কপালে পট্টি। মুখে থার্মোমিটার নিয়ে আমি বিছানায় আধশোয়া। চেকআপ করে, ডাক্তার আঙ্কেল চলে যাচ্ছেন। সাথে গেলেন চাচ্চুরা আর বাবা। বাকি সকলেই রুমে উপস্তিত। না চাইতেও চোখ যাচ্ছে তন্ময় ভাইয়ের দিক। সে রুমে ঢুকেন নি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। সাধারণত সে আমার রুমে আসেন না। মনেও নেই সে শেষ কবে, আমার রুমে প্রবেশ করেছেন। রেস্টুরেন্টে তার স্পর্শ, আমাকে তার বাইকে উঠানো, আমার আর তার ছবি ব্যবহার করা। কেমন অদ্ভুত লাগছে। সে কী আমায়। না না। ভাবতেও শরীর শিরশির করছে। আমাকে? আমাকে কীভাবে পছন্দ করবেন। হতেই পারেনা। তাহলে তার এমন করার কারণ? রুবি আপু আছেন, কোথায় তার সাথে তো কখনও এমন করেননি। সে আমায় বোনের চোখে দেখলে কী, কোমরে স্পর্শ করতেন? এভাবে ধীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি'তে তাকাতেন?
ভাবনায় ছেঁদ পড়লো দীপ্তর কথায়,
--' বলছি, অরু আপুর বিয়েটা জ্বরের সাথে দিয়েই দাও। তখন হয়তো জ্বরের কিছুটা মায়া হবে, আর অরু আপুকে কয়েকদিন পরপরের জ্বর থেকে মুক্ত দিবে। '
রুবি আপু হাসতে হাসতে শেষ। মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জোক্স বলেছে দীপ্ত। হাসতে হাসতে জবাব দিলো,
--' বোকা৷ জ্বরের সাথে অরুর বিয়ে দিলে, তখন জ্বর চব্বিশ ঘণ্টাই রইবে। কারণ তখন অরু হবে জ্বরের একমাত্র সুন্দরী বউ। চোখে না হারাবে। '
ছোট চাচী ধমকে দিলেন,
--' দীপ্ত, পড়াশোনা শেষ হয়েছে?'
--' না তো। '
--' তাহলে মাইর খাওয়ার আগে যা। '
দীপ্ত যাচ্ছেনা। বরং আকুতি স্বরে বলল,
--' মাত্র রাত বারোটা। সকালে বাকি পড়া শেষ করবো। '
--' আমি আসছি। যদি দেখি তুই বিছানায় এখনও নেই। দেখবি তোর অবস্থা '
দীপ্ত দৌঁড়ে চলে যাচ্ছে। আর এদিকে আমার খেয়ালই নেই যে, আমি তন্ময় ভাইয়ের দিক তাকিয়ে। সে ডান ভ্রু উঁচু করে আছে। দ্রুত অন্যপাশে তাকালাম। কী লজ্জাজনক। প্রচন্ড অদ্ভুত লাগছে। অদ্ভুত সব অনুভূতি। বুকের ধুকপুক বেড়ে চলেছে। রবিন ভাই যাওয়ার আগে বললেন,
--' ঔষধ খা ঠিকমতো জ্বরের রানী। '
সে যেতেই তার কিছুক্ষণের মাঝে তন্ময় ভাইও চলে গেলেন।
বড় মা জোরপূর্বক স্যুপ খাওয়ালেন। মা ঔষধ খাইয়ে রুমের বাতি নিভিয়ে দিলেন। মাথায় হাত বোলানেন,
--' ঘুমিয়ে যা। '
--' ঘুম আসছেনা মা। '
--' আসবে। কিছুক্ষণ চোখ বুঝে থাক। আমি যাই কাজ আছে। '
বলতে বলতে মা চলে গেলেন। অন্ধকার রুমে রয়ে গেলাম আমি আর আমার অদ্ভুত চিন্তাভাবনা, অনুভূতি। চোখের সামনে তন্ময় ভাইয়ের চেহরা, তার চোখ। তার বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকা। বৃষ্টির পানিতে তার সর্বমুখ ভিজে থাকা। তার আমার দিক তাকানো। আমাকে ধরা, অযথা শাসন করা। কারও সাথে কথা বলতে না দেওয়া। বাড়িতে ফোন করে জিজ্ঞেস করা, আমি পৌঁছেছি নাকি।
মাথাটা দু'হাতে চেপে ধরলাম। হয়েছে কী আমার। তন্ময় ভাই? কম্বলে মাথা ঢুকিয়ে ফেললাম। কিচ্ছু ভাববো না। তন্ময় ভাইয়ের নামও নিবো না।
অথচ, সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি। মাথায় তন্ময় ভাইয়ের সবকিছু। হঠাৎ এমন হওয়ার কারণ দেখছিনা। টেবিলে ব্রেকফাস্ট করতে বসে, আমি আঁড়চোখে সোফায় তাকালাম। তন্ময় ভাই বসে। ঢাকা যাননি। তার তো যাবার কথা ছিলো। যায়নি কেন?
ভাবনার মাঝে ছোট চাচ্চুর কন্ঠ,
--' জ্বর কমেছে অরু? কোনো সমস্যা হচ্ছে? '
--' জ্বী চাচ্চু। না সমস্যা নেই। '
মা আলাদা ভাবে দুধ দিলেন গ্লাসে।
--' পুরোটা শেষ কর। দুটো রুটি দিয়েছি। এখানে আবার একটা
রুটি কীভাবে থেকে যায়? তুই খাস কী? না খেয়ে মরবি? '
বলতে বলতে মা রান্নাঘরে যাচ্ছেন। আমি অসহায় মুখে আর চোখে খেলার আর দেখলাম।
পরিস্থিতি নির্জন হতেই, বড় চাচ্চু শান্ত স্বরে প্রস্তাবের কথা তুললেন। দীপ্ত, রুবি আপু এরা একদম সোফায় গিয়ে বসেছে, সব শুনবে বলে। অথচ, আমি সব মনোযোগ খাবার প্লেটে দিলাম। আজ আর এগুলো শুনতে মন সায় দিচ্ছেনা।
--' পুলিশ অফিসার আশিকুর রহমান। সে কাল বাড়ি এসেছিলো, তার মেয়ের জন্য। '
তন্ময় ভাই উঠতে নিচ্ছিলেন, তখনই বড় মা চেঁচালেন,
--' তুই কী বিয়ে করবিনা? বয়স কী কম হচ্ছে? তোর বয়সের ছেলেদের, বিয়ে হয়ে বাচ্চাও হয়ে আছে। বাড়িতে সুন্দর সুন্দর প্রস্তাব আসছে। তোর কী একটাকেও পছন্দ হয়না? নিশি মেয়েটার কোন দিক দিয়ে কমতি? '
বড় চাচ্চু, বড় মা'কে কথা বলতে বারন করলেন। সে শান্ত স্বরে আবারও বললেন,
--' তোমার কোনো পছন্দ আছে? '
তন্ময় ভাই চুপ মেরে গেলেন। বাড়ি আরও থমথমে হয়ে গেলো, বড় চাচ্চু বর্তমান প্রশ্নে,
--' তোমার কী অরুকে পছন্দ? '
পানি খেতে গিয়ে আমি চমকে উঠলাম। শুধু আমি না সকলেই। চাচীরা, মা রান্নাঘর থেকে দৌঁড়ে এলেন। বড় মা আওয়াজ তুললেন,
--' এগুলো কেমন প্রশ্ন? '
বড় চাচ্চু হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বললেন। তাই সকলে অবাক হলেও একটা শব্দ করেননি। এদিকে আমার বুকের ধুকপুক তীব্র। যেকোনো মুহুর্তে হার্টএট্যাক করে ফেলব।
তন্ময় ভাই তখনও অন্যদিকে তাকিয়ে। তার জবাব,
--' তেমন কিছু না। '
--' তাহলে অরুকে অন্য কোথাও বিয়ে দিলে, তো তোমার সমস্যা হবার কথা না। তাইনা? '
এবার সে চাচ্চুর দিক তাকালেন। চাচ্চু থামলেন না,
--' জবাব দিতে হবে তন্ময়। '
তন্ময় ভাই চলে যাচ্ছে বাড়ি থেকে। বড় মা চেঁচিয়ে ডাকলেন। সে শুনলেন না। এবার বাবা বড় চাচ্চু'কে বললেন,
--' এগুলো কেমন প্রশ্ন? ভাই আপনি না জেনে, '
চাচ্চু থামিয়ে দিলেন বাবাকে।
--' না জেনে কী? সে আমার ছেলে। আমার থেকে ভালো তাকে তার মা'ও চেনে না৷ '
আমি উপরে চলে এলাম। অনেক আগেই চলে আসতাম। শুধু সাহস পাচ্ছিলাম না। বড় চাচ্চু এমন কেন বললেন? এখনও বুকের তীব্র আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ভয়ও হচ্ছে প্রচন্ড।
সারাদিন বাড়ি শুনশান গেলো। সবাই এতটাই অবাক, কেউ কোনো শব্দই তোলেনি এই বিষয়ে। রাত হয়ে যাচ্ছে তন্ময় ভাই বাড়ি ফেরেননি। বড় মা চিন্তায় শেষ। তার ফোনে কল দেওয়া হয়েছে হাজার বার। রিসিভ হয়নি। আমার নিজেরও বেশ চিন্তা হচ্ছে। রুমে পাইচারী করেছি শুধু। সেদিন আর বাড়ি ফিরেনি সে। পরেরদিন বড় চাচ্চু জানতে পারেন, তন্ময় ভাই ঢাকা চলে গিয়েছেন। বিকেল দিকে ভাইয়ের সাথে কি কথা হয়েছে কে জানে, এরপর থেকে চাচ্চু আর এই পছন্দের ব্যাপারটা তুলেন নি। বরং সবাইকে এই ব্যাপারে কথা বলতে সম্পুর্ন নিষেধ করে দিলেন। এগুলো আমাকে জানালো দীপ্ত। আরও বলল,
--' তন্ময় ভাই তোমাকে পছন্দ করেন। আর সেটা বড় চাচ্চু জানেন।
এখন হয়তো এই বিষয়ে কথা আর হবেনা, কারণ তুমি এখনও ছোট। '
আমি শুধু অসহায় হয়ে তাদের বক্তব্য শুনে গেলাম। সে কী সত্যি পছন্দ করেন? আমাকে?এতো সুন্দর সুন্দর মেয়ে রেখে? আমার কেমন বিশ্বাসই হচ্ছিলো না।
তন্ময় ভাই বাড়ি ফিরছেন না আজ বিশ দিন হচ্ছে। সে বেশিরভাগ সময় কাজের সূত্রে ঢাকা থাকেন। এক মাস বা দু মাসে পর আসেন। আবার দু'চারদিন থেকে চলে যান। কিন্তু এবার সে রেগে বেরিয়েছে। তাই বাড়ির সকলে চিন্তায়। আবার বাড়িতে ফোনও করেননি। যেটা সে সদা করে থাকেন। এদিকে বড় মা কেঁদে কেটে শেষ। তার কতগা হচ্ছে, বড় চাচ্চু ভুলভাল কথা বলে ভাইয়াকে রাগিয়েছে।
কলেজ গিয়ে সুমনা'র গোয়েন্দাগিরি,
--' কীরে তন্ময় ভাই কই? এখনও ফিরেনি? '
সুমনার কন্ঠে স্পষ্ট, সে বেশ চিন্তিত। চিন্তিত তো সবাই। তাই না? আমি আমতাআমতা করে বললাম,
--' উম, চলে আসবেন। চিন্তা করিস না। '
--' আসলে একটা কল দিস, প্লিজ। '
--' হ্যাঁ। '
কথা তো দিয়েছি। এখন কল দিবো নাকি শিয়র না। আর কথা বাড়ালাম না। বরং তীব্র বৃষ্টির মাঝে ছাতা হাতে, দ্রুত বাড়ির রাস্তা ধরলাম। বাড়ি চলে যাওয়াই উত্তম। আমার মুখ হচ্ছে কেঁচি। কথা শুরু করলে সব বলে দেই। কখন না কখন এগুলো মুখ থেকে বেরোবে। পরে সুমনার মন ভেঙে যাবে।
অবশ্য কলেজ হতে বাড়ি কাছে। তাই বৃষ্টির মাঝে চলে যাওয়া যায়। মাথায় পৌঁছাতেই দেখলাম তন্ময় ভাই স্টলে বসে। তীব্র বৃষ্টির মাঝে সে স্পষ্ট। সাথে রয়েছে তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। আমাকে দেখে কথা বলা বন্ধ করলেন। ইশারা করলেন ওদিকে যেতে। আমি শ্বাস আঁটকে স্টলের পাশে দাঁড়ালাম। সেখানে বৃষ্টি পরছে না। সে তার হাতের মোবাইলের বাক্স ধরিয়ে দিলেন।
--' সবকিছু স্যাট করা। ফোন নাম্বার কাউকে দিবি না। '
আমি মাথা ঝাকালাম পুতুলের মতো। হাতে বাক্স নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। সে বললেন,
--' দ্রুত যা। বৃষ্টিতে ভিজবি না। '
--' জ্বী। '
আঁড়চোখে তাকালাম। সাহস জুগিয়ে বলেই ফেললাম,
--' বাড়ি আসবেন না? '
--' হ্যাঁ। আসবো। '
আমি মাথা দুলিয়ে সামনে এগোলাম। ঠোঁটের কোণে বিশ্ব হাসিটা জেন তার জন্য এই প্রথম। কেমন অনুভূতি হচ্ছিলো তা শব্দে উপস্থাপন করতে পারছিলাম। পেছনে ফিরে তাকে আরেকবার দেখতে চাওয়া আমার মন। অথচ আমি সর্বচ্চ চেষ্টা করছিলাম, যাতে পেছনে না ফিরি। সে নিশ্চয়ই তাকিয়ে। আমি ফিরলে সে দেখে ফেলবে? লজ্জাজনক হবে ব্যাপারটা। কিন্তু মন। তা শুনতে বারণ। হাজার প্রচেষ্টা ব্যর্থ। সেই আমি পরিষ্কার আকাশের নিচে, তীব্র বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তার দিক ফিরলাম । ঠিকই সে আমার দিক তাকিয়ে। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তার সেই চোখ, যা আমার উপর বিচরণ করছে। আমাকে দেখছে। আমি এবার দ্রুত পায়ে সামনে চললাম। বলা যায় একপ্রকার দৌঁড়িয়ে এসেছি।
.
.
.
চলবে...................................