সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিবেচনা করে, এবার একটা টেক্সট তন্ময় ভাই'কে সেন্ড করেই ফেললাম। রাত্রে ড্রাংক ছিলেন। সে ঠিকাছে কিনা। চিন্তা হচ্ছে খুব। অবশ্য সাথে তার বন্ধুরা আছেন। একেকজন একেকজনের জন্য, জান-প্রান দিয়ে দেন। তারপরও। আমিতো আমিই। কিছু মাথায় গাঁথলে সেটা দ্রুত বের করা অসম্ভব। অতিরিক্ত বাড়তি স্ট্রেস নিয়ে ফেলি। যেটা কখনও হবেনা, সেটা নিয়েও ভাবতে বসে পড়ি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। তার জবাব নেই। সে কী ব্যস্ত? হয়তো। নাহলে নিশ্চয়ই জবাব দিতেন। ভাবতে ভাবতে নিচে নামলাম। টিভি দেখতে মাত্র বসেছিলাম। তখনই বাড়ির কলিং বেল বাজছে। দীপ্ত লাফিয়ে গেইট খুলতে গেলো। বড় মামা, বড় মামী, ছোট মামী আর সুমনা এসেছে।
আমি সোফায় শক্ত হয়ে বসে। বড় নিশ্বাস ফেলে উঠলাম। মামা মাথায় হাত রাখলেন,
' কী অবস্থা আম্মার? '
' ভালো। বসো। '
বড় মামীও কথা বললেন। ছোট মামীর সাথে হালকা কথা বলে উপরে চলে এলাম। ওই মেয়ের মুখও দেখতাম না। জঘন্য কালসাপিনী।
পরপরই মা আসলেন,
' এগুলো কেমন অভদ্রতা অরু? দেখলি ভাই ভাবীরা এসেছেন। তুই কীভাবে ধপধপ পায়ে চলে এলি? '
' তো কি করব? তাদের মাঝে, '
কথা শেষ হয়নি। তখনই কালসাপিনী হাজির।
' ফুপি অরু হয়ে যাচ্ছে, একদম ডিপ্রেসড। কোনো কথা পুরো শুনবেই না। '
রাগে আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে। কতটা বেহায়া এই মেয়ে। মা ইশারা করলেন আমাকে চুপ থাকতে।
আমি পারলাম না। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
' আই ডু নোট ওয়ান্ট টু হেয়ার এনিথিং ফ্রম দ্যাট মাউথ অফ ইওর'স সুমনা। আমি বাজে ব্যবহার করার আগে, গেইট আউট ফ্রম মাই রুম প্লিজ। '
সুমনা অবাক কন্ঠে মা'কে উদ্দেশ্য করলো,
' দেখলে ফুপি। '
' মা এটাকে বেরোতে বলো। '
এবার ও নিজেই শব্দ করে বেরিয়ে গেলো। মা আওয়াজ তুললেন,
' কি ধরনের বেয়াদবি অরু? কি হচ্ছে এগুলো? '
' কি হচ্ছে মানে? ভাইয়ের মেয়ে, ভাই কি ভাববে তা নিয়ে চিন্তা শুধু? আর আমি? তোমার মেয়ে? কলেজের সকলের সামনে আমাকে উজাড় করে দাঁড় করিয়েছে। সকলের কাছে বলে বেরিয়েছে, আমি রাস্তার মেয়ে। ছেলে ধরে টাকা খাই। ছেলেদের সাথে রুমড্যাটে যাই। এগুলো শোনার পর, তুমি এই মেয়েকে বাড়িতে কিভাবে ঢুক-তে দাও? তাও আমার রুমে? '
' ছোট মানুষ বলে ফেলেছে। সেটার জন্য মাফ চাইতে এসেছে তো।
আর ও তো বলছে, এমন কিছুই নাকি বলেনি। '
' ও বলেনি? আমি কোথার থেকে শুনলাম? তুমি তোমার ভাই, ভাইয়ের মেয়ে ছাড়া কিচ্ছু দেখছ না। তুমি সবসময় এমন করো। সবসময়। কয়েকদিন পর দেখা যাবে, তোমার ভাইয়ের পরিবারের জন্য, আমাকে জবাই দিয়ে.. '
কথা শেষ না হতেই মা গালে থাপ্পড় মারলেন। আমি হতভম্ব হয়ে তার দিক চেয়ে। সে এর আগেও হাত তুলেছেন। ওই মেয়ের জন্য। তার ভাইয়ের মেয়ের জন্য। চোখের জল যেন নিজ স্বেচ্ছায় গড়িয়ে পরছে। আমি মাথা দোলালাম,
' হু। থাকো ভাই আর ভাইয়ের মেয়ে নিয়ে। '
বলতে দেরি আমার রুম থেকে বেরোতে দেরি হয়নি। মা পেছন হতে ডাকছেন। শুনলাম না। ভাই আর ভাইয়ের মেয়ে। দোষ করলেও সদা আমাকে বোঝাতে আসবে। আমাকে ভুল প্রমানিত করবে। ব্যস। দ্রুত গতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম। পেছন থেকে বড় চাচ্চু, বড় মা চেঁচিয়ে পিছু আসছেন। তাদের থেকে আমার চলার বেগ দ্রুত। মেইনগেইটে দারোয়ান নানা প্রশ্ন করছেন,
' কই যাবা মহামুনি? '
আমি মিথ্যে বললাম,
' নোটস আনতে। গেইট খোলো। '
সে খুলতেই চলে এলাম। পেছন থেকে বড় চাচ্চু চেঁচামেচি করছেন। গেইট না খোলার জন্য।
থাকব না এই বাড়িতে । থাকুক সে তার ভাইয়ের মেয়ে নিয়ে। এক সস্তা মেয়ে। সদা অপমান করে উল্টা বুঝিয়ে দিবে। সবাই তাই বুঝবে। আমিও তো ওর কথাই বিশ্বাস করতাম। এখন যখন চোখের সামনে সব ক্লিয়ার, ওর কথা শোনার প্রশ্নই আসেনা।
হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে এসেছি। অনেকদূর হলেও এলাকার ভেতর। এলাকার বাহিরে যাবার সাহস আমার নেই। আজকাল যা অবস্থা পৃথিবীর । তারপরও ভয় হচ্ছে। আপাতত মানুষ রয়েছে। রাতের আঁধার নামলে কি হবে? কই যাব? বাড়িতে একদমই ফিরতে চাইনা।
ঠান্ডা বাতাস বইছে। বিকেলের আবহাওয়ায় আকাশ চমৎকার। চারপাশে ঘুরাঘুরির পর সেই চেনা পার্কটি পেলাম। আমি আবার রাস্তা ভুলাক্কার। মনে থাকেনা রাস্তাঘাট। চারপাশে চোখ বোলালাম। গাছের নিবিড় পরিচর্যায় আশপাশ আকর্ষণীয়। এই এরিয়ায় একটাই পার্ক। মারাত্মক সুন্দর এবং বড়। সবসময় মোটামুটি মানুষ থাকে। বাচ্চা, বুড়ো, প্রেমিক-প্রেমিকা। সবরকম মানুষ দেখা যায়।
আলাদা ভাবে, এক পাশের ব্যাঞ্চে বসলাম। চোখ দুটো আবারও ভিজে আসছে। বাড়ি থেকে রেগে বেরোনো আমার এই প্রথম। আগে রেগে শুধু দরজা আটকে ছিলাম। বাড়ি ছাড়াটা বড্ড নতুন। কি থেকে কি করব, বুঝতেই পারছিনা। হঠাৎ মনে পড়লো তন্ময় ভাইয়ের কথা। নিশ্চয়ই সে খবর পেয়েছে। এখন আমাকে পেলে থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিবেন। প্রচন্ড রাগবেন। বাবাও হয়তো খুবই রেগে আছেন। রাগুক। যা ইচ্ছে করুক। তাও আর যাবো না ওই বাড়ি। সে থাকুক তার ভাই, ভাইয়ের মেয়ে নিয়ে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ঝলমলে আকাশে আঁধার ছেয়ে যাচ্ছে৷ পার্কের মানুষজনও এক-এক করে নেই৷ শুধু কয়েক জোড়া দেখা যাচ্ছে।
উহ। কি হবে আমার? ভয়ে শরীর কাঁপছে। কোথায় যাবো? রাত গভীর হলে কি করব? মারজির বাসায় যাবো? কিন্তু ওর আম্মু, নির্ঘাত বাড়িতে ফোন করে দিবে। আর কারও? বাকি রিলেটিভ'স গুলো সব দূরে দূরে৷ সেখানে যাবার জন্য প্রয়োজন টাকা৷ আর আমার কাছে চার আনাও নেই৷
ঘুমে চোখ বুঝে যাচ্ছে৷ একটু দাঁড়ালাম । তারপর আবারও বসলাম।
হঠাৎ কোথা হতে, এহসান এসে দাঁড়ালো। অবাক স্বরে বলল,
' তুই এখানে কি করছিস? '
ভয়ে ভয়ে আশপাশে নজর দিলাম। আবার তন্ময় ভাইকে সাথে নিয়ে এসেছে নাকি। না নেই। আমি অসহায় চোখে ওর দিক তাকালাম,
' বাড়ি থেকে চলে এসেছি। আর যাবো না। '।
এহসান শব্দ করে হাসছে। মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
' যাবিনা? তন্ময় ভাই তোর হাত-পা ভেঙে ফেলবে। '
আবারও ভয়ে জড়সড়ভাব চলে এলো। এই কুলাঙ্গার ছেলে।
' জালিম। অমানুষিক কথাবার্তা বলিস না। তুই কি করিস
এখানে? '
ও হাফ ছাড়া ভাবে, পাশে বসলো। কিছুটা দূরে থাকা এক জোড়া'দের ইশারা করলো,
' আমার বন্ধু। আর তার গার্লফ্রেন্ড। পাহারাদারী করছিলাম। মারজি একটু আগে তোদের বাড়ি গেলো। '
' কেন? '
' সকালে তোর জন্য খারাপ লেগেছে। তাই একটু আগে ড্রাইভার নিয়ে বেরিয়েছে। বাড়িতে আমাকে আর মা'কে শান্তি একদমই দেয়নি। একটু পরপর তোর ওই নাগিনী বোনের চমৎকার আইডেন্টিটি প্রকাশ করছিল। '
সুমনা? নামটাও তেতো মনে হচ্ছে। অস্বাভাবিক মেয়ে। কি দিয়ে তৈরি মেয়েটা? আমার বাড়িতে গিয়ে শাসন চালাচ্ছে। একদিন পেয়ে নেই। এমন শিক্ষা দিবোনা।
' চল দিয়ে আসি তোকে। '
চেঁচালাম,
'একদমই না। ইম্পসিবল।
' রাত গভীর হচ্ছে। কতক্ষন থাকবি? '
চিন্তিত স্বরে বললাম,
' জানিনা। তাও বাড়ি যাচ্ছি না। '
এহসান অনেকক্ষণ যাবত আমার সাথে কথা বলছে ।
ছেলেটা মারাত্মক ভালো। মারজির পাঁচ মিনিটের বড় ভাই। হ্যাঁ, দুজন টুইনস। যেকোনো পরিস্থিতিতে দুজনের চেহারা, অদলবদল করা যাবে।
ওদের আচার-আচরণ ও অনেকটা একই। কথা বলার ধরন আর গালের টোল টাও দুজনের সেইম। শুধু তফাত ছেলে আর মেয়ে।
ও টুপ আওয়াজ করলো,
' আমাদের বাড়িতে তো যেতে সমস্যা নেই, তাই না? '
উশখুশ করছে মন। এদের ভরসা নেই। কিন্তু রাস্তা ও তো নেই। রাত গভীর হচ্ছে। কই যাব আর?
ডিসিশন নিলাম এহসানের সাথে যাবো। ভয়ে আঁকুপাঁকু মন নিয়ে যাচ্ছি ওদের বাড়ির দিক। মন আনচান করছে। কেমন সায় দিচ্ছে না যাবার জন্য। দূর থেকে চেনা একজনের ছায়া দেখতে পেয়েই, আমার আত্মা লাফিয়ে উঠলো। বড়সড় চোখ করে এহসানের দিক তাকালাম। ও হাত উঁচু করলো,
' তন্ময় ভাই ফোন করেছিলেন। বললেন আমাদের বাড়ির আশেপাশে দেখতে। তো তোকে পেয়ে গেলাম। '
' জাহিলের বাচ্চা। '
তন্ময় ভাই এদিকে আসছেন। লাইটের আলোয় তার ফরসা চেহারা লাল হয়ে আছে। বাঁচার সম্ভাবনা নাই একদম।
.
.
.
চলবে...................................