ডানপাশের চওড়া বিল্ডিং ফেলে যাচ্ছে আমাদের গাড়ি। পরপর
এক বড় বাজার সামনে আসল। মানুষে গিজগিজ করছে। চারপাশে হৈচৈ। মাছ বিক্রেতাদের হাতে বড়বড় মাছ। সবজি ভর্তি ভ্যান দাঁড়িয়ে, ঠিক গাড়ির পাশে। বোরকা, কামিজ, শাড়ি পরিহিত নারীদের কোমর বেঁধে বাজার করার এক যুদ্ধ চলছে। দৃশ্য'টি আঁকতে সক্ষম হলে, খুবই সুন্দর এক ছবিতে রুপান্তরিত হতে পারতো। দীপ্ত কাঁধে ঘুমিয়ে পরেছে। ওর ঝাকড়া চুলগুলো গুঁছিয়ে দিলাম। ছেলেটা আমাকে বিপাকে ফেলে। তারপরও রেগে থাকতে পারিনা। অফুরন্ত আদর করতে ইচ্ছে হয় যে। ওর ছোটছোট
চোখের গ্লাস খুলে দিলাম। এই বয়সে ওর চশমার প্রয়োজন।
খালি চশমায় সবকিছু আবছা দেখে। সমস্যা'টা জন্মগত।
ইব্রাহিম ভাইয়া ধীর কন্ঠে বললেন,
' অরু তোমাদের কিছু লাগবে? এই বাজারের পর আর বাজার বা দোকান পাওয়া যাবেনা তেমন। পাহাড়ি অঞ্চলে ঢুকবো। '
বড় মা তো খাবার প্যাক করে দিয়েছেন। আর কী লাগবে? আমি রুবি আপুর দিক তাকালাম। রুবি আপু জবাব দিলেন,
' দীপ্তর জন্য, কিছু চিপস নিয়ে রাখ। তাতেই হবে। '
হ্যাঁ, এটা ঠিক। ইব্রাহিম ভাই দোকানের দিক যাচ্ছেন। আমি আবারও দূরবর্তী বাজারের দিক ধ্যান দিলাম। আঁড়চোখে সামনেও তাকালাম। তন্ময় ভাই ফোন টিপছেন। আজকে যা ভয় দেখিয়েছেন আমায়, মনে হয়না আমি আর তার আশপাশ থাকতে প্রস্তুত।
উফ। কী এক শব্দের জন্য হেনস্তা করলো। আমি আর ওই শব্দ জীবনে উচ্চারণ করব না। একদম করবো না।
ইব্রাহিম ফিরতে গাড়ি আবারও চলতে শুরু করেছে। চিকন সরু রাস্তা। আশেপাশে ফাঁকা। শুধু প্রাকৃতিক পরিবেশ। দোকানঘর পেছনে চলে যাচ্ছে। সামনে আর দেখা যাচ্ছে না।
হাত বের করতে গিয়েও দ্রুত ঢুকিয়ে ফেললাম। নাহলে শয়তান'টা আবার চেঁচাবে। রুবি আপু ইশারা করলেন,
' তোর ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট কই? '
আঁড়চোখে তন্ময় ভাইয়ের দিক তাকালাম। আমি কী বলে দিব যে, তন্ময় ভাই অ্যাকাউন্ট ডিলিট করে দিয়েছিলেন? বলেই দিব।
নালিশ ও দিব। না থাক। এভাবেই তা'কে দেখলেই শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। জবাব না পেয়ে রুবি আপু ফোনে মনোযোগী হলো।
হঠাৎ ইব্রাহিম ভাইয়া আমাকে দিয়ে রুবি আপুকে ইঙ্গিত করছেন,
' এখনও ব্লক খুলছে না। আজকাল মানুষদের মায়াদয়া কমে যাচ্ছে। একদম পাথরে পরিনত হচ্ছে। '
হাসি পাচ্ছে। রুবি আপু পারেও বটে। কী সুন্দর ভাবে ইব্রাহিম ভাই মানানোর চেষ্টা করছেন। ইশ, কিউট। এই কাহিনি যদি আমার আর তন্ময় ভাইয়ের মাঝে হতো। তাহলে সর্বপ্রথম তিনি এসে আমাকে এক থাপ্পড় দিতেন, তারপর ব্লক খুলে, ধমকে রফাদফা হতেন।
ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। আমার কপালে কেন ইনাকে পরতে হলো। হাহ।
রাতের আঁধার নেমে এসেছে। পাহাড়ি এলাকায় আমরা পৌঁছে গেছি। রাতের গভীরে হালকা ভাবে পাহাড়ের চড় দেখা যাচ্ছে। ওপাশে। এখনও দূর। এখানে হোটেলের জন্য আসা। এখানে
রাত্রে বেরোনো সাংঘাতিক ভয়ংকর ব্যাপার। ডাকাত আরও হাবিজাবি থাকে নাকি। রাতে না বেরোনো'ই উত্তম। দুটো রুম
বুক করা হয়েছে। একটা'য় আমি আর রুবি আপু। দ্বিতীয়'টা পুরুষ তিনজনের। চাবি দ্বারা রুম খুলে দিয়ে ইব্রাহিম ভাই বললেন,
' যারতার আওয়াজে রুম খুলবে না। '
রুবি আপুর জবাব,
' বাচ্চা না আমরা। যাও নিজের কাজে। '
মাথা ধরেছে আমার। ভেতরে ঢুকে এলাম। এই দুজনের ঝগড়া অকারণে লাগে। কী সাফ দিলকে ইব্রাহিম ভাই। তার সাথে কেন লাগে আপু? হু। পরপর আপুও এলেন। বললাম,
' তুমি ভাইয়ার সাথে শুধু শুধু লেগে থাক। নেহাতি তিনি তোমাকে
প্রচন্ড ভালবাসেন। নাহলে দেখতে, ধাক্কা দিয়ে ফেলে চলে যেত।'
রুবি আপু ভেঙালেন।
' কচু। তুই তো ওটাকে এখনও চিনতে পারিস নি। আর চিনবিও না। বাদ দে। যা ফ্রেস হ। '
হ্যাঁ, এটাও ঠিক অবশ্য। কে কোন মসিবতে রয়েছে, তা নিজে ছাড়া আর কেউ জানবে না। তাই না? ফ্রেস হয়ে আমি বিছানায় ঝাপিয়ে পড়লাম। ক্লান্ত লাগছে। মারাত্মক ডিজিটাল রুমটা। থাই গ্লাসটা সরালেই সুন্দর বাহিরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ে পাহাড়ের অবাস্তবিক সংমিশ্রণের দৃশ্য। রাতের আঁধারে সম্পুর্ন সৌন্দর্য উপভোগ করা যাচ্ছে না। সকালে উপভোগ করা যাবে।
আপাতত ঘুমানো প্রয়োজন। যখন ঘুমানোর প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম, আপু অবাক স্বরে বললেন,
' তুই আবারও ঘুমোবি? '
' তো কি করব? '
' উঠ। ওদের ডাকি। আড্ডা দি। বা খেলি। মজা হবে। '
' ইশ। এতো জার্নি করে আসলাম। আপাতত ঠান্ডা এক ঘুম।
তারপর সব কিছু। '
দরজায় নক। রুবি আপু দেখে খুলল। দীপ্ত এসেছে।
' ফ্রেস হব। কাপড় দাও। '
আপু বের করে দিলেন। দীপ্ত লাফাতে লাফাতে চলে গেল। এবার ঘুমানো যাবে। আরামসে।
দরজার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো। আবছা চোখে দেখলাম, ইব্রাহিম ভাই আপুকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। আপু ধীরে চেঁচাচ্ছেন,
' অরু একা। ধুর। '
' তন্ময় আছে। '
' হাত ছাড়। নাহলে..! '
' তুমি কী চাচ্ছ? কোলে তুলবো? '
' এই না। খবরদার। একদম তোমার গলা কেটে দিব। '
' আচ্ছা, দিও। '
ঘুমের মাঝেই হাসলাম। ঝাসিকি রানী। ভাইকেও ছাড় দিচ্ছেনা। বাহিরে নিতে চাচ্ছে হয়তো। রাতের ভিউ খুবই সুন্দর। ভেতরে আসার পূর্বে দেখেছিলাম। সেটাই দেখাতে নিচ্ছেন। আমি শুয়েই রইলাম। উঠতে ভালো লাগছে না। বেড-শিট চেপে আবারও চোখ বুঝলাম। কাল ঘুড়া যাবে। এক্সাইটেড। তখনই শব্দ। চলে আসল আপু? এতো দ্রুত? আমি ফিরলাম। চোখ কপালে তুলে বললাম,
' আপনি? '
তন্ময় ভাইয়ের জবাব নেই। বেশ শব্দ করে পাশে শুয়ে পরলেন। শুধু শুয়ে পড়লেন না, বিচ্ছিরিভাবে হাত-পা আমার উপর মেলে দিলেন।
শ্বাস আটকে আসছে। দ্রুত উঠে গেলাম। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে দূরে দাঁড়ালাম। একটা কথার জন্য তার এই রূপ? আগেই তো ভালো ছিলো। পরিবর্তন কেন হতে গেলো?
' আপনি এখানে কেন? '
তার জবাব নেই। ঘুমের ভান ধরেছে। এটা কী ধরনের অসভ্যতা?
বদমায়েশ লোক। আবারও প্রশ্ন করলাম,
' দীপ্ত কোথায়? '
' বাহিরে গিয়েছে। '
ওহ। তাহলে তিনজনই গিয়েছে তারা। আমাকে নিল না কেন? ডাকলেই তো হতো। অবশ্য আমি উঠতাম নাকি সন্দেহ।
' আপনাদের রুমে যান। ঘুমাব আমি। '
জবাব নেই তার।
' উঠুন। '
উঠছে না কেন?
' কি হলো, উঠুন। '
এবার তিনি উঠলেন। দু'হাতে চুল উচু করে বললেন,
' চল। '
' কোথায়? '
' গেলে দেখবি। '
ওহ। এই কথা। সাহেব হুকুম দিচ্ছেন। ভাবছিলাম না করে দিব। যাবো না বলতাম। কিন্তু একা ভয়ও করবে। অগ্যত যেতেই হবে৷
বাহিরে নিয়ে এসেছেন। সুন্দর আবহাওয়া। মৃদু বাতাস। চমৎকার অনুভূতি হচ্ছে। কিছুটা শীতও।লাগছে। ওড়না দিয়ে শরীর পেঁচিয়ে নিলাম। তার প্রশ্ন,
' ঠান্ডা লাগছে? '
' উঁহু। হালকা। ভাললাগছে। '
তিনি মিষ্টি হাসলেন। আমার দিক তাকালেন। আমিও আঁড়চোখে তার দিক তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে গেল। দ্রুত চোখ ফোরালাম। তার হাসির শব্দ,
' এতো নার্ভাস হচ্ছিস কেন? '
বললাম,
' কোথায়? '
তিনি হেসেই যাচ্ছেন। হাসলে তাকে সুন্দর দেখায়। মায়াবী দেখায়। এই হাসি থামানো প্রয়োজন। নাহলে নির্ঘাত আমার মন গলে তলিয়ে যাবে। প্রশ্ন করলাম,
' আপুরা কোথায়? '
' দ্বিতীয় রুমে। '
' কিহ? আপনাদের রুমে? আপনি না বললেন বাহিরে? তাহলে দীপ্ত কোথায়? '
' ঘুমাচ্ছে। '
স্পিচল্যাস হয়ে গেলাম। মানুষ পারেও বটে। আগে বললে তো আমি আসতাম না। রুমেই থাকতাম। ভাবলাম তারা নিচে, দেখা হবে। তা না। এভাবে তার সাথে পাশাপাশি হাঁটার অনুভূতি অতটা খারাপ না।
ভালোই লাগছে। ধীরে তার হাতের সাথে আমার হাত স্পর্শ করছে।
কিছুটা যায়গা রাখলাম মাঝে। আঁড়চোখে তাকে দেখে নিলাম। আসলেই তিনি খুব সুন্দর। হ্যান্ডসাম।
.
.
.
চলবে...................................