প্রেয়সী - পর্ব ২০ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


আমার জন্য বাড়িতে অঘোষিত নিয়ম ছিলো কোনো পিকনিক, ফ্রেন্ডস ট্রিপ অ্যাটেন্ড করা যাবেনা। অবশ্য ওটা বাড়ির নিয়ম কোনো কালে'ই ছিলো না। ওটা ছিল তন্ময় সাহেবের নিয়ম। 
তার আবার আমাকে নিয়ে ছিলো ময়লা চিন্তাভাবনা। যেটার বিন্দুমাত্র অনুমান অসহায় আমার ছিল না। যাইহোক, আজকের ট্রিপ আমি একদমই এঞ্জয় করতে পারবো না। কারণ, সোজা।
 সাথে থাকবে তন্ময় ভাই। দ্য গ্রেট তন্ময় শয়তান।
 এ থাকলে সাথে, 
এঞ্জয় যাবে ভেসে। 
আর যেহেতু ইব্রাহিম ভাই যাচ্ছে। তাহলে রুবি আপুকে তো আর পাওয়া যাবেনা। আমাকে তন্ময় ভাইয়ের সাথে'ই থাকতে হবে। 
আর তিনি আমায় নড়তে দিবে নাকি সন্দেহ। কত ধমক-থাপ্পড় কপালে আছে, তা পরে বেরিয়ে আসবে। স্রোতের মতো। 
দীপ্ত বিছানায় বসে। গেইম খেলছে। ছেলেটা মারাত্মক খেলতে পারে। আমিতো শুরু করতেই শেষ। 
অবশেষে আমার প্যাকিং কমপ্লিট। দীপ্ত'র আমার জিনিসপত্র একসাথে প্যাক করেছি৷   
 ও আঁড়চোখে তাকালো, 
' এবারেও হাঈস্কোর। '
' বাহ। '
' দেখতে হবেনা কে খেলছে। '
' কে খেলছে? '
' শাহজাহান দীপ্ত। '
' মা'গো। '
কথা দেখেছ ছেলের? বয়স হিসেবে বেশি বুঝে এবং জানে। পাকা ধান একদম। 
রুবি আপু পরপরই তার ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে হাজির। সানগ্লাস মাথায় স্যাট করে বলল,
' চল। তন্ময় দাঁড়িয়ে। '
' দাঁড়াতে দাও। '
' এহ। দাঁড়াতে দাও। পরে দেখা যাবে, ও আর যাবেই না নিয়ে। '
' তাতে কী? ইব্রাহিম ভাইয়ের সাথে যাবা। '
রুবি আপু থমকে গেলেন। নিশ্চয়ই কালকের ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা মনে করছেন। হি হি হি। 
রুবি আপু আঁড়চোখে তাকাল, 
' পাজি। দ্রুত কর। '
হেসে ফেললাম শব্দ করে। এখন লজ্জা পাচ্ছে। আর আমার সাথে কীসব আজেবাজে কথা বলেন, তখন লজ্জা করে না। 

যাবার সময়, বড় মা খাবার প্যাক করে দিবেন বলে, নাজেহাল অবস্থা করে ফেলেছেন আমাদের৷ তার উৎসুক দৃষ্টি তন্ময় ভাইয়ের উপর। 
' ছেলেটা আমার বাহিরের খাবার একদম খেতে পারেনা। গ্যাস্টিক উঠে যায়। তোরা নিশ্চয়ই এই দু'দিন রেস্টুরেন্টের খাবার খাবি। '
ইব্রাহিম ভাই জানালেন, 
' টেনশন নিয়েন না । উম, তন্ময় ক্যান হ্যান্ডেল। তাই না তন্ময়? '
তন্ময় ভাই বড়দের মতো বড় মা'র মাথায় হাত বোলালেন। আদূরে ভাবে বড়'মার মাথা চেপে বললেন, 
' সমস্যা হবেনা। আসছি। '
বড় মা গলে গেলেন। এবং আমাদের নানান জাতীয় স্ন্যাকস প্যাক করে দিলেন। তন্ময় ভাইয়ের জন্য ফ্ল্যাক্সে চা দিতেও ভুললেন না। 

ইব্রাহিম ভাইও নিজের গাড়ি নিয়ে এসেছেন। যেহেতু মাত্র পাঁচজন ট্রিপে যাচ্ছি, দুটো গাড়ি নেওয়ার প্রশ্নই আসেনা। তো সকলে যাব তন্ময় ভাইয়ের গাড়ি করে। তারা পুরুষ দুজন সামনে বসেছে। 
আর আমরা তিনজন পেছনে। আমি জানালার সাইডে। মাঝে দীপ্ত আর অপর সাইডে রুবি আপু। দীপ্তর নজর গেমসের দিক চলে গেলো। রুবি আপু আঁড়চোখে ইব্রাহিম ভাই'কে দেখতে ব্যস্ত। আর আমি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে। সুন্দর দৃষ্য। গাড়ি করে বেরোলে নজর সদা বাহিরে থাকে আমার। দ্রুত গতিতে অতিক্রম করা পথযাত্রা দেখতে বেশ লাগে। একদম নেশায় তলিয়ে যাওয়ার মতো। হঠাৎ তন্ময় ভাই ধমকালেন, 
' হাত ভেতরে নে। '
এইতো শুরু। আমায় এঞ্জয় করতে দিবেনা সেটার কসম কেটে এসেছেন । জানালা'ই বন্ধ করে দিলাম। যা দেখব না বাহিরে। তাতে কী। 
তন্ময় ভাই কর্নারের আয়না দিয়ে আমাকে চোখা রাঙালেন, 
' হাত বাহিরে দিতে না করেছি। উইন্ডো বন্ধ করতে বলিনি। 
খোল। '
' আমার পাশের জানালা। আমি খুলবা নাকি খুলবো না, সেটা একান্তই আমার ব্যাপার। '
' গাড়ি আমার। '
কত্তবড় বেশরম। 
' তাহলে আমি যাব না। গাড়ি থামান। আমি বাড়ি যাব। '
রুবি আপু হাসছেন, 
' কী সাংঘাতিক। এদের নিয়ে ট্রিপে গিয়েও শান্তি নেই। মাবুদ। '
তন্ময় ভাই মাঝপথে গাড়ি থামালেন। এবং ঠিকঠাক আমার পাশে এসে জানালা খুলে আবার গাড়ি স্টার্ট করে দিলেন। রাগবো না হাসবো ভুলে গেলাম। এমন শয়তান আমি আমার এতবছরের জীবনে দুটো দেখিনি। আমিও কম না। এই জানালা'র দিক আর তাকাব না। রুবি আপুকে বললাম, 
' এ'পাশে বস তো। '
তন্ময় ভাই না করে দিলেন, 
' রুবি উঠবি না। '
দজ্জাল একটা। 
' উঠবে না মানে? আপনার কথায়? '
তার জবাব নেই। রাগে আমি দীপ্তর দিক ফিরলাম। তখনই দীপ্ত কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা মেরে দিল, 
' তন্ময় ভাই। অরু আপু তোমাকে আনরোম্যাক্টিক গাধা বলেছে, রুবে আপুর রুমে বসে। '
হায়রে আল্লাহ। এটা কোন জালিয়াতিদের সাথে আমি। জোরসে চেঁচালাম, 
' না। মিথ্যে। এমন ক..কথা আমি কখনও বলিনি। গাধা আমি বলিনি। দীপ্তর বাচ্চা। '
ইব্রাহিম ভাই হাসছেন, 
' তার মানে আনরোম্যান্টিক বলেছ? '
আমার আওয়াজ বেরে গেলো, 
' না সেটাও বলিনি। সত্যি। '
পরপর দীপ্তর গলা চেপে ধরলাম। এই জাহিল পুচকে। এটা সব নষ্টের গোড়া। এবার আমার কান্না পাচ্ছে। জানতাম, এই ট্রিপে শুধু অত্যাচার হতে এসেছি। 
ইব্রাহিম ভাই শান্ত গলায় বললেন, 
' অরু, তোমাকে এক কাহিনি বলি। শোন। আমি আর তন্ময় কিন্তু একই স্কুল, কলেজ এবং ভার্সিটি থেকে। তো তোমাকে ভার্সিটি লাইফের এক ইন্সিডেন্ট বলি। আমাদের ব্যাচের ছেলেমেয়ে একেকটা হাঈসোসাইটি থেকে ছিল। সেখানে একটা মেয়ে ছিলো। নাম ঠিক মনে নেই। সেই মেয়ের বাবা মন্ত্রী ছিলেন। মেয়ের পাওয়ারে ভার্সিটি কাঁপে। ওই মেয়ে তন্ময়'কে দেখে ফিদা। ফ্রেন্ড একটা'কে পাঠিয়েছে প্রস্তাব নিয়ে। তন্ময়'কে তো চিনো। একঘেয়ে। ও তো জবাবই দেয়নি। এটা নিয়ে পুরো ভার্সিটি'তে সমালোচনা। নিউজ ছড়িয়ে পড়লো, তন্ময় মিনিস্টারের মেয়ে'কে রিজেক্ট করে দিছে। 
তারপর দিন ওই মেয়ে সামনে হাজির। নানান তর্কাতর্কি আমাদের সাথে। তন্ময়ের পাত্তা না পেয়ে, আমাদের বলেছিল। তখন আমি কুয়েশ্চন করেছিলাম, 
' ওকে তোমরা মেয়েরা এতো পছন্দ কেন কর বলোতো? ও তো একদম আনরোমান্টিক পারসন। মেয়েদের হ্যান্ডেল করতে জানে না। কখনও ঠিকভাবে কথা বলেনা। মেয়ের জবাব কী ছিলো, জানো? '
দীপ্তর উৎসুক কন্ঠ,
' কী? '
' বলেছিল, তন্ময় যেভাবে তাকায় সেটা দিয়ে একটা রোমান্টিক ইনটেন্স মুভি বানানো যাবে। আর হঠাৎ ওর চোখে চোখ পড়লে তার দ্বারা প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্ট পেয়ে যাবে। মেয়েদের জাতীয় ক্রাশ, সেই তন্ময়'কে তুমি আনরোমান্টিক বলো? ভাবা যায়? '
কান দুটো গরম হয়ে উঠলো। ছিঃ। রুবি আপু চোখ রাঙাল। ইব্রাহিম ভাইকে ধমকে দিল,
' চুপ থাক তুমি। '
আমি আলগোছে অন্যদিকে ফিরে গেলাম। কী লজ্জাজনক পরিস্থিতি। আজীব। একটা বিষয় নিয়ে, কী সাংঘাতিক ফিল্ম বানিয়ে ফেলল একেকজন। আনরোমান্টিক বলে, পাপ করে ফেলেছি যেমন। হাজার বার বলব, 
' আনরোমান্টিক, আনরোমান্টিক, আনরোমান্টিক। হু। '
আমিতো আনরোমান্টিক বলি কারণ, তিনি ভালভাবে কথা বলেন না। ফ্রেন্ডসদের বয়ফ্রেন্ডদের দেখি কী মোহাব্বত নিয়ে কথা বলে। আর তিনি কল দিয়ে একমিনিট পর কেটে দেন। তাই না আনরোমান্টিক বলি। 
আবারও জানালার বাহিরে নজর দিলাম। অনেকটা দূরে চলে এসেছি। চারপাশে সবুজ রঙের পরিবেশ। চমৎকার বাতাসে চুল আওলে আসছে। আমার চোখ লেগে আসছে। এই এক যন্ত্রণা। অতিরিক্ত ভাললাগায় চোখ বুঝে আসে। ঘুম পায়। 

ঘুমিয়ে পরেছিলাম বুঝি। শরীরের কাপড় শক্ত করে ধরে গোঙালাম। ঠান্ডা লাগছে কিছুটা। আবছা ভাবে চোখ মেললাম। এখনও গাড়িতে। অথচ, গাড়ি চলছে না। সামনের দিকে কেউ নেই। পাশে তাকাতেই দ্রুত উঠে বসলাম। পাশে তন্ময় ভাই। আমি তার কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে ছিলাম। ভাবা যায়? রুবি, দীপ্ত এরা কই? আঁড়চোখে তার দিক তাকালাম। তিনি এখনও আমার দিক তাকিয়ে। হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, 
' আমি আনরোমান্টিক? '
কলিজার পানি সব শুকিয়ে গেল। এটা কোনো কথা? এই একটা অযুক্তিযুক্ত কথা এখনও কেন মনে রেখেছে লোকটা? '
দ্রুত বললাম, 
' স..সসত্যিই বলিনি। '
ওদিকে কত যায়গা। অথচ আমার সাথে লেগে বসে। সমস্যা কী? 
তৎক্ষণাৎ তিনি আমার কোমরে চেপে নিজের কোলে বসালেন। 
অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় আমি চেঁচালাম, 
' তন্ময় ভা..। '
জামার ফালির ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে কোমর স্পর্শ করলেন। নামার চেষ্টা করতেই তিনি শক্ত করে চুল ধরলেন। মাথাটা তার দিক এগিয়ে নিলেন। 
' সারাজীবন তন্ময় ভাইয়া বলে বেরিয়েছিস ৷ এখন তোর সেই তন্ময় ভাইয়া যদি হঠাৎ তোকে স্পর্শ করে। তোর হয়তো খারাপ লাগবে। ব্যাপারটা হজম হবেনা। আমাকে ক্যারেক্টরল্যাস ভাবতে পারিস। বিদায় নিজেকে এতো কন্ট্রোল করা। কিন্তু সেই নিজেকে কন্ট্রোল রাখার দেখছি কোনো প্রয়োজন নেই। '
এমন আক্রমণে আমি ঠিক নেই। নির্ঘাত মরে যাব। তার বেগতিক হাত চেপে ধরলাম। 
' প্লিজ। '
তার আমার কথায় মনোযোগ নেই। তিনি কথার অমান্য করে, গলায় মুখ ডোবালেন। রুহ উড়ে যেতো যদি না রুবি আপু আসতো। রুবি আপুর আওয়াজ শুনে আমাকে ছেড়ে দিলেন। জীবনে মনে হয়, এমন ভয় আর অনুভূতি পায়নি। দ্রুত পায়ে গাড়ি থেকে নামলাম। 
রুবি আপুকে আমাকে দেখে তন্ময় ভাইয়ের দিক তাকালেন। আমি আপুর হাত চেপে ধরলাম। শরীর এখনও কাঁপছে। দাঁড়াতেও শক্তি পাচ্ছি না। আপু হাসলেন। 
' আয়। '
আর সাহস করলাম না তার দিক তাকানোর। 
.
.
.
চলবে...................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন