ভালোবাসি তোকে - পর্ব ২৩ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প


আদ্রিয়ানের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করতে করতে মুখ ফুলিয়ে রুমে গিয়ে দেখি সম্রাট শাজাহান শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ওনাকে দেখে মাথাটা প্রচন্ড গরম হচ্ছে। পেয়েছেন টা কী হ্যাঁ ? যখন যা ইচ্ছে তাই করবেন? এই তিনটে মাস তো শুধু কেয়ারিং এর নাম করে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তাহলে আজ কী হলো? আজ কেন এসে এমন ন্যাকামো করছেন সেটাইতো বুঝতে পারছিনা। উনি শুতে নিলেই আমি হনহনে পায়ে এগিয়ে গিয়ে একটা বালিশ নিয়ে ওনার দিকে ছুড়ে মারলাম। উনি বালিশটা ক্যাচ করে আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললেন,

--- " দেখো অনি কাল সারারাত না ঘুমিয়ে তোমাকে পাগলের মতো খুজেছি। নাও আ'ম সো মাচ টায়ার্ড। খুব ঘুম পাচ্ছে। একটু ঘুমিয়ে এনার্জি গেইন করে নেই তারপর উঠে তোমার সাথে আবার ঝগড়া করব।"

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। এই ছেলে সবসময় এতো চিল মুডে কীকরে থাকে। এতো কান্ড ঘটিয়েও এমন একটা ভাব করছে জেনো সবটাই নরমাল। আমি হাত ভাজ করে বললাম,

--- " এসব করে আপনি ঠিক কী প্রুভ করতে চাইছেন বলবেন?"

আদ্রিয়ান বালিশটা বেডে রেখে হাত দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন,

--- " দেখো আমি যা আমি তাই। আমি কোনোদিন কারও কাছে কিছু প্রমাণ করি না। ইনফ্যাক্ট প্রয়োজন ও মনে করি না। আমাকে বুঝতে হলে নিজে থেকেই বুঝতে হয়। আর যে বুঝতে পারেনা তার জন্যে.. কী জেনো বলেনা? হ্যাঁ একবালতি আফসোস।"

ওনার কথাটার আগা গোড়া কিছুই বুঝতে পারলাম না। ওনার এসব ধাঁধাময় কথাবার্তা বুঝতেই পারিনা আমি। মানছি উনি ইঞ্জিনিয়ার তাই বলে সবসময় ম্যাথের ইকুয়েশনের মতো করে জটিল জটিল কথা বললে হয়? আমি একগাদা বিরক্তি নিয়ে ওনার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম,

--- " সবসময় এরকম পেঁচিয়ে কথা কেনো বলুন তো? একটু সোজা করে বললেও তো হয় তাইনা?"

উনি গায়ে দেওয়ার চাদরটা মেলতে মেলতে বললেন,

--- " কেয়া কারু বেইবি আদাত সে মাজবুর হু।"

আমি বেডে বসে রাগী গলায় বললাম,

--- " আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড? নাকি আমি বাচ্চা? যে বেইবি বলছেন?"

উনি শুতে গিয়েও থেমে গিয়ে আমার আগাগোড়া একবার স্কান করে বললেন,

--- " ওওও তুমি বাচ্চা নও? ওহ দেন মাই ফল্ট।"

বলে আবার শুয়ে পরতে নিলেই আমি ওনার হাত ধরে বললাম,

--- " এই দাঁড়ান দাঁড়ান আপনি কী আমায় ইনসাল্ট করলেন?"

উনি ভ্রু কুচকে বললেন,

--- " তোমার তাই মনে হলো?"

--- " অফকোর্স হলো।"

--- " ওহ তোমার মনে হয়েছে? তাহলে তো ঠিকই আছে।"

বলে শুয়ে পরে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে ওনার কথাটা বোঝার চেষ্টা করলাম আর যখন বুঝতে পারলাম তখন রেগে ওনাকে ঝাকিয়ে বললাম,

--- " এই কী বললেন আপনি? আমি বাচ্চা?"

উনি চোখ বন্ধ করে রেখেই ভ্রু কুচকে বললেন,

--- " আরে নারে বাবা। তুমিতো আমার বউ। মানে গার্লফ্রেন্ডের আপডেটেড ভার্সেন। তাই বেবি বললাম। হয়েছে?"

আমি কনফিউসড হয়ে বসে রইলাম। কী বললেন উনি? বউ, গার্লফ্রেন্ড, আপডেটেড ভার্সেন। দূর। এসব মেলাতে গেলে আমিই পাগল হয়ে যাবো। আমি আবার ওনাকে ঝাকিয়ে বললাম,

--- " এই?"

উনি চোখ খুলে বিরক্তি নিয়ে বলল,

--- " অনি প্লিজ একটু ঘুমাতে দাও। এসব কথা পরে হবে।"

আমি ওনার শরীর থেকে চাদরটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বললাম,

--- " না পরে না এখনই হবে। আপনি এখনই চলে যাবেন। এটা আমার মামা বাড়ি আপনার কারোর না। তাই এক্ষুনি বেড়িয়ে যান।"

--- " উফফ। এসব কথা তো হয়ে গেলো তাইনা অনি?"

--- " না কিছু হয়নি আপনি থাকবেন না এখানে ব্যাস।"

উনি আমার দিকে ঘুরে শুয়ে চোখ বন্ধ করে বললেন,

--- " অনি এখন বাচ্চামো করোনা ঘুমাতে দাও আমায়।"

বলে চুপ হয়ে গেলেন। আমি চেঁচিয়ে বললাম,

--- " মানে কী হ্যাঁ? দেখুন আপনি যাই করুন না কেনো। যতোই এখানে থাকুন আর যতোই যা করুন আমি আপনার সাথে আর যাবোনা মানে যাবোনা। আর আপনার সাথে থাকবোও না বুঝেছেন?"

কিন্তু উনি কোনো রিঅ্যাক্টই করলেন না। আমি বিরক্ত হয়ে ওনাকে আবারও ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে আরো জোরে বললাম,

--- "এই।"

উনি এবার বিরক্ত হয়ে উঠে বসে বললেন,

--- " ভালো কথায় শোনার মেয়ে তুমি নও।"

বলে উঠে হাটুতে ভর দিয়ে বসে চট করেই আমায় কোলে তুলে নিলেন। আমি হকচকিয়ে তাকালাম ওনার দিকে। ব্যপারটা এতো দ্রুত ঘটল যে কিছুই বুঝলাম না। এরপর উনি আমায় বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিয়ে আমার কোলে শুয়ে পরলেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। গোটা ব্যাপারটা মাথার অনেক ওপর দিয়ে গেছে আমার। উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,

--- " এবার আমি যতোক্ষণ ঘুমাচ্ছি ততোক্ষণ আমায় পাহাড়া দাও। এটাই তোমার শাস্তি। আর হ্যাঁ আমার মাথায় একটু বিলি কেটে দাও তো ঘুমটা ভালো হবে।"

আমি রেগে ওনাকে সরানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম,

--- " বাহ। মামা বাড়ির আবদার নাকি? যা বলবেন তাই করতে হবে? সরুন উঠুন।"

উনি এবার আমার দিকে মুখ করে আমার কোমর জরিয়ে ধরে রইলেন যাতে আমি সরতে না পারি। আমি শক্ত হয়ে বসে আছি। হুটহাট করে এতো কাছে কেনো চলে আসেন উনি আমার? উনি কী জানেন ওনার এই কাছে আসাটা আমার বুকে তীব্র কম্পনের সৃষ্টি করেন, হার্ট কতো জোরে জোরে বিট করে? যদি আমি হার্ট অ‍্যাটাক করে মারা যাই তার দায় কী উনি নেবেন? উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

--- " কী হলো মাথায় বিলি কেটে দাও?"

আমি বিরক্তি নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রেখে বললাম,

--- '' আমি পারবোনা।"

উনি সাথে সাথেই আমার পেটে মুখ গুজে দিলেন। মুহূর্তেই চমকে উঠলাম আমি। শরীর হালকা কাঁপতে লাগল। আমি কিছু বলবো সেই শক্তিও নেই আমার মধ্যে। এমন কেনো ছেলেটা? উনি অস্ফুট স্বরে বললেন,

--- " আবার বলো?"

আমি আবারও কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম,

--- " প্ পারবোনা।"

উনি ওভাবে থেকেই বললেন,

--- " তাহলে আমিও ছাড়বোনা।"

উফ! এমন কেনো এই ছেলেটা? পুরো ফাসিয়ে দিলো। এখন আমি না রাজি হলে তো উনি সরবেনও না। আর এভাবে আমার পেটে মুখ গুজে রাখলে আমিতো শেষই হয়ে যাবো। ইতিমধ্যে যা অবস্থা হয়েছে। আমি কোনোরকমে বললাম,

--- " আচ্ছা দিচ্ছি।"

এটা শুনে আমায় ছাড়লেন। তারপর হেসে বললেন,

--- " দাও?"

আমি মনে একবস্তা বিরক্তি নিয়ে ওনার মাথায় বিলি কাটতে শুরু করলাম। উনিও চোখ বন্ধ করে ফেললেন। বেশ কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম উনি ঘুমিয়ে পরেছেন। সত্যিই খুব ক্লান্ত ছিলো তাইতো এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরলো।ক্লান্ত ঘুমন্ত মুখটাতেও অদ্ভুত মায়া কাজ করছে। আমি একদৃষ্টিতে দেখছি ওনাকে আর সেই মায়ায় নিজের অজান্তেই হয়তো জরিয়ে যাচ্ছি। ছেলেটা কখন কী করে কী চান সত্যিই বুঝতে পারিনা আমি। আচ্ছা উনি কেন এসছেন এখানে? আর আমায় ফেরাতেই বা কেনো চাইছেন? শুধু দায়িত্বের খাতিরে? তাহলে তো সকালেই রওনা দিতে পারতেন ওই রাতের বেলা খাওয়া, ঘুম সব ছেড়ে কেন এলেন? উফফ কিচ্ছু ভাবতে পারছিনা। তবে যাই হোক এতো তাড়াতাড়ি রাজি হবোনা আমি। অনেক কষ্ট দিয়েছে আমায়। যতো যাই করুক না কেনো? এসব ভাবতে ভাবতে মামী এসে বলল,

--- " এই অনি শোন হি.."

কিন্তু আমাদের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল। এইরে দরজাটাও বন্ধ করিনি। এরমধ্যে নানুও এলো পেছন পেছন উনিও আমাদের এভাবে দেখে থেমে গেলেন। নানু আর মামী একে ওপরের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলেন। মামী হাসতে হাসতে বলল,

--- " আরে দরজাটা বন্ধ করে নিবিতো।"

আমি হকচকিয়ে গিয়ে একটু তুতলিয়ে বললাম,

--- " ন্ না আসলে মামি।"

নানু্ও হাসতে হাসতে বলল,

--- " আচ্চা হয়েছে আমরা দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। ও ওঠার আগে কেউ আর এসে ডিসটার্ব করবেনা।"

হিয়া আপি আর ইফাজ ভাইয়া আসছে সেই নিউসটা দিয়ে ওনারা চলে গেলেন। আমি মুখ ভার করে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। না জানি কখন উঠবে। ততোক্ষণ আমায় এভাবে বসে থাকতে হবে দূর। শুধু শুধু বসে থাকতে ভাল্লাগছেনা তাই ওনার মাথায় আবার বিলি কেটে দিতে শুরু করলাম আর নানারকম ভাবনার সমারোহ ঘটলো মনে।

_________________

বিকেলের দিকে আপিরা চলে এলো। সাথে করে আদিব ভাইয়া, জাবিন আর আমার বাদর হতে গিয়ে ভুল করে মানুষ হয়ে যাওয়া আমার ভাই কাব্যকেও নিয়ে এসছে। আদ্রিয়ান, ইফাজ ভাইয়া,আপি, সজীব ভাইয়া, অর্ণব ভাইয়া, কাব্য, আদিব ভাইয়া ছাদে বসে সবাই মিলে গল্প করছে কিন্তু আমি মুখ ভার করে হাটু গুটিয়ে বসে আছি। অন্যসময় হলে হয়তো সব মাতিয়ে রাখতাম। কিন্তু আপাতত আমি রেগে আছি সবার ওপর বিশেষ করে আদ্রিয়ানের ওপর তাই কিছু বলছিনা। অর্ণব ভাইয়া বলল,

--- " কী হলো? আমাদের মিস বাচালনি এতো চুপচাপ? এটা ভাবা যায়?"

সজীব ভাইয়াও তাল মিলিয়ে বলল,

--- " আমিও সেটাই ভাবছি। কী রে বুড়ি? কী হয়েছে? খিদে পেয়েছে?"

আমি রাগে কটমট করে ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম,

--- " দেখো আমাকে একদম লেগ পুল করবেনা বলে দিচ্ছি।"

কাব্য হাসতে হাসতে বলল,

--- " তোর যেই দুফিটের লেগ। ওটা কেউ পুল করতে যাবেনা।"

আমি রেগে বললাম,

--- " এই তুই চুপ করবি? কানের নিচে ঠাটিয়ে একটা মারবো বেয়াদব ছেলে।"

ইফাজ ভাইয়া বললেন,

--- " হ্যাঁ তাইতো আমার বাচ্চা শালীটার লেগ পুল কেনো করছো?" 

আমি বিরক্তি হয়ে বললাম,

--- " ভাইয়া আমি মোটেও বাচ্চা নই। আ'ম এইটটিন নাও।"

আদ্রিয়ান ফোন দেখতে দেখতে বললেন,

--- " হ্যাঁ হ্যাঁ। ওকে বাচ্চা বলোনা। ও মোটেও বাচ্চা নয়। ও তো বুড়ি হয়ে গেছে। ঠাকুমা বলো।"

এরপর ফোন থেকে চোখ তুলে বলল,

--- " তা ঠাকুমা তোমার ঝুলিটাও একটু খোলো? আমরা সবাই একসাথে শুনি। ঠাকুমার ঝুলি?"

সবাই খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। আমি উঠে দাঁড়িয়ে মুখ ফুলিয়ে বললাম,

--- " এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছেনা।"

আদিব ভাইয়া হাসি থামিয়ে বলল,

--- " ছাড়না মেয়েটাকে এভাবে রাগাচ্ছিস কেনো।"

আপিও বলল,

--- " হ্যাঁ আদ্রিয়ান এবার থামো।"

আদ্রিয়ানও হাসি থামিয়ে দিয়ে সিরিয়াস মূখ করে বলল,

--- " ওহ হ্যাঁ তাইতো? ঠাকুমা রেগে গেলে তো আর ঝুলি খুলবেন না। না না ঠাকুমা রাগ করেনা আমরা আর কিছু বলছিনা।"

বলে আবারও শব্দ করে হেসে দিলেন। সাথে সবাই যোগ দিলো। আমি একবস্তা রাগ নিয়ে ফুসতে ফুসতে ওখান থেকে চলে যেতে নিলেই আদ্রিয়ান আমার হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে বাকিদের দিকে তাকিয়ে বললেন,

--- " এই একদম আমার বউকে রাগাবেনা কেউ। যে রাগাবে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। আর খবরদার কেউ ধারা জানতে চেওনা কারণ ওটা আমারও জানা নেই। সো বি কেয়ারফুল ওকে?"

সবাই একসাথে বলে উঠল,

--- " ওকে।"

বলে সবাই আবারও হেসে দিলো। আমি মুখ ফুলিয়ে বসে আছি। উঠতেও পারছিনা কারণ আদ্রিয়ান আমার কোমর জরিয়ে ধরে বসে আছেন। শুধু শুধু আমায় ইরিটেড করছে। ইচ্ছে করছে একটা আস্তো নারকেল নারকেল ফাটাই ওনার মাথায়। ইচ্ছে করে এমন করছে আমার সাথে। আমি নাকি ঠাকুমা। কোন এঙ্গেল দিয়ে ঠাকুমা লাগে আমায়? কথাই বলবোনা কারও সাথে। ওনার সাথেতো একদমই না। নেভার।
.
.
.
চলবে............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন