সকলেই ড্রয়িং রুমে উপস্থিত। বড় চাচ্চু বলছেন,
--' কাজ আছে আমার। যেতে পারবো না। তন্ময় আর রবিন যাবে সাথে। বাকি বাচ্চাদের নিয়ে নাও। '
বড় মা'র বিরক্তি কন্ঠের জবাব,
--' আপনার কখন সময় হয়? আপনার সময় হয়না , আপনার ছেলের সময় হয়না। দিনদুনিয়ার অযুহাত দেখিয়ে রাজি করাতে হয় একেকজনকে। '
--' ঘরে বসে থাকি? এখন কাজ ফেলে, জন্মদিন মানাতে যাবো তোমার সাথে ? '
--' আমার সাথে যাবেন কেন? বাহিরে রেখে এসেছেন যাদের, তাদের সাথে যাবেন। '
--' বাহিরে কাদের রেখে এসেছি? তোমার ভাইদের মতো ভেবে রেখেছ না-কি? একটা ঘরে রেখে বাহিরে আরও দু'চারটে বিয়ে করব। '
বড় মা রেগে গেলেন,
--' আমার পরিবার নিয়ে কথা তুলবেন না। '
থমথমে পরিবেশে শুধু চাচ্চু আর বড় মা'র আওয়াজ। তন্ময় ভাই ছাড়া বাড়ির সকলে উপস্থিত। অথচ কেউই শব্দ করছেন না। বরং চুপচাপ শুনছেন । বড় চাচ্চু কথা বলতে নিচ্ছিলেন, মুহুর্তে তন্ময় ভাই হাজির। সে ফোনে কথা বলতে বলতে আসছেন,
--' হ্যাঁ। আসব৷ এখনও বেরোই নি। বেরোবো। '
কল কেঁটে সে বড় মা'র দিক তাকালেন।
--' তৈরি হতে যাও। সময় নেই। '
ব্যস। সে তার রুমের দিক চলে গেলেন। বড় চাচ্চু আর কথা বাড়ালেন না। ধুপধাপ শব্দে বাহিরে চলে যাচ্ছেন। তখনই মা মুখ খুললেন। সে এতক্ষণ যাবত চুপ ছিলেন। কিন্তু তার চেহারায় স্পষ্ট, যে কিছু বলতে চাচ্ছেন।
ছোট গলায় বড় মা'কে অনুরোধ করলেন,
--' ভাবী, সুমনা'কে সাথে নেওয়া যায় কী? সমস্যা না হলে আরকি। মেয়েটা যেতে চাচ্ছে। '
বড় মা খুবই শান্ত মানুষ এবং ধৈর্যশীল। সে হাসিমুখে জবাব দিলেন,
--' সমস্যার কী৷ যাবে যেতে চাইলে। এখনই তৈরি হতে হবে তাহলে।
সন্ধ্যার আগে বেরোতে হবে। '
সুমনা মা'র পিছু হতে হেসে ফেলল। সুন্দর চেহরায় তার মিষ্টি হাসি ফুটে উঠেছে৷
--' ধন্যবাদ বড় মা। '
অতপর, রুবি আপু যখন জানলেন, সুমনা যাচ্ছে। সে তো সেই রেগেছেন। বড় মা ধমকে দিলেন,
--' বাচ্চা মানুষ। যাবে যাক। '
--' বাচ্চা? আর ও? যদি তুমি জানতে। '
তারপর, আমার দিক দাঁত কটমট করে বললেন,
--' বুঝবি তুই কাঁদতে কাঁদতে। দেখিস। '
যাহ? আবারও আমার দোষ? এখন না মা'র দোষ। সে না অনুমতি দিলেন। আমিতো দেইনি। আজীব।
সকলে তৈরি আমরা। আপাতত শুধু সুমনা'র বাকি।
আমি তৈরি থাকায় গাড়ির সামনে চলে আসলাম। তন্ময় ভাই,
রবিন ভাই, দীপ্ত আর রুবি আপু দাঁড়িয়ে। ফোন নিয়ে কথা বলছেন। আপাতত শুধু সুমনা আর বড় মা আসলেই হবে। দুটো গাড়ি বের করেছেন। নিশ্চয়ই একটা তন্ময় ভাই , আরেকটা রবিন ভাইয়া চালাবেন। ভাবলাম দ্রুত রবিন ভাইয়ের গাড়িতে বসে পড়ি। সাধারণত ব্ল্যাক'টা রবিন ভাই ব্যাবহার করেন। তো আমি কানে ইয়ারফোন গুঁজতে গুঁজতে, পেছনে আলগোছে বসে পড়লাম। পরপর রুবি আপু আর দীপ্তও বসলো পাশে। কান থেকে ইয়ারফোন খুলে ফেলল৷ এদের নিয়ে শান্তি নেই পৃথিবীতে।
রুবি আপু গাড়ির জানালা খুলে, রবিন ভাইকে ডাকলেন,
--' ভাইয়া। তুই বড় মা আর সুমনা'কে নিয়ে আয়। '
রবিন ভাইয়ের হয়তো সমস্যা নেই। সে আরামসে চাবি দিয়ে দিলেন।
--' তো বেরিয়ে যা। আমিও আসছি। '
তন্ময় ভাই গাড়ি স্টার্ট দিয়েছেন,
--' দীপ্ত সামনে আয়। '
দীপ্ত লক্ষী বাচ্চার মতো সামনে বসলো। তখনই সুমনা আর বড় মা বেরিয়েছেন। সুমনা দ্রুত দৌঁড়ে এসে বলছে,
--' আমি অরুদের সঙ্গে যাব। '
রবিন ভাইয়ের জবাব,
--' যায়গা নেই ওটাতে তেমন। এটা খালি। '
ততক্ষণে গাড়ি চলছে। রুবি আপু হাসছে,
--' ক্লিংগি একটা৷ ক্রিঞ্জ বিহেভিয়ার। ধুর। '
দীপ্ত আমার ফোনে গেমস খেলছে। আঁড়চোখে তাকালো,
--' মনে হয়, সুমনা আপু তন্ময় ভাইকে পছন্দ করেন। '
তন্ময় ভাই এমন ভাবে তাকিয়েছেন দীপ্তর দিক, যে দীপ্ত দ্রুত ফোন সরিয়ে ফেলল,
--' আররে আমি একা বলছি। রুবি আপুও বলছিল। মেয়েটা তোমার সাথে.. '
দীপ্ত চুপ হয়ে গেলো। আমি জানালার বাহিরে তাকালাম। সত্যি বলতে, ইদানীং তন্ময় ভাইয়ের নামের পাশে, অন্য মেয়েদের নাম কেমন সহ্য হয়না৷ আবার তন্ময় ভাইয়ের আশেপাশে আমি থাকতে পারিনা। সব দিক দিয়ে জ্বালা। এ কেমন অদ্ভুত অনুভূতি।
যেখানে যাচ্ছি, সেটা হচ্ছে তন্ময় ভাইয়ের নানু বাড়ি। বিশাল সেই বাড়িতে থাকেন তন্ময় ভাইয়ের চার মামা , তাদের বউ, বাচ্চা। আর নানু। হ্যাঁ তন্ময় ভাইয়ের নানী এখনও জীবিত। তার নানা মারা গিয়েছেন আজ চার বছর হচ্ছে। তখন তন্ময় ভাইয়ের যা অবস্থা ছিলো, তা নাইবা বা বললাম।
বড় মা হচ্ছেন সে বাড়ির চার ভাইয়ের একমাত্র বোন। খুবই সৌখিনতায় বড় করা তাকে। সে পাইনি এমন কিছুই নেই। এখন,
বড় মা'র বদলে সে বাড়িতে আদর পাচ্ছেন তন্ময় ভাই। সে প্রচুর প্রিয় ব্যক্তি সেখানে। সাধারণত তার নানু। সে তন্ময় ভাইয়ের পাগল।
তন্ময় ভাই ঢাকা হতে ফিরলে, আগে তাকে তার, নানুকে দেখে আসতে হয়। নাহলে নানু নিজেই কল করে আসতে বলবেন। মাঝেমধ্যে নিজে রেঁধে তন্ময় ভাইকে খাওয়াবেন।
এখনও সে তন্ময় ভাইকে কপালে চুমু খান। আর জড়িয়ে ধরলে তো ছাড়বেনই না। তারপর তার মামাতো ভাই-বোন গুলো। এদের নিয়ে যাই বলব কম। এক একটা খুবই অদ্ভুত। আজকে যাচ্ছি এদের রুপ দেখতে।
গাছগাছালী ছাড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে ভেতরে। বলা যায়, তাদের বাড়ির অবস্থান, এক জঙ্গলের ভেতরে। যেখানে আশেপাশে দোকান, স্টল বা অন্য কোনো বাড়ি নেই। বিশাল যায়গা নিয়ে তাদের এই বিশাল বাড়ি। বাড়িটি সম্পুর্ন পুরনো আমলের। তাও বাড়িতে কোনো পরিবর্তন আনেননি বা পুনরায় তৈরী করার সিদ্ধান্তও নেননি।
বিশালত্ব গেইট দিয়ে বাড়ির চারপাশ সম্পুর্ন নিরাপদ করা। অথচ, বাড়ির ভেতরে বর্তমান যুগ অনুযায়ী সৌখিনতায় ঘেরা।
বাড়ির সামনে রয়েছে চিকন রাস্তা। যেখানে শুধু একবারে একটা গাড়ি চলাচল করতে সক্ষম। সেই রাস্তার দু পাশেই ঘন গাছের সারি৷ বাহির থেকে দেখলে অনেকটা, ভুতুড়ে বাড়ির অনুভূতি পাওয়া যায়। কিছুটা ভয়ংকর ভীতু পরিবেশ।
রাস্তা সম্পুর্ন অন্ধকার। শুধু বাহিরে গাড়ির লাইটের আলো।
দীপ্ত বলল,
--' ওইযে পেছনে রবিন ভাইয়ের গাড়ি। তারাও চলে এসেছে। '
কিছুক্ষণের মাঝে আমরা আলোর দেখা পেলাম। তারমানে চলে এসেছি। বাড়ির সামনে লাইটস ব্যবহার করা। ধুমধাম গানের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। চেঁচামেচি তো আছেই।
আমাদের গাড়ি পৌঁছাতেই, অনেকে দৌঁড়ে দরজার সামনে। একজন আরেকজনকে চেঁচিয়ে ডাকছে।
আমি, রুবি আপু আর দীপ্ত, দেরি করে বেরোলাম। বেরোতেই আইরিন সামনে। বলেছিলাম না, মেয়েটা চমৎকার ভালো। আজ দেখতেও মাশাল্লাহ লাগছে। গরজিয়াস গ্রাউন্ পড়া, সাথে মাথায় ক্রাউন। তারপর গরজিয়াস মেকওভার। মোট কথা অনেক প্রিটি দেখতে। আমাদের সাথে ওর যায় ভালো। কয়েকটা প্রচন্ড অহংকারী বাবাহ। ওইযে দলবেঁধে দাঁড়িয়ে, আমাদের দিক তাকিয়ে। এদের ভাবসাব অন্যরকম। কিন্তু ব্যবহার ভালো। তেমন ক্লোজ ভাবে মেশা হয়না, যেমনটা আইরিনের সাথে হয়।
এদিকে সুমনা খুবই মিশুক। কি সুন্দর ওদের সাথে কথা বলছে। অথচ, এটা কিন্তু ওর প্রথম দেখা সকলের সাথে৷ যেটা বোঝাই যাচ্ছে না। ইমপ্রেসিভ।
এর মাঝে, আমি কতবার তন্ময় ভাইয়ের দিক তাকিয়েছি তা বলার বাহিরে। আমি তাকাই আঁড়চোখে। আর সে তাকালে তাকিয়েই থাকেন। আমার মতো আঁড়চোখে তাকান না। ব্যাপারটা মজার।
কিন্তু, আপাতত কিছুই মজার না। আইরিনের বন্ধুবী আছে এখানে, অনেক গুলো। সবগুলো তন্ময় ভাই আর রবিন ভাইয়ের দিক তাকিয়ে। রবিন ভাই কথা বলছেন কয়েকটার সাথে। আর কয়েকটা তন্ময় ভাইয়ের আশেপাশে। কিন্তু সে কথা বলছেন না। মোবাইল হাতে দাঁড়িয়ে।
রুবি আপু আমার কানে ফিসফিসিয়ে বললেন,
--' আইরিনের বন্ধুবী গুলোকে দেখ। আর সুমনা'কে দেখ, কী বেশরম।
তন্ময়ের সাথে সাথে হাঁটছে, কথা বলছে। আর তুই? তোর না ওর সাথে থাকার কথা। তোর হবু জামাই। অথচ, তুই? '
অনুভূতি আর লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে বললাম,
--' আমি কি করব। '
--' মানে? তুই ওরে বলবি না তোদের ব্যাপারে? বেশিকিছু না তন্ময়ের ফোনের লকস্ক্রিন দেখিয়ে দিস। বুঝে যাবে। তারপরও যদি না শুধরোয়, তো এমন অপমান করবো যে...!
--' থামো। ও জানে না বিদায় এমন করছে। আর ও সত্যি তন্ময় ভাইকে খুব পছন্দ করেন। '
--' কী সুন্দর। তো ওর সাথে বিয়েটা দিয়ে দি তন্ময়ের?'
আমি বড়সড় চোখ করে তাকালাম।
--' কী জবাব দেস না কেন? থাপ্পড় একটা দিয়ে, কান ঝালাপালা করে ফেলবো। '
কথাটা বলেই রুবি আপু চেঁচালেন,
--' তন্ময়। '
তন্ময় ভাই আসলেন।
--' কী হয়েছে? '
রুবি আপু অসহায় গলায় বললেন,
--' অরু ভয় পাচ্ছে। বেচারি। '
সে আমার দিক তাকালেন। দীপ্ত কর্কশ কন্ঠে বলল,
--' চুন্নি মিথ্যে বলছে। অরু আপু তেমন কিছুই বলেনি। ও উল্টো অরু আপুকে শেখাচ্ছে, কীভাবে তোমার পাশে থাকা প্রোয়জনীয় । '
তখন রুবি আপুর মুখ দেখার মতো ছিলো। ভয়ংকর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন দীপ্তর দিক। এরা এখানে এসেও থামছে না। অবশ্য আমি বেশ লজ্জা পেলাম। কী ভাববেন এখন?
অথচ তন্ময় ভাইয়ের জবাব ছিলো,
--' ও কী ফিটার খায়? অন্যদের বুঝাতে হবে কেন। '
কথাটা বলেই ইশারা করলেন ভেতরে যেতে। আর সে চলে গেলেন।
কথা বলতে বলেছে কে এটাকে? শয়তান।
.
.
.
চলবে...............................