প্রেয়সী - পর্ব ২৪ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


রুবি আপু জোরসে চেঁচাচ্ছে, 
- যাব না, যাব না। 
নিশ্চয়ই ইব্রাহিম ভাই ডাকছে তাকে। কতটা ভালবাসেন। একদম চোখ ছাড়া করেন না। কতটা লাকি আপু। আর তন্ময় ভাই। ইশ, নাম ও নেই। লোকটা সেই যে গিয়েছে। হাওয়া। যাক, যাক, যাক। 
মাত্র ছয়টা। যাও ঘুম ধরেছিল, তন্ময় ভাইয়ের ধমক খেয়ে চলে গেলো। এখন তাকে জ্বালাবো। কেন আমার ঘুম ভাঙিয়েছে। 
এবার আর তাকে মেসেজেস করলাম না। বরং সাহস নিয়ে রুমের দরজা খুলে বাহিরে গেলাম। তার রুম পরেরটি। রুমের দরজা খোলা। ধীরে গিয়ে উঁকি দিলাম। তিনি শার্টল্যাস। শরীর কেঁপে উঠলো। শার্টল্যাস তিনি, অথচ শ্বাসকষ্টে আমি। মাত্র গোসল সেরেছেন হয়তো। এখনও চুলে পানি। তিনি দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। হঠাৎ ঘুরে আমাকে দেখে ফেললেন। আমার দৌঁড় আর কে দেখে। তার শব্দ করে ডাকা শুনতে পেয়েছিলাম। তাও থামিনি। বুক ধুকপুক করছে। রুমে ঢুকে দরজা লক করে ফেললাম। রুবি আপু নেই। ওহ। তিনি তো ভাইয়ার সাথে বাহিরে বসে। বিছানায় শক্ত করে বসে আছি। যখনই ভাবলাম তিনি আসবেন না। তখনই দরজায় নক। নিশ্চয়ই তন্ময় ভাই। খুলে রিস্ক নেওয়ার প্রশ্নই আসেনা। 
বিছানায় উঠে কম্বলের ভেতর ঢুকে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ হচ্ছে। 
এখন আর কোনো নক নেই। আহ, চলে গিয়েছে। ধীরে এগিয়ে গেলাম। আস্তে করে দরজা হালকা খুলে, মাথাটা বের করেছিলাম। 
তন্ময় ভাই সোজা সামনে দাঁড়িয়ে। এই লোক যায়নি? দরজা লাগাতে গিয়েও পারলাম না। আমার থেকেও দ্রুত গতিতে 
 তিনি রুমে ঢুকলেন। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমার চুল টেনে ধরলেন, 
- ডেকেছিলাম, শুনেছিলি? 
ধীরে জবাব দিলাম, 
- শুনিনি। 
মারাত্মক ধীরে বললেন, 
- মিথ্যে কথা। ব্যাড গার্ল। 
ঢোক গিললাম। এভাবে কথা বলছে কেন? আঁড়চোখে তাকালাম। 
আমার দিক তাকিয়ে হাসলেন। বললেন, 
- রেস্ট নে। ইউ নিড ইট। 
চলে গেলেন। বড় বড় শ্বাস ফেললাম। এটা কোনো কথা? 

রাত গভীর। বিছানায় শুয়ে মনে পড়লো, সকালে পরিবার থেকে কল এসেছিল। মা-বাবা, বড় চাচ্চু, বড় মা সকলে কথা বলতে চেয়েছিলেন। কথাই বলতে পারলাম না। পাহাড়ে চড়ার জন্য এতটা এক্সাইটেড ছিলাম যে, ব্যাপারটা মাথা থেকে চলে গিয়েছিল। এখন তো অনেক রাত। হয়তো সকলে ঘুম বিভোর। কাল কথা বলে নেব। 
চোখ লেগে এসেছিলো, তখনই তন্ময় ভাই হন্তদন্ত হয়ে রুমে এসেছেন। তার এমতাবস্থা দেখে আমি দ্রুত বিছানা ছাড়লাম। 
তিনি ভাঙা কন্ঠে আদেশ দিলেন, 
- দ্রুত তৈরি হ। 
তার অবস্থা দেখে তৎক্ষণাৎ কেউ প্রশ্ন করেনি। বরং জামাকাপড় পরিবির্তন করে, কাপড়চোপড় ব্যাগে নিতে নিতে
 আপু প্রশ্ন করলো, 
- কী হয়েছে তন্ময়? 
তন্ময় ভাইয়ের জবাব নেই। ইব্রাহিম ভাই হাঁপাতে হাঁপাতে 
জবাব দিলেন,
- অরুর আম্মু হার্টএট্যাক করেছেন। 
আমার সামনের পৃথিবী থমকে দাঁড়ালো। কেমন সব অন্ধকারে মিশ্রিত হলো। সে তো ভালো ছিলেন, তাহলে? আসার পূর্বে সম্পুর্ন সুস্থ দেখে এসেছি। হঠাৎ কি হলো? মায়ের চেহারা চোখে ভাসতেই শরীর নেতিয়ে যাচ্ছে৷ এটা তার দ্বিতীয় তম হার্টএট্যাক। ভয়ে বুকে যন্ত্রণা হচ্ছে। কিছু হবেনা তো? ঠিক হয়ে যাবে তো? 
তন্ময় ভাই টেনে তার বুকে চেপে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। 
প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। কতক্ষণ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে যেয়েও, পারলাম না। চোখের জল অকারণে বেয়ে যাচ্ছে দিশেহারা হয়ে । কাঁদছি কেন আমি? মা ঠিক হয়ে যাবে। তন্ময় ভাই আমাকে নিয়ে হাঁটা ধরলেন। গাড়িতে বসিয়ে তিনি ড্রাইভিং গেলেন। পেছনে রুবি আপু আমাকে ধরে বসলো। আজ বাহিরের প্রকৃতিও আমাকে মোহিত করতে পারছে না। ধ্যান মেরে নিচে তাকিয়ে। এইত সেদিন বিকেলে কী সুন্দর কফি বানাতে শেখাল। বোকাঝোকা করলো। 
কী হয়ে গেলো একদিনের মাঝে? 

হসপিটাল পৌঁছে বাবার শুঁকনো চেহারা। চোখ নাক লালচে হয়ে আছে। পুরুষ মানুষ বিদায় কেমন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে। অথচ আমি কত সহজে কেঁদে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আচ্ছা, বাবার কেমন লাগছে? 
তিনি তো কাঁদতে পারছেন না। তার কী যন্ত্রণা'টা অতিরিক্ত ভাবে জমা হচ্ছে? সোজাসাপ্টা হয়ে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে এক অস্থির চাহনি দিলেন। যেখানে তিনি বোঝালেন, তোর মা ভালো নেই। 
কেন যেন, বাবাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করল। কিন্তু আমি নড়তে পারছি না। পা শক্ত ভাবে ফ্লোর ছুঁয়ে। অদ্ভুত ভাবে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। 
তাও, পাথরে পরিনত পা দুটো'কে নিয়ে বাবার দিক পৌঁছালাম। 
আমার কাঁদা দেখে বাবাও ভেঙে পড়লেন। লাল চোখ গুলো নিয়ে অন্যদিকে ঘুরে গেলেন। পেছন থেকে স্পষ্ট ভাসছে তার পিঠ কাঁপছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার অপরিসীম চেষ্টা করছে। 
নানুর বাড়ির সকলে এসেছে। অথচ কোথাও আমার নজর যাচ্ছেনা। বন্ধ হয়ে যাওয়া কাঁচের দরজার দিক তাকিয়ে। 
বড় মা কাঁদছে। নানু বাড়ির সকলে এসেছে। ছোট মামা পাশে এসে, আস্থা দিলেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার মন শান্ত হলো না। 
ভয়ে মন, শরীর কাঁপছে। বড় মা তার বুকে জড়িয়ে নিলেন। আদুরে কন্ঠে কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, 
- কাঁদিস না। আল্লাহ'কে ডাক। তিনি সব ঠিক করে দিবেন। 
সত্যি কী সব ঠিক হয়ে যাবে? এবার তো রিস্ক বেশি। এটা তার দ্বিতীয় তম হার্টএট্যাক। কতটা রিস্ক রয়েছে তা বোঝার মতো অবস্থা হয়েছে আমার। 

মায়ের জ্ঞান নেই। ডাক্তার এসে খুব সিরিয়াস ভাবে বড়দের সাথে কথা বলে গেলেন। বাবার চেহারা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ভালো কোন সংবাদ দেননি । ভোর থেকে সকলে হসপিটাল বসে। বড় মা কতবার করে খাওয়াতে চেষ্টা করলেন। আমি খেতে পারলাম না। 
বসে রইলাম। সন্ধ্যার আজান দিচ্ছে৷ মায়ের জ্ঞ্যান না আসা পর্যন্ত, আমার দ্বারা কিছু হবেনা। কিচ্ছু না। সারাদিন না খাওয়া আমার শরীর নেতিয়ে, ভয়, ক্লান্তি সব ঝেঁকে বসে। রাত দুটো'র দিক খবর, এলো মা নেই৷ বেঁচে থাকার লড়াইয়ে তিনি হেঁড়ে গেছেন। এতক্ষণের 
জমানো ভয় নিমিষেই ঘূর্নিঝড়ে রুপান্তরিত হলো। বাবা কেমন বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলেছে। সকাল থেকে নিজেকে শক্ত করে রাখা, আমার বাবা ভেঙে পড়লেন। বাচ্চাদে মতো কেঁদে উঠলেন। 
আমাকে শক্ত করে ধরে রাখা বড় মা, কেমন হাউমাউ করে কাঁদছেন। সকলের কান্নার শব্দে মাঝে, আমি নিঃশব্দে বসে। চোখ জল নেই। নেই কোনো হাউমাউ কান্নার শব্দ। শরীরের সব কিছু অবসে পরিনত হয়ে আছে। জ্ঞ্যান চিন্তাশক্তি কাজ করছে না। 
অবস্থা তখন বেগতিক হলো, যখন মায়ের লাশ বেরোলো। তাকে ধরে আমার হাউমাউ কান্নায় বাবা কাঁদছে। রুহ যেন কেউ নিয়ে যাচ্ছে । চোখ বুঝে শুয়ে থাকা আমার মায়ের দৃশ্য কেমন আমাকে মেরে ফেলছে। ঘন্টার পর ঘন্টা যাচ্ছে, অথচ মায়ের শরীর আমার থেকে কেউ নিতে পারছেনা। তার মুখের দিক তাকালে মনে পরে, আমাদের স্মৃতি। বাড়িতে ফিরে মা কাকে ডাকব। আর কোনো মা থাকবে না পৃথীবিতে। সারা জীবন থেকে মা চলে যাবে। 
এই অঝোর কান্নার বিরতি নেই। মায়ের সাথে থাকার শক্ত লড়াইয়ে তন্ময় ভাই আমাকে চেপে ধরে দাঁড় করালেন। কিন্তু আমাকে থামাতে পারছেন না। পাগলের মতো আমার কান্না দেখে তিনি অস্থির চোখে দাঁড়িয়ে। চোখের সামনে মা'কে এম্বুল্যান্সে নেওয়া হচ্ছে। পাগলের মতো ছুটে আমিও উঠলাম এম্বুল্যান্সে। বাবাও বসে ভেতরে। একধ্যানে মায়ের হাত ধরে বসে। কান্নার বেগ আমার বেড়ে চলেছে। ক্রমাগত কান্নার ফলে শ্বাস নিতে পারছিনা৷ 

মসজিদে নেওয়া হয়েছে মা'কে। গোসল করাবে৷ বড় মা, রুবি আপু আমাকে চেপে ধরে। নাহলে আমি আমার মায়ের কাছে থাকতাম। তার পাশে। মসজিদের গেইট থেকে কেউ আমাকে নিতে পারল না। মাথায় কাপড়ে আমি শক্ত হয়ে বসে। বড় মা ও আমাকে জড়িয়ে বসে। বাচ্চা দীপ্তর দিক আমার চোখ মাত্র গেলে। স্বাস্থ্যবান ছেলেটা কাঁদছে। চশমার নিচে চোখের পানি গুলো বেয়ে যাচ্ছে। ওর দিক তাকাতেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। কমে যাওয়ার কান্নার বেগ বেড়ে গেল। অস্থির ভাবে চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছে৷
শেষ বারের মতো তাকে দেখাল। মা'কে নিয়ে যাওয়ার পরে আমি নিস্তেজ হয়ে এলাম। নিমিষেই চোখের সামনের সব ঝাপসা হতে লাগলো। ধীরে ধীরে অন্ধকারে তলিয়ে গেলাম।
.
.
.
চলবে..............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন