিল। তাহলে ওকে মারার কী দরকার ছিল? আপনিও তো ঝামেলায় ফেঁসে যেতে পারেন।”

-“তার কোনো সুযোগই নেই। আর ওর শাস্তি আরো কঠিন হওয়া দরকার। আমি তো চেয়েছিলাম মেরেই ফেলব। ওই ডাম্বঅ্যাস পুলিশগুলোর জন্য পারলাম না।”

জেহের চোখ মুখ খিঁচে বলল কথাটা। যেন জিহাদকে মারতে না পেরে তার দুনিয়ার আফসোস হচ্ছে। ইনশিতা চেয়েছিল হাসপাতালে যাবে। জিহাদকে দেখতে নয়, জেসমিন চৌধুরীকে সামলাতে। মহিলাটা এত ভাবে সন্তানের জন্য! এই ভাবনাটা যদি জিহাদের ছোটবেলার সময়ে থাকত! তাহলে আর জিহাদের এমন দিন দেখতে হতো না।

হসপিটালে যাওয়ার প্ল্যান ক্যান্সেল করে দিলো ইনশিতা। জেহের মারাত্মক পরিমাণে রেগে আছে। এখন আবার এই কথা বলে রাগাতে চায় না। ঘরের পরিচারিকা একজনকে পাঠিয়ে দিলো হাসপাতালে জেসমিন চৌধুরীকে দেখার জন্য। 

কেটে গেল প্রায় দুটো মাস... 

এই দুটো মাসে জিহাদকে হসপিটালেই থাকতে হয়েছে। অবশ্যই পুলিশের নজরবন্দী হয়ে। অবস্থার তেমন একটা উন্নতি হয়নি। জেসমিন চৌধুরী রোজ গিয়েছেন ছেলেকে দেখতে। সাথে হরেকরকমের খাবার। জিহাদ তাকে দেখে কোনো ধরনের উচ্ছাস প্রকাশ করত না। বেডে শুয়ে থেকে সবসময় নজর রাখতো দরজার দিকে আর ভাবতো, এই বুঝি তার প্রিয় মানুষটি তাকে এক ঝলক জন্য আসবে। তার ভাবনাগুলো ছিল বৃথা। তবুও, নিজ মনে ভাবনা বুনতে তো কোনো বাঁধা নেই!

ইনশিতা আর জেহেরের দিন কাটছে ভালোই। তবে ইনশিতা ভয়ে ভয়ে থাকত। জিহাদের ভয় কাটেনি। আবার যদি আগের মতো হঠাৎ হামলে পড়ে? বিপদের তো কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। 

তার একদিন সকলেই একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। জেবা আসলো হুট করেই। তখন সকলে ড্রয়িংরুমে বসে ছিল। জেবাকে দেখে ইনশিতা চমকে দাঁড়িয়ে গেল। আজ তার কলেজ নেই, আর জেহের অফিসে। জেহের যদি এখন জেবাকে দেখত তাহলে নিশ্চিত জেবাকে জবাই করে ফেলত। জেবা কাঁদতে কাঁদতে এসে হঠাৎ করে ইন‌শিতার পায়ে পড়ল। 

-“আমাকে ক্ষমা করে দাও ইনশিতা, আমি ভুল করেছি, আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ।”

ইনশিতা দ্রুত পা সরিয়ে জেবাকে তুলল। জেসমিন চৌধুরী জেবাকে দেখে খুব রেগে গিয়েছেন। রাগের মাথায় জেবাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে পর পর দুবার চড় মেরে দেন। 

-“মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের এত বড় ক্ষতি করতে বিবেকে বাঁধল না? তোমাকেও উচিত ছিল নয়নিকার মতো মেরে ফেলা। তোমাকে পেটে ধরাটাই আমার ভুল ছিল।”

জেবা জেসমিন চৌধুরীর পায়ে পড়ল। 

-“মা, ও মা, আমাকে ক্ষমা করে দাও মা। আমি অনেক বড় ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও গো মা।”

জেসমিন চৌধুরী পা ছাড়িয়ে দূরে গেল, 

-“আগে মনে ছিল না নিজের করা অপরাধের কথা? তা এখন কী মনে করে ক্ষমা চাইছ? এটাও কোনো প্ল্যান নয়তো তোমাদের?”

জেবা জোরে জোরে মাথা নাড়াল। 

-“মা, বিশ্বাস করো। আমি মন থেকে ক্ষমা চাইছি। আমার অপরাধ আমায় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল এতদিন। কিছুতেই শান্তি পেতাম না। এতদিন আমি রংপুরের বাসায় ছিলাম। সব কিছু থেকেও যেন কিছুই ছিল না আমার। ঘুম হারাম হয়ে যেত। আমি প্রায়শ্চিত্ত আমার ভুলের জন্য। আমাকে ক্ষমা করে দাও মা।”

-“যার সাথে অন্যায় করেছ তার কাছে ক্ষমা চাও।”

জেবা বসা থেকেই ইনশিতার পা ধরল। আর বারবার বলতে লাগল ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য। ইনশিতা অপ্রস্তুতবোধ করল। জেবাকে ছাড়িয়ে তাকে সোফায় বসিয়ে দিলো। একগ্লাস পানি এনে তাকে খাইয়ে দিলো। তার পাশে বসে বলে, 

-“তুমি মন থেকে ক্ষমা চেয়েছ এটাই অনেক। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। উনি নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দেবেন।”

জেসমিন চৌধুরী ইনশিতাকে সাবধান করার গলায় বললেন, 

-“একে একদম সুযোগ দিবে না ইনশিতা। লাই পেয়ে পেয়ে দেখবে আরো ক্ষতি করার সুযোগ পাবে।”

জেবা মাথা নিচু করে কাঁদছে। ইনশিতা ইশারায় মা'কে শান্ত হতে বলে। জেসমিন চৌধুরীকে এক পাশে নিয়ে বলে, 

-“ও আপনার মেয়ে মা। ভুল করেছে, এখন ক্ষমাও চেয়েছে। ক্ষমা করে দিন না। আমার বিশ্বাস ও আর এমন ভুল করবে না।”

-“ইনশিতা দেখো...”

-“আপনি তো ওর মা। একবার ক্ষমা করে দেখুন। একবার ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিন। এতটা মাস অপরাধবোধ মাথায় নিয়ে মেয়েটা বেঁচে ছিল এটাই অনেক। যান মা, একবার ওর পাশে বসে ওকে কাছে টেনে নিন।”

জেসমিন চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন জেবার দিকে। এই মেয়েটা তো তার পেটের। একবার ক্ষমা করে দেওয়াই যায়। কিন্তু যা অপরাধ করেছে তাতে সময়ও লাগবে ক্ষমা করতে। জেবার পাশে বসে তার হাত ধরতেই জেবা হাউমাউ করে কেঁদে উঠে জেসমিনকে জড়িয়ে ধরে। ইনশিতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। 

একটু বাদেই কলিংবেল বেজে উঠে। ইনশিতা গিয়ে দরজা খুলতেই দেখে রাফিদ দাঁড়ানো। সে অস্থির গলায় বলল, 

-“কোনো সমস্যা ইতু? জরুরী তলব করলে? কিছু হয়েছে?”

ইনশিতা উত্তর না দিয়ে তাকে ভেতরে আসতে বলে। রাফিদ ভেতরে ঢুকেই দেখে জেবা বসা। তার চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে। যেন এক্ষুনি জেবাকে সে মেরে ফেলবে। সেদিন সে ইনশিতার করুণ অবস্থা নিজ চোখে দেখেছিল। আর তার জন্য এই সামনে বসে মেয়েটাই দায়ী। হাত মুঠ করে সে সামনের সোফায় বসে। জেবা তাকে দেখে আরো ডুকরে কেঁদে ওঠে। রাফিদের কাছে এসব ন্যাকামি লাগল। ইনশিতাকে তাড়া গলায় বলল, 

-“কী বলবে বলো ইনশিতা। আমার যেতে হবে আবার।”

ইনশিতা রাফিদের পাশে বসেই বলতে লাগে, 

-“জেবাকে ক্ষমা করে দাও ভাইয়া। আমি জানি তুমিও রেগে আছো জেবার উপর। ওকে ক্ষমা করে দেওয়া যায় না?”

রাফিদ চাপাস্বরে বলল, 

-“তোমার কত বড় ক্ষতি করতে চেয়েছে ও সেটা কী ভুলে গেলে? তুমি ক্ষমা করতে পারলেও আমি পারব না। নেভার।”

ইনশিতা কিছু সময় চুপ থেকে বলল। 

-“ভাইয়া। তুমি আমার একটা কথা রাখবে?”

-“বলো।”

-“আগে বলো রাখবে?”

-“আগে শুনে নিই।”

-“জেবাকে বিয়ে করে নাও। 

এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই রাফিদ উঠে দাঁড়াল।

-“তা কখনোই সম্ভব না ইনশিতা।”

-“কেন ভাইয়া? জানো মেয়েটা তোমাকে কত ভালোবাসে? তাহলে আপত্তি কিসের?”

-“আচ্ছা, মানলাম ও আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আমি কি ভালোবাসতে পারবো ও'কে? হয়তো ও'কে ভালো না বেসেও সংসার করতে পারতাম। তবে জেবা যা করেছে তাতে আমি ও'কে বেঁচে থাকতেও ক্ষমা করব না। সারাটাদিন ও'কে আমার ঘৃণা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে। আর আমার মা বাবাও জেবাকে প্রচুর ঘৃণা করে।”

জেবা এবার রাফিদের কাছে এসে হাত করে বলতে লাগে, 

-“এভাবে বলো না রাফিদ। আমি তোমাকে ভালোবাসি। ঘৃণা নিয়েও সংসার করতে পারব আমি। তাও আমায় দূরে ঠেলে দিও না।”

-“তা কখনোই সম্ভব নয়।”

জেবা চেঁচিয়ে উঠল,

-“কিন্তু কেন?”

রাফিদ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, 

-“কারণ আমি অলরেডি বিয়ে করে ফেলেছি।”

ইনশিতা আর জেবা দুজনেই সমস্বরে বলল,

-“কীহ!”

-“হ্যাঁ। ছয়দিন আগেই আকদ হয়ে গেছে আমার। সামনের সপ্তাহে তুলে নিবো।”

জেবা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ দিয়ে পানি পড়াও বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার। ইনশিতা এখনো বিস্ময় কাটাতে পারছে না। 

-“কবে হলো? কখন? আমাকে জানালে না কেন?”

-“ইতু আসলে, হঠাৎ করেই হয়ে গিয়েছে। তোমাকে জানানোর সুযোগ পাইনি।”

-“পাত্রী কে?”

-“শিফা।”

আরেক দফা চমকালো ইনশিতা। জেবা এসে ক্রোধান্বিত হয়ে রাফিদকে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, 

-“শিফা একটা লোভী মেয়ে রাফিদ। ও আগে জেহের ভাইয়ের পিছু পিছু ঘুরত। একটা লোভী মেয়েকে কী করে বিয়ে করতে পারলে?”

রাফিদ জেবার হাত ছাড়িয়ে ধাক্কা দিলো তাকে। 

-“ছিল। লোভী মেয়ে ছিল। তবে সেটা আরো এক বছর আগের কথা। এখন সে না লোভী আর না অশ্লীল। তার সাথেই আমার সংসার শুরু হবে। দোয়া করিও।”

জেবা রাগে থরথর করে কাঁপছে তখন। চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলল, 

-“ঐ মেয়েটাকে আমি মেরে ফেলব। আমার ভালোবাসা ছিনিয়ে নিয়েছে তাকে আমি শেষ করে ফেলব।”

বলেই সে বেরিয়ে যেতে নেয়। রাফিদ জেবার হাত ধরে আটকায়। ছুঁড়ে মারে সোফার উপর। 

-“সেদিন কিন্তু তুমিও একই ভাবে আমা...জেহেরের ভালোবাসাকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলে। তাও কত খারাপ উপায়ে। ভালোবাসার মানুষ অন্য কারো হলে কতটা কষ্ট লাগে দেখলে তো? ভালো হবে নিজের জীবন নতুন ভাবে শুরু করো। তুমি যেই ভুলটা করেছ তা তোমার কাছে সামান্য হলেও সেটা সামান্য নয়। একজন মেয়ের সম্ভ্রমহানি করতে সাহায্য করেছ তুমি। ভাবতে পারো তোমার মানসিকতা কতটা নীচ? আমি তোমাকে কোনোদিনও ক্ষমা করব না। তবে তুমি যদি আমার, শিফার, ইনশিতার ক্ষতি না করার মানসিকতা নিয়ে জীবন কাটাও তাহলে হয়তো ক্ষমা করতেও পারি। এবার তুমিই ভাবো, সকলের ক্ষতি করে আমার কাছে আরো খারাপ হতে চাও, নাকি যা হয়েছে তা মেনে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করতে চাও? নাও ডিসিশন ইজ ইওর'স। চলি। ভালো থেকো।”

রাফিদ চলে গেলে জেবা হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে থাকে। ইনশিতা গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। ইনশিতাকে জড়িয়ে জেবা কাঁদতে কাঁদতে বলে, 

-“কেন ইনশিতা? আমার সাথেই কেন এমন হলো? কেন রাফিদ আমাকে ক্ষমা করে বিয়ে করতে চাইছে না? কেন?”

ইনশিতা জেবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, 

-“যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে জেবা। এখন তোমার আমার কারোরই সাধ্য নেই ভাগ্য বদলানোর। মেনে নাও জেবা। হতে পারে পরবর্তীতে রাফিদের থেকেও ভালো কোনো জীবন সঙ্গী পেয়ে যাবে। আচ্ছা, তুমিই ভাবো, রাফিদ তোমাকে ভালোবাসে না। উল্টো তোমাকে ঘৃণা করে। এখন যদি সেই ঘৃণা নিয়েই রাফিদের সাথে সংসার করো তাহলে তুমি ভালো থাকতে পারবে তো। তুমি হয়তো আবেগের বশে বলবে তুমি পারবে। আবেগ দিয়ে কিন্তু এই জগত চলে না। ভাবতে হয় বাস্তবতা দিয়ে। সংসারের কয়েকদিন পর যখন দেখবে রাফিদ তোমাকে আগের চেয়েও বেশি ঘৃণা করবে তখন তুমি নিজেই অতিষ্ঠ হয়ে যাবে। তোমার কাছে সব বিষাক্ত লাগবে। সংসার তো হবেই না বরং তুমি তখন আত্মহত্যার পথ বেছে নেবে।”

ইনশিতা জেবাকে সামনে এনে আবার বলল, 

-“তাহলে তুমিই ভাবো, দিনে দিনে মরণ যন্ত্রণার সাথে বসবাস করার চেয়ে উত্তম নয় কি সেই যন্ত্রণা থেকে দূরে থাকা? তাহলে তুমিও রাফিদের থেকে দূরে থাকবে। ঘৃণ্য কাজ করে শুধু শুধু দরকার কী পাপের বোঝা বাড়ানোর? নিজের জীবন শুরু করো নতুন ভাবে। বলা তো যায় না, কখন তোমার জীবনেও নতুন কারো আগমনে রাফিদকেও ভুলে যাবে। পেছনের সব কষ্ট ছুঁড়ে মারো আর ভবিষ্যত ভেবে কাজ করো। ইন শা আল্লাহ, সফল হবে।”

জেবা এতক্ষণ নীরব থেকে ইনশিতার কথা গুলো শ্রবণ করল শুধু। 

-“বাবাকে টিকিট কাটতে বলো। আমি চলে যাবো এখান থেকে। এখানে থাকলে আমি দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো। দূরে গিয়ে নতুন করে সব শুরু করব। সব।”

ইনশিতা মৃদু হেসে বলে, 

-“আচ্ছা।”

জেবা তার পাপের শাস্তি ভোগ করেছে। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছে সে। ইনশিতাকে বিপদে ফেলার জন্য সে শুধু হেল্প করে ছিল। অথচ তার শাস্তি কতটাই না ভয়ানক। কখনো ক্ষুদ্র পাপ কাজের শাস্তিও হতে পারে বৃহৎ। এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে জেবা। ইনশিতার কথায় নতুন করে জীবন শুরু করবে। নতুন করে বাঁচতে শিখবে সে। 

জেবাকে রুমে দিয়ে ইনশিতা নিজের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। আবার কিছুর আওয়াজ শুনল। পিছনে ফিরতেই দেখলে কেমন হুড়মুড়িয়ে জেহের ঘরে ঢুকল। 

-“একি! আপনি অসময়ে?”

জেহের উত্তর না দিয়ে দৌড়ে এসে ইনশিতার বাহু ধরে কাছে আনলো। চুল উশকোখুশকো। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে, 

-“রাফিদ এসেছিল?”

-“হ্যাঁ।”

-“কেন এসেছে? তুমি ওর সামনে ছিলে? তোমার সাথে কথা বলেছে ও? কী কথা বলেছিলে? ওকে এখানে আসতে বলেছে সে?”

-“কি আশ্চর্য! কয়টা প্রশ্নের উত্তর দিবো?”

-“যা বলেছি সব বলো।”

-“আচ্ছা, আপনি একটু রেস্ট নিন। ঘেমে গেছেন তো। লাইম জুস আনছি আমি।”

-“কিচ্ছু লাগবে না আমার। বলো তুমি।”

জেহের ইনশিতাকে কাঁধে তুলে রুমে নিয়ে গেল। বিছানার সামনে দাঁড় করিয়ে ইনশিতাকে দুহাতের বন্ধনে আবদ্ধ করে বলে, 

-“কী বলেছে তোমায়? আবার নতুন করে ভালোবাসার কথা বলেছে? আমাকে তোমার থেকে কেড়ে নেওয়ার কথা বলেছে?”

-“নারে বাবা। আপনি শান্ত হোন, আমি বলছি।”

-“তোমাকে বলেছিলাম কোনো ছেলের সামনে না যেতে। আর রাফিদের সামনে তো নয়ই। আমার সহ্য হয় না। রুমে বন্দী করে রাখবো একদম।”

জেহের কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। সে একাধারে বলেই যাচ্ছে এক কথা। 

-“রোজ, আমি কিন্তু রাফিদকে মেরে ফেলব রোজ। ও'কে যেন তোমার আশেপাশেও না দেখি।”

ইনশিতা হঠাৎ জেহেরের মুখ চেপে ধরল। হাত দিয়ে না, অন্যভাবে। কিছুক্ষণ পর ছাড়ল জেহেরকে। জেহের এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। রোজ তাকে ছাড়ার পর আবার সে রোজের দিকে এগিয়ে গেল। ইনশিতা মুখের কাছে হাত এনে বলল, 

-“আগে পুরো কথাটা শুনুন। বলছি।”

জেহের যেন তাও শুনতে চাইছে না। ইনশিতাকে চেপে ধরে ঠোঁটের দিকে এগোতে চাইছে বারবার। ইনশিতা জেহেরের মুখ চেপে সবটা বলে ফেলল হড়বড় করে। জেবা আসার কথা শুনেই জেহেরের নেশা চোখে আগুনের ঝলকানি দেখা দিলো। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। সে উঠে দাঁড়াল। ইনশিতা জেহেরকে বাঁধা দিলো। 

-“এখন আর কিছু করবেন না। এমনিতেই অনেক বড় ধাক্কা গেছে আজ ওর উপর। প্লিজ এখন আর কোনো হাঙ্গামা করবেন না। আর ও এই দেশ ছেড়ে দেবে কয়েকদিন পর।”

জেহের তাও শুনল না। রাগে তার কপালের রগ ফুলে উঠেছে। মাথায় দপদপ করছে আগুন। ইনশিতা জেহেরের হাত ধরে নিজের দিকে ফিরালো। জেহেরের হাত তার কোমড়ে রেখে জেহেরের পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াল। জেহেরের বুকে ওষ্ঠ ছোঁয়ালো হালকা করে। সে টের পেল জেহের বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। রাগ উধাও হচ্ছে ধীরে ধীরে। এই একটাই অস্ত্র জেহেরকে রাগ থেকে বের করার। ইনশিতা জেহেরের ঠোঁটে হাত ছোঁয়ালো। জেহের নিজেকে সামলাতে না পেরে রোজের ঠোঁটে ডুবে। উষ্ণ স্পর্শে ভরিয়ে দিতে থাকে তাকে। 

পরদিন সকালে আরকেটা চমক দেওয়া খবর তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। জিহাদকে হসপিটালের কোত্থাও পাওয়া যায়নি। গত রাত থেকেই হাওয়া। অথচ চারিদিকে পুলিশের কড়া নজরদারি। তাহলে কীভাবেই বা পালাল সে। জেবাকে বলা হলেও সে জানে না বলে জানায়। খবরটা শুনে ভয়ে ইনশিতার বুক কামড়ে ধরল। জিহাদ কী নতুন কোনো ফাঁদ পেতেছে? এটা কী তার নতুন কোনো চাল ইনশিতাকে পাওয়ার? ইনশিতা সেই খবর শুনে আজ কলেজ যায়নি। জেহেরকে অফিস যেতে বারণ করেছে। জেহের সেই কথা শুনে রেগে গিয়ে বলে,

-“জিহাদের ভয়ে আমি কেন অফিস যাওয়া বন্ধ করবো? এত ভয়ের কী আছে? ও কিছুই করতে পারবে না। রেডি হও তাড়াতাড়ি। তোমাকে কলেজ দিয়েই আমি যাব।”

ইনশিতা মিনতি করে বলল, 

-“দুটো দিন অফিস কামাই দিলে কিছুই হবে না। জিহাদকে আগে ধরে নিক। প্লিজ জেহের, আমার ভালো লাগছে না কিছুই। যদি কোনো কিছু হয়ে যায়? রিস্ক নেওয়ার প্রয়োজনটা কী? আমি আপনাকে হারাতে চাই না জেহের। প্লিজ আজকে না যান।”

ইনশিতার চোখে মুখে জেহেরকে হারানোর আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ইনশিতার কান্নামাখা মুখ দেখতে জেহেরের ভালো লাগছে না। আবার এদিকে বিরক্তও লাগছে কেন রোজ জিহাদকে ভয় পাবে? রোজকে আর কোনো টেনশনে না ফেলতে সে অফিস যাওয়া বন্ধ করল। শুধু আজকের জন্যই। 

-“ওকে, যাবো না। তার বদলে আমার কিছু চাই।”

-“কী?”

জেহের গভীর দৃষ্টি মেলে তাকাল ইনশিতার পানে। ইনশিতা ভড়কে গেল। সে জেহেরের এই দৃষ্টির মানে বুঝল। তা দেখে জেহের ঠোঁট কামড়ে হাসল, 

-“ডোন্ট ওয়ারি। যা ভাবছ এমন কিছুই করব না। আমি শুধু চাই...উমম...একসাথে মুভি দেখব।”

ইনশিতা হাঁপ ছাড়ল। মৃদু হাসল সে। জেহের মুভি দেখার প্রস্তুতি নিয়েই বসল। জানালার পর্দা টেনে রুমটাকে অন্ধকার বানিয়ে পপকর্ণ নিয়ে বসে। বালিশের সাথে হেলান দিয়ে বুকের উপর রোজের মাথা টেনে আনে। তবে মুভি দেখতে গিয়ে ইনশিতা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় লজ্জার সম্মুখীন হলো। জেহের ইচ্ছে করেই এমন মুভি ছাড়ল! মুভির প্রায় বেশ কয়েকটি সিনেই প্রচুর আপত্তিকর সিন আসলে ইনশিতা লজ্জায় উঠে পড়তে চায়। জেহের তা দেখে ইনশিতাকে কোলের উপর এনে জোর করে চেপে ধরে। তার পুরো দৃষ্টি রোজের লাজরাঙা রক্তিম গালের উপর। ঘোর লেগে আসছে তার। লজ্জায় ইনশিতার কান দিয়ে যেন গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। কোনোমতে বলল, 

-“ইস! এসব কী? আমি দেখব না এসব, ছাড়ুন। ছিঃ কী অসভ্য আপনি!”

-“অসভ্য কাজ করতে পারো আর অসভ্য কিছু দেখলেই দোষ!”

ইনশিতার কথা বন্ধ হয়ে গেল লজ্জায়। তার উপর জেহেরের হাত বিচরণ করছে ইনশিতার জামার ভেতর। ইনশিতার ইচ্ছে হলো মাটি ফাঁক হয়ে যাক আর সে লাফিয়ে পড়ে। এত লজ্জা! এত লজ্জা! 
.
.
.
চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন