প্রেয়সী - পর্ব ১৭ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


তন্ময় ভাই আজ ছয়দিন যাবত বাড়ি নেই। সেই যে গিয়েছেন আর আসার নামগন্ধও নেই লোকটার। অবশ্য কল দিয়েছেন প্রায় প্রতিদিন। তাতে কী? কল আর সম্মুখীন হওয়া কি এক হলো? একদম না। কলে তো শুধু তার ম্যানলি ভয়েস শোনা যায়। তার সেই মারাত্মক মায়াবী, হ্যান্ডসাম ফেইস তো দেখাই যায়না। 
এবার ফিরলে অবশ্যই আমি আমার জবাব দিব তাকে। জবাব হবে হ্যাঁ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হাসি উপহার দিয়ে বলব,
 ' হ্যাঁ , আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি। একপায়ে রাজি। যখন বলবেন তখনই বিয়ে করে ফেলব। কিন্তু তার আগে আপনাকে আমাকে প্রপোজ করতে হবে। নিজের মুখে বলতে হবে যে, অরু। আমি তোমায় ভালবাসি। আর সারাজীবন একসাথে থাকতে চাই। '
ব্যস। তাহলেই হবে। সকলেই তার হবু বউকে প্রপোজ করে। তাকেও করতে হবে। আলবাত করতে হবে। না করলে বিয়েও ঝুলে থাকবে। কী লোক, এখনও বলেনি নিজের মনের কথা।
 বিয়ে করবি? পছন্দ করিস আমায়? এগুলো প্রপোজ? একদমই রোমাঞ্চকর না লোকটা। সে কী শারুখ খানের ফিল্ম কখনও দেখেননি? শারুখ খানের তুক্ষার রোমান্টিক ডায়ালগ গুলো কী শোনেন নি? 
ধবধবে আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে, দু'হাত ছড়িয়ে দেবে আর আমাকে ইশারা করবে, তার বাহুতে যায়গা করে নিতে। তা না, যত্তসব চুল টানাটানি। কত চুল ছিঁড়েছে তা তো বাদ'ই দিলাম। 
এখন কী আমি তাকে রোমান্স শেখাব? এতটাই 
চরিত্রহীন নাকি আমি? হ্যাঁ, হবো চরিত্রহীন তার জন্য। এবার আসুক। প্রপোজ না করলে কথা নেই। ফ্রেন্ডসদের বয়ফ্রেন্ড আছে। কী সুন্দর কাপল তারা। অথচ আমার? কী আছে তাও শিয়র জানিনা। 
কীভাবে বলব আমার ববয়ফ্রেন্ড আছে? সেতো তেমন কিছুই বলেনি। একদম ডিরেক্ট বিয়ে। প্রেম ছাড়া জীবনের মানে আছে? হ্যাঁ? প্রথম ভাললাগা তারপর চুটিয়ে প্রেম তারপর না বিয়ে। আর আমার সাথে কি হলো? যা'কে ভাবতাম পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাহিল শেষে তারই প্রেমে পড়লাম। এখন তো ভালবেসে ফেলেছি। এইযে রাত্রে ঘুমাতে পারিনা। তার চেহারা হাজার বার চোখ বন্ধ করে দেখে ফেলি। কলেজের ক্লাসে মন বসে না। শুধু তাকে ভাবি। অথচ সে? আমাকে ফেলে দিব্বি ভালো আছে। থাক ভালো। এবার আয় শয়তান। 
রুবি আপুর আর ইব্রাহিম ভাইয়ের ঝগড়া লেগেছে। সেটা হচ্ছে ইব্রাহিম ভাইয়ের এক্স'কে নিয়ে। আজ সারাদিন আপু না খেয়ে।
 তার কাঁদাকাটি'র কথা শোনে বড় চাচ্চু ইব্রাহিম ভাইয়াকে কল 
দেন। ইব্রাহিম ভাই তো সেই মাফ চেয়েছেন। লাগাতার বলেছেন, 
 ' ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে চাচ্চু। ঠিক হয়ে যাবে। '
এদিকে রুবি আপু কথা বলতে নারাজ। একদম শক্ত আওয়াজে তার জবাব,
' কথা বলবো না ওর সাথে। ও যাক, ওই মেয়ে'কে বিয়ে করুক। '
ইব্রাহিম ভাইয়ের অবস্থা তো নাজেহাল। কতবার আমাকে কল করেছেন বলার বাহিরে। তার একটাই কথা, 
' প্লিজ অরু। হ্যাল্প মি। কথা বলাই দাও। আই উইল ম্যানেজ। '
কীভাবে ম্যানেজ করবেন? রুবি আপু তো কথাই বলতে চাচ্ছেন না। 
আমিতো ইব্রাহিম ভাইয়ের দোষ দেখছিনা। আপু তো জানতেন তার এক্স রয়েছে। জানার পর রিলেশনে গিয়েছেন। এখন হঠাৎ দেখা হওয়ায় ভাইয়া তার এক্সের সাথে ছবি তুলেছেন। সেই ছবি এক্স তার ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে ছেড়েছেন। সেটা আবার আপু দেখে ফেলেছেন। এখন আপু রেগেমেগে শেষ। ইব্রাহিম ভাইয়ের কথা হচ্ছে ' সে তার এক্স। অতিত। বর্তমানে তার জীবনে কোনো 
 যায়গা নেই। সে শুধু একটি ছবি তুলেছেন। ব্যস। 
অথচ আপু মানতে নারাজ। এখন এই ঝামেলা থেকে উদ্ধার করতে পারবেন তন্ময় ভাই। কিন্তু তন্ময় ভাই খুবই বিজি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যে, তাই উনি চব্বিশঘণ্টা বিজি থাকেন। পৃথিবীর মোষ্ট বিজি সেডুয়াল নিশ্চয়ই উনার৷ তারপরও কল লাগালাম। এবার রিসিভ হয়েছে। 
' কি হয়েছে, বল। '
দেখ। কী অবাস্তবিক লোক। সারাটাদিন একটা কল দিল না। যাও আমি দিলাম। বলতেসে ' কি হয়েছে, বল। ' মন তো চাচ্ছিল কল'টা কেটে দি। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে করে বললাম, 
' এভাবে বলছেন, যেমন আমি আপনাকে ডিস্টার্ব করছি। হু। আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য আমি বসে নেই। আমারও অনেক কাজ। হোমওয়ার্ক আরও কত-কী। '
ওপাশ থেকে হাসির আওয়াজ। মনে হচ্ছে গোসলঘরে ছিলেন। ঝর্না বন্ধ করার শব্দ হলো। ইশ।
' আচ্ছা? হোমওয়ার্ক তারপর? আর কী কাজ শুনি? '
' আপনাকে কেন বলব? কে আপনি আমার? যাকেতাকে আমি আমার সারাদিনের কাজের এক্সপ্লেইন দিব নাকি। '
' অথচ, যাকেতাকে যেচে ফোন দেওয়া হচ্ছে? '
যাহ। কল কেটে দিলাম। বলব না এই লোকের সাথে কথা। পরপরই মনে পড়লো আপুর কথা৷ নিশ্চয়ই কাঁদছে। ইব্রাহিম ভাইয়ের অবস্থাও ভালো না। মানইজ্জত বেঁচে দিয়ে আবার কল দিলাম। সে রিসিভ করলেন। ওপাশে মিষ্টি হাসির আওয়াজ। হু মিষ্টি না ছাই। 
' হয়েছে কী? 
' নিজের জন্য কল দেই নি। নির্ঘাত প্রব্লেম আছে তাই দিয়েছি। উহ, আপনাকে কল দেওয়ার জন্য, আমি সারাদিন মোবাইল নিয়ে বসে থাকি না। '
এবার সে খুব মিষ্টি ভাবে ডাকলেন, 
' অরু? '
মনে হলো, আমার এতো অভিমান নিমিষেই হারিয়ে গেল। এতএত রাগের একটুও অবশিষ্ট নেই। তার স্থির কন্ঠ,
' এই চার'দিন আমি অনেক ব্যস্ত ছিলাম। এইতো মাত্র রুমে এসেছি। গোসল শেষে তোকেই কল দিতে নিচ্ছিলাম। খেয়েছিস? '
বাচ্চাদের মতো চুপ হয়ে গেলাম। চোখ টলমল করছে। ছোট আওয়াজে জবাব দিলাম, 
' হু। '
' লক্ষি মেয়ে। এখন বল কী হয়েছে? হোয়াই আর ইউ সো ডিস্টার্ব টুডে? '
আমি নিমিষেই সব বলে দিলাম। তন্ময় ভাই হাসলেন। বললেন, 
' আচ্ছা ঠিকাছে। আমি দেখছি। রাত হয়েছে, এখনও জেগে কেন? '
কী বলব? আপনি আমাকে ঘুমাতে দেন কোথায়? এইতো ঘুমাতে গেলে শুধু আপনার কথা মনে পড়ে। ঘুমাতেই পারিনা। সারারাত এদিকসেদিক করি। এ কি করে ফেললেন আমার সুন্দর জীবন'টার? 
' ঘুম আসছেনা। '
' এভাবে ফোন নিয়ে থাকলে আসবে? '
' উঁহু। '
' সেলফোন রেখে, চুপচাপ ঘুমিয়ে যাবি। ঠিকাছে? '
একটু কথা বললে কী হয়? এইতো মাত্র কল দিলাম। মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে। আর সে? এখনই রাখতে বলছে। অবশ্য সে খুবই ক্লান্ত। সারাদিন পর মাত্র ঘরে ঢুকেছেন। নিশ্চয়ই খান নি এখনও। আমি বললাম, 
' খেয়েছেন? '
' ইচ্ছে করছেনা। '
' খেয়ে তারপর ঘুমাবেন। '
সে একটু চুপ থেকে জবাব দিলেন, 
' আচ্ছা, খেয়ে তারপর ঘুমাব। '
আমি হাসলাম। সে খুবই সুইট। আবার শয়তান ও। সবই সে। 

সকালে উঠে আরেক তাজা নিউজ। তা হচ্ছে আপু আর ভাইয়ার বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়েছে। আগামী মাসের ২১ তারিখ। বাহ। মাত্র একমাস বাকি। চাচ্চুরা এখনই সকল কিছুর আলোচনা করছেন। রুবি আপুর রুমে যেতেই দেখলাম সে হেসে হেসে কথা বলছেন। পরপর জানতে পারলাম তাদের সমস্য সমাধান হয়ে গিয়েছে। তন্ময় ভাই কী এমন বললেন যে সব ঠিক হয়ে গেলো? জাদু। ছু মান্তার গান'টা গেয়েছেন নিশ্চয়ই। 
কলেজ গিয়ে আরেক প্যারা। সেটা হচ্ছে সুমনা আপা। তিনি এখন আরেকদল বানিয়েছেন। আমাকে দেখলেই কানাকানি করবেন। হাসবেন আর ফুসুরফাসুর তো আছেই। ওর মেয়ে সাথী গুলোও আমাকে ভেঙচি কাটবে। মারজি মুখ ভেঙাল,
' তুর কাজিন'টা যেমন সুন্দর তেমনি বান্দর। ওর মতো ছেছড়া আমি আমার এই জীবনে দুটো দেখিনি। ট্রাস্ট মি। '
' হয়েছে বাদ দে। '
' বাদ দে মানে? শোন, এখনও তুর এই কাজিন, তন্ময় ভাইয়ের পিছু ছাড়েনি। জানিস সেদিন তন্ময় ভাইকে কল দিয়ে প্রপোজ করেছে? '
অবাকের চুরান্তে গিয়ে চেঁচালাম, 
' কীহ? '
' হ্যাঁ। ওইযে সুমনার পাশে যে বসে, সেটা আমার ইংলিশ টিচারের মেয়ে। ওই আমাকে জানিয়েছিল। '
' তারপর? তন্ময় ভাইয়ের জবাব জানায়নি? '
মারজি হাসছে। কিটকিটিয়ে বলল,
' বলেছে নাকি, সামনে পেলে থাপড়ে দাঁত ফালাই দিবে। '
আমার সুন্দর তন্ময়। সবাই তারে নিয়ে টানাটানি করে। এটা কী ঠিক? এই সুমনা'কে কী করা যায়? বেশরম মেয়ে। এইবার সামনে আসুক। আমার হবু বরের দিক কু'নজর দেওয়া। আঙুল দিয়ে চোখ তুলে ফুটবল খেলব। 

কলেজ থেকে ফিরবার পথে সামনে দাঁড়ালো সুমনা। আমাকে দেখে হাসছে। ভ্রু কুঁচকে ফেললাম আমি।
' হয়েছে কী? '
' হয়নি। খুব জলদি হবে। '
হবে তুর কল্লা। তোয়াক্কা না করে চলে এলাম। নির্লজ্জ মেয়ে, কীভাবে আসে আবার আমার সাথে কথা বলতে? কোন মুখ দিয়ে কথা বলতে আসে? জাহিল। 
বাড়িতে এসে দেখলাম মা'য়ের মন খারাপ। কেমন মনমরা। হঠাৎ তার আবার কী হলো? কিছু একটা হয়েছে হয়তো। নিশ্চয়ই কিছু নিয়ে টেনশনে। দেখলাম বড় মা জিজ্ঞেস করছে, 
' কী হয়েছে? '
মা জবাব দিচ্ছেন না। ধীরে ধীরে কাজ করছেন। তার নাগাল না পেয়ে, উপরে চলে এলাম। ড্রেস পরিবর্তন করে যাই, দেখি কি হয়েছে তার। যখন নিচে নামলাম তখন আর সে আশেপাশে নেই। নিশ্চয়ই রুমে। আমি রুমের দিক যাচ্ছি। দূরত্ব থেকেই চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে৷ বাবা চেঁচাচ্ছেন। আবার কী হলো? এবার ধীরে এগোলাম। সাইড হয়ে তাকালাম। বাবা হাত তুলেছেন মা'কে মারার জন্য। আমি দ্রুত ভেতরে ঢুকতে থেমে গেলাম বাবার কথায়, 
' তোর পরিবার উঠেপড়ে লেগেছে আমার পরিবার বিনাশ করার জন্য। তোর ভাইয়ের মতো জালিয়াত, এই পৃথিবীতে আরেকটা 
নেই। আমার একমাত্র মেয়ে। তুই তার কথা না ভেবে ভাইয়ের মেয়ের কথা ভাবিস, কেম্নে? হ্যাঁ? তোর ভাই যখন তার মাইয়ার প্রস্তাব তন্ময়ের জন্য দেয়, তোর মুখ তখন কই ছিলো? বলিস নাই কেন, তন্ময় আর অরুর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। তন্ময়ের ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ হলে, বিয়ের কথাবার্তা শুরু হবে। তুই চাস কী? তোর ভাইয়ের মেয়ে তন্ময়রে পছন্দ করে, এখন ওদের বিয়ে দেওয়ার জন্য কথা বলতাম ? শোন, আমার একটা মাত্র মাইয়া। ওরে নিয়ে কোনো কাহিনী না। এই তোর পরিবার নিয়ে যদি আরেকটা শব্দ আমি শুনি। সেদিনই তোর এ-ই বাড়িতে শেষ দিন৷ '
কাঁপাকাপা পা নিয়ে আমি দ্রুত লোকালাম। বাবা রাগে রুম থেকে চলে যাচ্ছে। মা বসে কাঁদতে কাঁদতে বিরবির করছেন,
' আমি কেম্নে না করে দিমু? আমার বড় ভাই। যে আমারে দু'হাতে পালছেন। এই প্রথম অনুরোধ স্বরে কিছু বলেছেন। কীভাবে মুখের উপর না করি? কি করব আমি? '
রুমে ফিরে আমি চুপসে বসে রইলাম। হাত-পা কাঁপছে। 
ভয়ে গলা শুঁকিয়ে আসছে। আবার ঝামেলা এসেছে। কেন যেন মনে হচ্ছে, এই ঝামেলা এতো দ্রুত যাবে না। 
.
.
.
চলবে....................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন