প্রহেলিকা - পর্ব ৩২ - আশফি শেহরীন চিত্রা - ধারাবাহিক গল্প


জেহেরকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইনশিতা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার বুক ঢিপঢিপ করছে ভয়ে। একটু আগে মানিক এসেছিল জেহেরের জ্ঞান ফেরার কথা শুনে। সাথে আফজাল আর জেসমিন চৌধুরীও এসেছিল। জেহের তাদের দেখে খুব রেগে গিয়েছিল। তবে ইনশিতার কারণে রাগ দেখাতে পারেনি। তার একটু বাদে জেহের মাথার যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। মাথা চেপে ছটফট করতে থাকে। হাতের কাছে যা পায় সেটাই ছুঁড়ে মারে। ইনশিতা ভয় পেয়ে যায়। জেহেরকে থামাতে গেলে সে ইনশিতাকেও আঘাত করে। মানিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে জেহেরকে নিঃশব্দে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দেয়। 

জেসমিন চৌধুরী নিজেও ভয় পেয়েছেন ছেলের হঠাৎ এমন আচরণে। মানিক খানিকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলেন জেহেরকে। ইশারায় আফজালকে বের হতে বলল। মানিক রহমান আগে থেকেই জেহেরের অসুস্থতা সম্পর্কে জানেন। আর জেহেরকে যেসব মেডিসিন দেওয়া হয় তাতে অন্তত কিছুটা হলেও সুস্থ হওয়ার কথা। অথচ সুস্থতার বদলে জেহের যেন মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ডাক্তার হয়ে তিনি জেহেরের অসুস্থতা কিছুটা আঁচ করতে পারছেন। তবে মেডিসিন দেওয়া হয় জেহেরকে সুস্থ করতে, কিন্তু এমন উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ, মাথা যন্ত্রনা—এগুলো ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না তার। আফজালকে বলেন, 

-“ছেলেকে তো নিয়মিত মেডিসিন দেওয়াই হয়, তাহলে এমন অবস্থা কেন?”

আফজাল চিন্তিত মুখ করে বলেন, 

-“আমি নিজেও জানি না। প্রায়ই তাকে মেডিসিন দেওয়া হয়।”

-“কোনোদিন বাদ যায়নি তো?”

-“না, খাবারের সাথেই মেডিসিন দেওয়া হয়।”

-“মেডিসিনগুলো এখন আছে?”

-“না, বাড়িতে।”

-“কাউকে পাঠিয়ে আনা তো।”

-“আচ্ছা। কিন্তু কোনো সমস্যা?”

-“হু? না, আসলে চেক করবো মেডিসিনগুলো। জেহেরের এমন অবস্থার জন্য মেডিসিনগুলো দায়ী কিনা দেখতে হবে।”

আফজাল অবাক হয়ে বললেন, 

-“কিন্তু ওগুলো তো ডক্টরের সাজেস্ট করাই। আর তুইও তো জানিস।”

-“তবুও, আরেকবার দেখতে চাই।”

আফজাল ড্রাইভারকে মেডিসিনগুলো আনাতে পাঠালেন। ড্রাইভার মেডিসিন নিয়ে আসলে মানিক চলে যান ল্যাবে পরীক্ষা করতে। মানিক আফজালের বন্ধু হওয়াতেই তাদের এত সময় দেয়। নাহলে কোন ডাক্তারেরই বা এত সময় একজন পেশেন্টের পেছনে ব্যয় করার? 

ইনশিতা জেহেরের পাশে বসে আছে। তার একটি হাত বন্দী জেহেরের হাতে। আরেকহাতে জেহেরের উশকোখুশকো হয়ে যাওয়া চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে ঠিক করে দিচ্ছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে জেহেরের মুখ পানে। ফ্যাকাশে হয়ে আছে জেহেরের মুখ। গোলাপী ঠোঁটযুগল শুষ্ক। ইনশিতার ভালো লাগছে না জেহেরকে এই অবস্থায় দেখতে। তার সুস্থ জেহেরকে চাই। যে জেহের তাকে আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতোই ভালোবাসবে। 

সন্ধ্যায় মানিক আসলেন। আফজাল মাথা নিচু করে বসেছিলেন করিডোরের চেয়ারে। জেসমিনকে জোর করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বাড়িতে। মানিকের ডাক শুনে মাথা তুললেন। মানিককে খানিকটা উত্তেজিত দেখাচ্ছে। আফজাল ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে উঠে দাঁড়ালেন। 

-“ইজ এভ্রিথিং ওকে মানিক? তোকে কেমন যেন দেখাচ্ছে।”

মানিক উত্তেজিত গলায় বললেন, 

-“নাথিং ইজ ওকে। অনেক বড় ভুল হয়েছে তোদের দ্বারা। যার মাশুল দিতে হচ্ছে জেহেরকে।”

মানিকের কথায় খানিকটা চমকালেন আফজাল। বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন, 

-“কী বলছিস তুই? ভুল? কী এমন ভুল?”

-“তোরা কেমন বাবা মা হয়েছিস বল তো? নিজের ছেলের ব্যাপারে কোনো খোঁজ খবরই নিস না!”

-“আমরা কী করলাম? জেহেরের সব খোঁজই তো রাখি।”

মানিকের ইচ্ছে করছিল তৎক্ষণাৎ আফজালের মাথা ফাটিয়ে দেয়। এত বড় একটা ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে তাদের চোখের সামনে অথচ তারা চোখে পট্টি বেঁধে আছে! 

-“জেহেরের ঔষধের সাথে ড্রাগস মেশানো আছে।”

আফজাল বাজ পড়ার মতো চমকে উঠলেন। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল বিস্ময়ে। থমকে গেলেন তিনি। কথা বলতে পারলেন না কয়েক সেকেন্ড। 

-“কী বলছেন কী আঙ্কেল আপনি এসব?”

চমকে গিয়ে মানিক আর আফজাল পেছনে তাকাল। দেখল ইনশিতা চেয়ার ধরে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। ইনশিতা মাত্রই চোখে মুখে পানি দিয়ে আফজালের কাছে আসছিল। আসার সাথে সাথেই এমন কথা শুনল যে তার নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। ইনশিতা নিঃশ্বাস ফেলছে দ্রুত। কানের মধ্যে মানিকের কথাটা বাজতে লাগল। জেহেরকে ড্রাগস দেওয়া হচ্ছে আর সে নিজেই জানে না? এও কী সম্ভব! কই? কখনোই তো এমন কোনো ঘটনা তার চোখের সামনে ঘটেনি। 

মানিক ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললেন, 

-“এটা সত্যি। জেহেরকে সবসময় ড্রাগস দেওয়া হয় ঔষধের সাথে। এমনটা আরও বেশিদিন চললে জেহেরের অবনতি আরও বেশি হত, হয়তো বা কখনো মারাও যেত।”

ইনশিতা ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। আফজাল চোখ বন্ধ করলেন। ছেলের সাথে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে আর সে কিনা জানেও না? মানিক সামনে একটা চেয়ার টেনে বসল। প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো আফজালের দিকে, 

-“তুই কী কোনোভাবে টের পাসনি? এই ড্রাগস কিন্তু অনেকদিন ধরেই দেওয়া হচ্ছে।”

-“এসব সম্পর্কে কোনো ধারণাই আমার ছিল না। ইভেন কখন কীভাবে দেওয়া হতো সেটাই ধরতে পারছি না।”

মানিক খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, 

-“ড্রাগস ঔষধের সাথে দেওয়া হতো। ঔষধ কীভাবে জেহেরকে দিতি? ও তো ঔষধ খেতে চাইত না।”

-“ওর খাবারের সাথে ঔষধ মিশিয়ে দেওয়া হয়, ও জানে না।”

-“ঔষধ কে দিত?”

-“জিহাদই দিত সবসময়। এমনকি জেহের যখন ইনশিতাকে নিয়ে বাগানবাড়িতে ছিল তখন অফিসে আসলে জিহাদ গার্ডদের সাহায্যে লাঞ্চে মেডিসিন মিশিয়ে দেয়। জেহের এসব কিছুই জানে না।”

-“জিহাদ কোথায়?”

-“বলেছে তো ব্যবসার কাজে চট্টগ্রাম গেছে, আসতে না কি মাসখানেক লাগবে। জেবাকেও নিয়ে গেছে।”

-“জিহাদই বোধহয় ড্রাগস মিশিয়ে দিত।”

দ্বিতীয়বারের মতো চমকাল আফজাল, সাথে ইনশিতাও। খানিকটা চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। 

-“এটা কি করে সম্ভব? তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। জিহাদ কখনোই এসব করবে না, ওর ভাই হয় জেহের।”

-“এছাড়া তো আর কাউকেই দেখছি না, ঔষধ যেহেতু জিহাদই দেয় সেহেতু ড্রাগসও নিশ্চয় ও মেশায়!”

-“জিহাদই বা কেন করবে? ওর তো কোনো শত্রুতামি নেই জেহেরের সাথে।”

-“আছে বাবা।”

আফজাল চকিতে তাকালেন ইনশিতার দিকে। 

-“কী বলছ কী তুমি মা?”

ইনশিতা আঙুল মোচড়াতে লাগল। জিহাদের কার্যকলাপগুলো বলবে কিনা ভাবছে। শেষ পর্যন্ত বলেই দিলো তাদের সাথে করা জিহাদের সব কাজ। ইনশিতাকে পাওয়ার জন্য জিহাদ এ পর্যন্ত যা যা করেছে সব। 

আফজাল বুকে হাত দিয়ে বসে রইলেন। তার বুকটা অসম্ভব রকমের ব্যথা করছে। একদিনে এত রহস্য জানবেন সেটা তার ভাবনার বাইরে ছিল। ছোট ছেলেটা যে আড়ালে আপনজনের ক্ষতি করছে সেটা জেনেই তার কষ্ট হচ্ছে বেশি। ইনশিতা অনুরোধের স্বরে বলল, 

-“বাবা, আপনি প্লিজ মাকে এসব জানাবেন না। মা কষ্ট পাবে। প্লিজ বাবা।”

আফজাল নিরবে সম্মতি দিলো। তার নিজেরই তো খারাপ লাগছে এসব শুনে, জেসমিনকে জানতে দেবে না। মুহুর্তেই জিহাদ আর জেবার প্রতি অজস্র ঘৃণা জমল তার মনে। এত নিচু মন মানসিকতা! 

মানিক নিজের চোখের চশমা ঠিক করলেন,

-“জেহেরকে ড্রাগস দেওয়ার কারণেই তার এত অবনতি। কোনোদিন যদি ড্রাগস দেওয়া বন্ধ হতো তাতেই তার পাগলামি বেড়ে যেত। যখন ঔষধ দেওয়া হতো তখনই কিন্তু জেহের শান্ত হতো।”

ইনশিতার কাছে এবার সব ক্লিয়ার হলো। জেহেরের হঠাৎ হঠাৎ মাথা যন্ত্রণা, চিৎকার চেঁচামেচি এসব কিছুর কারণ তাহলে এ-ই! তাইতো সেদিন রাতে গার্ডের দেওয়া খাবার খাওয়ার পরই জেহের শান্ত হয়েছিল। জিহাদ এতটা নিকৃষ্ট শ্রেণীর মানুষ! একমাত্র ইনশিতাকে পাওয়ার জন্য নিজের আপন ভাইকে মারতেও পর্যন্ত দ্বিধাবোধ করে না! ছিঃ! 

-“এখন জেহেরকে ঠিক করা যায় কীভাবে?” আফজালের প্রশ্ন। 

-“ড্রাগস হঠাৎ করে দেওয়া বন্ধ হয়ে গেলে জেহের হয়তো আরও বেশি পাগলামি করতে পারে। এটা নেশা হয়ে গিয়েছে। নেশা হুট করে ছাড়ানো যায় না। আর সাপোর্ট করতে হবে অনেক।”

-“সাপোর্ট করা একমাত্র ইনশিতার হাতে। ইনশিতা ছাড়া আর কারো কথাই জেহের কানে নেয় না।”

মানিক এবার তাকালেন ইনশিতার দিকে। 

-“ইনশিতা, তোমাকে কিন্তু জেহেরকে প্রচুর সময় দিতে হবে। আর ওর পরিবারের প্রতি বিরূপ ধারণাটাও তোমাকেই বদলে দিতে হবে ধীরে ধীরে। পারবে তো?”

ইনশিতা বিড়বিড় করে বলল, 

-“না পারলেও পারতে হবে। জেহেরকে ভালো করতে যা করার লাগে সব করব। সব।”

ইনশিতা উঠে গিয়ে কেবিনে আসলো। এসে দেখল জেহের ঘুম থেকে উঠে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ইনশিতা গিয়ে জেহেরকে ডাক দিলে জেহের পেছন ফিরে। জেহেরকে দেখে চমকে যায় ইনশিতা। চোখ দুটো টকটকে লাল হয়ে আছে, কপালের রগ ফুলে গেছে, ফর্সা মুখটাও লাল বর্ণ ধারণ করেছে। 

-“জ-জেহের, আপনি ঠিক আছেন তো?”

জেহের চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, 

-“ছাড়বো না আমি। ছাড়বোনা। আই'ল কিল হিম।”

-“কী বলছেন এসব? কী হয়েছে?”

জেহের ইনশিতার দুই বাহুতে সজোরে চাপ দিয়ে কাছে আনল, 

-“জিহাদকে ছাড়বো না। আমাকে, আমাকে মারার এত প্ল্যান! ড্রাগস দেওয়া?”

ইনশিতা ভয়াতুর কন্ঠে বলল, 

-“আপনি জানেন কীভাবে?”

-“একটু আগে শুনেছি। তোমরা যখন কথা বলছিলে। জিহাদকে মেরেই ফেলব আমি। তোমাকে আমার কাছ থেকে দুরে সরানো, তাই না? হাড়ে হাড়ে বুঝাবো ও-কে।”

-“জেহের, এখন আপনি শান্ত হোন। আপনার মাথা ঠিক নেই।”

জেহের একাধারে একটা কথাই বলে যাচ্ছে। ইনশিতা নিজেই জেহেরকে টেনে বেডে বসাল। 

-“চুপ করুন, একদম চুপ। আর একটা কথাও যেন না শুনি।”

জেহের কড়া চোখে তাকাল ইনশিতার দিকে। ইনশিতা তোয়াক্কা করল না। এখন জেহেরের রাগকে পাত্তা দিলে চলবে না। ইনশিতা জেহেরের হাত দুটো মুঠোয় নিলো। শান্ত স্বরে বলল, 

-“আগে আপনি ঠিক হোন। তারপর যা করার করা যাবে। আঙ্কের আপনাকে সঠিক ঔষধ সাজেস্ট করেছে।”

জেহের চোখমুখ শক্ত করে আছে। তার ভেতরের রাগ উগড়ে ফেলতে চাইছে যেন। তবে তা ইনশিতার জন্য পারছে না। 

-“জেহের, তাকান আমার দিকে।”

জেহের তাকাল না। জানালার দিকে মুখ করে রইল। 

-“আপনি তাকাবেন না জেহের?”

জেহের ডানে বামে মাথা নাড়ল। 

-“সত্যি তো? আচ্ছা ঠিকাছে। তাকানো লাগবে না। আমি চলে যাচ্ছি। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত স্যার। আর বিরক্ত করব না।”

ইনশিতা চলে যেতে চাইলে জেহের হাত ছাড়ে না। ইনশিতা এবার বিরক্তি কন্ঠে বলল, 

-“তাকাবেনও না, আবার যেতেও দিবেন না। করবেনটা কী?”

জেহের এই কথায় ইনশিতার দিকে ফিরল। হাসি দিয়ে বলল, 

-“ভালোবাসবো।”

ইনশিতা থমকে গেল। তার ভেতরটা ঝিনঝিন করে উঠল অজানা শিহরণে। বেশিক্ষণ দৃষ্টি রাখতে পারল না জেহেরের নীল চোখে। দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। জেহের নিজেই হাত ধরে টেনে পাশে বসাল। ইনশিতার কাঁধে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করল। তার কিছুক্ষণ বাদেই হুট করেই মাথা চেপে ধরল। ইনশিতা খেয়াল করল তা। সে বুঝতে পারল। 

-“মাথা যন্ত্রনা করছে?”

-“খুব। পারছি না রোজ।”

-“আপনি জানেন জেহের। এইসব ড্রাগসের ইফেক্ট।”

-“কিন্তু আমি কি করব? সহ্য করতে পারি না।”

-“সহ্য করতে হবে এখন থেকে। তাতে সাহায্য করব আমি।”

জেহের কিছুক্ষণ চুপ থেকে কাতরানো গলায় বলল, 

-“তুমি বাহিরে যাও রোজ। মাথা খারাপ হয়ে গেলে তোমাকে আঘাত করে ফেলতে পারি।”

ইনশিতা গেল না। জেহেরের মাথা থেকে হাত সরিয়ে জেহেরের সামনা সামনি বসল। তারপর হুট করেই ভয়ংকর একটা কাজ করে ফেলল। জেহের যেন ভুলে গেল তার যন্ত্রণা। দুহাতে আকড়ে ধরল ইনশিতার গাল। ভালোবাসার সাগরে পা ডুবালো খনিকের জন্য।

.

.

-“মানিক?”

-“হু?”

-“জেহের আর ইনশিতাকে লন্ডনে পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়?”

মানিক কিছুক্ষণ নিরব দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল আফজালের দিকে। তারপর বলল, 

-“এমন ডিসিশন নেওয়ার কারণ?”

-“কী আর কারণ? ওখানে থাকাটা আমার কাছে জেহেরের জন্য বেস্ট মনে হলো তাই। ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো যাবে।”

মানিক আফজালের কাঁধে হাত রাখলেন। 

-“সাইকিয়াট্রিস্ট নিয়ে চিন্তা করিস না। তবে, তুই কি ভয় পাচ্ছিস?”

আফজাল কিছু বললেন না। 

-“জিহাদের কারণেই পাঠাতে চাস?”

-“তা নয়তো আর কী করব? জেহেরের এখন যা মেন্টালিটি তাতে এখানে রাখার সাহস পাচ্ছি না। জিহাদ যেকোনো সময় অ্যাটাক করতে পারে। ইনশিতা আর জেহেরের সেফটির জন্যই এই ডিসিশন।”

-“লন্ডনে গেলে যে জিহাদের হাত থেকে বাঁচবে না তার কী গ্যারান্টি?”

-“জিহাদের ব্যাপারটা আমি হ্যান্ডেল করব। আপাতত জিহাদের অগোচরে জেহের আর ইনশিতাকে দ্রুত পাঠাতে হবে।”

-“জিহাদ কোথায় আছে জানিস?”

-“না, তবে ধারণা করছি জিহাদ দেশের বাইরে নেই। ইনশিতার আশেপাশেই কোথাও হয়ত। তাই তার জানার আগেই পাঠাতে চাই।”

-“যা ভালো মনে করিস। আমিও তো ওখানেই আছি। টেনশন নিস না।”

-“হু।”

-“জেহের রাজি হবে তো?”

-“ইনশিতা রাজি হলেই চলবে। জেহের ইনশিতার কথা মানবে।”

-“আচ্ছা।”

ইনশিতাকে বলার পর সে আর কোনো দ্বিমত করেনি। জেহেরের সুস্থতাই এখন তার কাছে মুখ্য। জেহেরকে রাজি করাতে যদিও একটু বেগ পেতে হয়েছে। তবে ইনশিতার শত অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেনি। জেসমিন চৌধুরী চাইছিলেন না জেহেরকে দূরে রাখতে। আফজাল সাহেব বুঝিয়েছেন যে জেহেরকে ওখানে বেস্ট ট্রিটমেন্ট দেওয়া হবে। আর তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে। ইনশিতাকে আর জেহেরকে দ্রুত পারসোনাল প্লেনে পাঠিয়ে দেওয়া হলো লন্ডনে। 

.

.

৩ মাস পর
—————
জেহের আপাতত সুস্থ। জেহেরের অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। তার পেছনে অবদান বলতে গেলে ইনশিতারই বেশি রয়েছে। সারাটাক্ষণ জেহেরের কাছাকাছি ছিল। প্রোপার ট্রিটমেন্টের কারণে জেহেরের এখন আর আগের মতো মাথা যন্ত্রনা করে না। ইনশিতা যতটা পেরেছে জেহেরের পরিবারের সম্পর্কে ভুল ধারণা ভাঙানোর চেষ্টা করেছে। কতটা সফল হয়েছে সে আদৌ জানে না। জেহের সব মানলেও জেসমিনকে মা হিসেবে মানতে নারাজ। সে এখনো জেসমিনকেই দায়ী করে তার মায়ের মৃত্যুর জন্য। জেসমিন জেহেরের সাথে কথা বলতে নিলে জেহের ফোন কানে নিয়েই বসে থাকে। একটা শব্দও করে না সে। ইনশিতার জোরাজুরিতেই সে ফোন কানে ধরে। ইনশিতা সামনে থেকে চলে গেলে সে নিজেই ফোন কেটে দেয়। 

জেহের এখন আর আগের মতো অস্বাভাবিক আচরণ করে না। হিংস্রতা অনেকটাই কমে এসেছে। তবে রাগটা এখনো নাকের ডগায়। একটু এদিক সেদিক হলেই রেগে যায় খুব। জিনিসপত্র ছোঁড়াছুঁড়ি কমে এলেও তেমনটা না। সেদিন ইনশিতাকে খুঁজতে ছাদে গিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের ধবধবে সাদা এরিকের সাথে কথা বলতে দেখেছিল জেহের। সেটা নিয়ে তার কী রাগ! দূর থেকে এরিকের গায়ে প্লাস্টিকের চেয়ার ছুঁড়ে মেরেছিল। এরিক ভয়ে জেহেরকে পাগল উপাধি দিয়েছিল। আর ইনশিতাকে বলেছিল পাগলের সাথে না থাকতে। তা শুনে জেহের রেগে বোম। এরিকের বাসায় গিয়েই তার রুম তছনছ করে ফেলে। এরিক পুলিশ কেস করতে চাইলে ইনশিতা বহুবার ক্ষমা চেয়েছিল এরিকের কাছে। ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে এরিকের আর খোঁজ পায়নি। সেদিন ইনশিতাকে রুমে এনে চেপে ধরেছিল জেহের। রাগে গজগজ করতে করতে বলে, 

-“তুমি ঐ রাস্কেলটার সাথে কী কথা বলছিলে?”

-“আরে, হঠাৎ দেখা হয়েছে, আলাপ করতে আসছিল, কী করে না করতে পারি? তাই একটু কথা বলছিলাম। একটুই, বিশ্বাস করুন। যাস্ট একটুই।”

ইনশিতা জোড় করে হাসতে চাইল কিন্তু পারল না। আসলে এই সাদা চামড়ার এরিক এখানে আসার পর থেকে ইনশিতার পেছনে লেগেছিল। ইনশিতা একটা হেস্তনেস্ত করতেই ছাদে গিয়েছিল। এরিককে সাবধান করতে গিয়েছিল। কিন্তু জেহেরকে তা বলা যাবে না। ইনশিতার পেছন লেগেছে শুনলেই জেহের সাদা চামড়ার এরিককে মেরেও ফেলতে পারে। ইনশিতাকে পুরোটাদিন নজরবন্দী করে রেখেছিল জেহের। রুম থেকে বের হলেও পিছু পিছু যেত। কিচেনে রান্নার সময় পাশে বসেছিল। ইনশিতার বিরক্ত লাগেনি। বরং ভালোই লেগেছিল জেহেরের পাগলামোগুলো। 

জিহাদ ধরা পড়েছে এক সপ্তাহ আগে। তা শুনে ইনশিতা খুশি হলেও জেহের খুশি হতে পারেনি। সে চেয়েছিল নিজ হাতে শাস্তি দিবে। লন্ডনে থাকাকালীন তা সম্ভব নয়। তাই গোপনেই করতে হবে। 

জিহাদকে ধরেছিল এয়ারপোর্টে। বেচারা পাগল হয়ে গিয়েছিল ইনশিতার লন্ডনে যাওয়ার কথা শুনে। এতটাদিন সে খুঁজে গিয়েছিল ইনশিতা কোথায় আছে তা জানতে। যখন জেনেছে তখনই হন্তদন্ত হয়ে লন্ডনে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। জিহাদ এতটাই ডেসপারেট হয়ে গিয়েছিল যে তার ধারণা ছিল না তার বাবা তাকে খুঁজতে আগে থেকেই নৌ, বিমান আর রেইলে লোক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ইমিগ্রেশনেই তাকে পুলিশ দিয়ে এরেস্ট করা হয়। জিহাদ পালানোর চান্সটুকুও পায়নি। নিজের বোকামির জন্যই নিজে ধরা পড়েছে। 

জেসমিন চৌধুরী এসব ব্যাপারে এখনো অজ্ঞাত। তাকে জানানো হয়েছে জিহাদ আর জেবা ব্যবসা আর পড়ালেখার কাজে বাইরে গেছে। 
.
.
.
চলবে.............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন