আমার পিকনিক যাওয়া হলোনা । অথচ সুমনা সেই সেজেগুজে পিকনিক অ্যাটেন্ড করলো। যাওয়ার আগের দিন বাড়ি আসলো,
--' ক্যামেরা নিচ্ছি। সব ফিল্ম করে নিয়ে আসব। '
মনে হলো, সুমনা আমার কাঁটা দাগে লবণ ছুঁড়ে মেরে চলে গেলো।
যাক। দিন আমারও আসবে।
দু'দিন ছুটি আছে। ভাবলাম নানু বাড়ি ঘুরে আসবো। সাথে রুবি আপুকে নিয়ে যাবো। রুবি আপুর রুমে পৌঁছালাম। সে দিব্বি ধীর গলায় কথা বলছেন। আমাকে দেখতেই ফোন রেখে দিলেন।
--' আয়। বস। '
--' ভাবছিলাম নানু বাড়ি যেতাম। তুমি যাবে? '
রুবি আপু আলমারি থেকে কামিজ পছন্দ করতে ব্যস্ত। কয়েকটা কামিজ বিছানায় রেখে বললেন,
--' আজ বাহিরে ডিনার হবে। পুরো পরিবার। '
বাহিরে ডিনার হবে। ওয়াও। এতো এতো খারাপ সংবাদের
মাঝে , ভালো এক সংবাদ আসলো তাহলে। আনন্দে বুকটা নিমিষেই ঠান্ডা। স্রোতের সাথে একদফা ভাসতে ইচ্ছে করছে। খুশিতে গদগদ হয়ে উত্তর দিলাম,
--' সত্যি ? কোনটা পড়বে? '
--' তুই বলতো। '
--' পার্পল'টা? এটার সেইম আছে আমার। সাথে কানের দুল, হিলস ম্যাচ করা। '
রুবি আপু মানলেন।
--' তাহলে এটাই। '
আমার আর রুবি আপুর অনেক ড্রেস একই। চাচ্চু বা ভাইয়ারা কিছু আনলে একই এনেদেন প্রায়। সদা না। মানে মাঝেমধ্যে।
আবার আমি আর রুবি আপু যেচেও একই বানিয়ে ফেলি।
বিকেলে দীপ্ত আসলো রুমে। অসহায় চোখে আমার দিক
তাকালো। আমি হেসে ফেললাম। চুলগুলো খোঁপা করতে
বললাম,
-- ' কী হয়েছে জনাব? '
দীপ্ত ফিসফিসিয়ে বলল,
--' তন্ময় ভাইয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। '
আমি অবাক হলাম সাথে হাসিও পাচ্ছিলো। ছেলের জন্য বাড়িতে প্রস্তাব? নিশ্চয়ই কোনো গাঁধি মেয়ে দেওয়ানী হয়েছে।
--' নতুন কি। তা এবার কে নিয়ে এসেছে? '
দীপ্ত অসহায় ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
--' পুলিশ অফিসার আশিকুর রহমানের একমাত্র মেয়ে নিশির
জন্য। আশিকুর রহমান এবং তার বড় ভাইও এসেছিলেন। কি পরে এসেছেন জানো? '
আমি দ্রুত দীপ্তর পাশে বসলাম। আগ্রহী গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
--' কি পরে? '
--' লুঙ্গি রে বাবা। সাদা লুঙ্গির নিচে লাল জাঙিয়া । '
দীপ্ত হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পড়লো। তারপর হঠাৎ নিজেকে সিরিয়াস করে উঠে বসলো,
--' এমন পরিবারে ভাই বিয়ে দিব না। দেখা যাবে আমার ভাইয়াকেও সাদা লুঙ্গির নিচে লাল জাঙিয়া পড়িয়ে দিবে। '
অনেক কষ্ট করে হাসি থামাতে পারলাম না। তন্ময় ভাই আর লুঙ্গি, জাঙিয়া?
--' বতারপর? চাচ্চুরা কি বললেন? '
--' এতো এক্সাইটেড যে? তন্ময় ভাই রাজি হবেন না। '
--' তুই বল চাচ্চুরা কী বলেছেন? '
--' বলেছেন তন্ময়ের সাথে কথা বলে জানাবেন। '
ইশ। নিশি আপু সেই সুন্দরী। মাঝে মাঝে দেখা যায় গাড়ি করে ভার্সিটি যাচ্ছেন। উফ, ওয়েস্টার্ন পরে যখন বেরোয় না। মাশাল্লাহ। এতো সুন্দর মেয়েটাও তন্ময় ভাইকে পছন্দ করেন? আমার বেশ অবাক লাগছে। কি এমন দেখতে সে? সবাই এমন আহ্লাদী কেন তার ব্যাপারে?
অবশ্য তন্ময় ভাই রাজি হলে খাপে খাপ একদম। এমন ভাবী পেলে তো কপাল খুলে যাবে।
দীপ্ত দ্রুত পায়ে যেতে যেতে বলল,
--' যাচ্ছি আমি। হোমওয়ার্ক এখনই শেষ করতে হবে। সন্ধ্যায় তো যেতে হবে। '
সন্ধ্যা হওয়ার আগে বড় মা চেঁচামেচি করতে লাগলেন। বারবার করে বলছেন,
--' সাত'টায় বেরোতে হবে। এখনই তৈরি হয়ে নে যা। '
অথচ রুবি আপু আর আমি দিব্বি সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত। আমি আগ্রহী গলায় বললাম,
--' আজ মনে হয় প্রপোজ'টা করেই ফেলবে। '
--' এমন হিরো পেলে তো একদ...'
মা টিভি বন্ধ করে দিলেন।
--' দীপ্ত'কে দেখ। কি সুন্দর তৈরি হয়ে সোফায় বসে। তোদের তৈরি হতে লাগবে সারাদিন। যা এখনই। '
--' প্রপোজাল চলছে মা। আরেকটু। '
মা রিমোর্ট নিয়ে চলে যাচ্ছেন। রুবি আপু বললেন,
--' দেখে ফেলবোনি নেটে। '
--' ধুর! এই ধকধক ফিলিং টা কি তখন হবে? ইশ।'
রুমে পৌঁছে ঘড়ি দেখলাম। পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ। তন্ময় ভাই বলেছেন সাত'টায় বেরোবেন। তার মানে একদম সাতটা। নড়চড় হওয়া যাবেনা। ফ্রেস হয়ে আমি ফেইস প্যাক লাগালাম। গুনগুন করতে করতে রুমের বাহিরে, উঁকি দিতেই দেখলাম তন্ময় ভাই এসেছেন। শার্ট খুলতে খুলতে রুমে ঢুকছেন। এসেছে নায়ক আলী। জঙ্গল। আমি দ্রুত ভিতরে ঢুকে গেলাম।
হাতে হিলস নিয়ে রুবি আপু রুমে আসলেন। বিছানায় বসে হিলস পরতে নিয়ে, অসহায় গলায় বলছেন,
--' অরু। আমার এক চোখের আইলাইনার একটু বাঁকা হয়েছে। '
চুল স্ট্রেইট করতে গিয়ে জবাব দিলাম,
--' বোঝা যাচ্ছেনা। '
--' আজ আমি হেয়ার কার্ল করেছি। কেমন দেখাচ্ছে? মেকআপ ঠিকাছে? '
--' মাশাল্লাহ। '
--' দ্রুত কর মা চেঁচাচ্ছেন। '
আমি ঘুরতেই রুবি আপু চেঁচালেন।
--' দ্রুত। '
এই হচ্ছে এক জ্বালা। ইনার দ্রুত হলে আমার মাথা খেয়ে দিবে। আররে আমারও তো হতে হবে। হিলস পরতে গিয়ে মনে পড়লো, আমার পায়ে ব্যাথা। এখন? থাক। তাও হিলস পরতে হবে। হিলস না পরলে আমাকে লাগবে একটু। আমার চোদ্দগুষ্টি লম্বাচওড়া। আমিই হয়েছি শর্ট৷ রুবি আপু ফাইভ' সিক্স। আর আমি ফাইভ'থ্রি। হিলস না পরলে আমাকে দেখা যাবে? অবশ্য গাড়িতে যাবো আসবো। এতটা ব্যাথা পাওয়ার কথা না।
নিচে নেমে দেখলাম তন্ময় ভাই দাঁড়িয়ে। আমার দিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাহিরে চলে যাচ্ছেন। যা, জাহান্নাম চলে যা।
রবিন ভাই, দীপ্ত, চাচ্চুরা তৈরি হয়ে সোফাত বসে। এখন শুধু চাচীরা আসা বাকি। রুবি আপুও সোফায় বসলেন,
--' আমাদের সাথে ঘ্যানঘ্যান করে, এখন নিজেদেরই দেরি। বাহ। কি চমৎকার। '
পরপরই উঠে বাহিরে চলে যাচ্ছেন। আমি সোফায় বসলাম। শয়তান বাহিরে। যাওয়া যাবেনা। বড়দের সাথে যাবো। চাচীরা আসলেন আরও কিছুক্ষণ পর।
বড় মা শাড়ি পরেছেন। হিজাবের পিন লাগাতে লাগাতে বললেন,
--' চল চল। '
পরপর মা আর ছোট চাচীও হাজির।
তন্ময় ভাই জানালেন সেই গাড়ি নিবেননা। বাইক ব্যবহার করবেন । এভাবে কিন্তু সে বছরেও বাইক ব্যবহার করেন না। আজ নবাবজাদা'র অন্য প্ল্যান। আমি গাড়িতে উঠতে যাবো, তখন রুবি আপু বললেন,
--' তন্ময়ের সাথে যা। '
আমি আকাশ থেকে পরলাম। মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাথর আমার মাথায় ফালানো হলো।
--' আশ্চর্য, কেন? না আমি গাড়িতে যাবো। '
বড় আব্বু রাজি হলেন,
--' আচ্ছা, থাক। দীপ্ত যাক তন্ময়ের সাথে। '
গাড়িতে উঠছি না দেখে রুবি আপু তাড়া লাগালেন,
--' অরু গাড়িতে যাবেনা মনে হচ্ছে। '
এদিকে পেছন হতে হাত চেপে তন্ময় ভাই। নাহলে কখন বসে পরতাম। শরীর শিরশির করে উঠছে। দ্রুত শ্বাস নিতে হচ্ছে। ভয় পাচ্ছি না না হার্টএট্যাক করবো? সাহস নিয়ে তার দিক ফিরতেই
আমাকে ' খেয়ে ফেলবো ' লুক দিচ্ছেন। গাড়িতে উঠছি না দেখে দীপ্ত বলল,
--' আপু বাইকে যাবে। '
ব্যস। রবিন ভাই গাড়ি স্টার্ট দিলেন,
--' দ্রুত চলে আয় তন্ময়। '
তারা চলে যাচ্ছেন। আমাকে রেখে গেলেন শয়তানের সাথে। ভয়ে আমার হার্টবিট দীর্ঘ গতিতে চলছে। নিজেকে শান্ত করা খুব মুশকিল। আজ হাইট স্পষ্ট মাপা গেল। আমি উঁচু জুতা পরে তন্ময় ভাইয়ের বুক পর্যন্ত পড়ি। দারোয়ান কাকা এগিয়ে আসলেন,
--' আজ হঠাৎ বাইক? '
সে আমার দিক তাকালেন।
--' মনে রঙ লাগছে। '
বলতে বলতে সিগারেট ধরালেন। মূহুর্তে আমার চোখমুখ কুঁচকে গেলো। দারোয়ান কাকা হাসছেন,
--' এই রঙ তো তুমাগো লাইজ্ঞা। আমাগো ও তো ছিলো। সেগুলো ছিলো রঙিন দিন। তা কে লাগাইলো মনে রঙ? '
আমার মাথাটা ধরে গেলো। এইসব নষ্ট কথা আমার সামনে।
নানা আমার দিকা তাকালেন,
--' সুন্দর লাগতাছে মহামুনি। '
আমি হাসলাম,
--' ধন্যবাদ কাকা। '
--' দেরি হহইতাছে। যাও যাও। '
বলতে বলতে কাকা চলে যাচ্ছেন। তন্ময় ভাই ঠাঁই দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছেন। এ কেমন লোক? এর সমস্যা কি? উফ। বললাম,
--' আমাকে দিয়ে আসুন। তারপর যেটা ইচ্ছে সেটা করুন। '
কথা কানেই নিলো না যেমন। আমি কড়াকড়ি চোখে তার দিক তাকিয়ে। অথচ সে তাকাতেই অন্যদিক ফিরে গেলাম।
কি আর করার দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া। রাস্তার হেডলাইট আর মেইন গেইটের আলোয় আশপাশ রঙিন। আমাদের বাড়ির আশেপাশে দোকান নেই। একদম ফাঁকা। শুধু সামনে বাড়ি। আর আমাদের বাড়ির পেছনে। এভাবে কলেজের সামনে যাবার পথে অনেক দোকান পড়ে। নানান স্টল এবং হাবিজাবি।
তন্ময় ভাই বাইক স্টার্ট দিলেন, সিগারেট শেষ করে।
--' উঠ। '
সাবধানে উঠে বসলাম। না চাইতেও হাত দুটো তার ঘাড়ে রাখলাম। তার শরীরের থেকে পারফিউমের ঘ্রাণ আসছে। এই পারফিউমের ঘ্রাণ আমার খুব পছন্দের। আর সে সদা এটাই ব্যবহার করেন। বাহ। আমি আরও কয়েক একাধারে শ্বাস নিলাম।
খেয়াল করলাম, তন্ময় ভাই কেমন ধ্যান মেরে বসে।
--' শক্ত করে বস। ওড়না ভালভাবে পেঁচিয়ে নে। '
আমি ওড়না চুলসহ মাথায় পেঁচিয়ে ফেললাম।
--' নিয়েছি। '
বাইক চলছে। ঠান্ডা বাতাসে শরীরে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। চারপাশ কেমন নিমিষে পিছনে চলে যাচ্ছে। হেডলাইটের আলোয় পরিবেশ হলদে। চোখ লেগে আসছে। তন্ময় ভাইয়ের শান্ত আওয়াজ,
--' সমস্যা হচ্ছে? '
--' উঁহু। '
এমন সুন্দর ভাবে কথা বলছে কেন? তন্ময় ভাইয়ের এমন শান্ত আওয়াজ আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। আমি ঠিক তার শান্ত কন্ঠ এবং ভালো ব্যবহার, প্রচন্ড ভয় পাই। প্রচন্ড।
গাড়ির স্পিডের পরিনতি হচ্ছে, আমার বেসামাল ব্যালেন্স। কেমন বারবার তার উপর পড়ছি। লজ্জায় আমার মুখ গরম হয়ে উঠলো। হাত দুটো তার পিঠে রাখলাম। বাইক কী আরেকটু সুন্দর ভাবে চালানো যায়না?
গাড়ি পার্ক করে, তন্ময় ভাই আগে আমাকে নামতে সাহায্য করলেন। ভেতরে গিয়ে দেখা হলো, তন্ময় ভাইয়ের পরিচিত এক বন্ধুর সাথে যাকে আমি চিনিনা৷ লোকটা আমার দিক তাকিয়ে হাসলো। ধীরে বলল,
--' তুর প্রেয়সী নাকি? '
আমি হতবাক। আরও হতবাক তন্ময় ভাইয়ের জবাব না দেয়ায়। সে বেশ বলল,
--' পরে কথা হচ্ছে। '
আমার দিক তাকালেন,
--' আয়। '
আমি লোকটার দিক আঁড়চোখে তাকিয়ে, তন্ময় ভাইয়ের পিছু চললাম। টেবিল দোতলায় বুক করা হয়েছে। আরও হাঁটতে হবে। আমার পা আসলেই ব্যাথা করছে। আমার ধীর হাঁটা দেখে, সেও থেমে গেলেন। পরপর হাত ধরে তার সাথে নিয়ে চললেন। আজ কেমন অদ্ভুত লাগছে আমার। লজ্জাবোধ। আর অদ্ভুত অনুভূতি। আমি আঁড়চোখে আমাদের হাতের দিক তাকিয়ে।
হচ্ছে কি আমার?
.
.
.
চলবে...............................